সার্চিং ফর হোপ
ডিসেম্বর ১৯৪৭
আট বছর বয়সী সাচিকোর তৃতীয় শ্রেণীর পড়াশোনা শেষের পরপরই বাবা জানালেন, তাদের কোয়াগি ছাড়ার সময় চলে এসেছে। এটা ছাড়া আর কোনো উপায়ও ছিলো না। কারণ পোতাশ্রয়ের কাজকারবার কমে যাওয়ায় চাকরি হারিয়েছিলেন বাবা। ছাই ভর্তি ছোট তিনটি বাক্স, পূজার বেদি হিসেবে ব্যবহৃত কাঠের বড় বাক্স এবং বাকি জিনিসপত্র মা সুন্দর করে গুছিয়ে নিলেন। সাকামোতো সিমেট্রি, স্যানো মঠ আর কর্পূর গাছে ঘেরা সেই পুরনো জায়গাতেই ফিরে যাচ্ছিল তারা।
ধ্বংসস্তূপ থেকে আবারও জেগে উঠছিল নাগাসাকি শহর। রাত-দিন হাতুরি পেটানো আর করাত চলাচলের শব্দ শোনা যেত। সেই সাথে শোনা যেত শ্রমিকদের উৎসাহ দেয়া নানা কথাবার্তাও- “ভালো হয়েছে” কিংবা “কাজগুলো চালিয়ে যাও, ভালোই হচ্ছে।” উরাকামি উপত্যকার যে অংশটিতে পারমাণবিক বোমা বিষ্ফোরিত হয়েছিল, সেখানে আবারও নতুন ভবন মাথা তুলে দাঁড়াতে শুরু করেছিল, দাঁড়াচ্ছিল নতুন নতুন পিলারও। নতুন রাস্তা বানানো হচ্ছিলো। বিধ্বস্ত, গলে যাওয়া গাড়িগুলোর জায়গা দখল করছিল নতুন সব গাড়ি। স্কুলগুলো আবারও ছাত্র-ছাত্রীদের আনাগোনায় মুখরিত হয়ে উঠলো। কুড়েঘরের জায়গায় গড়ে উঠছিলো নতুন সব বাড়ি। নাগাসাকি শহর তখনও ধ্বংসের চিহ্নই বহন করে চলেছিল। কিন্তু বৃষ্টিপাত আর সময়ের পরিক্রমায় বোমা হামলার ফলে সৃষ্ট বিকিরণের প্রভাব অনেকটাই কমে এসেছিল।
বোমা হামলার পর একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে আগামী সত্তর বছর আর কোনোকিছুই জন্মাবে না। কিন্তু ফুল ফুটতে শুরু করেছিল। গোলাপী ফুলে ভরা করবী গাছের শাখাগুলো বাতাসে দোল খাচ্ছিলো। মিষ্টি আলু, গম আর ভুট্টা গাছ জন্মাতে শুরু করেছিল। এমনকি মাটির উপর দিয়ে কেঁচোর চলাচলও মানুষের আশার পালে হাওয়া দিচ্ছিল!
তবে এতকিছুর পরেও মানুষের মন থেকে বোমা হামলার পরবর্তী প্রভাব নিয়ে শংকার মেঘ দূরীভূত হয়নি। মর্নিং গ্লোরি ফুলগুলো স্বাভাবিকের চেয়ে ছোট ছিল, মাঝে মাঝে এর পাতাগুলোও থাকতো বিকৃতাবস্থায়। মিষ্টি আলুর গাছ জন্মাচ্ছিলো ঠিকই, কিন্তু অধিকাংশ সময় তাতে আলুই জন্মাতো না।
সাচিকোর বাবা-মায়ের দুশ্চিন্তা ছিলো ছ’বছর বয়সী মিসাকে নিয়ে। বোমা হামলার পর থেকেই মেয়েটি বেশ দুর্বল আর অসুস্থ ছিলো। সাচিকো, বাবা এবং মা তাদের পুরনো জায়গায় ফিরে এলেও মিসা যেন তাদের সাথে ঠিক কুলিয়ে উঠতে পারছিলো না।
বিষ্ফোরণের ধ্বংসের ছাপ রয়ে গিয়েছিল সর্বত্রই। স্যানো মঠের প্রবেশপথে থাকা পাথরের বিরাট গেটটি এক পায়েই দাঁড়িয়েছিল। অন্য পা বিধ্বস্ত অবস্থায় পাশেই মাটিতে পড়ে ছিল।
পাঁচ শতাধিক বছরের পুরনো কর্পূর গাছগুলোও আক্রান্ত হয়েছিল। তাদের শিকড় জুড়ে তৈরি হয়েছিল অগণিত ছিদ্র। সেই ছিদ্রগুলোতে জমেছিল ধূলাবালির স্তর। গাছগুলো ঠিকই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। শাখায় শাখায় দেখা যাচ্ছিল নতুন পাতা আর শ্বেতশুভ্র ফুলের সমারোহ।
গাছগুলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মা হাততালি দিয়ে বলে উঠলেন, “শাবাস, কর্পূরের দল! তোমরা যে কেবল বেঁচেই আছো তা-ই না, তোমরা বড়ও হচ্ছো।“
সাচিকোও গাছগুলোর দিকে তাকালো। মা ঠিকই বলেছিলেন। কিন্তু সাচিকো কি গাছগুলোর মতো এতটা দৃঢ়তা আর সহিষ্ণুতার অধিকারী হতে পারবে?
সাচিকোরা সপরিবারে তাদের আগের জায়গায় ফিরে আসলো। বাবা ছাইগুলো মাটিচাপা দেয়ার কাজ শুরু করলেন। ধ্বংসস্তূপ থেকেই সাচিকো পেরেক, টাইলস আর পুড়ে যাওয়া কাঠ সংগ্রহ করতে লাগলো। এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী, যিনি আবার বাবার বন্ধুও, ধসে পড়া একটি মঠ থেকে কাঠের ব্যবস্থা করে দিলেন। এসব দিয়েই বাবা নতুন করে তাদের বাড়িটা বানাবেন।
“দেখ, দেখ, আমি কী খুঁজে পেয়েছি,” হঠাৎ করেই চিৎকার করে উঠলেন বাবা। হাতের বেলচাটা ফেলে মাটিতে বসে পড়লেন তিনি। এরপর হাত দিয়েই ছাদের ভাঙা টাইলস, সিমেন্ট আর কাঠের টুকরা সরাতে লাগলেন। তারপর খুব যত্নের সাথে তিনি সবুজরঙা পাতার মতো কিছু একটা বের করে আনলেন। সূর্যের আলোতে সেটা চকচক করে উঠলো।
দাদীমার গামলা! কোনোরকম ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই টিকে ছিল ওটা। বাবা জিনিসটা মায়ের হাতে তুলে দিলেন।
মা আর নিজেকে থামিয়ে রাখতে পারলেন না। অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগলেন তিনি। আস্তে আস্তে গামলাটাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। এটা তার সম্পত্তি। মামা, আকি, ইচিরো, তোশি- সবার আঙুলের ছাপই মিশে আছে এতে। জীবিত হোক কিংবা আত্মিকভাবে, তারা সবাই আজ আবারও মিলিত হলো।
নতুন বাড়িতে দাদীমার গামলাটি মা খুব যত্ন সহকারে রাখলেন। অবশ্য সেটাকে বাড়ি না বলে খুপরি বললেও অত্যুক্তি হবে না। বাবা, মা, সাচিকো আর মিসার থাকার জন্য সেখানে খুব বেশি একটা জায়গা ছিলো না। নোংরা মেঝে আর দুটো পাথর দিয়ে রান্নাবান্নার ব্যবস্থা করা এ খুপরির সাথে পাহাড়ের গায়ে গড়ে ওঠা খুপরিগুলোর তেমন একটা পার্থক্য ছিলো না। বৃষ্টি হলে ছাদ দিয়ে পানি চুইয়ে পড়তো, দেয়ালের ফুটো দিয়ে প্রবাহিত হতো বাতাস।
মিষ্টি আলুর পাতা, বুনো ঘাস এবং খাওয়ার মতো আর যা কিছু খুঁজে পাওয়া সম্ভব, সেগুলো দিয়েই রাতের খাবার রান্না করলেন মা। ধ্বংসস্তূপের মাঝে খুঁজে পাওয়া একটি পাত্রে রান্না করলেন তিনি। ভাঙা একটি মাটির পাত্র থেকে পানি ঢেলে এবং দাদীমার গামলায় খাবার বেড়ে দিয়ে খাবার পরিবেশনের পর্ব শেষ করলেন তিনি।
পরিবারের সবাই দাদীমার গামলায় খাওয়াদাওয়া করতো, সেখানেই পানি নিয়ে মুখ ধুতো, আবার তাদের কাপড়চোপড়ও সেখানেই পরিষ্কার করতো। সূর্য ডুবে অন্ধকার নেমে এলে গামলাটি সরিয়ে রেখে বাবা-মা শোয়ার প্রস্তুতি নিতেন। হাতগুলো বুকে জড়িয়ে, পা দুটো ছড়িয়ে, দেয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমাতো তারা। পা দুটো প্রায়ই রুমের অন্যপাশের দেয়াল স্পর্শ করতো। নতুন বাড়িতে কোনো মাদুরই ছিলো না। সাচিকো আর মিসা বাবা-মায়ের উরুতে মাথা রেখে ঘুমাতো। মায়েরটায় মাথা রাখতো মিসা, আর বাবারটায় সাচিকো। এভাবেই ভোরের সূর্য ওঠার আগপর্যন্ত একসাথে জড়াজড়ি করে ঘুমাতো তারা সবাই।
… … … …
অ্যা সিড ফর দ্য ফিউচার
ফেব্রুয়ারি ১, ১৯৪৮
“দুনিয়ার কেবলমাত্র এই জায়গাটাতেই আমরা থাকতে পারি সাচিকো। কখনোই খারাপ কথা বলবে না, অন্যথায় কোনোদিনই শান্তি খুঁজে পাবে না। মনে রেখ, ঘৃণা থেকে কেবলমাত্র ঘৃণারই উৎপত্তি ঘটে ” এই কথাগুলো প্রায়ই সাচিকোকে বলতেন বাবা। এই মূলনীতি নিয়েই বেঁচে ছিলেন তিনি।
পড়াশোনা করতে আর খবরের কাগজ পড়তে প্রতিদিনই তিনি লাইব্রেরিতে যেতেন। এরপর ফিরে এসে যা যা জানতে পারলেন তা পরিবারের সদস্যদের শোনাতেন।
ফেব্রুয়ারির শুরুর দিককার এক বিকেলের কথা। ন’বছর বয়সী সাচিকো দেখতে পেলো, চন্দ্রমল্লিকার বাগান বানানোর জন্য বাবা বাইরে মাটি খনন করছেন। একটি খবর তার মন ভার করে রেখেছিল। মেয়ের কাঁধে হাত রেখে তিনি বললেন, “পৃথিবী আজ তার এক মহামানবকে হারিয়েছে রে মা।“
বাবার কথাগুলো ঠিকঠাক বুঝতে না পারলেও তার চোখের ভাষা সাচিকো ঠিকই পড়তে পেরেছিল। বাবা যে মহামানবের ব্যাপারে বলছিলেন, তিনি ভারতের মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, যাকে পুরো বিশ্ব ‘মহাত্মা’ নামেও চিনতো। ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি বিশ্ব গণমাধ্যমে খবর আসে, ঘাতকের বুলেটের আঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন গান্ধীজি। খবরের কাগজগুলো ভরে গিয়েছিল গান্ধীর বন্দনায়। তার নেতৃত্বগুণের প্রশংসা হচ্ছিলো সর্বত্র, যার বদৌলতে একটি বুলেটও খরচ না করে ইংরেজদের করাল থাবা থেকে ভারতের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলেন তিনি। সেই সাথে আলোচনা হচ্ছিলো তার শান্তিকামী ও অহিংস দর্শন নিয়েও।
গান্ধীজির জীবন এবং তার অহিংস দর্শন নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন বাবা। বাবার হাতটা তখনও সাচিকোর কাঁধেই রাখা ছিল। “গান্ধীজির কাজকর্ম নিয়ে পড়াশোনার বয়স এখনও তোমার হয়নি। কিন্তু একদিন তোমাকে এসব নিয়ে অবশ্যই পড়তে হবে। জীবনে চলার পথের বহু মূল্যবান শিক্ষাই তুমি পাবে এখান থেকে।“
বাবার কথাগুলো খুব বেশি একটা না বুঝলেও তার গম্ভীর কণ্ঠস্বর সেদিন সাচিকোকে দারুণ প্রভাবিত করেছিল।
“ঘৃণা থেকে কেবলমাত্র ঘৃণারই উৎপত্তি ঘটে“- বাবার এই কথাগুলো সাচিকোর মাথায় ঘুরতে লাগলো। বাবার কাজকর্মগুলো সে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলো। তিনি একটি ইঁদুরের ভাঙা পায়ে ছোট একটি ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন, রাস্তার একটি কুকুর আর একটি বিড়ালকে তাদের খুপরিতে থাকার জায়গা দিলেন, একটি গোল্ডফিশের থাকার জন্য ছোটখাট জলাধার তৈরি করলেন এবং ধ্বংসস্তুপের ভেতরেই একটি বাগান বানিয়ে ফেললেন। যুদ্ধের অনেক রুপই দেখা হয়ে গিয়েছিল বাবার। এখন নিজের সন্তানদের জন্য শান্তিপূর্ণ একটি জীবন গড়ে যেতেই কাজ করছিলেন তিনি।
বাবার কথামতো মহাত্মা গান্ধীর নাম নিজের মনে গেঁথে নিলো সাচিকো। কিন্তু সে যে কেন এমনটা করলো তা সে নিজেও জানে না।
এই সিরিজের পূর্ববর্তী পর্বসমূহ
১) পর্ব – ১ || ২) পর্ব – ২ || ৩) পর্ব – ৩ || ৪) পর্ব – ৪ || ৫) পর্ব – ৫ || ৬) পর্ব – ৬ || ৭) পর্ব ৭ || ৮) পর্ব ৮ || ৯) পর্ব ৯ || পর্ব ১০