২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর, তথা ৯/১১ বা নাইন ইলেভেন-এর সাথে বিশ্ববাসী কমবেশি পরিচিত। একবিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে ঐ দিনে সংঘটিত রক্তাক্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আগ্রাসনের এক নতুন যুগের সূচনা হয়। তবে পৃথিবীর সবচেয়ে সরু রাষ্ট্র চিলির ইতিহাসে ঐ দিনটি ভিন্ন অর্থ বহন করে। কারণ, ১৯৭৩ সালের ঠিক একই দিনে চিলি গণতান্ত্রিক সার্বভৌমত্ব হারিয়ে পরিণত হয় পরনির্ভরশীল এক স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রে। গণতন্ত্রের ঐ সংহরণ আর স্বৈরতন্ত্রের উত্থান ছিল যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা পুরোদমে সমর্থিত এবং সিআইএ কর্তৃক সুপরিকল্পিত।
১১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩ সাল, চিলি বিমানবাহিনীর জঙ্গিবিমান তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সালভাদর আলেন্দের সরকারি বাসভবন লা মোনেডা প্রাসাদে একাধিক বোমাবর্ষণ করে। সেনাবাহিনী কামান ও অন্যান্য যুদ্ধযানে সজ্জিত হয়ে বেরিয়ে পড়ে রাজধানী সান্তিয়াগোর রাস্তায়। গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতার জন্য পরিচিত রাষ্ট্রটি স্বীয় সামরিক বাহিনীর হাতে খুন হতে চলছিল। গণতন্ত্রকে নিক্ষেপ করা হয়েছিল আবর্জনার ভাগাড়ে। চিলির সেনাবাহিনীর উক্ত বিদ্রোহী আচরণের কেন্দ্রে ছিলেন তৎকালীন সেনাপ্রধান অগাস্টো পিনোশে। তার নেতৃত্বে সেনাবাহিনী সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে সম্পূর্ণ চিলি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় এবং রাষ্ট্রপতির ভবন ঘেরাও করে ফেলে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি আলেন্দেকে ক্ষমতাচ্যুত করা।
বাসভবনে অবরুদ্ধ সালভাদর আলেন্দে তার অফিসকক্ষে বন্দুক হাতে মৃত্যুর প্রহর গুনছিলেন। তিনি জানতেন, যখন তিনি মারা যাবেন, চিলির গণতন্ত্রও তার সাথে মারা যাবে। কিন্তু বিদ্রোহী সেনাদের প্রতিরোধের ক্ষমতা তার নেই। আর ভবিষ্যৎ ছিল পরিষ্কার। তাই পিনোশে কিংবা তার সৈন্যদের হাতে নির্মম ও অপমানজনক মৃত্যুর চেয়ে তিনি আত্মহত্যাকে শ্রেয় মনে করলেন। আলেন্দে নিজের হাতে থাকা একে-৪৭ দিয়েই নিজেকে গুলি করেছিলেন।
১১ সেপ্টেম্বরের উক্ত সেনা অভ্যুত্থান সম্পূর্ণ সফল হয়। জেনারেল অগাস্টো পিনোশে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। একইসাথে সেনা অভ্যুত্থানের গোপন মদদদাতা যুক্তরাষ্ট্র একজন পুতুল সরকারপ্রধান পেয়ে যায়, যিনি কিনা গোটা চিলিকে বিনাশর্তে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেবেন। সালভাদর আলেন্দের বিপক্ষে সেনা অভ্যুত্থানের মূল কারণ ছিল চিলিতে সমাজতন্ত্রের প্রসার রোধ করে গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনা। কিন্তু পিনোশের অধীনে উক্ত গণতন্ত্রকে রাজপথে হত্যা করা হয়। চিলির সাধারণ জনগণ পরবর্তী দুই দশকের জন্য প্রবেশ করে এক বিভীষিকাময় মৃত্যুপুরীতে। সেখানে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ মানবাধিকারকে গণকবর দিয়েছিল।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর সালভাদর আলেন্দেকে অবশ্যই মরতে হতো। গণতন্ত্রের সমালোচকদের কাছে, গণতন্ত্র এমন এক সরকার ব্যবস্থা, যেখানে জনগণ সরকার গঠন করলেও ক্ষমতা তাদের হাতে থাকে না। এ কথা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সঠিক। কারণ, ভোটাধিকার এবং রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতা এক জিনিস নয়। রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতা থাকে নির্দিষ্ট কয়েকটি গোষ্ঠীর কাছে। তাই জনগণ ভোট দিয়ে সরকার নির্বাচিত করলেও তাদের চাহিদা অনুযায়ী নয়, বরং ঐ নির্দিষ্ট গোষ্ঠীগুলোর ইচ্ছানুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। আর গণতন্ত্রের এই দুর্বল দিক আলেন্দের ক্ষেত্রে প্রমাণিত হতে চলেছিল।
ব্যক্তিগত জীবনে একজন পেশাদার চিকিৎসক সালভাদর আলেন্দে, রাজনৈতিক মতাদর্শের দিক দিয়ে ছিলেন একজন মার্ক্সবাদী। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে সমাজের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে রাষ্ট্রে সকল নাগরিকের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা করার প্রতিশ্রুতি চিলির সাধারণ জনগণের বেশ মনে ধরে। এই জনপ্রিয়তার দরুন ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার বড় সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। কিন্তু চিলি ও যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাদী গোষ্ঠীগুলো এটা মোটেও ভালো চোখে দেখেনি। কেননা, ব্যালটের ক্ষমতা তো জনগণের হাতে। আর সেই জনগণ যদি ভোট দিয়ে সমাজতন্ত্রকে আমন্ত্রণ জানায়, তবে তা পুঁজিবাদের জন্য মোটেও সুবিধার কথা নয়।
১৯৬১ সালে রাষ্ট্রপতি জন এফ. কেনেডি লাতিন আমেরিকার রাষ্ট্রসমূহে সমাজতন্ত্রের প্রসার রোধকল্পে শত কোটি ডলারের পরিকল্পনা হাতে নেন। তা ইতিহাসে অ্যালায়েন্স ফর প্রগ্রেস নামে পরিচিত। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ১৯৬৪ সালের নির্বাচনে ডানপন্থী পুঁজিবাদী দল ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টির রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী এডওয়ার্ডো ফ্রেকে আর্থিক ও রাজনৈতিক সমর্থন প্রদান করে। সেই নির্বাচনে ফ্রে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন এবং সালভাদর আলেন্দে পরাজয় বরণ করেন। কিন্তু ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পূর্বে আলেন্দের জনপ্রিয়তা দরুন তার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়া সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
সমাজতন্ত্রের আগমনে সর্বজনীন ভোটাধিকার, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতাসহ আরও অনেক মৌলিক অধিকার বিলুপ্ত হবে। ফ্রে তার নির্বাচনী প্রচারণায় আলেন্দের জনপ্রিয়তা কমাবার লক্ষ্যে সমাজতন্ত্রের এই অন্ধকার দিকগুলো তুলে ধরেন। কিন্তু পুঁজিবাদের যাঁতাকলে পিষ্ট সাধারণ জনগণ তার কথায় কান দেয়নি। বরং নতুন কোনো সমাধানের আশায় তারা আলেন্দেকে সমর্থন জানিয়েছিল। আর আলেন্দে ও তার বামপন্থী দল পপুলার ইউনিটি জন-আকাঙ্ক্ষা পূরণে গণতন্ত্রের মোড়কে সমাজতন্ত্রকে উপস্থিত করে। এছাড়া নোবেলবিজয়ী কবি পাবলো নেরুদা এবং তৎকালে জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী ভিক্টর হারার মতো সুপরিচিত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের সরাসরি সমর্থন আলেন্দের জনপ্রিয়তা আরো বৃদ্ধি করে।
আলেন্দের পরাজয় দেশের পুঁজিবাদীদের ভবিষ্যৎ রক্ষা করার জন্য আবশ্যক হয়ে পড়ে। তারা সমাজতান্ত্রিক এই নেতার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার ঠেকানোর জন্য বিভিন্ন প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। যেমন, ইন্টারন্যাশনাল টেলিফোন অ্যান্ড টেলিগ্রাফ কোম্পানির (আইটিটি) পক্ষ থেকে সিআইএ ও হেনরি কিসিঞ্জার বরাবর পত্রযোগে আলেন্দের ক্ষমতায় আরোহণ প্রতিরোধের আবেদন করা হয়। চিলির টেলিফোন যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর আধিপত্য বিস্তারকারী যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠান আলেন্দের কারণে এর বিনিয়োগ হারাবার শঙ্কায় ছিল।
১৯৭০ সালের ৪ সেপ্টেম্বরের নির্বাচনে সালভাদর আলেন্দের দল পপুলার ইউনিটি সর্বোচ্চসংখ্যক ভোট পেলেও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি। ফলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করার দায়িত্ব বর্তায় চিলির জাতীয় কংগ্রেসের উপর। তবে কংগ্রেসের ভোটের জন্য আরও সাত সপ্তাহের মতো অপেক্ষা করতে হতো। ঠিক এ সময়ে আলেন্দের ক্ষমতারোহণ ঠেকানোর জন্য রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন ব্যক্তিগতভাবে সিআইএ প্রধান রিচার্ডসন হেলমকে নির্দেশ দেন। সিআইএ সেনা অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা চালায়। সে প্রচেষ্টা চালাতে গিয়ে তৎকালীন সেনাপ্রধান রেনে স্নাইডারকে হত্যা করা হয়। কেননা, নীতিবান জেনারেল স্নাইডার বিশ্বাস করতেন, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করার অধিকার সেনাবাহিনীর নেই।
সিআইএ-র প্রচেষ্টাকৃত সেনা অভ্যুত্থান সফল হয়নি। বরং ২৪ অক্টোবর চিলির জাতীয় কংগ্রেসের ভোটে সালভাদর আলেন্দে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত সরকারপ্রধান, যিনি কিনা নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্রকে প্রাধান্য দেন। সরকার গঠনের পর তার সৃষ্ট লক্ষ্যগুলো ছিল আর কয়েকজন কমিউনিস্ট নেতার মতোই। তিনি রাষ্ট্রে আয় বৈষম্য হ্রাস, বেকারত্বের বিলুপ্তি এবং শিক্ষা ও চিকিৎসাখাতে জনগণের অংশগ্রহণ সহজীকরণ নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। তবে তার সবচেয়ে বড় লক্ষ্য ছিল চিলিতে আধিপত্য বিস্তারকারী বিদেশি কোম্পানিগুলোর জাতীয়করণ। বিশেষ করে তামা শিল্পের দুই বৃহৎ কোম্পানি অ্যানাকোন্ডা ও কেইনকোট।
যুদ্ধাস্ত্র থেকে গাড়ি, এমনকি নিত্য ব্যবহার্য টিভি-ফ্রিজে তামার ব্যবহার অপরিহার্য। অন্যদিকে পৃথিবীতে তামার সর্বোচ্চ উৎপাদক হলো চিলি। কিন্তু চিলির তামা খনিসমূহের উৎপাদন ও রপ্তানি ছিল অ্যানাকোন্ডা ও কেইনকোট নামক যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দুই কোম্পানির অধীনে। সালভাদর আলেন্দে ক্ষমতায় এসে কয়েকমাসের মধ্যে কংগ্রেসে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে উক্ত কোম্পানি দুটোর জাতীয়করণের ঘোষণা দেন। একইসাথে তিনি বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিপূরণ দিতেও অস্বীকৃতি জানান। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, কোম্পানি দুটো ১৯৫৫ সাল থেকে যে পরিমাণ অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করেছে, তাতে তাদের কোনোপ্রকার ক্ষতিপূরণ পাবার অধিকার নেই। এছাড়া, আইটিটিসহ আরো কয়েকটি কোম্পানির ক্ষতিপূরণ ছাড়াই জাতীয়করণ করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জাতীয়করণের ফলে নিক্সন-কিসিঞ্জার প্রশাসন আরও নড়েচড়ে বসে। কোম্পানিগুলোর জাতীয়করণের ফলে তামা শিল্প হাতছাড়া হওয়ার সাথে সাথে তাদের আরেকটি ভয় ছিল; তা হলো সমাজতন্ত্রের প্রসার। সালভাদর আলেন্দে ছিলেন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। তার নির্বাচন প্রক্রিয়া ছিল বৈধ ও সংবিধানসিদ্ধ। কিন্তু তিনি তো একজন সমাজতন্ত্রী। আর এটাই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য মূল সমস্যা। দক্ষিণ আমেরিকার অন্যান্য রাষ্ট্র যদি চিলির মতো সমাজতান্ত্রিক নেতাদের গণতান্ত্রিকভাবে সরকারপ্রধান নির্বাচিত করতে থাকে, তাহলে তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় বিপর্যয় ডেকে আনবে। ফলে, আলেন্দের পতন নিশ্চিত করা আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়।
ইতোপূর্বে সিআইএ সাবেক সেনাপ্রধান রেনে স্নাইডারকে হত্যা করার মাধ্যমে সেনা অভ্যুত্থানের পথ পরিষ্কার করে রেখেছিল। কিন্তু, খেটে খাওয়া সাধারণ জনগণসহ প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে আলেন্দেপ্রীতির বৃদ্ধি আবারও সেনা অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করে। তাই এবার যুক্তরাষ্ট্র সফল সেনা অভ্যুত্থানের পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার অপেক্ষায় থাকে। সেই বাবদ ১৯৭০ থেকে ১৯৭৩ সালের সেনা অভ্যুত্থান পর্যন্ত, এই তিন বছরে সিআইএ বিভিন্ন খাতে আট মিলিয়ন ডলারেরও বেশি খরচ করে। সাধারণ জনগণ না হোক, অন্তত প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে আলেন্দের জনপ্রিয়তা কমাতে হবে! তাহলেই সফল সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তার পতন নিশ্চিত করা সম্ভব। আর অতি শীঘ্রই যুক্তরাষ্ট্রের অপেক্ষার অবসান হতে যাচ্ছিল।
সালভাদর আলেন্দে চিলির জনগণের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু, রাষ্ট্র পরিচালনায় সমাজতান্ত্রিক নীতি অনুসরণ ছিল চিলির অভিজাত, বিত্তশালী ও চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলোর স্বার্থবিরোধী। তাই দেশের দরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষের প্রাণের নেতা হওয়া সত্ত্বেও তার শাসনকালের দীর্ঘস্থায়িত্ব প্রশ্নের মুখে পড়ে। অন্যদিকে আলেন্দের পক্ষে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক সমর্থন ছিল না বললেই চলে। সেসময়ে সমাজতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষক সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে তাকে রাজনৈতিক সাহায্য করার ব্যাপারে তেমন আগ্রহ দেখায়নি। আর নিকটবর্তী বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্র কিউবার রাষ্ট্রপতি ফিদেল ক্যাস্ট্রো ব্যক্তিগতভাবে চিলি সফর করলেও তার পক্ষে আদতে কোনো সমর্থন যোগানো সম্ভবপর ছিল না। একইসাথে চিলির প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো ছিল যুক্তরাষ্ট্রের একেকটি ঘাঁটি।
চিলির গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সালভাদর আলেন্দের পতনের প্রথম ঘণ্টা বাজে ১৯৭৩ সালের জুন মাসে। ২৯ শে জুন, লেফটেন্যান্ট কর্নেল রবার্তো সুপার, রাষ্ট্রপতি আলেন্দের বিরুদ্ধে সেনা অভ্যুত্থানের ডাক দেন, যা এল টানকিটাজো নামে পরিচিত।। কিন্তু চিলি ও এর রাষ্ট্রপতির জন্য সৌভাগ্যের বিষয় ছিল যে উক্ত সেনা অভ্যুত্থান বিফলে যায়। সত্য বলতে, জুন মাসের এই অভ্যুত্থান দিয়ে সিআইএ কেমন যেন আলেন্দে প্রশাসনকে বাজিয়ে দেখছিল। কারণ এর পরের ধাক্কাটিই ছিল চিলির রাষ্ট্রপতি ও এর গণতন্ত্রের জীবনহন্তারক।
জুন মাসের অভ্যুত্থান প্রতিরোধের পর রাষ্ট্রপতি আলেন্দে জেনারেল অগাস্টো পিনোশেকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন। অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা আলেন্দের পক্ষে আরেকটি অভ্যুত্থান প্রতিরোধ কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। জেনারেল পিনোশে সে সুযোগই গ্রহণ করেন। সেনা অভ্যুত্থান ঘোষণার আগেই সিআইএ চিলিতে অবস্থানরত যুক্তরাষ্ট্রের সকল নাগরিককে অন্যত্র সরিয়ে নেয়। তারা পিনোশের আসল পরিকল্পনা সম্পর্কে ভালোভাবেই জানত।
১৯৭৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর, স্বৈরতন্ত্রের এক ধাক্কায় চিলির গণতন্ত্রের নিপাত ঘটে। তবে সেদিনের সেনা অভ্যুত্থান যতটুকু না সরকার পতনের জন্য ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল ক্ষমতা প্রদর্শনের মহড়া। পিনোশে চিলির জনগণের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন, তাদের ভোট সরকার গঠন করতে পারে ঠিকই, কিন্তু স্থায়িত্ব দান করে না। আলেন্দেকে বরাবর সমর্থনকারী জনগণকে নিশ্চুপ রাখতে পিনোশে রাস্তায় ট্যাংক, আকাশে জঙ্গিবিমান এবং পানিতে যুদ্ধজাহাজ নামিয়ে দেন। গণতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলন করে প্রতিরোধ গড়া চিলির সাধারণ জনগণের পক্ষে সামরিক শক্তির মোকাবেলা মোটেও সম্ভবপর ছিল না।
আলেন্দের রাজনৈতিক দল পপুলার ইউনিটির কর্মী-সমর্থক থেকে শুরু করে চিলির সর্বস্তরের মানুষ পিনোশের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের শিকার হয়। এমনকি নোবেলবিজয়ী কবি পাবলো নেরুদা যাতে গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলতে না পারেন, সেজন্য হাসপাতাল কক্ষেই তাকে হত্যা করা হয়। জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী ভিক্টর হারার মৃত্যু চিলির জনগণকে এখনো কাঁদায়। ১১ সেপ্টেম্বর অভ্যুত্থানের দিনই তাকে আটক করে সান্তিয়াগো ফুটবল স্টেডিয়ামের বন্দি করা হয়। সেখানে কয়েকজন সেনাসদস্য তার হাতের সব ক’টি আঙুল ভেঙে ফেলে। এরপর তারা তার সামনে একটি গিটার নিয়ে এসে তাকে তা বাজাতে বলে এবং তাকে নিয়ে হাসি-তামাশা করতে থাকে। এই অমানবিক নির্যাতন শেষে উক্ত সেনাসদস্যরা তাকে গুলি করে হত্যা করে। ১৬ সেপ্টেম্বর সান্তিয়াগো রাস্তা থেকে মোট চল্লিশটি বুলেটের ক্ষতসহ তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।
ক্ষমতা গ্রহণের পর পিনোশে একজন দুর্বৃত্তে পরিণত হন। তিনি চিলির জাতীয় কংগ্রেস বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য জঘন্য থেকে জঘন্যতম পদ্ধতি ব্যবহার শুরু করেন। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় চিলির গোপন পুলিশ বাহিনী পিনোশের প্রতিপক্ষ বিশেষকরে গণতন্ত্রপন্থীদের হাজার হাজার গুম এবং খুন করা হয়। তার কর্মকাণ্ড এত ভয়ানক রূপ ধারণ করে যে ডানপন্থীরাও তার অত্যাচার থেকে রক্ষা পায়নি। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি এডওয়ার্ডো ফ্রে। তিনি আলেন্দের নীতিসমূহের চরম বিরোধী এবং আমেরিকার পুঁজিবাদী নীতির ভক্ত হওয়া সত্ত্বেও পিনোশে রাষ্ট্রক্ষমতার স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে তাকে হত্যা করেন। কারণ, ফ্রে এবং তার দল মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী সামরিক জান্তার সোচ্চার প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছিল।
সালভাদর আলেন্দে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সমন্বয়ে যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, তাতে তিনি ব্যর্থ হন। তার পতনের পূর্বেই চিলির অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি ও কালোবাজারির পরিমাণ বেড়ে যায়। তার ক্ষমতারোহণের তিন বছরের মধ্যে চিলির বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ২.৪ বিলিয়ন থেকে ৩.৪ বিলিয়নে পৌঁছে যায়। অন্যদিকে বিশ্ববাজারে তামার দামও হঠাৎ করে পড়ে যাওয়ায় আমদানি-রপ্তানি অসামঞ্জস্য দেখা দেয়। ফলস্বরূপ তার পদত্যাগের দাবি ওঠে এবং দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনাও তার ছিল না।
কিন্তু নিক্সন-কিসিঞ্জার প্রশাসন তাকে দ্বিতীয়বার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ দিতে চায়নি। কারণ, চিলির মতো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের ভোটে তার আবারও নির্বাচিত হওয়ার একটি সম্ভাবনা থেকে গিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষার্থে পিনোশের মাধ্যমে গণতন্ত্রের বলি দিয়ে তারা আলেন্দের পতন নিশ্চিত করে। মূলত দক্ষিণ আমেরিকায় সমাজতন্ত্রের উত্থান রোধ এবং চিলির তামা শিল্প নিজেদের হস্তগত করাই তাদের আসল উদ্দেশ্য ছিল। এতে চিলির জনগণের কী পরিণতি বরণ করতে হয়েছে, তা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা ছিল না।
অগাস্টো পিনোশের অধীনে চিলির অর্থনীতি যে একেবারে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল কিংবা দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছিল, এ দাবি করা সঠিক নয়। বরং সালভাদর আলেন্দে যে অনিশ্চয়তার পথে হাঁটছিলেন, তার থেকে বেশি সফলতা পিনোশে অর্জন করেছেন। কিন্তু সেই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করতে গিয়ে চিলির সাধারণ জনগণের যে মূল্য দিতে হয়েছে, তা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। ২০০৬ সালে জেনারেল পিনোশে ৯০ বছর বয়সে বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যান। ১৯৯০ সালে ক্ষমতা ছাড়ার পর থেকে তাকে কোনোপ্রকার বিচারের সম্মুখীন হতে হয়নি। কারণ তিনি যুক্তরাষ্ট্র নামক এক আন্তর্জাতিক পরাশক্তির স্বার্থরক্ষক ছিলেন।
মজার ব্যাপার হলো, ১৯৭৩ সালের সেনা অভ্যুত্থানে যুক্তরাষ্ট্র ও সিআইএ’র কী ভূমিকা ছিল, সে সম্পর্কিত গোপন নথিসমূহ কভার্ট অ্যাকশন ইন চিলি (১৯৬৩-১৯৭৩) নামে প্রকাশ করা হয়। আসলে নিজেদের গোপন তথ্যগুলো নিজেরাই প্রকাশ করে তারা তুলনামূলক কম শক্তিধর দেশগুলোকে এই বার্তা দেয় যে, তারা গোপনে অনেক কিছু করতে সক্ষম; তাই, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা এর কোনো প্রতিষ্ঠানের সাথে টক্কর দেওয়া মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময় থেকে আজ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব রাজনীতিতে যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে, তা অধিকাংশই গোপন ছলচাতুরিমূলক কূটনীতি দ্বারা। যখনই কোনো দেশের সরকার যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী কাজে আগ্রহ দেখিয়েছে, তখনই সেনা অভ্যুত্থান, গুপ্তহত্যা ও গৃহযুদ্ধসহ বিভিন্ন উপায় সে সরকারের পতন ঘটেছে। সে হিসেবে আলেন্দের পতন ছিল বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য নিশ্চিত করার একটি উদাহরণমাত্র।