প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষের যোগাযোগ ও যাতায়াত ব্যবস্থাও এগিয়ে গিয়েছে অনেক দূর। একটা সময় যেখানে পণ্য পরিবহণ করতে কয়েক মাস লেগে যেত সেখানে উন্নত যোগাযোগ আর যাতায়াত ব্যবস্থার কারণে সময় লাগে কয়েক দিন। প্রকৌশলীদের নিত্যনতুন চেষ্টার ফলে অনেক দুর্গম এলাকাতেও তৈরি হয়েছে রাস্তা, সেতু হয়েছে দুর্গম নদীর উপর দিয়ে। পাহাড় কেটে তার ভেতর দিয়ে সুড়ঙ্গপথ আধুনিক যাতায়াত ব্যাবস্থারই একটি উদাহরণ। এর ফলে যেমন সময় বেঁচে যায়, তেমনিভাবে আর্থিকভাবেও অনেক লাভ হয়। কিন্তু সামান্য ভুলের কারণে এসব সুড়ঙ্গপথ হয়ে উঠতে পারে পৃথিবীর বুকে এক নরক। ১৯৯৯ সালের ২৪ মার্চের সকালে ফ্রান্স ও ইতালির সীমান্তে অবস্থিত মন্ট ব্লঙ্ক টানেলে ঠিক তেমনি এক নরক নেমে এসেছিল।
মন্ট ব্লঙ্ক টানেল
ফ্রান্স ও ইতালির সীমান্তে অবস্থিত আল্পস পর্বতমালার অংশ মন্ট ব্লঙ্ক পাহাড়ের ভেতর সুড়ঙ্গ কেটে তৈরি হয়েছিল মন্ট ব্লঙ্ক টানেল। ১৯৫৭ সালে এর নির্মাণকাজ শুরু হয় আর শেষ হয় আট বছর পরে, ১৯৬৫ সালে। প্রায় সাড়ে এগারো কিলোমিটার দীর্ঘ এ টানেলটি পৃথিবীর অন্যতম দীর্ঘ টানেল। এ টানেলটির কারণে ফ্রান্স ও ইতালির সড়কপথে যোগাযোগে সময় অনেক কমে গিয়েছিল। পাহাড়ি পথে প্রায় সাত ঘন্টার পথ এ টানেলটির কারণে কমে গিয়েছিল এক ঘন্টারও কম সময়ে। ফলে প্রতিদিন হাজার হাজার গাড়ি ও ট্রাক ব্যবহার করত এ টানেলটি।
নারকীয় অগ্নিকান্ড
১৯৯৯ সালের ২৪ মার্চ সকাল ১০টা ৪৭ মিনিটে বেলজিয়ান ট্রাক ড্রাইভার গিলবার্ট ডিগ্রেভ ফ্রান্সের অংশ দিয়ে টানেলে প্রবেশ করেন। প্রথম দু’মিনিটে তিনি প্রায় এক মাইল দূরত্ব অতিক্রম করে ফেললেও তার ট্রাক থেকে বের হওয়া সাদা ধোঁয়া তার চোখে পড়েনি। রাস্তার অপর দিক থেকে আসা অন্য গাড়িগুলো যখন হেডলাইটের মাধ্যমে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে তখনই কেবল তিনি সেই ধোঁয়া খেয়াল করেন।
পুরো টানেলের নিরাপত্তার জন্য অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা, সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল। নির্দিষ্ট মাত্রার ধোঁয়া তৈরি হলেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা টানেলের নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষকদের কাছে অ্যালার্ম বাজিয়ে সতর্ক করে দিত। ধোঁয়া বেড়ে যাবার কারণে ফ্রান্স অংশে অ্যালার্ম বাজলেও ইতালি অংশে থাকা অ্যালার্ম বেজে ওঠেনি। কিন্তু ফ্রান্সে অ্যালার্ম বাজলেও ঠিক কোথায়, কী কারণে বাজছে সেটা বুঝে উঠতেও সময় লেগে যায়। মনে রাখা উচিৎ, ঘটনাটি ১৯৯৯ সালের। ক্যামেরা বা সেন্সর তখনো বর্তমান সময়ের মতো এতো উন্নত ছিল না, সেই সাথে ধোঁয়ার কারণে কিছু দেখাও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল।
অন্যদিকে টানেলের ভেতরে ধোঁয়া দেখতে পেয়ে ডিগ্রেভ ট্রাকের পেছনের ইমার্জেন্সি লাইট জ্বালিয়ে গাড়ি থামিয়ে দেন। দ্রুততম সময়ের মধ্যে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করলেও ১০টা ৫৩ মিনিটে তার গাড়িতে বিস্ফোরণ ঘটে যায়। এসময় ডিগ্রেভের ট্রাকের পেছনে বেশ কয়েকটি গাড়ি আর ট্রাক মিলিয়ে প্রায় ৩৮ জন আটকা পড়েন। অন্যদিকে ডিগ্রেভ দৌড়ে পালিয়ে যেতে থাকেন ইতালি অংশের দিকে।
ইতালি থেকে ফ্রান্সের দিকে যাওয়া গাড়িগুলো এই বিস্ফোরণ আর অগ্নিকান্ড দেখে টানেলে থাকা টেলিফোন থেকে ইতালি অংশে যোগাযোগ করে। ইতালি থেকে ফ্রান্সে যোগাযোগ করা হলে তখনই তারা নিশ্চিত হন পুরো ঘটনাটি সম্পর্কে, সেই সাথে বন্ধ করে দেয়া হয় টানেলে প্রবেশ মুখ। টানেলের ভেতরে এ ঘটনার আগেও বেশ কয়েকবার অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছিল, তবে প্রতিবারই সফলভাবে সেগুলোকে নিভিয়ে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু এবার কিছু করার আগেই পাঁচ মিনিটের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়ে ভয়াবহভাবে, কালো ধোঁয়ায় ভরে যেতে থাকে পুরো টানেল।
বিস্ফোরিত ট্রাকটির পেছনে আটকে যাওয়া গাড়িগুলো নিজেদের বাঁচানোর জন্য পেছন দিকে ফিরে যাবার চেষ্টা করে। কিন্তু ধোঁয়ার কারণে পুরো টানেলে অক্সিজেনস্বল্পতা সৃষ্টি হয়। ফলে চালকসহ প্রায় সবাই কয়েক মিনিটের মধ্যে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। টেনেলে অগ্নিকান্ডের জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত চারজন অগ্নিনির্বাপককর্মী দ্রুততম সময়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর জন্য রওনা দেন। একইসাথে ফ্রান্স অংশ থেকে স্থানীয় অগ্নিনির্বাপক কর্মীরাও উদ্ধার কাজে যোগ দিতে রওনা দেন। কিন্তু ধোঁয়ার কারণে কেউ বেশিদূর এগুতে পারেননি। অগ্নিকান্ডের সময় নিরাপত্তা ব্যবস্থামূলক কিছু ঘর তৈরি করা ছিল। সেগুলোতেই স্থান নিতে হয় সবাইকে, যেখানে পরবর্তী পাঁচ ঘন্টা মৃত্যুর সাথে লড়াই করতে হয় সবাইকে।
তবে ইতালীয় অংশ ধোঁয়া কম হবার কারণে ইতালি থেকে আসা অগ্নিনির্বাপক কর্মীরা বিস্ফোরিত ট্রাকটির বেশ কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। কিন্তু প্রায় এক হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াসে পুড়তে থাকা ট্রাক, গাড়ি, কাঁচ আর টায়ারের সামনে তাদের কিছুই করার ছিল না। বরং নিজেদের বাঁচাতে তাদেরও স্থান নিতে হয় নিরাপত্তা ঘরেই। আধাঘন্টার মধ্যে ধোঁয়া টানেলের ফ্রান্স অংশ দিয়ে বের হতে থাকে, সেই সাথে প্রচন্ড উত্তাপ। নিরুপায় হয়ে উদ্ধারের সব চেষ্টা বর্জন করতে হয় অগ্নিনির্বাপককর্মীদের। তবে এর মধ্যে আটকে পড়া অগ্নিনির্বাপক কর্মীরা নিরাপদে বের হয়ে আসেন।
টানা ৫৩ ঘন্টা ধরে জ্বলতে থাকে আগুন। এরপরেই অগ্নিনির্বাপককর্মী ও উদ্ধারকর্মীরা তাদের কাজ শুরু করতে পারেন। ভেতরে কাউকে জীবিত পাওয়া তো দূরের কথা, আটকে পড়া গাড়িগুলোর টায়ার, কাঁচের কোনো কিছু অবশিষ্ট ছিল না। শুধু টিকে ছিল লোহার কাঠামো। অ্যালুমিনিয়াম পর্যন্ত গলে গিয়েছিল সেই ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে। এককথায়, পৃথিবীর বুকে এক টুকরো নরক নেমে এসেছিল মন্ট ব্লঙ্ক টানেলে।
তদন্ত
স্বাভাবিকভাবেই দুই দেশের উপরই চাপ সৃষ্টি হয় এ ঘটনার কারণ খুঁজে বের করার জন্য। তদন্তকারীরা প্রথমেই বিস্ফোরিত গাড়িটির দিকে নজর দেন। পাহাড়ি রাস্তায় প্রায় সময়ই ইঞ্জিন অতিরিক্ত গরম হয়ে যায়। টানেলের বদ্ধ পরিবেশে সেই গরম ইঞ্জিনে আগুন ধরে যাবার সম্ভাবনা থাকে। গাড়ির গতিপথ আর একই মডেলের অন্যান্য গাড়ির ইঞ্জিনি ইঞ্জিন পরীক্ষা করে সেরকম কিছুই পাওয়া যায়নি। তবে বাহ্যিক কোনো দাহ্য পদার্থের কারণে ইঞ্জিনে আগুন লাগতে পারে বলে ধারণা করেন তারা। এক্ষেত্রে সিগারেটের ফিল্টার সম্ভাব্য বাহ্যিক পদার্থ হতে পারে। তদন্তকারীরা কম্পিউটার সিমুলেশনের মাধ্যমে সেটি প্রমাণের চেষ্টাও করেন। সিমুলেশন থেকে কিছুটা সফলতা পাওয়া গেলেও সেটি শতভাগ নিশ্চিত উত্তর ছিল না।
তবে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ছিল, আগুন এত দ্রুত কীভাবে ছড়িয়ে পড়ল। এর আগেও টানেলে আগুন ধরেছে এবং সেগুলো সফলভাবে দমন করা হয়েছিল। কিন্তু সেবার কী এমন ছিল যার কারণে এতো ভয়াবহ অবস্থা হলো? এর উত্তর জানার জন্য তদন্তকারীরা খোঁজ করেন ট্রাকটি কী পণ্য পরিবহণ করছিল তার। আর উত্তর পাওয়া যায় সেখানেই। ট্রাকটি ময়দা ও মার্জারিন (একধরনের মাখন) পরিবহন করছিল। তদন্তকারীরা মার্জারিনকে পুড়িয়ে দেখেন আগুনের স্পর্শে এটি ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। বেশ কিছু অব্যবহৃত টানেলে প্রায় একই রকম পরিবেশ তৈরি করে দেখা যায়, মন্ট ব্লঙ্কের চেয়েও ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হতে পারে।
৩৮ জন মানুষ মন্ট ব্লঙ্কের অগ্নিকান্ডে মারা যান, আর প্রত্যেকেই মারা যান অক্সিজেনের অভাবে। কোনো ইঞ্জিনে আগুন লাগলে সেটি বন্ধ হয়ে গেলে আগুন আরো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, কারণ অক্সিজেন সরবরাহ বেড়ে যাওয়া। সেদিন ডিগ্রেভ যদি ট্রাকটি চালিয়েই যেতেন তাহলে হয়তো টানেল থেকে বের হয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু ট্রাক থামিয়ে দেবার কারণে ইঞ্জিনে অক্সিজেন সরবরাহ বেড়ে যায় আর বিস্ফোরণ ঘটে। টানেলের বদ্ধ পরিবেশে আগুন দ্রুত সব অক্সিজেন পুড়িয়ে ফেলে, ফলে অন্যরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
পুরো ঘটনায় দায় রয়েছে কর্তৃপক্ষেরও। অগ্নিকান্ড ঘটলে দ্রুত বাতাস বের করে নেবার ব্যবস্থা ছিল টানেলে, যাতে অক্সিজেন কমে গিয়ে আগুন আর জ্বলতে না পারে। কিন্তু সেদিন বাতাস বের করে নেবার বদলে নতুন করে বাতাস প্রবেশ করানো হয় টানেলে! নতুন অক্সিজেন পেয়ে আগুন বেড়েই চলে। এতে ইতালির দিক থেকে প্রবেশ করা গাড়িগুলোতে যারা ছিলেন তারা জীবন নিয়ে নিরাপদে ফিরে আসতে পারলেও উল্টো দিকে থাকা ৩৮ জনকে জীবন দিতে হয়। ইতালি ও ফ্রান্স কর্তৃপক্ষের নিজেদের মধ্যে কোনো যোগাযোগই ছিল না। টানেলের ভেতরে যে ৩৮ জন জীবন্ত আটকা পড়ে রয়েছে সেটাও তারা বুঝতে পারেননি।
এ দুর্ঘটনার পর প্রায় তিন বছর বন্ধ থাকে টানেলটি। ট্রাক ড্রাইভার ডিগ্রেভ, ট্রাক কোম্পানি ভলভো, টানেলের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপকসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করা হয়। প্রায় সবারই বিভিন্ন মেয়াদে জেল ও জরিমানা হয়। তবে ট্রাক কোম্পানি ভলভোকে মুক্তি দেয়া হয়। পরবর্তীতে আরো উন্নত নিরাপত্তা ব্যবস্থা, সিসিটিভি ক্যামেরা, স্মোক ডিটেক্টরসহ আধুনিক সেন্সর বসানো হয়। অগ্নিনির্বাপক কর্মীদের জন্য উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু সবকিছুই হয় ভয়াবহ এক অগ্নিকান্ডের শিক্ষা হিসেবে।
ফুটনোট
১. Seconds From Disaster, Season 1 Episode 2 (National Geographic Documentary)
ফিচার ইমেজ- VideoBlocks