আধুনিক সমাজে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার কোনো উপায় নেই। দেশ কিংবা ব্যক্তি– থাকতে হলে আশেপাশে কাউকে সাথে নিয়েই থাকতে হবে। মানচিত্রের দিকে তাকালে এটা খালি চোখেই বোঝা যাবে যে একটা দেশের সীমানা শেষ হওয়ার পর পরই আরেকটি দেশের ভৌগলিক সীমারেখা শুরু হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ কোনো দেশের ক্ষেত্রেই বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থান করার উপায় নেই, ঠিক যেমন একজন ব্যক্তির পক্ষে সমাজ ছেড়ে একা থাকা সম্ভব নয়।
আমাদের উন্নয়ন কিংবা সমৃদ্ধির জন্য প্রতিবেশীর ভূমিকা রয়েছে। ভালো প্রতিবেশীর কাছ থেকে যেমন বিপদে সাহায্য পাওয়ার সুযোগ রয়েছে, তেমনই প্রতিবেশী যদি ‘খারাপ’ হয় কিংবা প্রতিবেশীর সাথে সম্পর্ক যদি তলানিতে ঠেকে, তাহলে প্রতিবেশীর কারণেই বিপদের মুখে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। পৃথিবীর প্রতিটি রাষ্ট্রকেই তাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক কিংবা রাজনৈতিক সম্পর্কের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হয়।
১৯৩৩ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট যখন ক্ষমতায় আসলেন, তখন তিনি পূর্ববর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্টদের পররাষ্ট্র নীতি থেকে একটু সরে আসার চেষ্টা করলেন। গতানুগতিক আমেরিকা যেভাবে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর বিরুদ্ধে প্রয়োজনে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে মার্কিন স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করেছিল, তিনি এই নীতি থেকে সরে এসে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালান। অবশ্য এই নতুন নীতির সম্পূর্ণ কৃতিত্ব তাকে দিলে একটু ভুল হবে। তার আগেও প্রেসিডেন্ট হার্বার্ট হুভার লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর সাথে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা চালিয়েছিলেন। ৪ মার্চের ভাষণে তিনি প্রথমবারের মতো গুড নেইবার পলিসি ব্যাখ্যা করলেন; এটি কেন দরকার সেই সম্পর্কে বললেন। এরপর উরুগুয়েতে আয়োজিত লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর এক কনফারেন্সে আমেরিকার সেক্রেটারি অব স্টেট কর্ডেল হাল বলেন,
“অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ কিংবা কূটনৈতিক বিষয়গুলোতে নাক গলানোর অধিকার কোনো দেশের নেই।”
আমেরিকা কেন অতীতের সামরিক হস্তক্ষেপের নীতি থেকে সরে এসেছিল? উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের শুরুর দিকে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে মার্কিন কোম্পানিগুলোকে অনৈতিক বাণিজ্যিক সুবিধা দেয়ার জন্য একের পর এক দৃষ্টিকটু সামরিক হস্তক্ষেপ করতে থাকে আমেরিকা। সাধারণত একটি দেশ যখন পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য অর্জনের জন্য নৌবাহিনীর মাধ্যমে পেশিশক্তি প্রদর্শন ও হস্তক্ষেপ করে, তাকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ‘গানবোট ডিপ্লোমেসি’ (Gunboat Diplomacy) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে আমেরিকার গানবোট ডিপ্লোমেসির প্রয়োগ সেই দেশগুলোকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। সেসব দেশে ক্রমেই জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। সেসব দেশের নেতাদের মাঝেও অসন্তোষ গড়ে ওঠে। আমেরিকা বুঝতে পেরেছিল- এভাবে চলতে থাকলে তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থের উপর আঘাত আসা সময়ের ব্যাপার। এজন্যই তারা ‘গুড নেইবার পলিসি’র প্রবর্তন করে তড়িঘড়ি করে।
আমেরিকা ১৯১২ সালে লাতিন আমেরিকার দেশ নিকারাগুয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ চালায় যার মূল কারণ ছিল আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরকে সংযুক্ত করা খাল নির্মাণে আমেরিকা ব্যতীত অন্য কোনো দেশ যেন সেখানে পা রাখতে না পারে। গুড নেইবার পলিসির অধীনে আমেরিকা ১৯৩৩ সালে নিকারাগুয়া থেকে নৌবাহিনীর সেনাদের প্রত্যাহার করে।
১৯১৫ সালে লাতিন আমেরিকার আরেক দেশ হাইতিতে আমেরিকাপন্থী স্বৈরশাসককে হত্যা করে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। এর প্রতিশোধ নিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন প্রায় সাড়ে তিনশো নৌসেনাকে হাইতির সমুদ্র বন্দর দখলের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেন। গুড নেইবার পলিসির অধীনে নিকারাগুয়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের এক বছর পরেই হাইতি থেকেও মার্কিন নৌসেনা প্রত্যাহার করা হয়৷ এভাবে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো থেকে ধীরে ধীরে আমেরিকা সামরিক হস্তক্ষেপের নীতি থেকে সরে আসে। ফলশ্রুতিতে আমেরিকার সাথে দেশগুলোর বাণিজ্যিক সম্পর্কের গভীরতা বৃদ্ধি পায়।
১৮৯৮ সালের স্প্যানিশ-আমেরিকান যুদ্ধের পর থেকেই কিউবায় আমেরিকান সৈন্যরা দখলদারিত্ব বজায় রেখেছিল। কিন্তু ১৯৩৪ সালে গুড নেইবার পলিসির কারণে আমেরিকা দেশটির ভূখণ্ড থেকে সৈন্য সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়, যদিও ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত আমেরিকা দেশটির অভ্যন্তরীণ নানা বিষয়ে হস্তক্ষেপ অব্যাহত রেখেছিল। আমেরিকার এমন হস্তক্ষেপ দেশটিতে তীব্র মার্কিনবিদ্বেষী মনোভাব গড়ে তোলে, একপর্যায়ে ফিদেল ক্যাস্ত্রোর নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে দেশটি স্বাধীনতা অর্জন করে।
মেক্সিকোতে একসময় মার্কিন ও ব্রিটিশ তেল উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো সক্রিয় ছিল। কিন্তু পরবর্তী মেক্সিকান সরকারের বেধে দেয়া নিয়মকানুন মানতে অস্বীকৃতি জানায় ব্রিটিশরা, তবে আমেরিকানরা তাদের গুড নেইবার পলিসির জন্য মেক্সিকো সরকারের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মেক্সিকো আমেরিকার কাছে তেল রপ্তানিতে সম্মত হয়। মেক্সিকো এখনও আমেরিকায় বিশাল পরিমাণ তেল রপ্তানি করে৷ দেশটিতে তেল রপ্তানিতে সৌদি আরব ও কানাডার পরই মেক্সিকোর অবস্থান।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার এই নীতিতে বিশাল পরিবর্তন আসে। আমেরিকার সামনে তখন প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় ইউরোপ ও জাপান পুনর্গঠনে সর্বোচ্চ সহায়তা প্রদান করা। কারণ, সোভিয়েত ইউনিয়ন সর্বোচ্চ চেষ্টা করছিল যুদ্ধ-পরবর্তী অবস্থার সুযোগ নিয়ে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার জন্য। আমেরিকা রীতিমতো লাতিন আমেরিকায় বিভিন্ন রকমের হস্তক্ষেপ করতে শুরু করে। যেমন: সিআইএ ১৯৫৪ সালে গুয়াতেমালার প্রেসিডেন্ট জ্যাকব আরবেঞ্জকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে। ঠিক একইভাবে চিলির প্রেসিডেন্ট সালভাদর আলেন্দেকে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-র মদদে উৎখাত করা হয়। প্রতিবেশী দেশ কিউবার স্বাধীনতা সংগ্রাম রুখে দিতে আমেরিকা ‘বে অব পিগস’ আক্রমণ করে, যেটির ব্যর্থতা আমেরিকার ইতিহাসে কালিমা লেপন করেছে। এছাড়া ডমিনিকান রিপাবলিকের উপর মার্কিন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ঘটনাও গুড নেইবার পলিসি থেকে সরে আসার বিষয়টি নির্দেশ করে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লাতিন আমেরিকার অনেক দেশই মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমেরিকার সাহায্য পেয়েছে। ২০০৭ সালে আমেরিকা, মেক্সিকো এবং মধ্য আমেরিকার দেশগুলোর মাঝে ‘মেরিদা ইনিশিয়েটিভ’ নামে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যে চুক্তিতে মাদক পাচার এবং আন্তর্জাতিক সংঘবদ্ধ অপরাধের বিরুদ্ধে সহযোগিতাকে প্রাধান্য দেয়া হয়।
শুধু যে আমেরিকাই এই নীতির অনুসরণ করেছে, এরকমটা ভাবলে ভুল হবে। এই নীতির প্রবর্তনের পেছনে আমেরিকাকে কৃতিত্ব দেয়া হলেও অন্য নামে কিংবা স্বীকৃতি ছাড়া এই নীতি অনেক আগে থেকেই কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রচলিত আছে– এরকম তথ্যও পাওয়া যায়। ভারতের দিকে তাকালে বিষয়টি পরিষ্কার হতে পারে। ভারতের আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের দিকেও দৃষ্টিপাত করা যেতে পারে।
সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে বৈদেশিক নীতিতে পরিবর্তন আনতে হয়। আমেরিকা যখন গুড নেইবার পলিসি নিয়ে হাজির হয়, তখন সেটা তার বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষার জন্যই জরুরি ছিল। এই নীতির অনুসরণে দেরি হলে লাতিন আমেরিকার তীব্র জনরোষ ঠেকানো হয়তো কষ্টকর হয়ে দাঁড়াতে আমেরিকার পক্ষে। আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই নীতি থেকে সরে আসাও ছিল সময়ের দাবি, কারণ সোভিয়েত ইউনিয়ন বিপ্লব ছড়িয়ে দেয়ার যে মন্ত্র নিয়ে আবির্ভাব হয়েছিল, সেটির বিপরীতে ‘সফট পলিটিক্স’ কতটুকু কার্যকর হতো, সেটিও প্রশ্নের ব্যাপার। সম্প্রতি অনেক দেশই এই নীতি অনুসরণ করছে। আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য এই নীতির অনুসরণ বহুলাংশে জরুরি।