সম্রাট হুমায়ুনের বাংলা বিজয়: বাংলা থেকে শের খানের পশ্চাদপসরণ

১৫৩৮ সালের মাঝামাঝির দিকে শের খান সালতানাত-ই-বাঙ্গালার রাজধানী গৌড় দখল করে নিতে সক্ষম হলেন। গৌড় দখল শের খানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার ছিলো। কারণ তার অত্যন্ত শক্তিশালী একটি দুর্গ চুনার ততদিনে মুঘল অবরোধের মুখে প্রায় নতি স্বীকার করতে যাচ্ছিলো।

সুতরাং, বাংলা বিজয় ছিলো শের খানের জন্য ভাগ্য নির্ধারণকারী একটি লড়াই। তবে শেষপর্যন্ত শের খান এই লড়াইয়ে বেশ ভালোভাবেই নিজেকে প্রমাণ করতে সক্ষম হলেন।

এদিকে শের খানের আফগান বাহিনীর হাতে বাংলার রাজধানী গৌড়ের পতনের পর বাংলার সেনাবাহিনী সম্পূর্ণরুপে ধ্বংস হয়ে গেলো। বাংলার হোসেন শাহী রাজবংশের সর্বশেষ সুলতান গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ শাহ আহত হয়ে ভাটার দিকে পালিয়ে গেলেন। আর তার পুত্ররা ধরা পরলো শের খানের বাহিনীর হাতে।

সম্রাট হুমায়ুন কখনোই শের খানকে মুঘল সাম্রাজ্যের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করতে প্রস্তুত ছিলেন না। কিন্তু শের খান ১৫৩৭ সালের শুরুতে যখন বাংলার রাজধানী গৌড়ের দিকে সেনা অভিযান প্রেরণ করলেন, তখন সম্রাটের ঘুম ভাংলো। তিনি বুঝতে পারলেন, শের খান ধীরে ধীরে মুঘল সাম্রাজ্যের জন্য হুমকি হয়ে উঠছেন, এবং তাকে এখনই বাঁধা দেয়া প্রয়োজন।

শের খানের বাংলা আক্রমণের প্রেক্ষাপটে সম্রাট হুমায়ুনও একই সালের ২৭ জুলাই বাংলা ও বিহার দখলের জন্য রাজধানী আগ্রা ত্যাগ করেন। সম্রাট হুমায়ুনের নেতৃত্বাধীন মুঘল সেনাবাহিনী প্রথমে চুনার অবরোধ করে। চুনার দুর্গটি তখন শের খানের অন্যতম একটি শক্তিস্তম্ভ ছিলো। চুনার খুব সহজেই মুঘল সেনাবাহিনীর কাছে নতি স্বীকার করার কথা ছিলো। কিন্তু হিসেব শেষপর্যন্ত মেলেনি।

১৮০৩ সালে অঙ্কিত চুনার দুর্গের একটি চিত্র; Image Source: Wikimedia Commons

চুনার দুর্গটি দখল করতে প্রত্যাশার চেয়েও বেশি সময় লেগে গেলো। ফলে সম্রাট হুমায়ুন বাংলায় পৌঁছানোর পূর্বেই শের খান বাংলা দখল করে নিলেন। এ সময় শের খান তখন বহরকুণ্ড থেকে তার সেনাবাহিনীকে পরিচালনা করছিলেন। হুমায়ুন দ্রুত বহরকুণ্ডের দিকে ধেয়ে যেতে শুরু করলেন।

এরকম পরিস্থিতিতে বহরকুণ্ডের দিকে ধেয়ে গিয়ে শের খানকে বিতাড়িত করাই ছিলো যেকোনো সম্রাটের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু বিচিত্র মনের খেয়ালী এই সম্রাট হুমায়ুন কী মনে করে কে জানে, কবুল হুসেন তুর্কমানকে শের খানের দরবারে প্রেরণ করলেন। কবুল হুসেন তুর্কমান শের খানকে জানালেন মুঘল সম্রাট সন্ধি করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।

হুমায়ুনের পক্ষ থেকে শের খানকে সন্ধির জন্য বেশ কিছু শর্ত দেয়া হলো। শের খান সম্রাটের সব শর্ত মেনে নিয়ে হুমায়ুনকে বার্তা পাঠালেন,

‘আমি গৌড় অধিকার করে নিয়েছি। আমার পেছনে বিশাল এক আফগান সেনাবাহিনী আছে। এখন সম্রাট যদি বাংলা আক্রমণ থেকে বিরত থাকেন, তাহলে আমিও সম্রাটের নিকট বিহার অর্পণ করে দিতে রাজি আছি। তিনি যাকেই বিহারের ক্ষমতায় বসান না কেন, আমি তার হাতেই বিহার ছেড়ে দিবো। সুলতান সিকান্দারের শাসনামলের বাংলার সীমানা মেনে চলবো আমি। বাংলা থেকে নিয়মিত বার্ষিক ১০ লাখ মুদ্রাও কর দিবো আমি। তবে শর্ত শুধু একটিই। সম্রাটকে বাংলা অভিযান পরিত্যাগ করে আগ্রা ফিরে যেতে হবে।’

শের খান সম্রাটকে বাংলা থেকে প্রাপ্ত রাজকীয় সিলমোহরও পাঠিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি করেছিলেন, বিনিময়ে শের খানের শর্ত ছিলো একটিই। সম্রাট অবশ্যই সেনাবাহিনীসহ আগ্রা ফিরে যেতে হবে।

শের খান; Image Source: thefamouspeople.com

আসলে শের খান তখনো মুঘল সাম্রাজ্যের সাথে সরাসরি যুদ্ধে নামতে প্রস্তুত ছিলেন না, এবং তিনি সম্রাট হুমায়ুনকে বেশ শ্রদ্ধা করতেন। তিনি সত্যিকার অর্থেই সম্রাটের সাথে সমস্ত বিভেদ মিটিয়ে নেয়ার চেষ্টা চালাতে লাগলেন।

এদিকে, সম্রাট হুমায়ুন আর শের খানের মাঝে যখন দূত চালাচালির ঘটনা ঘটছে, তখনই আরেকটা ঘটনা ঘটলো যা ইতিহাসের গতিই চিরদিনের জন্য পরিবর্তন করে দিলো। বাংলার পরাজিত সুলতান গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ শাহ এ সময় চুনারের কাছাকাছি দরবেশপুর নামক স্থানে সম্রাট হুমায়ুনের সাথে সাক্ষাৎ করলেন।

তিনি সম্রাটকে বোঝাতে সক্ষম হলেন যে, শের খান শুধুমাত্র গৌড়ই দখল করতে পেরেছেন এবং তখনো বাংলার বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড তার অধীনেই আছে। তিনি বাংলার রাজধানী পুনরুদ্ধার করতে চাইলে বাংলার জনগণ তাকে অকাতরে সহায়তা করবে।

গৌড়ের প্রবেশপথ; Image Source: Wikimedia Commons

গিয়াস উদ্দিন মুহাম্মদ শাহ সম্রাটকে এটাও বোঝালেন, বাংলায় সম্রাটের বাহিনীর রসদের কোনো অভাব হবে না।

বাংলার সুলতান মুঘল সম্রাটকে এসকল তথ্য দিলেন বটে, তবে বাস্তবতা সত্যিকার অর্থে অন্যরকম ছিলো।

এদিকে সম্রাট বাংলার সুলতানের কথা শুনে তার প্রতি বেশ সহানুভূতিশীল হয়ে পড়লেন। তিনি সুলতানকে সাহায্য করাকে নিজের দায়িত্ব মনে করলেন। শেষপর্যন্ত, তিনি বাংলায় অভিযান চালিয়ে বাংলার মসনদে গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ শাহকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা সিদ্ধান্ত নিলেন।

সম্রাটের উদ্দেশ্য খারাপ ছিলো না, তবে সম্রাট এক্ষেত্রে একটি ভুল করে ফেললেন। তিনি সুলতান গিয়াস উদ্দিন মুহাম্মদ শাহের তথ্য যাচাই করেও দেখলেন না। আর মুঘল গোয়েন্দারাও সম্রাটকে সঠিক তথ্য সরবরাহে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হলেন।

শের খানের সাথে সম্পূর্ণ নিশ্চিত একটি সন্ধি আলোচনা বন্ধ করে সম্রাট হুমায়ুন বাংলা আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে লাগলেন।

শের খান যখন শুনলেন সম্রাট বাংলায় অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তখন সম্রাটের উপর থেকে তার বিশ্বাস একেবারেই উঠে গেলো। সমস্ত আফগানরা ধরে নিলো, মুঘল সম্রাটের কথার কোনো মূল্য নেই।

সম্রাট হুমায়ুনের এই সিদ্ধান্ত সমগ্র মুঘল সাম্রাজ্যকে একটি হাস্যরসের বস্তু হিসেবে পরিণত করলো। উল্লেখ্য, সম্রাট হুমায়ুন ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়, একই রকম আচরণ করেছিলেন মাণ্ডুতে। বাহাদুর শাহের সাথে চুক্তি করার পরও তিনি মাণ্ডুতে অভিযান চালিয়ে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিলেন।

গুজরাটিরা এরপর থেকে মুঘল সাম্রাজ্যকে আর কখনোই বিশ্বাস করেনি। তারা মুঘলদের ঘৃণা করতো। এমনকি পরবর্তীতে গুজরাট থেকে মুঘলদের লেজ গুটিয়ে পালানোর পেছনে সম্রাটের সেই মাণ্ডুর সিদ্ধান্তের অনেক প্রভাব ছিলো।

শের শাহের সাথে প্রায় নিশ্চিত সন্ধির কথাবার্তা চলার পরও সম্রাট কেন হুট করে সন্ধি আলোচনা ভেস্তে দিয়ে বাংলায় অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিলেন, তা বেশ রহস্যময় একটি ব্যাপার।

মুঘল সম্রাট হুমায়ুন; Image Source: Wikimedia Commons

এই ঘটনার পেছনে সম্রাট হুমায়ুনের ব্যক্তিগত বিচক্ষণতার অভাব যেমন ছিলো, তেমনই কিছুটা দোষ ছিলো শের খানেরও। সন্ধির শর্ত পালনের ব্যাপারে শের খানকে তেমন আন্তরিক মনে হয়নি। এমনকি মুঘল যোদ্ধারা যখন রোহতাস দুর্গের দখল বুঝে নিতে গিয়েছিলেন, তাদের সেখান থেকে শূন্য হাতে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিলো।

তাছাড়া, সম্রাট দেরিতে হলেও শের খানের উচ্চাকাঙ্ক্ষা টের পেয়েছিলেন। তিনি নিজ ইচ্ছায় শের খানকে কোনো সুযোগই দিতে রাজি ছিলেন না।

এখন যেহেতু স্বয়ং বাংলার সুলতান তার কাছে সাহায্য চাইছে, সেক্ষেত্রে সম্রাটের বাংলা অভিযানের জন্য যথাযথ একটি কারণ হাতে চলে এসেছে। সম্রাট হুমায়ুন এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইছিলেন না।

আসলে মূল কথা হলো, সম্রাট হুমায়ুন শের খানকে বিশ্বাস করতেন না। তিনি জানতেন শের খান তাকে মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে ভেতরে ভেতরে শক্তি সঞ্চয় করছে। শের খান ভীষণ উচ্চাকাঙ্ক্ষী একজন শাসক ছিলেন, যার চোখ সবসময়ই হিন্দুস্তানের মসনদের দিকে ছিলো। তাছাড়া, সম্রাট বাবরের হিন্দুস্তান বিজয়ের পর থেকেই আফগানরা পদে পদে মুঘলদের বিরোধীতা করে যাচ্ছিলো।

বার বার তাদের মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেয়া হচ্ছিলো, কিন্তু সামান্য যোগ্য নেতৃত্ব পেলেই তারা আবারও সংঘটিত হয়ে যাচ্ছিলো। এমন একটি শক্তি, যাদের মূল লক্ষ্যই হিন্দুস্তান থেকে মুঘলদের বিতাড়িত করা, তাদের কোনো সুযোগ দেয়াই সম্রাটের কাছে যুক্তিসংগত মনে হলো না।

আর সম্রাটের এ সিদ্ধান্তের পর আফগানরাও বুঝে গেলো, মুঘলরা স্বেচ্ছায় তাদের এক ইঞ্চি জমিও দিতে রাজি না। মুঘলদের সাথে প্রতিযোগীতা করে টিকে থাকার একমাত্র উপায় হচ্ছে যুদ্ধ!

তবে এ ঘটনার পেছনে যত যুক্তিই দাঁড় করানো হোক না কেন, সন্ধি আলোচনা শুরু করার পর কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই তা ভেস্তে দেয়া সম্রাট হুমায়ুনের মতো একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষের জন্য কোনোমতেই উচিত কাজ হয়নি। তার এই সিদ্ধান্তের ফলে তিনি আফগানদের কাছে মিথ্যুক বলে প্রমাণিত হলেন।

আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, তখন পর্যন্ত মুঘল সাম্রাজ্যের মতো অজেয় একটি সাম্রাজ্যের সম্রাটকে কেন শুরুতে সন্ধিবার্তা পাঠাতে হলো? তা-ও সম্পূর্ণ বিনা কারণে! সম্রাট চাইলেই শের খানকে দৌড়ের উপর রাখতে পারতেন। সম্রাট হুমায়ুনের এসকল খেয়ালী সিদ্ধান্তের জন্য গোটা মুঘল সাম্রাজ্যকে দীর্ঘদিন অবর্ণনীয় যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছিল।

১৫৩৮ সালের মে মাসের শুরুতে সম্রাট হুমায়ুন তার বাংলা অভিযান শুরু করলেন। তিনি মুঘল সেনাবাহিনীকে দুটি ভাগে ভাগ করলেন। তরদী বেগ, ইব্রাহীম বায়েজিদের পুত্র জাহাঙ্গীর কুলি বেগ আর মুঈদ বেগের নেতৃত্বে প্রায় ৩০,০০০ অশ্বারোহীর একটি শক্তিশালী বাহিনী মূল বাহিনীর আগেই প্রেরণ করে দিলেন।

মূল সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন সম্রাট হুমায়ুন স্বয়ং।

গঙ্গার তীর ধরে মুঘল সেনাবাহিনী পাটনা পর্যন্ত পৌছলো। কাশিম হুসেন সুলতানকে পাটনার গভর্নর নিয়োগ দিয়ে মুঘল সেনাবাহিনী মুঙ্গেরের পথ ধরলো।

ঘটনাক্রমে শের খান এসময় পাটনার নিকটবর্তী একটি গ্রামে হাতে গোনা কয়েকজন আফগানকে নিয়ে অবস্থান করছিলেন। ইতোমধ্যেই তিনি তার মূল বাহিনী রোহতাস দুর্গে পাঠিয়ে দিয়েছেন।

মুঘল গোয়েন্দারা এ তথ্য জানালে পরের দিন শের খানকে ধাওয়া করে একটি ক্ষুদ্র বাহিনী প্রেরণ করা হয়। শের খানকে ধাওয়ার সংবাদ পেয়ে সইফ খান শের খানকে পালানোর সুযোগ করে দিতে গুরগড় নামক স্থানে অবস্থান করলেন।

শের খানকে আফগানরা তাদের জাতীয় নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। নিজেদের জীবনের বিনিময়ে হলেও তারা তাদের নেতার জীবন রক্ষা করবে।

গুরগড়ে মুঘল যোদ্ধারা সইফ খানের বাহিনীর মুখোমুখি হলেন। সইফ খান প্রচণ্ড সাহস আর বীরত্বের সাথে মুঘল যোদ্ধাদের মুকাবিলা করলেন। থেমে থেমে দুপুর পর্যন্ত সংঘর্ষ হলো। এ সংঘর্ষে সইফ খানের প্রায় ৩০০ জন যোদ্ধা নিহত হলেন। তারা প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে সইফ খানের আত্মীয় ছিলেন।

সইফ খান নিজেও মারাত্মক আহত হয়েছিলেন। সইফ খান যখন মুঘল যোদ্ধাদের হাতে বন্দী হলেন, তখন বোঝা যাচ্ছিলো না তিনি জীবিত না মৃত। তবে খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, তার শ্বাস-প্রশ্বাস তখনও চলছিলো।

বন্দী করে সইফ খানকে মুঈদ খানের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হলো।

ইতোমধ্যে সইফ খানের বীরত্বের কথা গোটা সেনাবাহিনীতে রটে গিয়েছিলো। স্বয়ং সম্রাট হুমায়ুন তার বীরত্ব আর সাহসের কথা শুনলেন। তিনি সইফ খানকে নিজের চোখে দেখতে চাইলেন।

সইফ খানকে সম্রাটের সামনে উপস্থিত করা হলো। সম্রাট আবারও তার বীরত্বের কাহিনী শুনলেন। সম্রাট এরপর উচ্চস্বরে ঘোষণা দিলেন, প্রত্যেক সৈনিকেরই সইফ খানের মতো হওয়া প্রয়োজন।

সম্রাট সইফ খানের বীরত্বে সত্যিই বেশ মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি সইফ খানকে বললেন, আমি তোমাকে মুক্তি দিলাম। তোমার যেখানে ইচ্ছা সেখানে চলে যেতে পারো।

আহত সইফ খান দুর্বল কিন্তু স্পষ্ট কন্ঠে জানালেন, আমার পরিবারবর্গ শের খানের কাছে আছে। আমি আমার প্রভুর কাছে ফেরত যেতে চাই।

সম্রাট হুমায়ুন বললেন, যেমনটা বলেছি, আমি তোমাকে মুক্তি দিয়ে দিয়েছি। তুমি যেখানে ইচ্ছা সেখানেই যেতে পারো।

মুঘল সেনাবাহিনী আবারও যাত্রা শুরু করলো। পাটনা থেকে মুঙ্গের হয়ে মুঘল সেনাবাহিনী ভাগলপুর পৌঁছালো। ভাগলপুর থেকে মুঘল সেনাবাহিনী কহলগাঁও পৌঁছলো। কহলগাঁও থেকে জাহাঙ্গীর কুলি বেগ আর বৈরাম খান প্রায় ৬,০০০ অশ্বারোহী নিয়ে মূল সেনাবাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন। তারা মূল সেনাবাহিনীর অগ্রগামী বাহিনী হিসেবে যাত্রা শুরু করলেন।

মুঘল সেনাবাহিনী আবারও যাত্রা শুরু করলো। এবার লক্ষ্য তেলিয়াগড়ি।

শের খান যখন সম্রাট হুমায়ুনের বাংলায় অভিযান চালানোর সিদ্ধান্তের সংবাদ পেয়েছিলেন, তখনই তার পুত্র জালাল খানের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী বাহিনীকে তেলিয়াগড়িতে মোতায়েন করে দেন। তেলিয়াগড়ির গিরিপথ বিহার আর বাংলার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। মুঘল সেনাবাহিনীকে যদি বাংলায় প্রবেশ করতে হয়, তা হলে এই পথই পাড়ি দিয়ে যেতে হবে।

আফগানরা সত্যিই তেলিয়াগড়িতে ছিলো। শের খানের পুত্র জালাল খানের নেতৃত্বে প্রায় ১৩,০০০ দক্ষ অশ্বারোহী তেলিয়াগড়িতে মুঘলদের বাঁধা দিতে অবস্থান করছিলো। জালাল খানের উপর সরাসরি নির্দেশ দেয়া আছে। কোনোভাবেই মুঘলরা যেন তেলিয়াগড়ি পার হতে না পারে।

গৌড়ের রাজকোষ তখনো নিরাপদে সরিয়ে নেয়া সম্ভব হয়নি। এই রাজকোষ রোহতাস দুর্গে না পৌঁছানো পর্যন্ত যেভাবেই হোক, মুঘলদের ঠেকাতে হবে। শের খান নিজের পুত্রকে সহায়তা করতে মুসাহিব খানকে প্রেরণ করলেন।

জালাল খান কিছুটা চিন্তিত। তিনি নিশ্চিত তেলিয়াগড়িয়ে বেশ ভালো রক্তপাত হতে যাচ্ছে।

জালাল খান তার সেনাবাহিনীকে রক্ষণাত্মক সাজে সাজিয়ে ফেললেন। বাংলায় যেতে হলে মুঘলদের অবশ্যই এই গিরিপথ পাড়ি দিতে হবে। জালাল খান গিড়িপথের আশেপাশের পাহাড়ের উপর কামান মোতায়েন করে দিলেন।

মুঘল গোয়েন্দারা জালাল খানের এই রক্ষণাত্মক বুহ্যের খবর জানাতে সক্ষম হলেন। মুঘল সেনাবাহিনী সতর্ক হয়ে গেলো।

তেলিয়াগড়ি থেকে কিছুটা দূরে সম্রাট হুমায়ুন তার রাজকীয় শিবির ফেললেন।

সম্রাট হুমায়ুন জাহাঙ্গীর বেগকে দায়িত্ব দিলেন তেলিয়াগড়ির গিরিপথ পরিষ্কার করতে। জাহাঙ্গীর বেগ গিরিপথের দিকে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে তাবু ফেললেন। জাহাঙ্গীর বেগের নেতৃত্বাধীন মুঘল সেনাবাহিনী কয়েকদিন শিবিরে অবস্থান করলো। এসময় দূর থেকে আফগান আর মুঘল যোদ্ধারা একে অন্যকে ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ করতে লাগল।

এদিকে জালাল খান আক্রমণের জন্য তোড়জোড় করতে লাগলেন। তার উপর শের খানের কঠোর নির্দেশ ছিলো যেন আগে আক্রমণ পরিচালনা না করেন। কিন্তু পাল্টাপাল্টি ব্যাঙ্গ বিদ্রুপের একপর্যায়ে তিনি ধৈর্য্য হারিয়ে ফেললেন। শের খানের নির্দেশ ভুলে ৬,০০০ সৈন্য নিয়ে হঠাৎ করেই মুঘল শিবিরে আক্রমণ করে বসলেন। এই ঘটনা ১৫৩৮ সালের জুলাই মাসের ঘটনা।

বৈরাম খান জালাল খানের এই তীব্র আক্রমণের মুকাবিলা করলেন। তিনি চরম ধৈর্য্য, প্রচণ্ড সাহস আর বীরত্ব প্রদর্শন করলেন। তবে মুঘল সেনাবাহিনীর পরাজয় ঠেকাতে পারলেন না। জালাল খান তার বাহিনী নিয়ে বিধ্বস্ত হলেন বটে, তবে মুঘল সেনাবাহিনীরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে গেলো এই যুদ্ধে। জাহাঙ্গীর বেগ এ যুদ্ধে মারাত্মক আহত হলেন।

হুমায়ুনকে এই পরাজয়ের খবর দেয়া হলো। কিন্তু তিনি তাৎক্ষণিক কোনো পাল্টা অভিযান চালাতে পারলেন না। আবহাওয়া খারাপ থাকায় সম্রাট হুমায়ুনকে কিছুদিন ধৈর্য্যধারণ করতে হলো।

এদিকে, জালাল খান গৌড়ের পথরোধ করে শক্ত অবস্থান নিয়ে বসে রইলেন। আবহাওয়ার কিছুটা উন্নতি হলে সম্রাট হুমায়ুন স্বয়ং মূল সেনাবাহিনী নিয়ে গিরিপথের দিকে অগ্রসর হলেন। জালাল খান বুঝলেন, এবার আর গিরিপথ আগলে রাখা যাবে না। তিনি জঙ্গলে পালিয়ে গেলেন।

রোহতাস দুর্গের একাংশ; Image Source: Wikimedia Commons

ইতোমধ্যেই শের খান বাংলার রাজকোষ ঝাড়খণ্ড হয়ে রোহতাস দুর্গে সরিয়ে নিলেন। জালাল খান রোহতাস দুর্গের দিকে চলে গেলেন।

মুঘল সেনাবাহিনী এরপর কহলগাঁওতে যাত্রাবিরতি করলো। কহলগাঁওতে একটি দুঃসংবাদ এসে পৌছলো।

শের খানের আফগান বাহিনী বাংলার সুলতান গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ শাহের দুই পুত্রকে হত্যা করে ফেলেছে। গৌড় পরাজয়ের সময় সুলতানের এই দুই পুত্র শের খানের হাতে ধরা পরেছিলো।

বাংলার মসনদ হারিয়ে সুলতান গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ শাহ এমনিতেই মানসিক দিক দিয়ে দুর্বল হয়ে পরেছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়নের সময় তিনি ছিলেন প্রচন্ড আহত। মানসিক এবং শারিরীকভাবে আহত হয়েও সুলতান গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ শাহ প্রবল আশায় বুক বেঁধে বেঁচে ছিলেন। কিন্তু এবার আর একই সাথে দুই পুত্র হারানোর শোক সামলাতে পারলেন না তিনি। মুঘল শিবিরে মৃত্যুবরণ করলেন বাংলার সুলতান গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ শাহ।

সুলতানকে সাদুল্লাপুরে পূর্ণ মর্যাদার সাথে সমাহিত করা হলো।

হোসেন শাহী স্থাপত্য রীতির ছোয়ায় গৌড়ের সবথেকে বড় মসজিদ ‘বড় সোনা মসজিদ’ ; Image Source:  double-dolphin.blogspot.com

এরপর সম্রাট হুমায়ুন আবার গৌড় অভিমুখে যাত্রা করলেন। তিনি প্রায় বিনা বাঁধাতেই গৌড়ের অধিকার বুঝে নিলেন।

গৌড়ের বড় সোনা মসজিদের এই জায়গাটিতে একসময় নিয়মিত সালাত আদায় করা হতো। আজ জায়গাটি শুধুই একটি ধ্বংসস্তুপ; Image Source: double-dolphin.blogspot.com

অবশেষে ১৫৩৮ সালের জুলাই মাসের শেষের দিকে বাবরপুত্র দ্বিতীয় মুঘল সম্রাট নাসির উদ্দিন মুহাম্মদ হুমায়ুন তার বাংলা জয় সম্পন্ন করলেন। বাংলা তো জয় হলো, এটা সত্য। কিন্তু সম্রাট নিজেও বুঝতে পারলেন না তিনি কিছুদিনের মাঝেই ভয়ানক এক ফাঁদে পড়তে যাচ্ছেন! সে আলোচনা যথাসময়ে করা হবে।

তথ্যসূত্র

১। মোগল সম্রাট হুমায়ুন, মূল (হিন্দি): ড হরিশংকর শ্রীবাস্তব, অনুবাদ: মুহম্মদ জালালউদ্দিন বিশ্বাস, ঐতিহ্য প্রকাশনী, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারী ২০০৫

২। তারিখ-ই-শের শাহ; মূল: আব্বাস সারওয়ানী, অনুবাদ গ্রন্থের নাম: শের শাহ, অনুবাদক: সাদিয়া আফরোজ, সমতট প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারী ২০১৫

৩। রিয়াজ-উস-সালাতীন, মূল লেখক: গোলাম হোসায়ন সলীম, অনুবাদ গ্রন্থের নাম: বাংলার ইতিহাস, অনুবাদক: আকবরউদ্দীন, অবসর প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারী ২০০৮

৪। হুমায়ুননামা, মূল: গুলবদন বেগম, অনুবাদ: এ কে এম শাহনাওয়াজ, জ্ঞানকোষ প্রকাশনী, প্রকাশকাল: জানুয়ারী ২০১৬

 

এই সিরিজের আগের পর্বসমূহ

১। প্রাক-মুঘল যুগে হিন্দুস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা || ২। তরাইনের যুদ্ধ: হিন্দুস্তানের ইতিহাস পাল্টে দেওয়া দুই যুদ্ধ || ৩। দিল্লী সালতানাতের ইতিকথা: দাস শাসনামল || ৪। রাজিয়া সুলতানা: ভারতবর্ষের প্রথম নারী শাসক || ৫। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: খিলজী শাসনামল || ৬। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: তুঘলক শাসনামল || ৭। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: তৈমুরের হিন্দুস্তান আক্রমণ ও সৈয়দ রাজবংশের শাসন || ৮। দিল্লী সালতানাতের ইতিকথা: লোদী সাম্রাজ্য || ৯। রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনীর গঠন এবং গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস || ১০। রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত কিছু অস্ত্রশস্ত্র || ১১। জহির উদ-দিন মুহাম্মদ বাবুর: ‘একজন’ বাঘের উত্থান || ১২। বাদশাহ বাবরের কাবুলের দিনগুলো || ১৩। বাদশাহ বাবর: হিন্দুস্তানের পথে || ১৪। বাদশাহ বাবরের হিন্দুস্তান অভিযান: চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি || ১৫। মুঘল সাম্রাজ্যের উত্থান: হিন্দুস্তানে বাবরের চূড়ান্ত লড়াই || ১৬। খানুয়ার যুদ্ধ: মুঘল বনাম রাজপুত সংঘাত || ১৭। ঘাঘরার যুদ্ধ: মুঘল বনাম আফগান লড়াই || ১৮। কেমন ছিল সম্রাট বাবরের হিন্দুস্তানের দিনগুলো? || ১৯। মুঘল সম্রাট বাবরের মৃত্যু: মুঘল সাম্রাজ্য এবং হিন্দুস্তানের উজ্জ্বল এক নক্ষত্রের অকাল পতন || ২০। সিংহাসনের ষড়যন্ত্র পেরিয়ে মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের অভিষেক || ২১। মুঘল সাম্রাজ্যের নতুন দিগন্ত: সম্রাট হুমায়ুনের ঘটনাবহুল শাসনামল ||  ২২। দিল্লি সালতানাত থেকে মুজাফফরি সালতানাত: প্রাক-মুঘল শাসনামলে গুজরাটের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস || ২৩। মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের গুজরাট অভিযানের প্রেক্ষাপট || ২৪। সম্রাট হুমায়ুনের গুজরাট অভিযান: সুলতান বাহাদুর শাহের পলায়ন || ২৫। সম্রাট হুমায়ুনের গুজরাট অভিযান ও গুজরাটের পতন || ২৬। গুজরাট থেকে মুঘলদের পলায়ন: মুঘল সাম্রাজ্যের চরম লজ্জাজনক একটি পরিণতি || ২৭। শের খান: হিন্দুস্তানের এক নতুন বাঘের উত্থানের গল্প || ২৮। শের খানের বাংলা অভিযান || ২৯। গুজরাটের সুলতান বাহাদুর শাহ হত্যাকাণ্ড: সাম্রাজ্যবাদী পর্তুগীজদের বিশ্বাসঘাতকতার একটি নিকৃষ্ট উদাহরণ || ৩০। শের খানের বাংলা বিজয়

ফিচার ইমেজ: lonesome-traveler.de

Related Articles

Exit mobile version