গুপ্তহত্যার শাব্দিক অর্থ হলো অপ্রস্তুত অবস্থায় কারো উপর অতর্কিত আক্রমণ করা বা গোপনে যেকোনো কৌশল অবলম্বন করে হত্যাকার্য সম্পন্ন করা। তবে গুপ্তহত্যা শব্দটি কোনো সেলিব্রেটি, রাজনীতিবিদ, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব অথবা কোনো রাজকীয় সম্মানে ভূষিত ব্যক্তিকে গোপনে হত্যা করার ক্ষেত্রে জড়িত। এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের পেছনে কোনো সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য থাকে। সাধারণত রাজনৈতিক দম্ভের লড়াই বা ঈর্ষা, উগ্র ধর্মীয় আদর্শবাদ, চুক্তিভিত্তিক হত্যাকাণ্ড, প্রতিশোধ, শাসকদের মাঝে ক্ষমতার লড়াই, এমনকি খ্যাতি প্রচারের উদ্দেশ্য ইত্যাদি মনোবাসনা পূরণের লোভেই এসব গুপ্তহত্যার ঘটনা ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিয়েছে।
আজ আমরা ইতিহাস বিখ্যাত কয়েকজন নারী রাজনীতিবিদের কথা জানবো, যারা গুপ্তহত্যার শিকার হয়েই অকালে প্রাণ হারিয়েছেন। চরম নৃশংস ছিল এসব হত্যাকাণ্ড। প্রকাশ্য রাস্তায় গুলি করে কিংবা আত্মঘাতী বোমার আঘাতে হত্যা করা হয়েছে তাদের কিংবা অবলম্বন করা হয়েছে সুনিপুণ কোনো প্ল্যান। চলুন জেনে নিই গা শিউরে উঠা এসব হত্যাকাণ্ডের মাঝ দিয়ে কারা চিরবিদায় নিয়েছেন আমাদের মাঝ থেকে।
সাদো আলি ওয়ারসেম (সোমালিয়া)
ওয়ারসেম ২০১২ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মিনেয়াপোলিস শহরের সুপরিচিত এবং জনপ্রিয় গায়িকার খেতাব কুড়িয়ে এসেছিলেন। কিন্তু কী খেয়ালের বশে তা কে-ই বা জানে, ২০১২ সালে তিনি পাড়ি জমালেন সোমালিয়াতে। হয়তোবা মৃত্যুর হাতছানি! ঐ বছরই ফেডারেল পার্লামেন্টের সদস্য হন ওয়ারসেম। ক্ষমতায় থাকাকালীন ২০১৪ সালে অ্যাম্বাস্যাডর হোটেলের নিকটবর্তী মোগাদিসু নামক স্থানে ওয়ারসেমকে হত্যা করে জঙ্গিরা। এক প্রত্যক্ষদর্শী জানায়, আততায়ী প্রাইভেট কারের ভেতরে থেকেই তাকে লক্ষ্য করে বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি ছোঁড়ে এবং ততক্ষণাৎ পালিয়ে যায়।
জো কক্স (ব্রিটেন)
ব্রেক্সিট নিয়ে যখন ব্রিটেনে চলছিল সরগরম অবস্থা, ঠিক তখনই, ২০১৬ সালের ১৬ জুন তারিখে আততায়ীদের হাতে খুন হন ব্রিটেনের লেবার পার্টির প্রথম সারির সংসদ সদস্য জো কক্স। নিজের নির্বাচনী এলাকা ওয়েস্ট ইয়র্কশায়ারের ব্রিস্টল লাইব্রেরির সামনে বৈঠক করছিলেন এই নেত্রী। ঠিক ঐ মুহূর্তে আততায়ীরা প্রকাশ্যে খুব কাছ থেকে প্রথমে তাকে গুলি করে এবং পরে ছুরিকাঘাতে একাধিকবার জখম করে। অবস্থা এতটাই গুরুতর হয়েছিল যে, তাৎক্ষণিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও তাকে বাঁচানো সম্ভবপর হয় নি। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৪২ বছর।
তিনি যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়নে থেকে যাওয়ার পক্ষে জোর সমর্থন চালাচ্ছিলেন। পঞ্চাশোর্ধ্ব এক ব্যক্তি তাকে খুব কাছ থেকে গুলি করার পরে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ হত্যাকারীকে গ্রেফতার করে। পুলিশ মারফত জানা যায়, হত্যাকারীর নাম থমাস আলেকজান্ডার মেয়ার এবং সে জন্মসূত্রে একজন স্কটিশ। সে এ ধরনের আরো হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ায় আদালত তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে।
ইন্দিরা গান্ধী (ভারত)
ইন্দিরা গান্ধীর পুরো নাম ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী গান্ধী নেহরু। তিনি ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর একমাত্র কন্যা। ইন্দিরা গান্ধী প্রথমবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পান ১৯৬৬ সালে। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে আসীন ছিলেন তিনি। দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হন ১৯৮০ সালে এবং ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর ক্ষমতায় থাকাবস্থায় তিনি খুন হন। তিনি ছিলেন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের শীর্ষ নেত্রী। তাকে গুলি করে হত্যা করে তার দুই শিখ দেহরক্ষী সতওয়ান্ত সিং ও বেয়ান্ত সিং।
১৯৮৪ সালের জুন মাসের প্রথম দিকে ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে পাঞ্জাবের অমৃতসরে শিখদের স্বর্ণমন্দিরে ‘অপারেশান ব্লু স্টার’ নামে ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক সামরিক অভিযান পরিচালিত হয়। সে অভিযান শিখ সমাজকে ইন্দিরা সরকারের প্রতি বিক্ষুব্ধ করে তোলে। ধারণা করা হয়, সেই ক্ষোভের জের ধরেই ইন্দিরা গান্ধী খুন হন তার দুই শিখ দেহরক্ষীর হাতেই। অন্যান্য দেহরক্ষীরা বেয়ান্ত সিংকে ঘটনাস্থলে গুলি করে হত্যা করে আর সতওয়ান্ত সিংকে গ্রেফতার করে। সতওয়ান্ত সিংকে পরবর্তীতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ইন্দিরা গান্ধীই ভারতের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী এবং দ্বিতীয় দীর্ঘতম সময়ের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
আগাথে উইলিঙ্গিমানা (রুয়ান্ডা)
আগাথে উইলিঙ্গিমানা ছিলেন এযাবতকালের রুয়ান্ডার প্রথম এবং একমাত্র নারী প্রধানমন্ত্রী। ম্যাডাম আগাথে নামেই দেশবাসীর কাছে বিপুল জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। তিনি শিক্ষকতা পেশায় জড়িত ছিলেন। বুটেয়ারি একাডেমিক স্কুলে চার বছর রসায়নের শিক্ষিকা হিসেব কাজ করেন তিনি। ১৯৮৬ সালে বুটেয়ারি একাডেমিক স্কুলের সহকর্মী ও স্টাফদের নিয়ে সোরিওরিটি এবং ক্রেডিট কো-অপারেটিভ সোসাইটি নামে সংগঠন গড়ে তোলেন।
১৯৮৯ সালে তিনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পরিচালক হিসেবে নিয়োজিত হন। ১৯৯২ সালে তিনি রাজনীতিতে যোগ দেন। রিপাবলিকান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (এমডিআর) দলের একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে কাজ শুরু করেন আগাথে। তখন দলটি বিরোধী দলে ছিল। এর চার মাস পর সরকারী দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণে ব্যর্থ হলে তার দল সহ পাঁচটি বিরোধী দল মিলে সরকার গঠন করা হয়। উইলিঙ্গিমানাকে সে সরকারের শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে শিক্ষায় জাতিগত কোটা পদ্ধতির বিলুপ্তি, মেধার ভিত্তিতে সরকারী স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ এবং মেধাবীদের বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা করেন তিনি। রুয়ান্ডার অন্যতম জাতিগোষ্ঠী হুতুরা সহ চরমপন্থী দলগুলো এসব সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধীতা জানায় এবং উইলিঙ্গিমানাকে তাদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে।
১৯৯৩ সালের ১৭ জুলাই রাষ্ট্রপতি এবং সরকারের অন্যান্য পাঁচটি দলের মধ্যে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে উইলিঙ্গিমানাকে পরবর্তী নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এর কিছুদিন পরেই রুয়ান্ডার চরমপন্থীরা ১৯৯৪ সালের ৬ এপ্রিল রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্টের বিমান উড়িয়ে দেয়। সেই বিমান দুর্ঘটনায় প্রেসিডেন্টের মৃত্যু ঘটে। এই ঘটনার পরের দিনই আগাথে উইলিঙ্গিয়ামানা ও তার পরিবারকে নিজ বাসভবনে গুলি করে হত্যা করে সে দেশের চরমপন্থীরা। এই হত্যাকাণ্ডের পরপরই শুরু হয় রুয়ান্ডার চরমপন্থীদের ব্যাপক গণহত্যা।
বেনজির ভুট্টো (পাকিস্তান)
পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) নেত্রী বেনজির ভুট্টো ২০০৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর রাওয়ালপিন্ডির লিয়াকত ন্যাশনাল বাগ পার্কে নির্বাচনী সমাবেশ ও র্যালি শেষে গাড়িতে ওঠার পরেই এক আত্মঘাতী হামলায় নিহত হন। আততায়ী প্রথমে তার ঘাড়ে গুলি করে। তারপরেও তাদের চেষ্টা সফল হয়নি ভেবে আশপাশের স্থান থেকে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় তারা।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, যে আততায়ী গুলি করেছিল, সে নিরাপত্তারক্ষীদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। তাৎক্ষণিকভাবেই হাসপাতালে নেওয়ার পথে বেনজির ভূট্টো মারা যান। রাওয়ালপিন্ডির জেনারেল হাসপাতাল থেকে রিপোর্ট পেশ করা হয় যে, তার বুকে এবং ঘাড়ে গুলি লাগার কারণেই মৃত্যু ঘটে। বেনজির ভুট্টো যেখানে আক্রমণের শিকার হয়ে নিহত হন, ঠিক একই স্থানে পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ১৯৫১ সালে আততায়ীদের হাতে নিহত হন। নির্বাসন জীবনের সমাপ্তি টেনে ২০০৮ সালের নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ভুট্টো। এর আগে তিনি দু’বার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।