দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নৃশংসতার কথা তখন অনেকেই ভুলে গেছে। এর অস্তিত্ব তখন বইয়ের পাতায়, সিনেমার রূপালি পর্দায় কিংবা সামরিক জাদুঘরের ক্যাবিনেটে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিলো। ইউরোপের বড় রাষ্ট্রগুলো তখন শান্তিপূর্ণভাবে একজোট হয়ে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছিলো। ঠিক তখন ইউরোপের অন্যতম পরাশক্তি যুগোস্লোভিয়াতে বিভক্তির গুঞ্জন শুরু হয়। যুগোস্লোভিয়ার রাষ্ট্রনায়ক মার্শাল টিটোর মৃত্যুর পর দেশটি বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এর মাধ্যমে সার্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া, মেসিডোনিয়া, বসনিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। কিন্তু ভিন্ন জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে বিরোধ দেখা দেয়। আঞ্চলিক নেতারা সমঝোতায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়। ফলে তারা একে অপরের বিরুদ্ধে এক নৃশংস গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।
১৯৯১ সালে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধ চলে কয়েক বছর জুড়ে। যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে জন্ম নেয় এক অভিশপ্ত ইতিহাস। আর সেই ইতিহাসের খলনায়কদের মধ্যে প্রথম যে তিনজনের নাম মনে আসে তারা হলো স্লোবোদান মিলোসেভিচ, রাদোভান কারাদজিচ এবং রাতকো ম্লাদিচ। উগ্র জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী এই তিন সার্ব নেতার হাতে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। ইতিহাসের পাতায় এদেরকে একসাথে ‘বলকান কসাই’ নামে ডাকা হয়।
‘শুধুই সার্ব’ মতবাদের বিশ্বাসী রাষ্ট্রপতি মিলোসেভিচ
১৯৮৭ সালে যুগোস্লোভিয়ার অন্তর্গত রাজ্য কসোভো পরিদর্শনে যান সার্ব নেতা স্লোবোদান মিলোসেভিচ। তৎকালীন কসভোর অধিকাংশ নাগরিক ছিলো আলবেনীয় বংশোদ্ভূত। তারা সার্বদের উপর পৈশাচিক নির্যাতন চালাতো। রাজ্যের সংখ্যালঘু সার্বরা মিলোসেভিচের আগমনে আশার আলো খুঁজে পায়। তারা একজোট হয়ে তাদের নেতার সাথে দেখা করতে যায়। তারা মিলোসেভিচের হোটেলের ফটকের সামনে বিভিন্ন ব্যানার নিয়ে ভিড় করে। একপর্যায়ে পুলিশ তাদের উপর লাঠিচার্জ করে। ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে সার্বরা। মিলোসেভিচ এই ঘটনায় ক্ষুদ্ধ হয়ে পড়েন। তিনি সার্বদের অধিকার রক্ষার্থে কসভোতে বিশাল সমাবেশের আয়োজন করেন। সমাবেশে তিনি সার্বদের অধিকার আন্দোলনকে সমর্থন করেন এবং ঘোষণা করেন, “From now on, no one has the right to beat you”।হাজার হাজার সার্ব সেদিন মিলোসেভিচের বক্তব্যে নতুন আশার আলো খুঁজে পায়। পরবর্তীতে যুগোস্লোভিয়া ভাঙনের ফলে গঠিত নতুন রাষ্ট্র সার্বিয়ার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে নিজের প্রার্থিতা ঘোষণা করেন মিলোসেভিচ। কসোভোতে সার্বদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের সমর্থন করায় সার্বরা তাকে বিপুল ভোটে জয়ী করে। শুরু হয় কুখ্যাত মিলোসেভিচের শাসন।
তিনি প্রথমেই তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইভান স্তাম্বোলিচকে হত্যা করেন। তার রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি ছিলো ‘শুধুই সার্ব, বৃহত্তর সার্বিয়ার লক্ষ্যে’। সার্বিয়ার সাথে স্লোভেনিয়া এবং ক্রোয়েশিয়া নামক আরো দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। স্লোভেনিয়াতে কোনো সার্ব বসবাস করতো না। তাই মিলোসেভিচ স্লোভেনিয়ার প্রতি আগ্রহী ছিলেন না। তার কুনজর পড়ে ক্রোয়েশিয়ার উপর। সেখানে সংখ্যালঘু সার্বরা নতুন রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশে অপারগতা প্রকাশ করলে মিলোসেভিচ তাদের পক্ষ নিয়ে ক্রোয়েশিয়ার সাথে গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। মিলোসেভিচের কাছে ক্রোটদের গুরুত্বপূর্ণ নগরী ভুকুবারের পতন ঘটে। সার্বরা ভুকুবারের হাজার হাজার ক্রোটদের নির্বিচারে হত্যা করে। কী ছিলো তাদের অপরাধ? তাদের অপরাধ তারা সার্বিয়ার নাগরিক নন।
মিলোসেভিচের সৈনিকরা ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। মর্ত্যের বুকে নেমে আসে নরকের অভিশাপ। মিলোসেভিচের পরবর্তী আগ্রাসনের শিকার হয় নব্য রাষ্ট্র বসনিয়া এবং হার্জেগোভিনা। বসনিয়া যুদ্ধে তার সাথে হত্যাযজ্ঞে অংশ নেন অপর দুই কুখ্যাত নেতা রাদোভান কারাদজিচ এবং রাতকো ম্লাদিচ।
বসনিয়ার পিশাচ রাদোভান কারাদজিচ
সার্বিয়া রক্ষার্থে গণহত্যাকে নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে মনে করতেন তৎকালীন বসনিয়া-সার্ব অঞ্চলের রাষ্ট্রপ্রধান রাদোভান কারাদজিচ। দ্বিতীর বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে ভয়াবহ গণহত্যার কারিগর মানুষরূপী পিশাচ কারাদজিচ। স্লোবোদান মিলোসেভিচের মতো তিনিও ছিলেন উগ্র জাতীয়তাবাদী নেতা। বসনিয়ার গৃহযুদ্ধে তিনি নির্বিচারে নিরীহ নারী, শিশুসহ লক্ষাধিক নাগরিক হত্যা করেন। তাকে আড়ালে ডাকা হতো ‘বসনিয়ার কসাই’ এবং ‘বলকানের কসাই’ হিসেবে।
রাদোভান কারাদজিচ একজন আত্মকেন্দ্রিক নেতা। তিনি কিছু কবিতাও রচনা করেন। তার কবিতার ভাষায় ফুটে উঠেছে তার উগ্রতা। একটি কবিতায় তিনি নিজেকে ‘লৌহমানব’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তার প্রচণ্ড ক্ষমতার নেশা ছিল। ১৯৯২ সালে তিনি বসনিয়া এবং হার্জেগোভিনার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তার শাসনামলে বসনিয়ায় বসবাসরত মুসলিম এবং ক্রোটদের সাথে সার্বদের দ্বন্দ্ব বেঁধে যায়।
কারাদজিচ বসনিয়ার মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা সারায়েভো অবরোধের আদেশ দেন। ৪৪ দিনব্যাপী অবরুদ্ধ সারায়েভোতে কারাদজিচের নির্দেশে নির্বিচারে মুসলিম হত্যা করা হয়। ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকার হিসাব অনুযায়ী প্রায় ১,৫০০ শিশুসহ ১০ হাজারের মতো মুসলিম হত্যা করা হয়।
বিশ্বের অন্যান্য কুখ্যাত নেতা থেকে কারাদজিচ একদিক দিয়ে আলাদা। কারণ তিনি একটি নয়, দুটি গণহত্যার খলনায়ক। নিষ্ঠুর কারাদজিচের পরবর্তী শিকার হয় আরেক মুসলিম অধ্যুষ্যিত অঞ্চল স্রেব্রেনিৎসা। এই গণহত্যার নেতৃত্ব দেন কারাদজিচের অধীনস্থ সামরিক অধিনায়ক রাতকো ম্লাদিচ।
স্রেব্রেনিৎসার খলনায়ক রাতকো ম্লাদিচ
উগ্র রাষ্ট্রপ্রধান কারাদজিচ এবং মিলোসেভিচের সবচেয়ে বড় মিত্র ছিলেন বসনিয়া যুদ্ধে বসনিয়া-সার্ব সামরিক অধিনায়ক রাতকো ম্লাদিচ। তিনি নিজে আগ্রাসনের রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন। সারায়েভোর গণহত্যায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করার ফলে তাকে আরেকটি গণহত্যার দায়িত্ব প্রদান করেন কারাদজিচ। স্রেব্রেনিৎসা গণহত্যা জার্মান হলোকাস্টের পর ইউরোপে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে নৃশংস হত্যাকাণ্ড। ১৯৯৫ সালের জুলাই মাসে ম্লাদিচ তার বাহিনী নিয়ে স্রেব্রেনিৎসা অবরোধ করেন। শহরের সাথে পুরো বসনিয়ার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। এরপর সুসজ্জিত সামরিক বাহিনী নিয়ে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন নিরীহ মুসলিমদের উপর।
স্রেব্রেনিৎসায় প্রায় ৮ হাজার মুসলিমকে হত্যা করা হয়। কারাদজিচ এবং মিলোসেভিচের লক্ষ্য ছিলো এই অঞ্চল থেকে নন-সার্ব জাতিদের বিতাড়িত করা। গণহত্যার পর ম্লাদিচ তার সৈনিকদের শহর থেকে নন-সার্বদের তাড়িয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন।
প্রায় ২০ হাজার মুসলিম নারী এবং শিশুকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। সার্বসেনারা বসনিয়ান মুসলিম এবং ক্রোট নারীদের ধর্ষণ করার মতো ঘৃণ্য অপরাধে লিপ্ত হয়। ম্লাদিচের নির্দেশে হাজার হাজার ক্রোট এবং মুসলিম নাগরিককে বন্দী করা হয়।
এভাবে তিনজন কসাইয়ের আগ্রাসনের ফলে বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ইউরোপে মানবতার চূড়ান্ত পতন ঘটে। বলকান কসাইত্রয়ীর পাশবিকতায় প্রাণ হারায় হাজারো নিরীহ নাগরিক।
যুদ্ধাপরাধে মামলা দায়ের এবং গ্রেফতার
১৯৯৯ সালের মে মাসে বসনিয়া যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে জাতিসংঘ নিয়ন্ত্রিত সংগঠন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যে প্রধান আসামী হিসেবে স্লোবোদান মিলোসেভিচ, রাদোভান কারাদজিচ এবং রাতকো ম্লাদিচের নাম উল্লেখ করা হয়।
ওদিকে গৃহযুদ্ধ অবসান হওয়ার পর, সার্বিয়ায় মিলোসেভিচের জনপ্রিয়তা কমে প্রায় শূন্যের কাছাকাছি চলে যায়। ২০০০ সালে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তিনি শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। কিন্তু ক্ষমতালোভী মিলোসেভিচ ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেন। সার্বিয়ার জনগণ মিলোসেভিচের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে। মাসব্যাপী আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেন তিনি। যে সার্বদের জন্য তিনি এতো হত্যাযজ্ঞ করলেন, শেষপর্যন্ত তারাই তার বিরুদ্ধে পথে নামলো। তিনি এতোটাই হতাশ হয়ে পড়েন যে, বাড়ি ফিরে নিজের স্ত্রীকে হত্যা করার চেষ্টা করেন। পরবর্তীতে পুলিশ এসে তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়।
২০০২ সালে তাকে নেদারল্যান্ডসের দি হেগ শহরে আন্তর্জাতিক আদালতের হাতে হস্তান্তর করা হয়। শুরু হয় মিলোসেভিচের বিচার। তিনি সেখানেও দর্পের সাথে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। বিচারকার্য শেষ হবার আগেই ২০০৬ সালে মিলোসেভিচ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কারাগারে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
মিলোসেভিচকে গ্রেফতার করা গেলেও বাকি দুজন বলকান কসাই তখন পলাতক। FBI, CIA, Interpol সহ পৃথিবীর বিখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর Most Wanted List-এর শীর্ষে চলে আসে তাদের নাম। তাদের ধরিয়ে দিতে পারলে প্রায় ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পুরষ্কার ঘোষণা করা হয়।
প্রায় ১৩ বছর পালিয়ে বেড়ানোর পর বেলগ্রেডের এক মফস্বল থেকে ধরা পড়েন রাদোভান কারাদজিচ। তিনি সেখানে একজন চিকিৎসকের ছদ্মবেশে বহুদিন ধরে বাস করছিলেন। তার বিরুদ্ধে দুটি গণহত্যা, পাঁচটি মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড, চারটি যুদ্ধাপরাধ এবং একটি জেনেভা চুক্তিভঙ্গের অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করা হয়েছিলো।
মিলোসেভিচের মতোই কারাদজিচ নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। তার মতে যুদ্ধাপরাধের দায় সংশ্লিষ্ট সামরিক অধিনায়কদের উপর বর্তায়। কিন্তু মামলায় তিনি হেরে যান। তাকে ৪০ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
কারাদজিচের বিচার চলমান অবস্থায় ধরা পড়েন শেষ পলাতক কসাই রাতকো ম্লাদিচ। তিনি উত্তর সার্বিয়ার একটি গ্রামে লুকিয়ে ছিলেন। ম্লাদিচের বিরুদ্ধেও কারাদজিচের অনুরূপ অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছিলো। তিনি দি হেগে বিচারকার্য চলার সময় কোর্টের নিয়ম বহির্ভূত আচরণ করে সমালোচনার মুখে পড়েন। তাকে ২০১১ সালে প্রথম বিচারের জন্য আদালতে হাজির করা হয়। তিনি কোর্টে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ‘বানোয়াট’ বলে দাবি করেন। এরপর তিনি অসুস্থতার দোহাই দিয়ে ২০১২ সালের জুলাই পর্যন্ত বিচারকার্য স্থগিত রাখেন। এখন পর্যন্ত তার বিচারকার্য চলছে।
বসনিয়া যুদ্ধে বলকান কসাইদের দ্বারা সংঘটিত হত্যাকাণ্ড বিশ্বমানবতার জন্য এক কালো অধ্যায়। কিন্তু অপরাধ করে কেউ ছাড় পেতে পারে না। পৃথিবীর বুকে সকল অত্যাচারী নেতার পতন ঘটেছে। তাদের অহংকার ধূলিস্যাৎ হয়েছে ন্যায়ের হাতে। বলকান কসাইদের গ্রেফতার এবং বিচারকার্য পরিচালনা যেন তাই প্রমাণ করে। আর যেন পৃথিবীর বুকে নতুন করে স্রেব্রেনিৎসার অভিশাপ ফিরে না আসে, সেদিকে লক্ষ্য রেখে বিশ্বনেতাদের একসাথে কাজ করতে হবে। কারণ মানবতাহীন মানবজাতি পশুর সমান।
ফিচার ইমেজ: The Japan Times