বুরুন্ডি
‘বুরুন্ডি প্রজাতন্ত্র’ (কিরুন্ডি: Repubulika y’u Burundi; ফরাসি: République du Burundi; ইংরেজি: Republic of Burundi) আফ্রিকার ‘গ্রেট রিফট ভ্যালি’ অঞ্চলে অবস্থিত একটি ক্ষুদ্র স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র। গ্রেট রিফট ভ্যালি হচ্ছে আফ্রিকার এমন একটি অঞ্চল যেখানে ‘আফ্রিকান বৃহৎ হ্রদ’ অঞ্চল এবং পূর্ব আফ্রিকা পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। ২৭,৮৩৪ বর্গ কি.মি. আয়তনবিশিষ্ট রাষ্ট্র বুরুন্ডির উত্তরে রুয়ান্ডা, পূর্ব ও দক্ষিণ–পূর্বে তাঞ্জানিয়া, দক্ষিণ–পশ্চিমে ট্যাঙ্গানিকা হ্রদ এবং পশ্চিমে কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র অবস্থিত। বুরুন্ডি একটি জার্মান উপনিবেশ ছিল, সুতরাং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেনের এই অঞ্চল আক্রমণ করার সম্ভাবনা ছিল ব্যাপক। কিন্তু ব্রিটিশরা শেষ পর্যন্ত এই অঞ্চলে আক্রমণ করেনি।
ষোড়শ শতাব্দীতে বর্তমান বুরুন্ডির ভূখণ্ডে ‘বুরুন্ডি’ নামক একটি রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র স্থাপিত হয় এবং বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত বুরুন্ডিতে এই রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা টিকে ছিল। ১৮৫৬ সালে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা হ্যানিং স্পিক এমন একটি অভিযাত্রী দলে যোগদান করেন, যারা মধ্য আফ্রিকায় বুরুন্ডির নিকটবর্তী অঞ্চলে অভিযান চালাচ্ছিল। স্পিক ছিলেন প্রথম ব্রিটিশ নাগরিক, যিনি বর্তমান বুরুন্ডির ভূখণ্ডে প্রবেশ করেন। কেবল তাই নয়, ধারণা করা হয়, স্পিক ছিলেন বুরুন্ডিতে প্রবেশকারী প্রথম ইউরোপীয় ব্যক্তি। স্পিক একজন ব্রিটিশ সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন বটে, কিন্তু বুরুন্ডিতে তার প্রবেশের সঙ্গে সামরিক বিষয়াবলির কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। সেজন্য তার বুরুন্ডিতে প্রবেশকে ‘আক্রমণ’ হিসেবে বিবেচনা করা যায় না।
১৮৮০–এর দশকে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো আফ্রিকা মহাদেশকে নিজেদের মধ্যে বণ্টন করে নেয় এবং বর্তমান বুরুন্ডির ভূখণ্ড জার্মানির প্রভাব বলয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়। এসময় জার্মান সরকারের অনুমোদনপ্রাপ্ত ‘জার্মান ইস্ট আফ্রিকা কোম্পানি’ (ভারতবর্ষে সক্রিয় ‘ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’র অনুরূপ) এই অঞ্চলে সক্রিয় ছিল এবং এটির কার্যক্রমের মধ্য দিয়েই বুরুন্ডিতে জার্মান উপনিবেশ স্থাপনের প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়। ১৮৯০–এর দশকে জার্মান সরকার জার্মান ইস্ট আফ্রিকা কোম্পানির কাছ থেকে সরাসরি বুরুন্ডির দায়িত্ব অধিগ্রহণ করে এবং এটিকে পার্শ্ববর্তী জার্মান–নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র রুয়ান্ডার সঙ্গে যুক্ত করে ‘রুয়ান্ডা–উরুন্ডি’ নামক একটি উপনিবেশ সৃষ্টি করে। উক্ত উপনিবেশটি ‘জার্মান পূর্ব আফ্রিকা’র অন্তর্ভুক্ত ছিল। জার্মান শাসনাধীনে বুরুন্ডির রাজতান্ত্রিক শাসনকাঠামো বহুলাংশে অপরিবর্তিত রয়ে যায়।
১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে প্রাথমিকভাবে এতদঞ্চলে ব্রিটিশ, বেলজীয় ও জার্মান উপনিবেশগুলোর প্রশাসন আফ্রিকায় শান্তি বজায় রাখার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল। কিন্তু অচিরেই এই অঞ্চলটি মিত্রশক্তি ও কেন্দ্রীয় শক্তির মধ্যেকার একটি তীব্র যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয় এবং মিত্রশক্তি এতদঞ্চলের জার্মান উপনিবেশগুলোর ওপর আক্রমণ পরিচালনা করতে শুরু করে। এ সময় একটি ব্রিটিশ নৌবহর ট্যাঙ্গানিকা হ্রদে জার্মানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এটি সম্ভব যে, এই অভিযান চলাকালে ব্রিটিশরা বুরুন্ডির জলসীমায় প্রবেশ করেছিল এবং হ্রদের তীরে অবস্থিত জার্মান লক্ষ্যবস্তুর ওপর আক্রমণ চালিয়েছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষেই এ সময় ব্রিটিশরা বুরুন্ডির ভূখণ্ডে কোনো সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছিল কিনা, সেটি নিশ্চিত নয় এবং এই বিষয়ে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এজন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেন বুরুন্ডির ভূখণ্ডে আক্রমণ চালিয়েছিল, এটি নিশ্চিতভাবে বলা যায় না।
১৯১৬ সালে ব্রিটিশ সৈন্যরা ব্রিটিশ–নিয়ন্ত্রিত উগান্ডা থেকে দক্ষিণে ভিক্টোরিয়া হ্রদের তীরে অবস্থিত ও তাঞ্জানিয়ার (তদানীন্তন জার্মান পূর্ব আফ্রিকার অন্তর্গত) অন্তর্ভুক্ত বুকোবার দিকে অগ্রসর হয়, কিন্তু তারা বুরুন্ডির ভূখণ্ডে প্রবেশ করেনি। অন্যদিকে, ১৯১৬ সালের জুনে তদানীন্তন বেলজীয় কঙ্গো (বর্তমান কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র) থেকে বেলজীয় সৈন্যরা পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয় এবং জার্মানদেরকে পরাজিত করে বুরুন্ডি দখল করে নেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বাকি সময় জুড়ে বুরুন্ডি বেলজীয় সামরিক শাসনের অধীনে ছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৯ সালের প্যারিস শান্তি সম্মেলনে মিত্রশক্তির সর্বোচ্চ পরিষদ সমগ্র জার্মান পূর্ব আফ্রিকাকে ব্রিটেনের কাছে হস্তান্তর করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সেক্ষেত্রে বুরুন্ডি ব্রিটিশ শাসনাধীনে চলে যেত। কিন্তু বেলজিয়াম এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করে এবং পরবর্তীতে এই বিষয়ে ব্রিটেন ও বেলজিয়ামের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী ইতোমধ্যেই বেলজিয়ামের দখলে থাকা রুয়ান্ডা–উরুন্ডিকে বেলজিয়ামের কাছে হস্তান্তর করা হয় এবং এর মধ্য দিয়ে বুরুন্ডির ভূখণ্ড সরাসরি বেলজীয় শাসনাধীনে আসে। ১৯২২ সালে জাতিপুঞ্জ (League of Nations) আনুষ্ঠানিকভাবে বেলজিয়ামকে রুয়ান্ডা–উরুন্ডি শাসনের ‘ম্যান্ডেট’ প্রদান করে। জাতিপুঞ্জের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, রুয়ান্ডা–উরুন্ডি ছিল একটি ‘বি–ক্লাস’ ম্যান্ডেট, অর্থাৎ বেলজিয়ামের জন্য এই ভূখণ্ডের প্রশাসন ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার সুযোগ ছিল। অবশ্য বেলজীয়রা জার্মানদের নীতি অনুসরণ করে এবং বুরুন্ডিতে বিদ্যমান রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে বহুলাংশে অপরিবর্তিত রাখে।
একই সময়ে বুগুফি অঞ্চল ব্রিটেনের হস্তগত হয়। প্রাপ্ত তথ্যপ্রমাণ অনুযায়ী, জার্মান শাসন চলাকালে এই অঞ্চলটি বুরুন্ডির অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অঞ্চলটিকে বুরুন্ডি থেকে পৃথক করা হয় এবং ব্রিটিশরা এটিকে তাদের ‘ট্যাঙ্গানিকা’ উপনিবেশের সঙ্গে সংযুক্ত করে। এই অঞ্চলটি পরবর্তীতে ট্যাঙ্গানিকার অংশ হিসেবেই থেকে যায় এবং বর্তমানে অঞ্চলটি তাঞ্জানিয়ার অংশ। বুগুফি বুরুন্ডির অংশ ছিল এবং পরবর্তীতে এটি ব্রিটিশ শাসনাধীনে চলে গেছে, এজন্য এটিকে বুরুন্ডির ভূখণ্ডে ব্রিটিশ আক্রমণ হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে। কিন্তু ব্রিটিশরা বুগুফি অঞ্চলে কোনো সামরিক অভিযান পরিচালনা করেনি কিংবা অঞ্চলটিকে বলপূর্বক দখল করে নেয়নি। বেলজীয়রা জার্মানদের কাছ থেকে বুরুন্ডি দখল করে নেয় এবং যুদ্ধের পর আলোচনার মধ্য দিয়ে বুগুফি অঞ্চলকে বুরুন্ডি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ব্রিটেনের কাছে হস্তান্তর করে। সুতরাং ব্রিটিশদের বুগুফি অঞ্চল অধিকারকে ঠিক বুরুন্ডির ভূখণ্ডে ব্রিটিশ আক্রমণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বুরুন্ডি জাতিসংঘের অছি পরিষদের তত্ত্বাবধানে বেলজিয়ামের শাসনাধীন একটি ‘অছি অঞ্চলে’ (trustee territory) পরিণত হয়। অবশেষে ১৯৬২ সালে বুরুন্ডি বেলজিয়ামের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। সামগ্রিকভাবে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পর্যন্ত ব্রিটেন বুরুন্ডিতে কোনো আক্রমণ চালায়নি, এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী প্রায় এক শতাব্দীতে আর বুরুন্ডিতে ব্রিটিশ আক্রমণ পরিচালনার মতো কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। এজন্য বুরুন্ডি সেই অতি অল্প সংখ্যক রাষ্ট্রের মধ্যে একটি, যারা কখনো ব্রিটিশ আক্রমণের ভুক্তভোগী হয়নি।
বেলারুশ
‘বেলারুশ প্রজাতন্ত্র’ (বেলারুশীয়: Рэспубліка Беларусь, ‘রেসপুবলিকা বেলারুস’; রুশ: Республика Беларусь, ‘রেসপুবলিকা বেলারুস’) পূর্ব ইউরোপে অবস্থিত একটি স্থলবেষ্টিত ‘পূর্ব স্লাভিক’ ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। ২,০৭,৬০০ বর্গ কি.মি. আয়তনবিশিষ্ট এই রাষ্ট্রটির পূর্ব ও উত্তর–পূর্বে রাশিয়া, দক্ষিণে ইউক্রেন, পশ্চিমে পোল্যান্ড এবং উত্তর–পশ্চিমে লিথুয়ানিয়া ও লাতভিয়া অবস্থিত। রাষ্ট্রটির সীমান্তে কোনো সমুদ্র নেই, এজন্য ব্রিটিশ নৌবাহিনীর পক্ষে এই অঞ্চলে আক্রমণ পরিচালনা করার কোনো সুযোগ ছিল না। অবশ্য এই অঞ্চলে যে ব্রিটিশরা কখনোই কোনো ধরনের সামরিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেনি, এমনটা নয় কিন্তু।
বর্তমান বেলারুশীয় রাষ্ট্রের ভূখণ্ড ৯ম শতাব্দীতে ‘কিয়েভ রুশ’/’প্রাচীন রুশ’ রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে কিয়েভ রুশ দুর্বল হয়ে পড়তে শুরু করলে কিয়েভ রুশের অন্তর্গত বিভিন্ন প্রদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে আরম্ভ করে। ‘পলোৎস্ক রাজ্য’ ছিল বর্তমান বেলারুশের ভূখণ্ডে প্রতিষ্ঠিত অনুরূপ একটি রাষ্ট্র। চতুর্দশ শতাব্দীর শেষদিকে রাষ্ট্রটি ‘লিথুয়ানিয়া গ্র্যান্ড ডাচি’র অন্তর্ভুক্ত হয়। এসময় টিউটোনিক নাইটদের সঙ্গে লিথুয়ানিয়ার সংঘর্ষ চলে আসছিল এবং বর্তমান বেলারুশের ভূখণ্ড লিথুয়ানিয়ার অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ফলে বেলারুশও এই লিথুয়ানীয়–টিউটোনিক দ্বন্দ্বের একটি ক্ষেত্রে পরিণত হয়।
‘অর্ডার অফ ব্রাদার্স অফ দ্য জার্মান হাউজ অফ সেইন্ট মেরি ইন জেরুজালেম’ বা সংক্ষেপে ‘টিউটোনিক অর্ডার’ ছিল ১১৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্মীয় ‘সামরিক অর্ডার’। স্বেচ্ছাসেবক ও মার্সেনারিদের সমন্বয়ে গঠিত উক্ত সামরিক অর্ডারের সদস্যদের ‘টিউটোনিক নাইট’ হিসেবে অভিহিত করা হতো। অর্ডারটির মূল লক্ষ্য ছিল ফিলিস্তিনে খ্রিস্টান তীর্থযাত্রীদের নিরাপত্তা প্রদান করা। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে খ্রিস্টানদের চূড়ান্ত পরাজয়ের পর তাদের কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু বাল্টিক অঞ্চলে স্থানান্তরিত হয় এবং এতদঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর (যেমন: পোল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া ও নভগরোদ) সঙ্গে তারা প্রলম্বিত যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হয়ে পড়ে। টিউটোনিক নাইটদের শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল এবং এজন্য তারা ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মার্সেনারি সংগ্রহ করে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করতে পারত। যেসব অঞ্চল থেকে স্বেচ্ছাসেবক ও মার্সেনারিরা টিউটোনিক অর্ডারে যোগদান করতে আসত, তাদের মধ্যে একটি ছিল ইংল্যান্ড।
চতুর্দশ শতাব্দীতে বেশকিছু ইংরেজ নাইট এতদঞ্চলে অভিযান পরিচালনার জন্য স্বেচ্ছাসেবক বা মার্সেনারি হিসেবে টিউটোনিক নাইটদের সঙ্গে যোগদান করে। টিউটোনিক নাইটরা তাদের ক্ষমতার চূড়ান্ত পর্যায়ে বর্তমান বেলারুশের গ্রোদনো প্রদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করত। এটি সম্ভব যে, টিউটোনিক নাইটদের সহযোগী ইংরেজ নাইটরাও গ্রোদনো অঞ্চলে অভিযান পরিচালনায় অংশগ্রহণ করেছিল। যদিও গ্রোদনো অঞ্চলে অভিযান পরিচালনায় ইংরেজ নাইটরা অংশগ্রহণ করেছিল কিনা, এই বিষয়টি স্পষ্ট নয়, কিন্তু কিছু ইংরেজ নাইট যে টিউটোনিক নাইটদের ভিলনিয়াস (বর্তমান লিথুয়ানিয়ার রাজধানী) অবরোধে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিল, সেটি নিশ্চিত। বেলারুশের সীমান্ত থেকে ভিলনিয়াসের দূরত্ব মাত্র ২০ মাইল। এজন্য গ্রোদনো অঞ্চলে আক্রমণ পরিচালনায় ইংরেজ নাইটদের অংশগ্রহণ তেমন অস্বাভাবিক ঘটনা বলে প্রতীয়মান হয় না।
এরকমটি যদি ঘটে থাকে, সেক্ষেত্রে একে বেলারুশের ভূখণ্ডে ব্রিটিশ আক্রমণ হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এমন কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি, যেটির ভিত্তিতে নিশ্চিত রূপে দাবি করা যেতে পারে যে, ইংরেজ নাইটরা বর্তমান বেলারুশের ভূখণ্ডে টিউটোনিক নাইটদের সঙ্গে মিলে আক্রমণ পরিচালনা করেছিল। এজন্য ব্রিটিশরা কখনো বর্তমান বেলারুশের ভূখণ্ডে আক্রমণ পরিচালনা করেনি, এমনটিই ধরে নেয়া হয়।
অবশ্য ব্রিটিশ নাগরিকরা পরবর্তীতেও বর্তমান বেলারুশের ভূখণ্ডে সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করেছিল। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষদিকে এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে বেশ কয়েকজন স্কটিশ জাতিভুক্ত সমরনায়ক রুশ সেনাবাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। এসময় রুশ সেনাবাহিনীতে অন্তত ১৫ জন স্কটিশ জাতিভুক্ত জেনারেল পদমর্যাদার কর্মকর্তা ছিলেন। বস্তুত এসময় রুশ সেনাবাহিনীতে অন্য কোনো বিদেশি জাতির তুলনায় স্কটিশদের প্রভাব ছিল অপেক্ষাকৃতভাবে অনেক বেশি। আর এই স্কটিশ সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেকেই কর্মরত ছিলেন বর্তমান বেলারুশের ভূখণ্ডে। যেমন: স্কটিশ জাতিভুক্ত মার্শাল ব্যারন জর্জ ওগিলভি রুশ সেনাবাহিনীর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন এবং তিনি গ্রোদনো অঞ্চলে মোতায়েনকৃত একটি রুশ সৈন্যদলের অধিনায়ক ছিলেন।
অবশ্য বর্তমান বেলারুশের ভূখণ্ডে উক্ত স্কটিশ কর্মকর্তাদের অবস্থানকে ব্রিটিশ ‘আক্রমণ’ হিসেবে বিবেচনা করা যায় না, কারণ তাদেরকে বেলারুশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য নয়, বরং বেলারুশের সুরক্ষার জন্যই সেখানে মোতায়েন করা হয়েছিল। তদুপরি, বেলারুশে তাদের অবস্থানের সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিল না।
পরবর্তীতে বেলারুশ বেশ কয়েকবার বিভিন্ন যুদ্ধের রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। নেপোলিয়নীয় যুদ্ধসমূহ থেকে আরম্ভ করে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি যুদ্ধে বেলারুশ একটি উল্লেখযোগ্য রণভূমি ছিল। ব্রিটেন এই যুদ্ধগুলোতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে, কিন্তু এসময় তারা কখনো বেলারুশের ভূখণ্ডে কোনো ধরনের সামরিক অভিযান পরিচালনা করেনি। তদুপরি, ১৮৫৩–১৮৫৬ সালের পূর্বাঞ্চলীয়/ক্রিমিয়ান যুদ্ধের সময় এবং ১৯১৮–১৯২০ সালে মিত্রশক্তির রাশিয়া আক্রমণের সময় ব্রিটেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে এবং রুশ ভূখণ্ডে আক্রমণ পরিচালনা করেছে। এসময় বেলারুশ যেহেতু রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিল, সেহেতু বর্তমান বেলারুশের ভূখণ্ডে ব্রিটিশ আক্রমণ পরিচালনার একটি উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু স্থলবেষ্টিত বেলারুশের ভূখণ্ডে সৈন্য প্রেরণ করা ব্রিটিশদের জন্য বরাবরই কঠিন ছিল, সেজন্য এই যুদ্ধগুলোর সময়ও তারা বেলারুশের ভূখণ্ডে আক্রমণ পরিচালনার প্রচেষ্টা চালায়নি।
সামগ্রিকভাবে, চতুর্দশ শতাব্দীতে ইংরেজ নাইটরা টিউটোনিক নাইটদের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে বর্তমান বেলারুশের গ্রোদনো অঞ্চলে আক্রমণ চালিয়ে থাকতে পারে, এরকম একটি সম্ভাবনা রয়েছে, কিন্তু এই ঘটনার পর্যাপ্ত ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। আর এই ঘটনার বাইরে ব্রিটেন কখনো এই অঞ্চলে আক্রমণ পরিচালনা করেনি। এজন্য বেলারুশকে সেই অল্প কয়েকটি রাষ্ট্রের মধ্যে একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যেগুলো কখনো ব্রিটিশ আক্রমণের সম্মুখীন হয়নি।