১৯৮০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ইরানের ওপর ইরাকি আক্রমণের মধ্য দিয়ে ইরাক–ইরান যুদ্ধ আরম্ভ হয়, এবং ১৯৮৮ সালের ২০ আগস্ট ইরান কর্তৃক যুদ্ধবিরতিতে সম্মতি প্রদানের মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধের অবসান ঘটে। আট বছরব্যাপী এই ধ্বংসাত্মক যুদ্ধে ইরাক ও ইরান উভয়েই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। যুদ্ধ চলাকালে ১,০৫,০০০ থেকে ৫,০০,০০০ ইরাকি সৈন্য এবং ২,০০,০০০ থেকে ৬,০০,০০০ ইরানি সৈন্য নিহত হয়। তদুপরি, এই যুদ্ধের ফলে ইরাক ও ইরানের আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৫৬,১০০ কোটি (বা ৫৬১ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার এবং ৬২,৭০০ কোটি (বা ৬২৭ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার।
এই যুদ্ধের সময় ইরানের ওপর ইরাকি আক্রমণ ব্যর্থ হয়, এবং ইরানের খুজেস্তান প্রদেশের জাতিগত আরবদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদ ছড়িয়ে দেয়া ও ইরানি ভূমি দখলের ইরাকি প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। অনুরূপভাবে, এই যুদ্ধের সময় ইরাকের ওপর ইরানি আক্রমণ ব্যর্থ হয়, এবং ইরাকের শিয়াদের মধ্যে বিদ্রোহের সৃষ্টি করা ও ইরাকি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার ইরানি প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই যুদ্ধে কোনো পক্ষই জয়যুক্ত হয়নি, কিন্তু যুদ্ধের শেষে উভয় পক্ষই নিজেদেরকে বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করে।
এই যুদ্ধ চলাকালে সাদ্দাম হুসেইনের নেতৃত্বাধীন ইরাকি উগ্র জাতীয়তাবাদ বাআ’স সরকার ব্যাপক আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভ করে। দুই পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পাশাপাশি ফ্রান্স, ব্রিটেন, পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি, ইতালি, গ্রিস, সৌদি আরব, কুয়েত ও আরো বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র সক্রিয়ভাবে এই যুদ্ধের সময় ইরাককে সহায়তা করে। অন্যদিকে, এই যুদ্ধের সময় আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বাধীন ইরানি ‘ইসলামি বিপ্লবী’ সরকার কার্যত আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন ছিল এবং সিরিয়া, লিবিয়া ও উত্তর কোরিয়া ছিল তাদের প্রধান সমর্থক। কিন্তু এর বাইরে একটি রাষ্ট্র এই যুদ্ধ চলাকালে ইরানকে ব্যাপক সহায়তা প্রদান করে, কিন্তু ইরানি সরকার কখনোই এই তথ্যটিকে স্বীকার করেনি। এই রাষ্ট্রটি হচ্ছে ইসরায়েল।
পাহলভি রাজবংশের শাসনামলে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। ইরান ছিল ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলকে স্বীকৃতি প্রদানকারী দ্বিতীয় মুসলিম রাষ্ট্র। এ সময় ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে ব্যাপক সামরিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যের অনারব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার অংশ হিসেবে এবং নিজস্ব জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, বেসামরিক বাণিজ্যের বিস্তার, গোয়েন্দা সহায়তা, সোভিয়েত ‘হুমকি’র মোকাবিলা ও অস্ত্র রপ্তানির বাজার সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে ইসরায়েল এ সময় ইরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছিল।
কিন্তু ১৯৭৯ সালে ‘ইরানি ইসলামি বিপ্লবে’র পর ইরানে যে সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়, সেটি ছিল বাহ্যিকভাবে তীব্র ইসরায়েলবিরোধী। তারা ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং তেহরানে অবস্থিত ইসরায়েলি দূতাবাস বন্ধ করে দিয়ে সেটিকে ‘ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থা’র (Palestine Liberation Organization, ‘PLO’) কাছে হস্তান্তর করে। ইরানি নেতৃবৃন্দ ইসরায়েলকে ‘শয়তান–এ কুচাক’ বা ‘ছোট শয়তান’ (Little Satan) হিসেবে অভিহিত করে (উল্লেখ্য, ইসরায়েলের প্রধান সমর্থক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তারা ‘বড় শয়তান’ হিসেবে অভিহিত করত), এবং ইসরায়েলের অস্তিত্বের অধিকারকে (right to exist) তারা অস্বীকার করে। তদুপরি, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ইসরায়েলবিরোধী গ্রুপকে (যেমন: হিজবুল্লাহ) ইরান সক্রিয় সহায়তা প্রদান করতে শুরু করে।
এমতাবস্থায় আপাতদৃষ্টিতে ইরাক–ইরান যুদ্ধে ইরানকে সহায়তা করার মতো কোনো কারণ ইসরায়েলের ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই যুদ্ধ চলাকালে ইসরায়েল ইরানকে ব্যাপকভাবে সহায়তা প্রদান করে। যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে যখন ইরাকি বাহিনী ইরানের বিরুদ্ধে বিশেষ সাফল্য অর্জন করছিল, সেসময় ইসরায়েলি অস্ত্র ও অন্যান্য সামরিক সহায়তা ইরানকে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সহায়তা করে। যুদ্ধ শুরুর পরপরই ইরানি সরকার গোপনে ইসরায়েলের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং ইসরায়েলি সহায়তা লাভের জন্য দেশটির সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছায়। যুদ্ধ শুরুর তিন দিন পরেই ইসরায়েলি সামরিক প্রশিক্ষকরা ইরানে পৌঁছায় এবং নতুন ইরানি সেনা কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করে। ১৯৮০ সালে ইরানের বিভিন্ন বিমানঘাঁটিতে প্রায় ৩৫০ জন ইসরায়েলি টেকনিশিয়ান কাজ করছিল।
ইরানি সরকারের জন্য কর্মরত অস্ত্র ব্যবসায়ী আহমাদ হায়দারির মতে, ইরাক–ইরান যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে ইরানের ব্যবহৃত প্রায় ৮০% অস্ত্রশস্ত্র এসেছিল ইসরায়েল থেকে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও গোয়েন্দা কার্যক্রম বিশেষজ্ঞ মার্ক ফাইথিয়ানের মতে, ইরাক–ইরান যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে ইরানি বিমানবাহিনী যে সচল ছিল, তার মূল কারণ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুমতিক্রমে ইসরায়েল ইরানকে তাদের মার্কিন–নির্মিত বিমানগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় খুচরো যন্ত্রাংশ সরবরাহ করেছিল। তেল আভিভ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জাফে ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ’ কর্তৃক প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮১ থেকে ১৯৮৩ সালের মধ্যে ইসরায়েল ইরানকে প্রায় ৫০ কোটি (বা ৫০০ মিলিয়ন) মার্কিন ডলার মূল্যের সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করে। অবশ্য মার্কিন সরকারের প্রদত্ত তথ্য অনুসারে, ১৯৮১ থেকে ১৯৮৩ সালে প্রতি বছর ইসরায়েল ইরানকে ৫০ কোটি (বা ৫০০ মিলিয়ন) থেকে ২০০ কোটি (বা ২ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার মূল্যের অস্ত্র সরবরাহ করে।
১৯৮১ সালে ইসরায়েল কর্তৃক ইরানের নিকট সরবরাহকৃত সামরিক সরঞ্জামের মধ্যে ছিল ১৫০টি ‘এম–৪০’ ট্যাঙ্ক–বিধ্বংসী কামান, ২৪,০০০ গোলা, ট্যাঙ্কের খুচরো যন্ত্রাংশ ও যুদ্ধবিমানের ইঞ্জিন এবং TOW ট্যাঙ্ক–বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র।
তদুপরি, ১৯৮১ সালের জুলাইয়ে ইরানে নিযুক্ত প্রাক্তন ইসরায়েলি সামরিক অ্যাটাশে (১৯৫৫–১৯৭৯) ইয়াকোভ নিমরোদি ইরানি জাতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে গোপনে একটি চুক্তি করেন এবং চুক্তি অনুযায়ী ইসরায়েল ইরানকে ১৩ কোটি ৬০ লক্ষ (বা ১৩৬ মিলিয়ন) মার্কিন ডলার মূল্যের সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করে। এগুলোর মধ্যে ছিল ‘ল্যান্স’ ফিল্ড আর্টিলারি সারফেস–টু–সারফেস ক্ষেপণাস্ত্র, ‘কপারহেড’ গোলা এবং ‘হক’ বিমান–বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র। ১৯৮২ সালে ইসরায়েল ইরানকে ৪৫,০০০ ‘উজি’ সাব–মেশিনগান, ট্যাঙ্ক–বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের লঞ্চার, ক্ষেপণাস্ত্র, কামান ও যুদ্ধবিমানের যন্ত্রাংশ সরবরাহ করে। শুধু তাই নয়, ১৯৮২ সালের লেবানন যুদ্ধে ইসরায়েল পিএলওর কাছ থেকে যে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র জব্দ করেছিল, সেগুলোর বড় একটি অংশও ইরানের নিকট হস্তান্তর করা হয়।
১৯৮৩ ও ১৯৮৪ সালে ইসরায়েল ইরানকে যথাক্রমে ১০ কোটি (বা ১০০ মিলিয়ন) ও ৫ কোটি (৫০ মিলিয়ন) মার্কিন ডলার মূল্যের অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করে। ১৯৮৪ সালের জুলাইয়ে সুইজারল্যান্ডের জুরিখে ইয়াকোভ নিমরোদি, সিরীয় উপরাষ্ট্রপতি রিফাত আল–আসাদ (সিরীয় রাষ্ট্রপতি হাফেজ আল–আসাদের ভাই) এবং ইরানি কর্মকর্তাদের মধ্যে একটি গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকের পর ইসরায়েল ইরানকে শত শত টন বিস্ফোরক ও ডায়নামাইট সরবরাহ করে। ইরান ইসরায়েলকে জ্বালানি তেল সরবরাহ করে এবং এর মধ্য দিয়ে ইসরায়েল কর্তৃক সরবরাহকৃত সিংহভাগ অস্ত্রশস্ত্রের মূল্য পরিশোধ করে। তদুপরি, এ সময় ইরানের তেল রপ্তানির ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা থাকায় ইসরায়েল ইরানকে গোপনে তেল বিক্রি করতেও সহায়তা করে।
তদুপরি, ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৭ সালের মধ্যে ইসরায়েলের মধ্যস্থতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে ২,৫০২টি TOW ট্যাঙ্ক–বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র, অন্তত ১৮টি ‘হক’ বিমান–বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং এগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় খুচরো যন্ত্রাংশ সরবরাহ করে। এটি ছিল ইরানের ওপরে আরোপিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞারই লঙ্ঘন, কিন্তু ইসরায়েলের মধ্যস্থতায় যুক্তরাষ্ট্র এই পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং ইরানের নিকট অস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থ নিকারাগুয়ার ‘কন্ট্রা’ বিদ্রোহীদের প্রদান করে। এই ঘটনাটি পরবর্তীতে ‘ইরান–কন্ট্রা কেলেঙ্কারি’র সৃষ্টি করে। তদানীন্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রিগ্যান পরবর্তীতে তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রকে ভুয়া তথ্য সরবরাহ করেছিল এবং ইরানি সরকারের মধ্যপন্থী অংশকে মার্কিন অস্ত্র সরবরাহ করা হচ্ছে, মার্কিন সরকারকে এ রকমটা বুঝিয়েছিল।
অস্ত্র ও সামরিক উপদেষ্টা সরবরাহ, কারিগরি সহায়তা প্রদান এবং অন্যান্য অসামরিক সহায়তার পাশাপাশি ইরাক–ইরান যুদ্ধ চলাকালে ইসরায়েল ইরানকে সক্রিয় সামরিক সহায়তাও প্রদান করে। যুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই ইরাক পরমাণু অস্ত্র তৈরির প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল, এবং ইরাক এই অস্ত্র তৈরি করতে সক্ষম হলে সেটি হতো ইরানের জন্য একটি বড় হুমকি। এজন্য ১৯৮০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ইরানি বিমানবাহিনী ‘অপারেশন স্কর্চ সোর্ড’ ইরাকের ওসিরাক পারমাণবিক রিঅ্যাক্টরের ওপর আক্রমণ চালিয়ে এটিকে ধ্বংস করে দেয়ার প্রচেষ্টা চালায়।
ইরানি আক্রমণে ইরাকি রিঅ্যাক্টরটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কিন্তু ধ্বংস হয়নি। পরবর্তীতে ১৯৮১ সালের ৭ জুন ইসরায়েলি বিমানবাহিনী ‘অপারেশন অপেরা’ পরিচালনা করে এবং ইরাকের ওসিরাক পারমাণবিক রিঅ্যাক্টরটি ধ্বংস করে দেয়। এর মধ্য দিয়ে ইরাকের পরমাণু প্রকল্প স্থগিত হয়ে যায় এবং সম্ভাব্য ইরাকি পারমাণবিক আক্রমণ থেকে ইরান রক্ষা পায়।
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠে, ইরান বাহ্যিকভাবে এতটা তীব্র ইসরায়েলবিরোধী নীতি গ্রহণ করার পরেও ইসরায়েল কেন ইরাক–ইরান যুদ্ধে ইরানকে সমর্থন করছিল? বস্তুত কোনো রাষ্ট্রই স্বার্থ ব্যতীত কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করে না, এবং ইসরায়েলও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল না। ইরাক–ইরান যুদ্ধে ইরানকে সমর্থনের পেছনে তাদের নানাবিধ কারণ ছিল।
প্রথমত, সেসময় ইসরায়েল ইরানের তুলনায় ইরাককে নিজেদের জন্য বেশি মারাত্মক হুমকি হিসেবে বিবেচনা করত। ইরাকের সঙ্গে ইসরায়েলের কোনো সীমান্ত ছিল না, কিন্তু আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ইরাক ফিলিস্তিনিদের জোরালো সমর্থক এবং তীব্র ইসরায়েলবিরোধী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। ১৯৪৮–১৯৪৯, ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালের আরব–ইসরায়েলি যুদ্ধগুলোতে ইরাক সক্রিয়ভাবে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। ইরাক–ইরান যুদ্ধের সময় ইরাকে ক্ষমতাসীন বাআ’স দল ছিল আদর্শিকভাবে জায়নবাদের তীব্র বিরোধী এবং ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের জোরালো সমর্থক। ইরাকি রাষ্ট্রপতি সাদ্দাম হুসেইন ব্যক্তিগতভাবেও তীব্র ইসরায়েলবিরোধী ছিলেন এবং ইরাকের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রচারণায় সাদ্দামকে জেরুজালেম বিজয়ী রাজা দ্বিতীয় নেবুচাদনেজার ও সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর উত্তরসূরি হিসেবে প্রচার করা হতো। তদুপরি, ইরাক বিভিন্ন ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক দলকে অর্থ ও অস্ত্র সহায়তা প্রদান করত।
১৯৭০–এর দশকের শেষদিকে ইরাকের সামরিক শক্তিও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং অত্যাধুনিক সোভিয়েত ও ফরাসি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ইরাকি সশস্ত্রবাহিনী ক্রমশ আরব বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সশস্ত্রবাহিনীতে পরিণত হচ্ছিল। এমতাবস্থায় ইসরায়েল ইরাকের ক্রমবর্ধমান শক্তিকে ভীতির দৃষ্টিতে দেখছিল।
ইরানে পাহলভি রাজবংশের শাসন চলাকালে ইরানের ছিল বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম সশস্ত্রবাহিনী এবং ইসরায়েল ইরাককে প্রতিহত করার জন্য ইরানের ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু ইরানি বিপ্লবের পর আয়াতুল্লাহ খোমেনির সরকার ইরানি সশস্ত্রবাহিনীতে ব্যাপক শুদ্ধি অভিযান চালায় এবং এর ফলে ইরানি সশস্ত্রবাহিনীর শক্তিসামর্থ্য বহুলাংশে হ্রাস পায়। তদুপরি, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরান তাদের সশস্ত্রবাহিনীর পশ্চিমা–নির্মিত অস্ত্রশস্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় খুচরো যন্ত্রাংশ সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয় এবং এর ফলে তাদের সামরিক সরঞ্জামের বড় একটি অংশ অকেজো হয়ে পড়ে।
এই পরিস্থিতিতে এতদঞ্চলের সামরিক ভারসাম্য ইরাকের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ইরাক–ইরান যুদ্ধ শুরু হলে ইসরায়েলের আশঙ্কা আরো ঘনীভূত হয়, কারণ এই যুদ্ধে ইরান পরাজিত হলে ইরানের তেলসমৃদ্ধ বিস্তীর্ণ অঞ্চল ইরাকের হস্তগত হতো এবং ইরাক মধ্যপ্রাচ্যের অবিসংবাদিত প্রধান শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হত। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক পরিস্থিতি ইসরায়েলের জন্য মারাত্মক প্রতিকূল হয়ে উঠত। এজন্য ইসরায়েলি নেতৃবৃন্দ বিবেচনা করেন যে, যদিও সাদ্দামের ইরাক ও খোমেনির ইরান উভয়েই ইসরায়েলবিরোধী, কিন্তু সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত ইরানের তুলনায় সামরিকভাবে শক্তিশালী ইরাক ইসরায়েলের জন্য বেশি বিপজ্জনক। এজন্য ইসরায়েল এই যুদ্ধে ইরাকের বিজয় রোধ করার জন্য সচেষ্ট হয়ে ওঠে এবং ইরানকে সহায়তা করতে শুরু করে।
অবশ্য যুদ্ধে ইরাক পরাজিত হয়ে ইরান জয়যুক্ত হোক, এরকমটা যে ইসরায়েলের কাম্য ছিল তা নয়। ইরানের সামরিক বাহিনীর তৎকালীন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ইরান যে সহজে ইরাককে পরাজিত করতে পারবে না, এটি সকলের কাছেই স্পষ্ট ছিল। এজন্য ইরাকও যাতে ইরানকে সহজে পরাজিত করতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করাই ছিল ইসরায়েলের লক্ষ্য।
তাদের উদ্দেশ্য ছিল সরল: ইরাক বা ইরান কেউই সহজে এই যুদ্ধে বিজয়ী হতে পারবে না এবং এর ফলে উভয় পক্ষ একটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে লিপ্ত হবে। এর মধ্য দিয়ে তাদের উভয়েরই শক্তিক্ষয় ঘটবে এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বড় ধরনের কোনো শত্রুভাবাপন্ন কার্যক্রম চালানোর সুযোগ তাদের থাকবে না। বাস্তবিকই ইরাক–ইরান যুদ্ধ আট বছর স্থায়ী হয় এবং ইরাক ও ইরান উভয়কে বিধ্বস্ত করে ফেলে।
দ্বিতীয়ত, ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের আগে ইরান ছিল ইসরায়েলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। ইরানের অভ্যন্তরে প্রভাব বিস্তারের জন্য ইসরায়েল বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। ১৯৬৭ সালের আরব–ইসরায়েলি যুদ্ধের পর ইসরায়েলের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, ইসরায়েল ইরানকে আরব বিশ্বের প্রান্তে অবস্থিত এমন একটি ইসরায়েলি মিত্র হিসেবে বিবেচনা করত, যেটির মাধ্যমে ইসরায়েল কর্তৃক আরব বিশ্বকে ঘিরে ফেলার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুযোগ ছিল।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ইসরায়েল নিজেই আরব রাষ্ট্রগুলোর দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল, এবং শত্রুভাবাপন্ন আরব রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে শক্তির ভারসাম্য নিজেদের পক্ষে আনার উদ্দেশ্যে ইসরায়েল আরব বিশ্বের প্রান্তিক অঞ্চলে অবস্থিত অনারব রাষ্ট্রগুলোর (যেমন: ইরান, তুরস্ক ও ইথিওপিয়া) সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার নীতি গ্রহণ করেছিল।
ইরানের ‘ইসলামি বিপ্লব’ ছিল এক্ষেত্রে ইসরায়েলের জন্য বড় একটি সঙ্কট। এই বিপ্লবের ফলে ইসরায়েল কয়েক দশক ধরে ইরানের অভ্যন্তরে যে প্রভাব বিস্তার করেছিল, সেটি অকস্মাৎ বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু ইরাক–ইরান যুদ্ধ ইসরায়েলকে পুনরায় ইরানের ওপর প্রভাব বিস্তারের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। তদানীন্তন ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী (পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী) অ্যারিয়েল শ্যারনের মতে, ইরানে সংঘটিত বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পর ইসরায়েল চাচ্ছিল ইরানের সঙ্গে সংযোগ সম্পূর্ণভাবে ছিন্ন না করে একটি ‘ক্ষুদ্র জানালা’ (small window) খোলা রাখতে। এই উদ্দেশ্য নিয়ে ইসরায়েল ইরাক–ইরান যুদ্ধের সময় ইরানকে সহায়তা প্রদান করে। ইসরায়েলি নেতৃবৃন্দের ধারণা ছিল, এর মধ্য দিয়ে ইরানের ওপর ইসরায়েলের অন্তত আংশিক প্রভাব বজায় থাকবে এবং ইরানি সরকারের তীব্র ইসরায়েলবিরোধী নীতি আংশিকভাবে প্রশমিত করা সম্ভবপর হবে।
তৃতীয়ত, ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের আগে ইরান ছিল ইসরায়েলি অস্ত্রের একটি বৃহৎ বাজার। ইরানি সশস্ত্রবাহিনীর সামরিক সরঞ্জামের বড় একটি অংশ আসত ইসরায়েল থেকে। স্বভাবতই ইসরায়েলি মিলিটারি–ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের জন্য ইরানের অস্ত্রের বাজার ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর এই বিরাট বাজার ইসরায়েলিদের হাতছাড়া হয়ে যায়। এটি ছিল ইসরায়েলি সামরিক শিল্পের জন্য একটি বড় মাত্রার ক্ষতি। এজন্য ইরাক–ইরান যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ইরান যখন অস্ত্রশস্ত্র ও খুচরো যন্ত্রাংশের অভাবে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছিল, ইসরায়েল তখন সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে ইরানকে অস্ত্র সরবরাহ করতে শুরু করে। ইসরায়েলি মিলিটারি–ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের উদ্দেশ্য ছিল যেকোনো মূল্যে ইরানের বাজার ধরে রাখা। ইরানে ঠিক কোন ধরনের সরকার ক্ষমতাসীন, সেটি নিয়ে তাদের বিশেষ মাথাব্যথা ছিল না।
অবশ্য ইরানের নিকট গোপনে অস্ত্র রপ্তানির পেছনে ইসরায়েলি সরকার ও গোয়েন্দা সংস্থার নিজস্ব স্বার্থও জড়িত ছিল। ইরানের নিকট রপ্তানিকৃত অস্ত্রশস্ত্রের বিনিময়ে ইরান ইসরায়েলকে যে অর্থ সরবরাহ করে, সেটির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ইসরায়েলের রাষ্ট্রীয় বাজেটের অন্তর্ভুক্ত হয়নি। ইসরায়েলি বিশ্লেষকদের মতে, এই অর্থের একটি বড় অংশ ইসরায়েলে ক্ষমতাসীন লিকুদ দল ও ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের অনানুষ্ঠানিক ফান্ডে জমা হয়। স্বভাবতই ইসরায়েলি মিলিটারি–ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের পাশাপাশি ইসরায়েলের ক্ষমতাসীন দল ও গোয়েন্দা সংস্থাও ইরানকে সামরিক সহায়তা প্রদান করতে আগ্রহী ছিল।
চতুর্থত, ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের প্রাক্কালে ইরানে ৮০,০০০ থেকে ১,০০,০০০ ইহুদি বসবাস করত। পাহলভি রাজবংশের শাসনামলে ইরানি ইহুদিদের প্রতি সেরকম কোনো বৈষম্য বা নিপীড়ন করা হতো না। কিন্তু ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর ইরানি সরকার যে তীব্র ইসরায়েলবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে, এতে করে আশঙ্কা দেখা দেয় যে, ইরানে বসবাসরত ইহুদিদের ওপরও নিপীড়ন শুরু হতে পারে। এই আশঙ্কা থেকে ইসরায়েল ইরানি ইহুদিদের দেশত্যাগের বন্দোবস্ত করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। ইরাক–ইরান যুদ্ধের সময় ইসরায়েল কর্তৃক ইরানকে অস্ত্র সরবরাহের পেছনে এই বিষয়টিরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
ইসরায়েল কর্তৃক ইরানকে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহের বিনিময়ে ইরানি সরকার ইরানি ইহুদিদের একটি বড় অংশকে দেশত্যাগের অনুমতি প্রদান করে। এর ফলে প্রায় ৬০,০০০ ইরানি ইহুদি ইরান ত্যাগ করতে সমর্থ হয়। এদের মধ্যে প্রায় ৩৫,০০০ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, প্রায় ২০,০০০ ইসরায়েলে এবং প্রায় ৫,০০০ ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রে চলে যায়।
সর্বোপরি, ইরাক–ইরান যুদ্ধের সময় ইসরায়েল কর্তৃক ইরানকে সহায়তা প্রদান এবং ইরান কর্তৃক সেই সহায়তা গ্রহণের একটি উল্লেখযোগ্য কারণ ছিল তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি উভয় রাষ্ট্রের তীব্র অবিশ্বাস। ১৯৫৬, ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালের আরব–ইসরায়েলি যুদ্ধগুলোতে সোভিয়েত ইউনিয়ন আরব রাষ্ট্রগুলোকে ব্যাপক রাজনৈতিক ও সামরিক সহায়তা প্রদান করে এবং ১৯৬৭–১৯৭০ সালের মিসরীয়–ইসরায়েলি সংঘাতে সোভিয়েত সৈন্যরা সরাসরি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।
মিসর (১৯৭৩ সাল পর্যন্ত), সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া ও দক্ষিণ ইয়েমেনের মতো তীব্র ইসরায়েলবিরোধী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, এবং এই রাষ্ট্রগুলোর সামরিক শক্তির অন্যতম প্রধান উৎস ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। তদুপরি, সোভিয়েতরা পিএলওকেও আর্থিক ও সামরিক সহায়তা প্রদান করত এবং ১৯৬৭ সালের আরব–ইসরায়েলি যুদ্ধের পর থেকে ইসরায়েলের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল না। স্বভাবতই ইসরায়েল সোভিয়েত ইউনিয়নকে নিজস্ব অস্তিত্বের জন্য একটি বড় হুমকি হিসেবে বিবেচনা করত।
অনুরূপভাবে, পাহলভি রাজবংশের শাসনামলে ইরান সোভিয়েত ইউনিয়নকে নিজস্ব রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার জন্য একটি গুরুতর হুমকি হিসেবে বিবেচনা করত। ১৯৪৫–১৯৪৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ইরানি আজারবাইজান ও ইরানি কুর্দিস্তানে দুইটি সোভিয়েত–নিয়ন্ত্রিত কমিউনিস্ট রাষ্ট্র স্থাপনের প্রচেষ্টা চালিয়েছিল, এবং পরবর্তীতে ইরানের রাজতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করে কমিউনিস্ট তুদেহ দলকে ইরানের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার জন্যও সোভিয়েতরা সচেষ্ট ছিল। এমতাবস্থায় ইরান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে, যার একটি অন্যতম কারণ ছিল সোভিয়েত হুমকি প্রতিহত করা।
১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পরেও এই পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আসেনি। ইরানের নতুন ‘ইসলামি প্রজাতান্ত্রিক’ সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের পাশাপাশি সোভিয়েত ইউনিয়নেরও তীব্র বিরোধী ছিল। তারা পার্শ্ববর্তী আফগানিস্তানে চলমান গৃহযুদ্ধে সোভিয়েত–সমর্থিত আফগান কমিউনিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মিলিট্যান্ট গ্রুপকে সহায়তা প্রদান করে, এবং সোভিয়েত সরকারের আশঙ্কা ছিল যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের দক্ষিণাঞ্চলীয় মুসলিম–অধ্যুষিত প্রজাতন্ত্রগুলোতে ইরান ধর্মীয় উগ্রপন্থা ও বিচ্ছিন্নতাবাদ ছড়িয়ে দিতে পারে। এমতাবস্থায় ইরাক–ইরান যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন কঠোরভাবে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার প্রচেষ্টা চালালেও পরবর্তীতে তারা ইরাকের দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং ইরাককে বিপুক পরিমাণ সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করে।
এই পরিস্থিতিতে ইরানি সরকার মধ্যপ্রাচ্যে নিজেকে একাকী হিসেবে আবিষ্কার করে এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ইরাকের বিরুদ্ধে মিত্র খুঁজতে থাকে। ইসরায়েলও ইরাক ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়কে ভীতির দৃষ্টিতে দেখত, এবং ‘শত্রুর শত্রু বন্ধু’ এই নীতির ভিত্তিতে ইরান ও ইসরায়েল পরস্পরের সঙ্গে একটি গোপন ও অনানুষ্ঠানিক মৈত্রীতে আবদ্ধ হয়। ইরাক–ইরান যুদ্ধ চলাকালে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যেকার এই মিত্রতা বজায় থাকে। অবশ্য এ সময় ইরান কার্যত ইসরায়েলের প্রতি একটি দ্বিমুখী নীতি অনুসরণ করে। একদিকে তারা গোপনে ইসরায়েলের সঙ্গে সামরিক ও অন্যান্য সহযোগিতামূলক সম্পর্কে লিপ্ত হয়, অন্যদিকে প্রকাশ্যে তারা তীব্র ইসরায়েলবিরোধী মনোভাব ব্যক্ত করে এবং মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে বিভিন্ন ইসরায়েলবিরোধী গ্রুপকে সহায়তা প্রদান অব্যাহত রাখে। ইসরায়েলিরা ইরানের এই দ্বিমুখী নীতি সম্পর্কে সচেতন ছিল, কিন্তু প্রয়োজনের তাগিদে তারা ইরানকে সহায়তা প্রদান অব্যাহত রাখে।
১৯৮৮ সালে অমীমাংসিতভাবে ইরাক–ইরান যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে এবং এর মধ্য দিয়ে ইরানের নিকট ইসরায়েলি সহায়তার প্রয়োজনীয়তা বহুলাংশে হ্রাস পায়। স্বাভাবিকভাবেই এর ফলে বিপরীতমুখী ও বাহ্যিকভাবে শত্রুভাবাপন্ন রাষ্ট্র দুইটির মধ্যে যুদ্ধকালীন অনানুষ্ঠানিক মৈত্রীতে ফাটল ধরতে শুরু করে। অবশ্য তা সত্ত্বেও যুদ্ধক্লান্ত ও বিধ্বস্ত ইরান তৎক্ষণাৎ ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি দ্বন্দ্বে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত থাকে।
কিন্তু ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাকি সমরযন্ত্রকে প্রায় সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয় এবং একই বছরে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যের শক্তির ভারসাম্য ইরান ও ইসরায়েলের দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং সোভিয়েত ও ইরাকি হুমকির ভয় থেকে উভয় রাষ্ট্র মুক্ত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ইরান ও ইসরায়েল পরস্পরের কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত হয় এবং রাষ্ট্রদ্বয়ের মধ্যে একটি তীব্র দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের সৃষ্টি হয়, যা এখন পর্যন্ত বিদ্যমান রয়েছে।