১৯৮০ সালের ২৪ এপ্রিল। ‘অপারেশন ঈগল ক্ল’ অভিযানের পরিকল্পিত প্রথম রাত। ওমানের মাসিরাহ দ্বীপ থেকে আকাশে উড়লো তিনটি ‘এমসি-১৩০ই কমব্যাট ট্যালন’। অভিযানে ব্যবহৃত বিমানগুলোর নাম ‘ড্রাগন- ১, ২, ৩’। রাত ১০:৪৫ মিনিটে মরুভূমির বুকে পূর্ব নির্ধারিত নির্জন স্থান ‘ডেজার্ট-১’এ অবতরণ করলো ড্রাগন-১। নিরাপত্তার খাতিরে বিমানের আলো নেভানো, বন্ধ করে রাখা হয়েছে রেডিও। তাই অসমতল স্থানে অবতরণ করতে গিয়ে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলো ড্রাগন-১। বিমান থেকে বেরিয়ে এলো ‘ইউনাইটেড স্টেটস এয়ার ফোর্স’ বা ইউএসএফ এর একটি ‘কমব্যাট কন্ট্রোল টিম’ বা সিসিটি। সিসিটির নেতৃত্বে ছিলেন কর্নেল কার্নি এবং বেকউইথ। বিমান থেকে নেমেই সিসিটি একটি সমান্তরাল ল্যান্ডিং জোন তৈরির কাজ শুরু করলো এবং স্থাপন করলো ‘টাকান বিকন’ (বিশেষ ধরনের নেভিগেশন ব্যবস্থা)।
সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেলে উভয় ল্যান্ডিং জোনে (মরুভূমির উপর দিয়ে যাওয়া পাশাপাশি দুটি রাস্তাকেই রানওয়ে হিসেবে প্রস্তুত করা হয়) অবতরণ করে আকাশে ভাসতে থাকা ড্রাগন-২ ও ৩। সৈন্যবাহিনী ও অন্যান্য সরঞ্জাম নামিয়ে দিয়ে ১১:১৫ মিনিটেই ড্রাগন-২ ও ড্রাগন-৩ উড়াল দিলো আকাশে। কারণ সেখানে কিছুক্ষণ পরই অবতরণ করবে ‘রিপাবলিক-৪, ৫, ৬’ নামধারী ৩টি ইসি-১৩০ই কার্গো বিমান। সাথে আসবে মূল অভিযানকে সুরক্ষা দিতে ‘ব্লুবিয়ার্ড- ১,২, …, ৮’ নামধারী আরো আটটি ‘আরএইচ-৫৩ ডি’ মাইনসুইপার হেলিকপ্টার।
এদিকে তিনটি ড্রাগন থেকে ‘ডেজার্ট-১’ এ অবতরণ করেছে মোট ১১৮ জন সৈন্য। এর মধ্যে প্রধান অ্যাসাল্ট টিমে রয়েছে ৯৩ জন ‘ডেলটা ফোর্স’ সদস্য, যারা সরাসরি দূতাবাস আক্রমণ করবে। ১৩ জনের অপর একটি দল আক্রমণ করবে পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়। আর ১২ জন ‘ইউনাইটেড স্টেটস আর্মি রেঞ্জারস’ বা ইউএসএআর এর একটি দল যেকোনো বেসামরিক যান চলাচলের পথরোধ করার দায়িত্বে নিযুক্ত হবে।
এত বড় গোপন সেনা অভিযান আর সেখানে কোনো নাটকীয়তা থাকবে না, তা কি হয়? নাটকীয়তার শুরু হলো রানওয়ে হিসেবে ব্যবহৃত রাস্তায় একটি যাত্রীবাহী বাসের আগমনের মধ্য দিয়ে। বাসটিকে রক্ষীবাহিনী থামিয়ে রাস্তার একপাশে নিয়ে আটকে রাখে, কিছুক্ষণের মধ্যেই রাস্তায় আগমন ঘটে একটি জ্বালানি বোঝাই লরির, যার পেছনে ছিল আরো একটি পিকআপ ভ্যান।
রক্ষীবাহিনী থামবার ইঙ্গিত দিলেও লরিটি দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল। তখন বাধ্য হয়ে লরিটিকে মিসাইল দিয়ে উড়িয়ে দেয়া হলো। তবে বিস্ময়করভাবে লরি ড্রাইভার বেঁচে গেলো এবং পেছনের পিকআপে উঠে পলায়ন করলো! অন্যদিকে লরি বিস্ফোরণের বিশাল অগ্নিকুণ্ড কতদূর থেকে দেখা যাবে, তা হয়ে ওঠে মূল চিন্তার বিষয়। তবে এই ঘটনার চেয়েও বড় সমস্যা অন্যত্র ঘটে গেছে, যা প্রভাব ফেলতে পারে পুরো অভিযানের উপর। এদিকে ‘ডেজার্ট-১’এ অবতরণ করেছে রিপাবলিক-৪, ৫, ৬।
সমস্যার শুরু ব্লুবিয়ার্ড-৬ থেকে। ডেজার্ট-১ থেকে প্রায় অর্ধশত মাইল দূরেই হেলিকপ্টারের পাইলট হঠাৎ সেন্সরে লক্ষ্য করলেন যে, হেলিকপ্টারের রটার ব্লেডে (পাখা) ফাটল ধরেছে। তৎক্ষণাৎ ব্লুবিয়ার্ড-৬ অবতরণ করে এবং পাইলট এটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করলেন। আর ক্রুদেরকে সে স্থান থেকে উঠিয়ে নেয় ব্লুবিয়ার্ড-৮।
অন্যদিকে রাডারের শনাক্তকরণ এড়াতে হেলিকপ্টারগুলো উড়ছিল সর্বোচ্চ ২০০ ফুট উচ্চতায়। ফলে বালুময় মরুপৃষ্ঠের খুব কাছে দিয়ে উড়ে যাবার সময় সৃষ্টি হয় ‘হাবুব’ বা ধূলিঝড়ের। হাবুবের কবলে ব্লুবিয়ার্ড-৫ যান্ত্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ‘ইউএসএস নিমিতজ’ এ (আমেরিকান নৌবাহিনীর একটি ক্যারিয়ার যুদ্ধজাহাজ) ফিরে যায়। বাকি ছয়টি হেলিকপ্টার নির্ধারিত সময়ের ৫০ থেকে ৯০ মিনিট পর একে একে ডেজার্ট-১’ এ গিয়ে পৌঁছে। সবশেষে পৌঁছায় ব্লুবিয়ার্ড-২। ধূলিঝড়ের কবলে পড়ে এই হেলিকপ্টারটির হাইড্রলিক সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে পরিত্যক্ত হয় আরো একটি হেলিকপ্টার। আর এরই সাথে অভিযান বর্জন করার সিদ্ধান্ত হয়! তবে মূল দুঃস্বপ্নটা তখনো বাকি ছিল।
ঘটনার সূত্রপাত হয় ১৯৭৯ সালের ৪ নভেম্বরে। সেদিন ইরানের তেহরানে অবস্থিত আমেরিকান দূতাবাসে একযোগে ঢুকে পড়ে আয়াতুল্লাহ খোমেনির অনুসারী হাজারো বিদ্রোহী শিক্ষার্থী। তারা দূতাবাসের ভেতরে মোট ৬৬ জন মার্কিনীকে জিম্মি করে রাখে। ফলে আমেরিকা আর ইরানের মধ্যে যুদ্ধ যুদ্ধ অবস্থার সৃষ্টি হয়। এর কারণটাও অবশ্য পুরনো। মোহাম্মদ রেজা পাহলভি, যিনি ‘শাহ অব ইরান’ নামে পরিচিত, ১৯৪১ থেকে দীর্ঘ ৩৮ বছর ইরান শাসন করেন। তার স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে ৭০ এর দশক থেকেই বিদ্রোহ গড়ে উঠেছিল। শাহ এর প্রতি আমেরিকার শক্ত সমর্থনের কারণে বিদ্রোহীরা ক্ষুব্ধ ছিল আমেরিকার উপরও। এরই প্রেক্ষাপটে জিম্মি সংকটের উদ্ভব হয়। ১৯৭৯’র ফেব্রুয়ারিতে বিদ্রোহে ক্ষমতাচ্যুত হন শাহ। বছরের শেষদিকে শুরু হয় জিম্মি সংকট।
এদিকে ১৪ জন জিম্মিকে ছেড়ে দেয়ার পর অবশিষ্ট ছিল ৫২ জন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার বন্দীদের মুক্ত করতে ইরানের সাথে কূটনৈতিক আলোচনার প্রচেষ্টা চালান। কিন্তু খোমেনির উদ্দেশ্য ছিল কার্টার প্রশাসনের দুর্নাম। তাই আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন তিনি। ফলে জিম্মিদের মুক্ত করতে আমেরিকার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে উদ্ধার অভিযানের আদেশ দেন জিমি কার্টার। স্বাভাবিকভাবেই এই জিম্মি সংকট আমেরিকান প্রশাসনে টালমাটাল অবস্থার সৃষ্টি করে। এদিকে নির্বাচনের মাত্র ৬ মাস আগে এমন ঘটনা কার্টার প্রশাসনের জন্য বিব্রতকর অবস্থা তৈরি করেছিল। কিন্তু কার্টার ভাবলেন ভিন্ন কিছু। আয়াতুল্লাহ খোমেনির কূটনৈতিক আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানে তিনি বরং খুশিই হলেন! তিনি কিছু চিন্তা না করে সরাসরি সামরিক সমাধানের দিকেই গেলেন। কেননা, নির্বাচনের আগে আগে একটি বীরত্বপূর্ণ অভিযানের মাধ্যমে বন্দীদের মুক্ত করে আনতে পারলে ভোটের রাজনীতিতে এগিয়ে যাওয়া যাবে অনেক দূর! ফলে শুরু হলো এক উচ্চাভিলাষী, অতিমাত্রায় জটিল এবং ভুলে ভরা আত্মঘাতী দুই রাতের পরিকল্পনা। পরিকল্পনার প্রধান দিকগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।
মিশরের ওয়াদি কেনা বিমানঘাঁটি থেকে পুরো যৌথ বাহিনী পরিচালনা করবেন মেজর জেনারেল ভট এবং সরাসরি যোগাযোগ রাখবেন প্রেসিডেন্টের সাথে। তার কাছে সরাসরি অভিযানের খবর দিবেন স্থলবাহিনীর কমান্ডার জেমস কাইল এবং চার্লস বেকউইথ।
তেহরান থেকে রিচার্ড মেডোজের নেতৃত্বে একদল সিআইএ এজেন্টকে দায়িত্ব দেয়া হয় জিম্মিদের তথ্যাদি সংগ্রহের জন্য। দূতাবাস থেকে প্রাথমিকভাবে মুক্তি পাওয়া ১৪ জনের মধ্যে একজনের কাছে সে সম্পর্কিত মূল্যবান তথ্য পায় সিআইএ।
প্রথম রাত
আমেরিকার নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস নিমিতজে অপেক্ষারত আটটি আরএইচ-৫৩ডি হেলিকপ্টার অপারেশনের জন্য নির্ধারিত দুটি স্থানের প্রথম স্থান ডেজার্ট-১’এ চলে আসে। পরবর্তীতে বিশ্লেষকরা একে একটি হাস্যকর ভুল বলে মন্তব্য করেছেন। কারণ আরএইচ- ৫৩ডি হচ্ছে একপ্রকার মাইনসুইপার হেলিকপ্টার, যা বিশেষ অভিযানের জন্য উপযুক্ত নয়। এর চেয়ে ভালো হেলিকপ্টারও (এইচএইচ- ৩ই) ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর কাছে।
তিনটি এমসি- ১৩০ই কমব্যাট ট্যালন বিমান ডেলটা ফোর্স ও রেঞ্জার বাহিনী এবং অন্যান্য লজিস্টিক সরঞ্জাম ডেজার্ট-১’ এ পৌঁছে দেয়। প্রথমে কেবল ড্রাগন-১ বিমানটি অবতরণ করে অন্যান্য বিমানের জন্য নেভিগেশন ব্যবস্থা চালু করবে। এ সময় প্রতিটি বিমান ‘রেডিও সাইলেন্স’ বজায় রাখবে যার আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল না। কারণ মরুভূমিতে ইরানের প্রতিরক্ষা বাহিনীর নজরদারি ছিল বেশ দুর্বল।
সৈন্যবাহিনী বিমান থেকে নামার পর ড্রাগন-২ ও ৩ ডেজার্ট-১ ত্যাগ করবে এবং তিনটি ইসি-১৩০ই (রিপাবলিক-৪,৫,৬) বিমান পর্যাপ্ত জ্বালানি নিয়ে ডেজার্ট-১’এ অবতরণ করবে। রিপাবলিক বিমানগুলোর একটাই কাজ, আর তা হচ্ছে হেলিকপ্টারগুলোকে মাঝপথে জ্বালানি সরবরাহ করা। এখানেই প্রশ্ন থেকে যায় যে, মার্কিন প্রতিরক্ষাবাহিনী এত কসরত করে জ্বালানি সরবরাহের ব্যবস্থা করতে গেল কেন? কেননা এইচএইচ-৩ই হেলিকপ্টারগুলোর ‘ইন-ফ্লাইট’ জ্বালানি সরবরাহের ব্যবস্থা আছে। এই হেলিকপ্টার ব্যবহার করলে ডেজার্ট-১ এর প্রয়োজনই হতো না, অভিযান হতে পারতো একদিনেই!
দ্বিতীয় রাত
হেলিকপ্টারগুলো ডেজার্ট-১ থেকে উড়ে গিয়ে ডেজার্ট-২’এ ডেলটা ফোর্সকে নামিয়ে দিয়ে আসবে। ডেজার্ট-২ তেহরানে মার্কিন দূতাবাস থেকে মাত্র ৫০ মাইল দূরে। সেখানে তেহরানে অবস্থানরত সিআইএ এজেন্টরা পূর্বেই ৬টি ট্রাক নিয়ে অপেক্ষারত থাকবে ডেলটা ফোর্সের জন্য।
ছয়টি ট্রাকে ডেলটা ফোর্স চলে যাবে দূতাবাসে এবং জিম্মিদের মুক্ত করবে। দূতাবাসে প্রবেশের পর উদ্ধার কাজ শেষ করার জন্য সময় বরাদ্দ মাত্র ৪৫ মিনিট! অর্থাৎ সৈন্যদের সময় মাথায় রেখে দ্রুত অভিযান পরিচালনা করতে হতো যা ‘হিট অর মিস’ অপারেশনের মতো।
জিম্মিদের মুক্ত করার পর তাদের নিয়ে যাওয়া হবে দূতাবাসের নিকটবর্তী একটি ফুটবল স্টেডিয়ামে যেখান থেকে হেলিকপ্টারে তাদের নিয়ে যাওয়া হবে ইরানের মানজারিয়াহ বিমান ঘাঁটিতে। অন্যদিকে আগেরদিন ডেজার্ট-১ থেকে ছেড়ে যাওয়া ড্রাগন-১, ২ মিশরের ওয়াদি কেনা বিমানঘাঁটিতে থাকবে। দ্বিতীয় রাতে জিম্মিদের নিয়ে হেলিকপ্টার মানজারিয়াহতে আসার পূর্বেই এই ড্রাগন বিমানগুলো রেঞ্জার বাহিনী সেখানে পৌঁছে দেবে, যারা ইরানি বাহিনী থেকে বিমানঘাঁটি মুক্ত করে রাখবে।
হেলিকপ্টার মানজারিয়াহতে পৌঁছুতে পৌঁছুতে সেখানে উপস্থিত হবে সৌদি আরব থেকে সি-১৪১ কার্গো বিমান। এই বিমানেই মুক্তদের নিয়ে যাওয়া হবে তেহরানের বাইরে। এ সময় ইরানি বাহিনী পিছু ধাওয়া করলে তিনটি এসি-১৩০ গানশিপ বিমান সুরক্ষা দেবে।
উল্লেখ্য, এই অতিমাত্রায় জটিল অভিযানের পরিকল্পনা প্রায় পাঁচ মাস ধরে চলতে থাকে! একইসাথে চলে এর প্রস্তুতি। কিন্তু পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, পাঁচ মাসের প্রস্তুতি ও পরিকল্পনাও ছিল ভুলে ভরা। পরিকল্পনাটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল, যেখানে অনেক কিছুই ভুল হয়ে যেতে পারতো। পরিকল্পনাবিদরা এর সাফল্য কিংবা ব্যর্থতার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কোনো চেষ্টাই করেননি।
এমনও শোনা যায় যে, তারা কয়েক বছর আগেই ঘটে যাওয়া ইসরায়েলি প্যারা কমান্ডো বাহিনীর দুঃসাহসিক ‘অপারেশন এন্টাবে’ উদ্ধার অভিযানের চেয়ে আরো বীরত্বপূর্ণ কিছু করে বিশ্বকে দেখানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল! অথচ অপারেশন এন্টাবের পরিকল্পনার প্রতিটি ধাপ ছিল নিখুঁত, যেখানে ঈগল ক্ল ছিল সম্পূর্ণ গোঁজামিলে ভরপুর!
মরুভূমিতে সিআইএ এর অনুসন্ধানে রিপোর্ট করা হয়েছিল যে হেলিকপ্টারগুলো অন্তত ৩ হাজার ফুট উঁচুতে উড়লেও ইরানের রাডারে ধরা পড়বে না, কারণ সেখানে ইরানের নজরদারি দুর্বল। কিন্তু তারপরও কেন এতো নিচুতে হেলিকপ্টারগুলো ওড়ানো হয়েছিল, তা জানা যায়নি। অন্যদিকে পুরো অভিযানটিকে এতোটাই গোপন রাখা হয়েছে যে যারা অভিযানে যাবে, তারা যুদ্ধক্ষেত্রে যাবার আগ পর্যন্ত জানতো না তারা কোন অপারেশনে যাচ্ছে! অথচ যেকোনো বিশেষ অপারেশনের আগে একাধিক মহড়া দেয়ার নিয়ম রয়েছে।
ডেলটা ফোর্স, রেঞ্জার বাহিনী কিংবা মেরিন কোরের লজিস্টিক সাহায্যকারী ক্রুদের পৃথকভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হলেও অভিযান সম্পর্কে তারা অবহিত ছিল না। অভিযান শুরুর দিন তারা জানতে পারে, তারা কোথায় এবং কী অপারেশনে যাচ্ছে! অন্যদিকে ইরানের মরুভূমিতে হাবুবের ব্যাপারে একেবারেই অজ্ঞ ছিল মেরিন কোরের আনকোরা ক্রুরা, যারা কিনা ব্লুবিয়ার্ডগুলোর পাইলট ছিলেন। ফলে অপ্রত্যাশিত পরিবেশে তারা গোল পাকিয়ে আগেই খুইয়ে বসেন তিনটি হেলিকপ্টার, যা কিনা অভিযান বর্জনের সিদ্ধান্তে নিতে বাধ্য করে।
অভিযান শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যাওয়ায় মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য যতটা না বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হতো, তার চেয়ে বেশি লজ্জাজনক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে শেষের নাটকীয়তায়। ডেজার্ট-১’এ তখন উপস্থিত রয়েছে তিনটি ইসি-১৩০ বিমান এবং অবশিষ্ট পাঁচটি ব্লুবিয়ার্ড। কমান্ডার কাইল এবং বেকউইথের নির্দেশ ছিল দ্রুত ব্লুবিয়ার্ডগুলোতে জ্বালানি সরবরাহ করা এবং সেখান থেকে চলে যাওয়া। কিন্তু রিপাবলিক-৩ থেকে জ্বালানি সংগ্রহ করে উড়তে গিয়ে অপ্রত্যাশিত এক বিপদে পড়ে ব্লুবিয়ার্ড-৬। হঠাৎ করে দূর থেকে তৈরি হওয়া একটি হাবুবের কবলে পড়ে ব্লুবিয়ার্ড-৬ এবং পাইলট অস্বচ্ছ ধুলাবালিতে কিছু দেখতে না পেয়ে ভুলক্রমে হেলিকপ্টার সহ আছড়ে পড়েন রিপাবলিক-৩ এর উপর। মুহূর্তে রিপাবলিক-৩ এর জ্বালানি ব্লাডার জ্বলে উঠে এবং এর ভেতরে অবস্থান করা মেরিন কোরের পাঁচজন সদস্য মারা যায়। ভস্মীভূত হয় ব্লুবিয়ার্ডে থাকা তিনজনও।
আকস্মিক এই ঘটনায় ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে ডেলটা ফোর্স ও অন্যান্য ক্রু সদস্যরা। বিভ্রান্ত হয়ে যান কমান্ডার কাইল এবং বেকউইথ। রিপাবলিক-১ ও ২’এ অবশিষ্ট জ্বালানি দিয়ে তখন অক্ষত চারটি হেলিকপ্টারের প্রয়োজনীয়তা মেটানো সম্ভব ছিল না। ফলে সিদ্ধান্ত হলো হেলিকপ্টারগুলো সেখানেই ফেলে রিপাবলিক-১ ও ২ এ চড়ে সবাই ডেজার্ট-১ ত্যাগ করবে। ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল হয়ে তারা সিআইএ এর নথিপত্রের বাক্স ও অন্যান্য আরো অনেক গোপন নথিপথ নিতেও ভুলে গেল! আর অগ্নিনির্বাপণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় আটজনকে ভস্মের মধ্যে ফেলেই সবাই মাসিরাহ বিমানঘাঁটিতে পৌঁছুলো। শেষ হলো ইতিহাসের সবচেয়ে লজ্জাজনক ‘বিশেষ অভিযান’!
অপারেশন ঈগল ক্ল এর ঘটনা ছিল কার্টার প্রশাসন এবং পুরো মার্কিন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য কলঙ্কজনক। স্থলবাহিনীর ফেলে আসা নথিপত্র ঘেঁটে ইরানি বাহিনী পরবর্তী এক সপ্তাহে পুরো তেহরানে শতাধিক সিআইএ এজেন্ট গ্রেফতার এবং হত্যা করে! আর চারটি অক্ষত আরএইচ-৫৩ডি হেলিকপ্টার তো আজ অবধি ব্যবহার করছে ইরান! অন্যদিকে এই বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের জন্য দ্রুতই নতুন এবং অধিকতর উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা হাতে নেয় কার্টার প্রশাসন। কিন্তু নির্বাচনে কার্টার হেরে যান রোনাল্ড রিগ্যানের কাছে। ফলে দ্বিতীয় অভিযানের পরিকল্পনা আর এগোয়নি। অন্যদিকে ইরানও জিম্মিদের দূতাবাস থেকে সরিয়ে গোপন স্থানে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে অবশ্য জিম্মিদের দীর্ঘ ৪৪৪ দিনের বন্দীদশা থেকে মুক্তি দেয় ইরান। এরপর এই ত্রুটিপূর্ণ অভিযান নিয়ে তৈরি হয় অনেক ষড়যন্ত্র তত্ত্ব।
জিম্মি দশার মাঝেই কয়েকজন মার্কিনকে মুক্ত করায় কানাডার বিশেষ ভূমিকা ছিল, যা নিয়ে তৈরি হয় হলিউড সিনেমা ‘আর্গো’। যা-ই হোক, প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকা মার্কিন প্রতিরক্ষা বাহিনীর সক্ষমতা নিয়ে কারো মনে কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু ভিয়েতনাম যুদ্ধে পরাজিত হবার মাত্র কয়েক বছরের মাথায় এমন গ্লানিময় এক অভিযান যেন মার্কিন প্রতিরক্ষাকে বিশ্ব দরবারে অসহায়ই করে দিয়েছিল। এই অভিযানের প্রভাব মুছে যেতে তাই অনেক সময় লেগেছিল।
ফিচার ইমেজ: wallpaperswide.com