পৃথিবীর বুকে মানুষের হাতেই এমন সব ঘটনা ঘটে যায়, যার রূপ অনেক সময় নাটক সিনেমার কল্পনাকেও হার মানায় শতগুণে। ইতিহাসের বুকে তেমনি এক ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে ১৯৭৮ সালের ১৮ই নভেম্বর দিনটি। সুদূর যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণে গায়ানা নামক রাজ্যে ঘটে যায় এক মর্মান্তিক ঘটনা। গায়ানার জোন্সটাউন নামক এক অঞ্চলে প্রায় হাজারের কাছাকাছি নর-নারী ও শিশু বিষ খেয়ে সেদিন আত্মহত্যা করে। তবে পর্যালোচকদের মতে, এটি আত্মহত্যা নয়, বরং খুন।
১৯৫৬ সালে দিকের ঘটনা। জিম জোন্স নামে একজন বেশ প্রভাবশালী ধর্মযাজক ছিলেন। তার একান্ত চেষ্টায় ও অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়াপোলিস শহরে পিপলস টেম্পল নামে একটি গির্জা প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৬৬ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার রেডউড ভ্যালিতে গির্জাটি স্থানান্তরিত করা হয়। ভক্তদের মাঝে গির্জাটির সুনাম খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
জিম জোন্সের তত্ত্বাবধানে চালিত এই গির্জাটি ছিল শহরের বাকি গির্জাগুলো থেকে অনেকটাই আলাদা। যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদ বিলুপ্তির পথে হলেও তখনও কালো সাদার বৈষম্য বিদ্যমান। ধনী-গরিবের শোষণ দৃশ্যমান সর্বত্র। কিন্তু পিপলস টেম্পলের ভিত্তি ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। এখানে সকলেই সমানভাবে সৃষ্টিকর্তার সেবা করার সৌভাগ্য লাভ করতেন। এই গির্জায় কোনো বর্ণ বৈষম্য ছিল না। সেবকগণ প্রতিনিয়ত গির্জার জন্যে কাজ করে যেতেন। এখানে ছিল না কোনো ধনী-গরিবের ভেদাভেদ। আর তাই জিম জোন্স ধীরে ধীরে সকলের কাছে অসম্ভব প্রিয় হয়ে ওঠেন।
প্রাথমিকভাবে গির্জার চিন্তাভাবনা ছিল সকলেই একত্রে বসবাস করবে এবং প্রয়োজনে সকলেই সকলকে সাহায্য করবে। জোন্সের এই স্বপ্ন ধীরে ধীরে আরও বড় হতে থাকে। জোন্স গির্জাকে কেন্দ্র করে একটি ছোটখাটো সমাজ তৈরি করার পরিকল্পনা করতে থাকেন। তিনি এমন এক সম্প্রদায় তৈরি করার কথা চিন্তা করেন যেখানে তিনি নিজের মতো করে সবকিছু সাজিয়ে নিতে পারবেন। যেখানে সকলেই সমান অধিকার ভোগ করবে এবং পরস্পর পরস্পরের জন্যে কাজ করবে। আর এই উদ্দেশ্য সফল করার জন্য তার এমন একটি জায়গার প্রয়োজন ছিল যেটি হবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যন্ত কোনো অঞ্চল; যেখানে সরকারের কোনো প্রভাব থাকবে না।
অনেক চেষ্টার পর জোন্স দক্ষিণ আমেরিকার গায়ানা রাজ্যের এক গহীন জঙ্গলে দুর্গম একটি এলাকা খুঁজে পান। এলাকাটি গায়ানার লোকালয় থেকে অনেক দূরে ছিল বলে সরকারের কোনো সুযোগ সুবিধা সেখানে ছিল না। কিন্তু এলাকাটি জোন্সের চাহিদা মেটানোর জন্য পুরোপুরি উপযুক্ত ছিল। ১৯৭৩ সালে জোন্স গায়ানা সরকারের কাছ থেকে সেই এলাকার কিছু খাস জমি ইজারা নেন। সেই জমিগুলো ছিল জঙ্গলে পরিপূর্ণ। জোন্স জঙ্গল পরিষ্কার করার কাজে কিছু শ্রমিক নিযুক্ত করেন। সব কাজ শেষে ১৯৭৭ সালের দিকে ৫০ জন মানুষের আবাসস্থলে পরিণত হয় গায়ানার এই অঞ্চল।
জোন্স এমন এক শহরের কল্পনা করতেন যেখানে থাকবে না কোনো অভাব, মনোমালিন্য, বর্ণবাদ বা ধনী-গরিবের ভেদাভেদ। সব মিলিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ শাসন ব্যবস্থায় রূপ নেবে সেটি, যা জোন্সটাউন নামে পরিচিতি লাভ করবে।
কিন্তু সেখানকার বাস্তব পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণই ভিন্ন। জোন্সের অনুসারীরা, যারা জোন্সের উপর নির্ভর করে অনেকটা রাস্তা পাড়ি দিয়ে জোন্সের শহরে পদার্পণ করল, তাদের অভিজ্ঞতা হলো ভয়াবহ। তখনো সকলের জন্যে খাবারের ব্যবস্থা ঠিকভাবে করা হয়ে ওঠেনি, ছিল না থাকার পর্যাপ্ত ব্যবস্থাও। তাই ছেলে আরে মেয়েদের আলাদা আলাদা থাকার ব্যবস্থা করা হয়। শহরের অন্যান্য অঞ্চল থেকে তাপ এবং আর্দ্রতা বেশ ভয়াবহ থাকার কারণে সাধারণ মানুষ ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়তে লাগল। এমন সময় শহরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে ভেবে জোন্স লাউডস্পিকারে তার বক্তৃতা সম্প্রচার করতে থাকল। এই সম্প্রচার সারা দিন রাত ধরে চলত। জীবিকার প্রয়োজনে একেক জনকে প্রায় ১০-১১ ঘণ্টার বেশি কাজ করতে হতো। অনেক কষ্টে ক্লান্ত শ্রান্ত দেহ নিয়ে লাউডস্পিকারে কথার মাঝেও ঘুমানোর চেষ্টা করা নিতান্তই কষ্টসাধ্য হয়ে উঠছিল সকলের কাছে।
এতকিছুর মাঝেও অনেকের জোন্সটাউন ভালো লেগে গিয়েছিল। আর যাদের ভালো লাগেনি, তারা সেখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু জোন্সটাউন থেকে বাইরে বেরুনো ছিল প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। কেননা জোন্সটাউনের চারপাশে রয়েছে গভীর জঙ্গল। আর জোন্সটাউনকে ঘিরে রয়েছে অসংখ্য সশস্ত্র প্রহরী। শহর থেকে বাইরে বেরুতে গেলে লাগত জোন্সের অনুমতি। আর জোন্স চাইতেন না, কেউ এই শহর থেকে বাইরে বেরিয়ে যাক।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্বকারী ক্যালিফোর্নিয়ার কংগ্রেসম্যান লিও রাইয়ানের কাছে জোন্সটাউনের ব্যাপারে কিছু অস্বাভাবিকতার কথা কানে আসে। তখন তিনি জোন্সটাউন সরেজমিনে পরিদর্শন করার জন্যে মনস্থির করেন। সঙ্গে নিলেন তার পরামর্শদাতা, ‘এনবিসি’ ছবি পরিচালক দল এবং পিপলস টেম্পলের সাথে জড়িত কিছু লোক।
নভেম্বর ১৭ তারিখ রাইয়ান তার দল সহ জোন্সটাউনে উপস্থিত হন। প্রথম দিকে তারা কিছুই বুঝে উঠতে পারেননি। সবকিছু সহজ এবং স্বাভাবিক বলে মনে হতে থাকে। কংগ্রেসম্যানের জন্য বেশ জমকালো ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু রাতে খাওয়ার সময় দলের এনবিসির এক সদস্যের হাতে একটি চিরকুট পৌঁছে। সেই চিরকুটে কিছু লোকের নাম ছিল, যারা জোন্সটাউনের বন্দী জীবন থেকে মুক্তি চায় বলে উল্লেখ করা হয়। এরপর রাইয়ানের কাছে সবকিছু স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে।
পরদিন রাইয়ান সকলের উদ্দেশ্যে ঘোষণা দিলেন যে, কেউ যদি তার সাথে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যেতে চান তবে তার সাথে ফিরে যেতে পারবেন। কিন্তু জোন্সের ভয়ে খুব কম সংখ্যক লোক রাইয়ানের সঙ্গী হতে সম্মত হন।
জোন্সটাউন ত্যাগ করার সময় ঘনিয়ে এলো তাদের। জোন্সটাউনের যারা যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যেতে সম্মত হয়েছিল তাদের এক এক করে একটি ভ্যানে তোলা হল। আর তাদের নিরাপত্তার জন্য রাইয়ান পিছনের একটি গাড়িতে অবস্থান করতে লাগলেন। রাইয়ানের মনে হলো, তার সাথে হয়তো আর কিছু লোক চলে যাওয়ার জন্যে আগ্রহী আছে। তাই রাইয়ান আরেকবার জোন্সটাউনের ভেতরে আহ্বান করার জন্য গেলেন।
কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে জোন্সের অনুসারীদের একজন হঠাৎ রাইয়ানের উপর আক্রমণ করে বসে। তখন বিপদ দেখে রাইয়ান এবং তার সহযোগীরা দ্রুত গাড়ি নিয়ে সে স্থান ত্যাগ করেন। গাড়ি নিরাপদেই এয়ারপোর্টে পৌঁছে। প্লেন তখনো প্রস্তুত ছিল না বলে সকলে ভীতসন্ত্রস্থ হয়ে এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করতে লাগল। এয়ারপোর্টে একটি বিশাল গাড়ি এসে ভিড় করে এবং সেটি থেকে কিছু সশস্ত্র ব্যক্তি নেমে এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে লাগে রাইয়ান এবং তার দলের উপর। এতে রাইয়ান সহ মোট পাঁচজনের তৎক্ষণাৎ মৃত্যু ঘটে। বাকিদের অনেকেই ভীষণভাবে আহত হয়।
এদিকে জোন্স বুঝতে পারে, এই ঘটনা ছড়িয়ে যাওয়ার পর তাদেরকে বিশাল ধরপাকড়ের সম্মুখীন হতে হবে। তাই তিনি জোন্সটাউনের সকল অধিবাসীকে একত্র করেন। তিনি খুব বিচলিত এবং ভীত হয়ে পড়েছিলেন। জোন্স সকলকে বোঝাতে লাগলেন, তাদের বেঁচে থাকা এখন মোটেই নিরাপদ নয়। কেননা যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী এসে তাদের সন্তানদের নির্যাতন করবে। তাই এর চাইতে ভাল তারা সকলেই একত্রে জীবন ত্যাগ করবে। জোন্স অনেকভাবে তার বাসিন্দাদের প্ররোচিত করতে লাগলেন। অবশেষে সকলের সামনে সায়ানাইড রাখলেন তিনি। প্রথমে বাচ্চা এবং শিশুদের সিরিঞ্জের মাধ্যমে বিষ দেওয়া হলো। এরপর বয়স্কদের বিষ খাওয়ার জন্যে আদেশ দেওয়া হয়। ফলে অনেকের মধ্যে এই দৃশ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই জোন্সের এই আদেশে বিষ মুখে তুলে নেয়। কিন্তু কিছু আতঙ্কগ্রস্থ লোক ভয়ে ছোটাছুটি করার চেষ্টা করে। তবে সশস্ত্র পাহারার কারণে অনেকেই বাধ্য হয় বিষ খেতে। এর মাঝেও কিছু লোক বেঁচে যায়, যারা পরবর্তীতে জোন্সের এই ভয়ানক কাজের বর্ণনা দেন।
১৯৭৮ সালের ১৮ নভেম্বর সেখানে মোট ৯১৪ লোকের মৃত্যু ঘটে, যার মধ্যে ২৭৬ জন ছিল শিশু। জোন্স নিজে কিন্তু বিষ খাননি। মাথায় গুলি লেগে মৃত্যু ঘটে জোন্সের। তবে এটি সঠিক বলা যায় না যে তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন নাকি অন্য কেউ তাকে গুলি করেছিল।
জিম জোন্স: ৯১৪ জনকে খুন করেছিলো যে মানুষটি
জিম জোন্স: পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভণ্ড ধর্মব্যবসায়ী খুনি। ৯১৪ জনকে হত্যা করে এই মানুষটি।
Posted by Roar বাংলা on 12 सप्टेंबर 2017
ফিচার ইমেজ- David Hume Kennerly/Getty Images