বিংশ শতকের শুরুর দিকে, ১৯০৫ সালে, জুরিখের প্যাটেন্ট অফিসে কর্মরত একজন তরুণ গবেষক চারটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশ করে ইউরোপের বিজ্ঞানীমহলে বেশ সাড়া জাগান। আলোকরশ্মির শক্তি ও তেজস্ক্রিয়তা, পরমাণুর আয়তন ও গতি-প্রক্রিয়া আর অভিকর্ষ সম্পর্কিত অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের এই প্রবন্ধগুলো নিউটন, ফ্যারাডে এবং ম্যাক্সওয়েলের উদ্ভাবিত এবং দুশো বছর ধরে বিরাজমান ধ্রুপদী পদার্থ বিজ্ঞানের মৌলিক ধারণাগুলোর ভিত্তিমূলে প্রচণ্ড নাড়া দেয়! আইনস্টাইনের নতুন ব্যাখ্যানুযায়ী সময় ও স্থান স্থায়ী নয়, বরং আপেক্ষিক। ১৯০৫ সালটি পরবর্তীকালে আইনস্টাইনের অলৌকিক বছর (Annus mirabillis) হিসেবে পরিচিত হয়।
আইনস্টাইন যদিও পরবর্তী দশ-পনের বছর সাধারণ মানুষের কাছে অচেনাই রয়ে যাবেন। তবে ইউরোপের যে ক’জন চিন্তাশীল এবং বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তি এই বৈপ্লবিক ধারণাগুলো দ্রুত অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, তাদের মধ্যে একজন ছিলেন ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রতিভাবান তরুণ গণিতবিদ হ্যান্স হান। ভিয়েনার একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া হান্স হান ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করলেও পরে গণিতে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন।
হ্যান্স হান ছিলেন ভিয়েনায় অবস্থিত বিশ শতকের একটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক চক্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। বিজ্ঞানের প্রকৃতি ও দর্শন, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি, এবং জ্ঞানতত্ত্বের বিকাশ ও প্রসারে ভূমিকা পালনকারী এই দার্শনিক চক্রই পরবর্তীতে সাধারণ মানুষের কাছে ‘ভিয়েনা সার্কেল’ নামে পরিচিতি লাভ করে। হান ছাড়াও আরও দুজন মেধাবী বুদ্ধিজীবী এবং ভিয়েনাবাসী এই দার্শনিক চক্রের প্রতিষ্ঠালগ্নে যুক্ত ছিলেন– অটো নিউরাথ এবং মরিৎজ শ্লিক। দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানী নিউরাথ ছিলেন ভিয়েনা মিউজিয়াম অফ সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক। আর ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক মরিৎজ শ্লিক, জার্মান পদার্থবিদ ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের অধীনে পদার্থবিজ্ঞানে ডক্টরেট অর্জন করেছিলেন। এছাড়াও ভিয়েনায় বসবাসরত এবং ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত আরও কয়েকজন তরুণ, ও চিন্তাশীল ব্যক্তিরা এই চক্রে শুরুতে যোগ দেন। পরবর্তী বছরগুলোতে ভিয়েনাবাসী আরও তিন মেধাবী এবং বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তি এই সার্কেলের সাথে যুক্ত হন– দার্শনিক রুডলফ কার্নাপ, গণিতবিদ কার্ল মেনজার এবং যুক্তিবিদ কার্ল গোডেল। দার্শনিক কার্ল পপারও এই সার্কেলের সাথে যুক্ত ছিলেন।
১৯০৭ সাল থেকে প্রাথমিকভাবে এই চক্রের আলোচনা শুরু হয়। প্রথমদিকে আলোচনা সভা হতো ভিয়েনার কোনো কফি হাউজে; পরবর্তীতে ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো লেকচার রুমে। তারা আলোচনা করতেন উনিশ শতকের এবং সমসাময়িক গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক এবং দার্শনিক, যেমন: ফরাসি গণিতবিদ এবং পদার্থ বিজ্ঞানী পিয়েরে ডুহেম, হেনরি পয়েনকেয়ার, জার্মান ও অস্ট্রিয়ান দার্শনিক ও পদার্থবিজ্ঞানী আর্নস্ট মাখ – তাদের চিন্তা নিয়ে। তারা আলোচনা করতেন বিভিন্ন দার্শনিক প্রশ্ন– যেমন বৈজ্ঞানিক জ্ঞান কী? এর প্রকৃতি আর বিশেষত্ব কী? মেটাফিজিক্স বা অধিবিদ্যানির্ভর বক্তব্যের কি কোনো অর্থ আছে? তারা চেষ্টা করছিলেন বিজ্ঞানের নতুন ধারণাগুলোর উপর ভিত্তি করে এক দৃষ্টিভঙ্গি বা দর্শন তৈরি করতে।
এই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরির প্রচেষ্টায় তারা প্রাথমিকভাবে প্রভাবিত হন উনিশ শতকের অন্যতম প্রধান দুই পদার্থবিজ্ঞানী ও দার্শনিক আর্নস্ট মাখ এবং লুডভিগ বোল্টজম্যান দ্বারা। আর্নস্ট মাখ এবং লুডভিগ বোল্টজম্যান, দুজনেই বিশ্বাস করতেন যে, কোনো অভিজ্ঞতালব্ধ বক্তব্যকে গ্রহণযোগ্য হতে হলে তাকে পরীক্ষালব্ধ বৈধতা (Experimental Validation) অর্জন করতেন হবে। সোজা কথায়, পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞান বা বক্তব্যই শুধু গ্রহণযোগ্য। মাখ এবং বোল্টজম্যান ছাড়া আরও দুজন সমসাময়িক বিজ্ঞানী ও দার্শনিকের চিন্তা ভিয়েনা সার্কেলের সদস্যদের প্রভাবিত করেছিল– পদার্থবিদ আইনস্টাইন, এবং গণিতবিদ ও দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল।
ভিয়েনা সার্কেলের মূল বক্তব্য কী ছিল? কী দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিশ্বাস এর সদস্যদের একত্রিত করেছিল? প্রাথমিকভাবে সদস্যদের সবাই ছিলেন গণিত, পদার্থবিজ্ঞান এবং দর্শনের ছাত্র এবং বিজ্ঞানের প্রতি একনিষ্ঠ। তারা মনে করতেন, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও দৃষ্টিভঙ্গি মানুষের চিন্তাজগতে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে সক্ষম এবং দর্শনের কাজ হলো বিজ্ঞানকে সহায়তা করা। তাদের লক্ষ্য ছিল বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সাথে ছদ্মজ্ঞানের পার্থক্য তুলে ধরার মধ্য দিয়ে একটি বিজ্ঞাননির্ভর জ্ঞানতত্ত্বের প্রতিষ্ঠা করা। ভিয়েনা সার্কেলের সদস্যরা একটি দার্শনিক আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন যা পরবর্তীতে বিভিন্ন নামে, যেমন- লজিক্যাল পজিটিভিজম, যৌক্তিক অভিজ্ঞতাবাদ, বৈজ্ঞানিক অভিজ্ঞতাবাদ হিসেবে পরিচিতি পায়। তারা মনে করতেন যে, কোনো নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের কাঠামোকে এর বিষয়বস্তু থেকে পৃথক করা যেতে পারে, এবং এই কাঠামোটি যৌক্তিক ভিত্তির উপর পর প্রতিষ্ঠিত কিনা তা যাচাই করা গুরুত্বপূর্ণ। তারা একটি যাচাইযোগ্যতার নীতি (Verifiability principle) প্রস্তাব করেছিলেন যা মূলত অভিজ্ঞতা এবং পর্যবেক্ষণ নির্ভর।
ভিয়েনা সার্কেলের উত্থান হয় এমন একসময়ে যাকে বলা যায় নিউটন উদ্ভাবিত ধ্রুপদী পদার্থবিজ্ঞান-পরবর্তী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাল। এই সময়ই পদার্থবিদ ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক, নিলস বোর, আইনস্টাইন এবং ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ তাদের চিন্তা এবং গবেষণার মাধ্যমে মহাজগৎ, স্থান ও সময়, পরমাণু, আলোকরশ্মি ইত্যাদি বিষয়ে মানুষের প্রচলিত ধারণাগুলোকে সম্পূর্ণভাবে বদলে দেন! ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক যদিও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে অনেক অবদান রেখেছিলেন, তবে তার খ্যাতি মূলত কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রবর্তক হিসেবে। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব যেমন স্থান এবং সময় সম্পর্কে মানুষের ধারণা জগতে বিপ্লব করেছিল ঠিক তেমনি এই কোয়ান্টাম তত্ত্বটিও পারমাণবিক এবং সাব-অ্যাটমিক প্রক্রিয়াগুলো সম্পর্কে মানুষের বোঝার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটায়। ভিয়েনা সার্কেলের সদস্যরা এসব বৈপ্লবিক ধারণা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন এবং তাদের সভাতে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করতেন।
ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ ১৯২৭ সালে তার অনিশ্চয়তা নীতি (Uncertainty principle) সম্পর্কিত গবেষণা প্রকাশ করেন। এই নীতি অনুযায়ী একটি কণার গতি এবং অবস্থান একই সময়ে বা একই সাথে নির্ধারণ করা যায় না, কারণ একটিকে নির্ধারণ করার প্রক্রিয়া অন্যটিকে প্রভাবিত করে। প্রায় একই সময়, ১৯২৮ সালে, ড্যানিশ পদার্থবিজ্ঞানী নিলস বোর পারমাণবিক কাঠামো এবং কোয়ান্টাম তত্ত্ব সম্পর্কে তার গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রকাশ করেন। এই দুই যুগান্তকারী গবেষণা চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত ধারণা যে, বিজ্ঞান পৃথিবীর একটি সামগ্রিক এবং স্থায়ী ব্যাখ্যা প্রদান করতে পারে– তাকে সম্পূর্ণ বদলে দেয়।
ভিয়েনা সার্কেলের সদস্যরা সমসাময়িক বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে প্রাধান্য দিয়েছিলেন আইনস্টাইনকে। এর অন্যতম কারণ হলো, তারা যে অভিজ্ঞতা বা পর্যবেক্ষণ পন্থার উপর গুরুত্ব দিতেন, আইনস্টাইন সেসবের সাথে একমত ছিলেন। আইনস্টাইন পদার্থবিজ্ঞানের জগতে বেশ কয়েকটি সাহসী কিন্তু যাচাইযোগ্য অনুমান (hypothesis) প্রস্তাব করেছিলেন এবং তিনি এই প্রকল্পগুলোকে পরিবর্তন বা ত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিলেন যদি সেগুলো পরীক্ষা বা প্রতিপাদনে উত্তরিত না হত।
অভিজ্ঞতাভিত্তিক পন্থার উপর গুরুত্ব ছাড়াও আইনস্টাইনের আরেকটি গবেষণা ভিয়েনা সার্কেলের সদস্যদের কাছে মূল্যবান ছিল। তার বিস্ময়কর এবং প্রায় অসম্ভব একটি অনুমান ছিল যে অভিকর্ষ সময়, স্থান ও আলোকরশ্মিকে প্রভাবিত করে (“Gravity bends space-time and light”- Einstein)। ১৯১৯ সালে বিজ্ঞানীরা এই অনুমানকে পরীক্ষা করে সঠিক বলে ঘোষণা দেন! সার্কেলের সদস্যরা মনে করতেন, এই অসাধারণ ধারণা অষ্টাদশ শতকের সবচেয়ে প্রভাবশালী ইউরোপীয় দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের জ্ঞানতত্ত্বের ভিত্তিকে ব্যাপকভাবে দুর্বল করে দেয়।
এ বিষয়টি অনুধাবন করার জন্য কিছুটা দার্শনিক প্রেক্ষাপট আলোচনা করা প্রয়োজন। প্লেটো, এরিস্টটলের সময় থেকেই দার্শনিকরা জ্ঞানের প্রকৃতি, উৎস এবং সীমা সম্পর্কে চিন্তা করেছেন এবং এই আলোচনায় বিশ্লেষণধর্মী সত্যের সাথে সংশ্লেষনধর্মী সত্যের পার্থক্য (Analytic vs synthetic truth) এবং অভিজ্ঞতাপূর্ব জ্ঞানের সাথে অভিজ্ঞতাভিত্তিক জ্ঞানের পার্থক্যকে (A priori vs a posteriori knowledge) গুরুত্ব দিয়েছেন। বিশ্লেষণধর্মী সত্য কোনো একটি বক্তব্যের অর্থের মধ্যে নিহিত থাকে, এটা কোনো নতুন তথ্য বা জ্ঞান প্রদান করে না। একটি উদাহরণ হতে পারে এই বক্তব্যটি, “সকল অকৃতদার ব্যক্তিই অবিবাহিত”। এই বক্তব্যটি তার সংজ্ঞানুযায়ীই গ্রহণযোগ্য, যদিও এটা আমাদেরকে নতুন কোনো তথ্য বা সত্য প্রদান করে না। অপরদিকে, সংশ্লেষণধর্মী বক্তব্য নতুন তথ্য বা সত্য উপস্থাপন করে যা অভিজ্ঞতা বা পর্যবেক্ষণনির্ভর। “পৃথিবী গোলাকার” বা “এখন বর্ষাকাল”, এই বক্তব্যগুলো সংশ্লেষণধর্মী।
অন্যদিকে অভিজ্ঞতাপূর্ব জ্ঞান (A priori knowledge) পর্যবেক্ষণ বা অভিজ্ঞতা নির্ভর নয়। “একটি বর্গক্ষেত্রের চারটি বাহু পরস্পর সমান”– এই বক্তব্যটি গ্রহণের জন্য পর্যবেক্ষণ বা অভিজ্ঞতার প্রয়োজন নেই। অন্যদিকে “জলকে তাপ দিলে তা বাষ্পে পরিণত হয়” এই বক্তব্যের সত্যতা পর্যবেক্ষণ বা পরীক্ষা ছাড়া নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। সেই কারণে এ ধরনের জ্ঞান অভিজ্ঞতাভিত্তিক পদ্ধতির (a posteriori) মাধ্যমেই আহরণ করা সম্ভব।
এই আলোচনা থেকে এটা প্রতীয়মান হয় যে, বিশ্লেষণধর্মী সত্য অভিজ্ঞতাপূর্ব পদ্ধতির মাধ্যমে আহরণ করা সম্ভব, কিন্তু সংশ্লেষণধর্মী বক্তব্য বা সত্য শুধুমাত্র পর্যবেক্ষণ বা অভিজ্ঞতাভিত্তিক পদ্ধতির মাধ্যমেই গ্রহণ করা যায়।
দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট মনে করতেন, তৃতীয় একটি পদ্ধতি আছে, যাকে বলা যায় সংশ্লেষণধর্মী অভিজ্ঞতাপূর্ব পদ্ধতি (synthetic a priori), যার মাধ্যমে কোনো পর্যবেক্ষণ বা অভিজ্ঞতা ছাড়াই জগত সম্পর্কে নতুন জ্ঞান আহরণ করা সম্ভব। কান্টের মতে, এই ধরনের সত্য জ্যামিতি এবং অন্য ক্ষেত্রে বিদ্যমান। তার মতে, সংশ্লেষণধর্মী অভিজ্ঞতাবিহীন এই সত্যগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তা একটি কাঠামো তৈরি করে যার মাধ্যমে আমরা জগতকে অনুধাবন করতে পারি। “দুটি বিন্দুর মধ্যে সবচেয়ে কম দূরত্ব হলো একটি সরলরেখা”, “দুটি বস্তুর প্রতিটি যদি একটি তৃতীয় বস্তুর সমান হয়, তবে তারা একে অপরের সমান“, “সকল ঘটনার পেছনে কারণ আছে”– এই বক্তব্যগুলো, কান্টের মতে, সংশ্লেষণধর্মী অভিজ্ঞতাবিহীন সত্যের উদাহরণ!
“দুটি বিন্দুর মধ্যে সবচেয়ে কম দূরত্ব হলো একটি সরলরেখা”- ইউক্লিডিয়ান জ্যামিতির এই গুরুত্বপূর্ণ স্বতঃসিদ্ধটি ছিল একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। প্রকৃতিতে সংশ্লেষনধর্মী অভিজ্ঞতাবিহীন সত্যের অস্তিত্ব আছে, ইমানুয়েল কান্টের এমন যুক্তি জ্ঞানের প্রকৃতি ও উৎস সম্পর্কে অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিকদের অবস্থানকে দুর্বল করে, কিন্ত এই যুক্তিকে খণ্ডন করার মতো শক্তিশালী তথ্য বা প্রমাণ অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিকদের হাতে ছিল না। কিন্ত আইনস্টাইন তার গবেষণার দ্বারা প্রমাণ করেন যে ইউক্লিডিয়ান জ্যামিতির স্বতঃসিদ্ধগুলো, যা স্ব-প্রতিষ্ঠিত সত্য (self-evident truth) হিসেবে গ্রহণযোগ্য ছিল, তা মূলত সত্য নয়। তিনি দেখান, দুটি বিন্দুর মধ্যে যা সবচেয়ে কম দূরত্ব তা আসলে একটি বক্র রেখা! আইনস্টাইন ও সমসাময়িক পদার্থবিদদের এসব বৈপ্লবিক ধারণা ভিয়েনা সার্কেলের সদস্যদের একটি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও দর্শন তৈরি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
উপরোক্ত বিজ্ঞানীরা ছাড়াও আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ অস্ট্রিয়ান দার্শনিকের চিন্তা দ্বারা ভিয়েনা সার্কেলের সদস্যরা প্রভাবিত হয়েছিলেন; তিনি লুডভিগ উইটগেনস্টাইন! সম্ভবত বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিক, উইটগেনস্টাইনের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ Tracatus Logico-Phhilosophicus প্রকাশিত হয় ১৯২১ সালে। গ্রন্থটি সার্কেলের সদস্যদের বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করে; তারা অনেক সময় ধরে গ্রন্থটি নিয়ে আলোচনা এবং বিশ্লেষণ করেছিলেন।
উইটগেনস্টাইন তার এই গ্রন্থে উল্লেখ করেন, দার্শনিকরা জগতকে বোঝার জন্য বিভিন্ন বিমূর্ত ধারণা বা শব্দ যেমন সত্তা, আদর্শ, বাস্তবতা ব্যবহার করেন যা দার্শনিক আলোচনাকে জটিল এবং অর্থহীন করে তোলে। তিনি প্রশ্ন করেন, বিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের জগতে কোয়ান্টাম এবং আপেক্ষিকতার মতো বিস্ময়কর আবিষ্কার পর, দর্শনের কি আদৌ এসব বিমূর্ত ধারণা নিয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন আছে? এই প্রশ্নের উত্তরে ‘না’ বলে উইটগেনস্টাইন আধুনিক দার্শনিক চিন্তাকে সম্পূর্ণ নতুন দিকের সন্ধান দেন। তিনি মন্তব্য করেন, দর্শনের যে চিরাচরিত সমস্যাগুলো বিরাজমান, সেগুলো মূলত ভুল ভাষা ব্যবহার করার কারণে। তার মতে, দার্শনিকদের যা প্রয়োজন তা হলো স্পষ্টতা! “Tracatus”-এ উইটগেনস্টাইন লিখলেন, “যা কিছু চিন্তা করা সম্ভব, তা স্পষ্টভাবে চিন্তা করা যায়। যা কিছু বলা সম্ভব, তা স্পষ্ট করে বলা যায়।”
উইটগেনস্টাইন যদিও কখনো ভিয়েনা সার্কেলের সভায় যোগ দেননি, তবে তিনি এর মূল ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ রেখেছিলেন এবং তাদের সাথে তার গ্রন্থের বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। সার্কেলের সদস্যরা “Tracatus” এবং ইংরেজ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের উদ্ভাবিত প্রতীকী যুক্তি (symbolic logic) থেকে ধারণা নিয়ে ভাষাকে যথাযথ করার এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি গঠনের প্রচেষ্টায় মনোনিবেশ করেন। বার্ট্রান্ড রাসেল তার প্রতীকী যুক্তির ধারণায় দেখান, যেকোনো বাক্যকে ধারাবাহিক চিহ্ন এবং সূত্রের মধ্যে প্রকাশ করার সম্ভব। এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে সার্কেলের সদস্যরা ১৯২৯ সালে “The Scientific Conception of the World “ নামে একটি ইশতেহার প্রকাশ করেন। এতে তারা বলেন, দুটি বিষয়ে সার্কেলের সদস্যরা একমত: প্রথমত, পর্যবেক্ষণ বা অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান বা বক্তব্যই শুধু গ্রহণযোগ্য; দ্বিতীয়ত, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি যৌক্তিক বিশ্লেষণের উপর নির্ভরশীল।
এই দুই ধারণা থেকে একটি নতুন চিন্তাপ্রক্রিয়া শুরু হয় যা পরবর্তীতে যৌক্তিক অভিজ্ঞতাবাদ (Logical empiricism) নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। যৌক্তিক অভিজ্ঞতাবাদীর কাছে দর্শন ভাব বা বস্তু নিয়ে কাজ করে না, দর্শন কাজ করে বক্তব্য বা প্রপঞ্চ নিয়ে। সত্যের সন্ধানে দর্শনের দায়িত্ব হলো কোনো বক্তব্যের গঠন পরীক্ষা করা এবং এটা নিশ্চিত করা যে বক্তব্যটি ভাষাগত এবং যৌক্তিকভাবে সঠিক।
১৯২০ দশকের শেষের দিকে ভিয়েনা সার্কেলের নাম ও পরিচিতি ইউরোপের অন্যান্য শহরে পৌঁছায়। ভিয়েনা সার্কেলের সদস্যরা ইউরোপের বিভিন্ন শহরের সমমনা ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয় যখন ১৯২৭ সালে সার্কেলের সদস্যরা বার্লিনভিত্তিক সোসাইটি ফর এম্পিরিক্যাল ফিলসফির সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হন। এই গোষ্ঠীর প্রধান ছিলেন হ্যান্স রাইখেনবাখ- বৈজ্ঞানিক দর্শনের একজন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব, শিক্ষাবিদ এবং যৌক্তিক অভিজ্ঞতাবাদের প্রবক্তা।
১৯৩০ এর দশকের প্রথম দিক থেকে জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল হতে শুরু করে। ডানপন্থী এবং ইহুদীবিদ্বেষী গোষ্ঠীগুলো ক্রমশ জনসমর্থন ও শক্তি অর্জন করতে থাকে। ১৯৩৩ সালে জার্মানিতে নাৎসি পার্টি নির্বাচনে বিজয়ী হয় এবং অ্যাডলফ হিটলার চ্যান্সেলর মনোনীত হন। অস্ট্রিয়াতেও নাৎসি পার্টির সমর্থন ও শক্তি বাড়তে থাকে। ভিয়েনা সার্কেলের সদস্যরা সরকারি নজরদারির মধ্যে আসতে শুরু করেন। ভিয়েনা সার্কেল ক্রমশ তার সংহতি হারাতে থাকে। রুডলফ কার্নাপ ভিয়েনা ছেড়ে প্রাগে চলে যান; উইটগেনস্টাইন চলে আসেন ক্যামব্রিজে। ১৯৩৪ সালে অস্ট্রিয়ার গৃহযুদ্ধের পর অটো নিউরাথকে অস্ট্রিয়াতে আসার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। একই সময়ে হ্যান্স হান অকস্মাৎ মৃত্যুবরণ করেন। তরুণ কার্ট গোডেল মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন, যদিও পরবর্তীতে সুস্থ হয়ে তিনি আমেরিকাতে চলে আসেন। তারপর ১৯৩৬ সালে মরিৎজ শ্লিক ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার একজন প্রাক্তন ছাত্রের হাতে নিহত হন। প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে কার্ল মেনজার এবং কার্ল পপার ভিয়েনা ছেড়ে আমেরিকার পথে পাড়ি জমান।
১৯৩৮ সালে জার্মানির তৃতীয় রাইখ যখন অস্ট্রিয়াকে জার্মানির সাথে একীভূত করে, তার পূর্বেই ভিয়েনা সার্কেলের বেশিরভাগ সদস্যরা ভিয়েনা ত্যাগ করেন। অনেক সদস্যই ইংল্যান্ড এবং আমেরিকাতে আশ্রয় পান। ডানপন্থী এবং ইহুদিবিদ্বেষী যে রাজনৈতিক স্রোত জার্মানি ও অস্ট্রিয়ায় শুরু হয়েছিল, তা শেষ নাগাদ ভিয়েনা সার্কেলকে গ্রাস করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল ইউরোপের, সেই সাথে ভিয়েনার জনজীবনকে ব্যাপকভাবে ব্যহত করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি হয় ১৯৪৫ সালে। ভিয়েনা সার্কেল ততদিনে সুপরিচিত, যদিও সার্কেলের সদস্যরা তখন বিচ্ছিন্ন এবং বেশিরভাগ সদস্যরা ইতিমধ্যে ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও অন্যান্য দেশে পাড়ি জমিয়েছেন।
বিংশ শতকের প্রারম্ভে ভিয়েনায় অসাধারণ মেধাবী ও প্রতিভাবান বুদ্ধিজীবী, বিজ্ঞানী, চিত্রকর এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের সম্মিলন ঘটে। মনোবিজ্ঞানে সিগমুন্ড ফ্রয়েড, চিত্রকলায় গুস্তাভ ক্লিম্ট, সংগীতে রিচার্ড স্ট্রাউস, পদার্থবিজ্ঞানে আর্নস্ট মাখ এবং লুডভিগ বোল্টজম্যান, দর্শনে উইটগেনস্টাইন ও কার্ল পপার– এরা সকলেই এই সময়ে ভিয়েনায় থেকে তাদের কাজের ক্ষেত্রে বিস্ময়কর অবদান রাখেন। ভিয়েনা সার্কেলের সদস্যরা বৌদ্ধিক ও সৃজনশীলতা বিকাশের সেই অসাধারণ সময়ের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এই সময়ে পদার্থবিজ্ঞান, গণিত এবং বিজ্ঞানের অন্য ক্ষেত্রে যে বৈপ্লবিক ধারণাগুলোর উন্মেষ হয়েছিল, তারা সেগুলোর তাৎপর্য সঠিকভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। সেই সাথে তারা এই ধারণাগুলোর উপর ভিত্তি করে একটি আধুনিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও দর্শন নির্মাণ করতে সক্ষম হন। তাদের এই ধারণাগুলো পরবর্তী দশকগুলোতে পাশ্চাত্যের বৌদ্ধিক এবং বৈজ্ঞানিক কার্যকলাপ ও উদ্যোগে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে।