ইতিহাস জন্ম নিয়েছিল ইংল্যান্ডের যে ১০টি স্থানে

পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে সমৃদ্ধ দেশগুলোর একটি ইংল্যান্ড। ঔপনিবেশিক শাসনের মাধ্যমে ইংরেজরা তাদের সমৃদ্ধ সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দিয়েছে বিশ্বের প্রান্তে প্রান্তে, যার ছিটেফোঁটা হয়তো পেয়েছি আমরাও। ঐতিহাসিক যুদ্ধক্ষেত্র, রাজপ্রাসাদ, প্রার্থনালয়, বাগানবাড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পুরো ইংল্যান্ড জুড়েই। প্রতিটি ঐতিহাসিক নিদর্শনই সরকারীভাবে খুব যত্নসহকারে সংরক্ষণ করা হয়েছে। ইংল্যান্ডের ইতিহাস বা সংস্কৃতির চেয়ে বেশি ঈর্ষণীয় ও অনুকরণীয় দিক হচ্ছে তারা যেভাবে তা সংরক্ষণ করেছে।

বিভিন্ন সময়ে বিশ্বের ইতিহাস রচনা করেছে যে জাতি তাদের ঐতিহাসিক দশটি স্থান নিয়ে সাজানো হয়েছে এই প্রবন্ধটি।

স্টোন হেঞ্জ

বিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় প্রাগৈতিহাসিক স্থানগুলোর একটি স্টোন হেঞ্জ। প্রায় ২৫ টন ওজনের এক একটি পাথরের খণ্ডকে বৃত্তাকারে সাজিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে এই নিখুঁত স্থাপত্য নিদর্শনকে। অনুমান করা হয়, ইংল্যান্ডের এই প্রাচীন স্থাপত্যটি নির্মাণ করা হয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে। প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা, একসময় গণ সমাধিক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হত এই জায়গাটি।

গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত এই স্থানটি ব্যক্তি মালিকানাধীন ছিল। শেষবারের মতো স্থানটি খোলা বাজারে বিক্রি হয় ১৯১৫ সালে। এর তিন বছর পরেই স্থানটি মালিক তার ক্রয়কৃত সম্পত্তিকে জাতির উদ্দেশ্যে দান করেন এবং এর পর থেকে আজ অবধি স্থানটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত।

Source: English Heritage

হাউজস্টেডস রোমান ফোর্ট

খ্রিস্টপূর্ব ১২২ সনের দিকে নর্থাম্বারল্যান্ডে নির্মিত এই রোমান দুর্গটি ইউরোপের ইতিহাসে স্বয়ংসম্পূর্ণ দুর্গগুলোর একটি। একসাথে প্রায় হাজারখানেক সৈন্য রাখার ধারণক্ষমতা ছিল এই দুর্গটির। হিড্রিয়ান ওয়াল দিয়ে যখন এই দুর্গটি নির্মিত হয়, তখন ইংল্যান্ডের এই দুর্গটি রোমান রাজ্য ব্রিটানিয়ার অংশ ছিল। প্রতাপশালী রোমান সেনাবাহিনীর অনেক অজানা ও রোমাঞ্চকর খুঁটিনাটির আভা ছড়িয়ে যাচ্ছে এই ঐতিহাসিক নিদর্শনটি।

Source: Hadrians Wall

ব্যাটল আবি, ১০৬৬ সনের হ্যাস্টিং এর যুদ্ধের যুদ্ধক্ষেত্র

ইংল্যান্ডের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ের সন্ধিক্ষণ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে এই নিদর্শনটি। হ্যাস্টিং এর যুদ্ধের মাধ্যমে ১০৬৬ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের ক্ষমতা দখল করেন নর্মান সম্রাট উইলিয়াম দ্য কনকরার (William the conqueror)। অ্যাংলো-স্যাক্সন রাজা দ্বিতীয় হ্যারোল্ডের বিরুদ্ধে হওয়া এই যুদ্ধে প্রচুর প্রাণনাশ হয়, যার জন্য তৎকালীন পোপ দ্বিতীয় আলেকজান্ডার নর্মানদের প্রায়শ্চিত্ত করতে বলেন। যার প্রতিক্রিয়ায় রাজা উইলিয়াম সেই যুদ্ধক্ষেত্রেই একটি আবি (Abbey) বা প্রার্থনালয় নির্মাণ করেন। যদিও প্রার্থনালয়েও সামান্য অংশই এখনো অক্ষত আছে, কিন্তু হাজার বছরের নর্মান স্থাপত্যের সাক্ষর-বাহী গেটহাউজ এবং কোর্টহাউজ এখনো টিকে আছে। প্রার্থনালয়ের সোপানে দাঁড়িয়ে এখনো সেই বিখ্যাত হ্যাস্টিং এর যুদ্ধের যুদ্ধক্ষেত্রটি দেখা যায়। সোপানে দাঁড়িয়ে আপনি দেখতে পাবেন স্যাক্সনরা শুরুতে যেই উঁচু ঢিবিতে দাঁড়িয়েছিল সেই ঢিবিটি, দেখতে পাবেন নর্মানদের মিথ্যা পশ্চাদগমনের ফলে তারা যেই স্থানে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে সেই স্থানটি। এককথায় পুরো যুদ্ধক্ষেত্রটিই আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠবে।

Source: English Heritage

ডোভার ক্যাসেল

কেন্টের ডোভার ক্যাসেলকে বলা হয় ‘ইংল্যান্ডের চাবি’। এটি একটি প্রাচীন লৌহযুগীয় দুর্গ যা আবিষ্কৃত হয়েছিল একাদশ শতাব্দীতে। ইউরোপের যেকোনো জায়গা দিয়ে ইংল্যান্ডে প্রবেশ করতে হলেই তখন ডোভার ক্যাসেলের অতিক্রম করতে হত। আর এই কারণেই এই দুর্গটি শত শত বছর ধরে প্রহরীর ভূমিকা পালন করে গিয়েছে। ডোভারের সমীহ জাগানো অতন্দ্র প্রহরা যেন স্বতন্ত্র ইংল্যান্ডেরই রূপক। লৌহ যুগের গিরিদুর্গটি, রোমান এবং স্যাক্সনদের দ্বারা নব রূপায়িত ও সুসজ্জিত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত এই দুর্গটি সামরিক কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। স্নায়ুযুদ্ধের সময়, যখন পারমাণবিক বোমার ভয়ে টালমাটাল বিশ্ব, তখন এটি সরকারের স্থানীয় আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে সংরক্ষিত ছিল।

Source: You Tube

রিভোহ আবি

ইংল্যান্ডের সর্বপ্রাচীন সন্ন্যাস আশ্রমগুলোর একটি এটি। দ্বাদশ শতাব্দীতে সিস্টোরশান সন্ন্যাসীদের দ্বারা আবিষ্কৃত হয় এই প্রার্থনালয়টি। প্রথমদিককার ইংলিশ গোথিক স্থাপত্যশৈলীর একটি উজ্জ্বল নিদর্শন এই রিভোহ আবি। ১৫৩৮ সালে রাজা অষ্টম হেনরি ‘ডিসসলুশন অব মনাস্টেরিস’-র মাধ্যমে আইন করে সব মঠ বন্ধ করে দিলে ধীরে ধীরে এই ঐতিহাসিক স্থানটি অভিগ্রস্ত হতে শুরু করে। স্থাপনাটি পুরোপুরি ধ্বংসের দিকেই যখন এগোচ্ছিল। হয়তো এতদিনে ধসেই যেত না যদি না ১৯১৭ সালে স্থাপনাটি সরকারী নজরদারিতে না আসতো। পরবর্তীতে এর ধসে যাওয়া দেয়াল আবার পুনর্নির্মিত হয়েছে যাতে করে দর্শনার্থীরা এর আসল গড়নটা ধরতে পারে।

Source: Britain Express

কেনিলোর্থ ক্যাসেল ও এলিজাবেথান গার্ডেন

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে উইকশায়ারের কেনিলোর্থ ক্যাসেলটি রাজ-রাজড়াদের প্রাসাদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। ঐতিহাসিকগণ এটিকে মধ্যযুগীয় আধা রাজকীয় প্রাসাদের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন। রাজা জন, যুবরাজ জন অব গন্ট ও রবার্ট ডুডলির মতো রাজারা এই স্থাপত্যটিকে প্রাসাদ হিসেবে ব্যবহার করেছেন।  টুডো যুগে নর্মানদের দ্বারা নির্মিত এই বিখ্যাত স্থাপনাটি ১২৬৬ খ্রিস্টাব্দে প্রায় ছয় মাস অবরুদ্ধ অবস্থায় ছিল।

বিখ্যাত প্রাসাদটি এখনো উইকসায়ারে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে। এর পাশেই রানী এলিজাবেথের সম্মানে একটি দৃষ্টিনন্দন বাগান তৈরি করা হয়েছে।

Source: Wikimedia Commons

 অডলি এন্ড হাউজ এন্ড গার্ডেনস

ইসেক্সের অডলি এন্ড হাউজ মূলত সতের শতাব্দীতে নির্মিত একটি রাজকীয় অট্টালিকা। জ্যাকবিয়ান স্থাপত্যশিল্পের একটি অনন্য নিদর্শন এ বাড়িটি, যার মূল নকশার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ বর্তমানে অক্ষত রয়েছে। অক্ষত অংশখানিই ইংল্যান্ডের একসময়ের সর্ববৃহৎ জ্যাকবিয়ান স্থাপত্যকলার স্মৃতি বহন করে দাঁড়িয়ে আছে এবং এই প্রাসাদসম অট্টালিকাটিই বর্তমান ইংল্যান্ডের একটি উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান বলে বিবেচিত। নেটফ্লিক্সের জনপ্রিয় ড্রামা সিরিজ ‘ক্রাউন’ একটি বড় অংশের শুটিং হয়েছে এই প্রাসাদসম বাসভবনে।

Source: English Heritage

চার্লস ডারউইনের বাসা

কেন্টে অবস্থিত বিশ্ববিখ্যাত উদ্ভিদতাত্ত্বিক চার্লস ডারউইনের প্রাক্তন বাসাটি ইংল্যান্ডের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে একটি। ঐতিহাসিকভাবেও এই বাসা ও সংলগ্ন বাগানটি অনেক গুরুত্ব বহন করে। কেননা, এখানে বসেই ডারউইন বিবর্তনবাদের তত্ত্ব আবিষ্কার করেন।

ডাউন হাউজ নামে পরিচিত এই বাড়িটি ১৯০৭ সাল পর্যন্ত ডারউইনের পরিবারের মালিকানাধীন ছিল। ১৯০৭ সালে তারা বাড়িটি বিক্রি করে দেয়ার পর তা বিভিন্নভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। ১৯৯৬ সালে বাড়িটি ইংল্যান্ড সরকার কিনে নেয় এবং ডারউইনের সময়ে বাগান বাড়িটির সবকিছু যেভাবে ছিল সেভাবে সাজানো হয়। বর্তমান বাসা এবং এর সংলগ্ন বাগানটি আপনাকে কিংবদন্তি বিজ্ঞানীর কার্যপরিধি এবং জীবনযাপন সম্বন্ধে মোক্ষম ধারণা দিবে।

Source: English Heritage

রেস্ট পার্ক

বেডফোর্ডশায়ারের রেস্ট পার্ককে বলা হয় ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বড় ‘সিক্রেট গার্ডেন’। একটা সময় প্রবৃদ্ধ হয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গেলেও বর্তমানে এই রেস্ট পার্ককে ইংল্যান্ডের অষ্টাদশ শতাব্দীয় সেরা বাগানবাড়িগুলোর একটি হিসেবেই দেখা হয়। মধ্যযুগ থেকে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত এই বাগানের মালিকানা ছিল গ্রে পরিবারের কাছে। বাগানের নকশা করার জন্য তারা বিভিন্ন সময়ে বিখ্যাত অনেক জর্জিয়ান ডিজাইনারকে নিয়োগ করেছে। নতুন নতুন নকশার উদ্ভবে যখন বাকি সব জায়গা থেকে পুরনো নকশা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে তখন রেস্ট পার্কের অধিষ্ঠিত প্রজন্ম সবসময় পূর্বসূরিদের নকশাকেই সম্মান দেখিয়ে গিয়েছে, যার ফলশ্রুতিতে আজকে আপনিও চাইলে তিনশ বছর পূর্বের ইংল্যান্ডের বাগান ইতিহাসেও ঘুরে আসতে পারবেন।

বাগান সংলগ্ন বাড়িটি নির্মাণ করা হয় ১৮৩০ সালে, ফরাসি দুর্গের আদলে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে এ বাড়িকে মিলিটারি হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল।

Source: English Heritage

অসবর্ন

রাজকীয় জীবনযাপন সম্পর্কে বাস্তব ধারণা পেতে, বিশেষ করে রানী ভিক্টোরিয়া ও যুবরাজ এলবার্টের জীবনযাপন নিয়ে জানতে চাইলে অসবর্নের চেয়ে উত্তম স্থান আর বোধহয় নেই। রাইট দ্বীপে অবস্থিত এই রাজকীয় বাসভবনটি রানী ভিক্টোরিয়া ও যুবরাজ এলবার্টের গ্রীষ্মকালীন বাসস্থান ও অবসরযাপন কেন্দ্র ছিল। ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে এই বাসভবনটির নকশা করেন স্বয়ং যুবরাজ এলবার্ট।

Source: aeroengland.co.uk

১৯০১ সালে রানী ভিক্টোরিয়ার মৃত্যুর পর এই বাসস্থানের একটি নির্দিষ্ট অংশ দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। রানী ভিক্টোরিয়া জীবন নিয়ে নির্মিত সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া হলিউড ফিল্ম ‘ভিক্টোরিয়া এন্ড আবদুল’ এর শুটিং হয়েছে এখানেই।

Related Articles

Exit mobile version