এই বর্ণবাদী সরকারের প্রশাসন সুপারম্যানের ধ্যানধারণা আর কমিকবুক রাজনীতিতে বিশ্বাসী। সুপারম্যান কোনো কৃষ্ণাঙ্গ লোককে বাঁচায়নি। বুঝতে পারছ কি? তুমি শুধুমাত্র সেই সাক্ষীদের কথাই শুনেছ যাদেরকে সরকারের শুয়র এজেন্টরা কোর্টে ধরে নিয়ে এসেছে মিথ্যা বলানোর জন্য। একইসাথে পুলিশদের বর্ণবাদী আর ফ্যাসিবাদী কার্যকলাপ উপেক্ষা করে গিয়েছ। আমি আমার সাংবিধানিক অধিকার দাবি করছি!
-ববি সিল
উপরের বক্তব্যটি কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আদায়ে কাজ করা সংগঠন ব্ল্যাক প্যান্থার পার্টির সহ-প্রতিষ্ঠাতা ববি সিলের। তিনি এই কথাটি ১৯৬৯ সালে শুরু হওয়া বিখ্যাত শিকাগো সেভেন ট্রায়ালের সময় বিচারপতি জুলিয়াস হফম্যানের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন। তার বক্তব্যে ইঙ্গিত পাওয়া যায় সেই বিচার কার্যক্রম অনেকটা একতরফা হচ্ছিল।
প্রকৃতপক্ষে তা-ই হচ্ছিল। আর সেই ঘটনার ওপর ভিত্তি করে নেটফ্লিক্সে গত ১৬ অক্টোবর মুক্তি পায় ‘দ্য ট্রায়াল অব শিকাগো সেভেন’ সিনেমাটি। ষাটের দশকে আমেরিকা যখন ভিয়েতনামের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তখন ভিয়েতনাম বিরোধী সক্রিয় কর্মীদের সাথে শিকাগো পুলিশের সংঘর্ষ হয়। সেই সংঘর্ষের জন্য প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের প্রশাসন আট জন কর্মীকে দায়ী করে মামলা করে। সেই মামলাটি ‘দ্য ট্রায়াল অব শিকাগো সেভেন’ নামে বিখ্যাত হয়ে আছে। পাঁচ মাস ধরে চলা সেই মামলা নিয়েই এই কোর্ট রুম ড্রামা সিনেমাটা। এর অনেক ঘটনা প্রকৃতপক্ষে আরো ভয়ংকর ছিল। আবার কিছু অংশ হলিউডের বাড়িয়ে দেখানোর অভ্যাসের শিকার। কী ঘটেছিল আসলে তখন?
দাঙ্গার সূচনা
দাঙ্গার শুরুটা হয় ১৯৬৮ সালের ২৮ আগস্ট। এ সময় আমেরিকা খুব সঙ্কটাপন্ন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। মার্টিন লুথার কিং ও সিনেটর রবার্ট কেনেডি আততায়ীদের হাতে খুন হলেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধে প্রতি মাসে এক হাজারেরও বেশি আমেরিকান সৈনিক মারা যাচ্ছিল।
যুদ্ধে পরাজয়ের ইঙ্গিত দেখে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট লিনডন জনসন দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে না দাঁড়ানোর অভূতপূর্ব সিদ্ধান্ত নিলেন। কেনেডির মৃত্যুর পর ভাইস প্রেসিডেন্ট হুবার্ট হামফ্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য দাঁড়ান। কিন্তু পুরো দেশের মতো ডেমোক্রেটিক পার্টিও ভিয়েতনাম যুদ্ধের পক্ষে ও বিপক্ষে দুই ভাগ হয়ে গিয়েছিল। যুদ্ধবিরোধী অংশটি হামফ্রের বিরোধিতা করে। এদিকে যুদ্ধবিরোধী অংশের মিনেসোটার সিনেটর ইউজিন ম্যাকার্থি শিক্ষার্থী ও বাম সক্রিয় কর্মীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
তখন তরুণদের অনেকেই ম্যাকার্থির হয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থীতার প্রচারণা চালান। কিন্তু অনেক সংগঠনই ডেমোক্রেটদের ওপর আস্থা রাখতে পারছিল না। এই সংগঠনগুলোর নেতারা ম্যাকার্থির প্রার্থীতা পাওয়ার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন না। তাই শিকাগো আসেন তরুণদের বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনতে এবং প্রশাসনের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে।
১৯৬৮ সালের সেই গ্রীষ্মে দশ হাজারেরও বেশি আন্দোলনকারী জড়ো হন শিকাগোতে। এর কিছুদিন আগে শিকাগো পুলিশের দ্বারা ডিন জনসন নামের এক তরুণের মৃত্যুও প্রভাব ফেলেছিল এই আন্দোলনে। তারা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাম্ফিথিয়েটারের দিকে যেতে চাচ্ছিলেন যেখানে ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কনভেনশন হচ্ছিল। ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কনভেনশনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট ও ভাইস-প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ঘোষণা করা হয়।
আন্দোলনের বেশিরভাগই ছিলেন কলেজ শিক্ষার্থী। সংগঠনগুলোর নেতারা কোনো সহিংস কার্যকলাপে জড়াতে আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু শিকাগো এসে দেখেন সেখানকার ডেমোক্রেট মেয়র রিচার্ড ড্যালি রীতিমতো যুদ্ধের মহড়া শুরু করে দিয়েছেন।
আন্দোলনকারীদের ঠেকাতে সেখানে ছিল বারো হাজারেরও বেশি শিকাগো পুলিশ অফিসার, ইলিনয় ন্যাশনাল গার্ডের ৫,৬০০ জন সদস্য এবং আমেরিকান সেনাবাহিনীর পাঁচ হাজার সদস্য। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন রূপ নেয় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে। পুলিশ তখন মিছিলের মধ্যে কাঁদুনে গ্যাস ছুঁড়ে মারে আর লাঠিচার্জ করতে থাকে। পাঁচ দিন ধরে চলা আন্দোলনে প্রায় ৭০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
প্রহসনের বিচার
এর ১২ মাস পর আট জন আসামিকে আদালতে নিয়ে আসা হয় বিচারকার্যের জন্য। আট জন ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী হলেও তাদের আদর্শ, আন্দোলনের ধরন, রাজনৈতিক এজেন্ডার পার্থক্য ছিল। অ্যাবি হফম্যান ও জেরি রুবিন ছিলেন কর্তৃত্ববাদ বিরোধী ইয়ুথ ইন্টারন্যাশনাল পার্টির কর্মী। তাদের সংগঠনের সদস্যদের ‘ইপ্পি’ বলে ডাকা হতো। টম হেইডেন ও রিনি ডেভিস ছিলেন ‘স্টুডেন্ট ফর আ ডেমোক্রেটিক সোসাইটি’ বা এসডিএস’র প্রতিষ্ঠাতা। এই সংগঠনটি ছিল ক্যাম্পাসভিত্তিক ১৫০টি সংগঠনের একটি কোয়ালিশন। তারা প্রচলিত ব্যবস্থার পরিবর্তন ও ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন করে আসছিল।
ডেভিড ডেলিংগার ছিলেন একজন সাবেক বয় স্কাউট নেতা। তিনি ‘মোবিলাইজেশন কমিটি টু এন্ড দ্য ওয়ার ইন ভিয়েতনাম’ বা মোব নামের একটি সংগঠন তৈরি করেন, যা যুদ্ধবিরোধী কার্যক্রমের জন্য শুরু করা হয়েছিল। অধ্যাপক জন ফ্রয়েন্স ও লি ওয়েইনার খুবই প্রান্তিকভাবে এই আন্দোলনে জড়িত ছিলেন। ধারণা করা হয় যুদ্ধবিরোধী অন্যান্য একাডেমিশিয়ানদের সতর্ক করে দিতেই তাদেরকেও মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ববি সিল ছিলেন শিকাগো প্যান্থারসের প্রধান। তার সংগঠনটি তুলনামূলক সশস্ত্র কার্যক্রমে জড়িত ছিল বেশি।
আসামি পক্ষের আইনজীবী হিসাবে দুজন কাজ করেছিলেন। তারা হলেন উইলিয়াম কুন্সটলার এবং লিওনার্ড ওয়েইনগ্লাস। তারা নাগরিক অধিকার আদায়ের জন্য সুপরিচিত ছিলেন।
বিচারকার্যের শুরু থেকেই এটা ছিল মূলত প্রহসনের বিচার। বিচারপতি জুলিয়াস হফম্যান সরকারের প্রতি খুবই পক্ষপাতি আচরণ করে আসছিলেন। তিনি বিচারের প্রথম দিনই বিবাদী পক্ষের চার জন অ্যাটর্নির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন, যারা ট্রায়াল শুরু হওয়ার আগে কাজ করছিল কিন্তু পরে মামলা ছেড়ে দেয়। পরবর্তীতে আইনজীবী মহলে বিচারপতির রায়ের সমালোচনা হওয়ায় তিনি এই রায় ফিরিয়ে নেন।
হফম্যান আসামিদের প্রতিনিয়তই হুমকি-ধামকির মধ্যে রাখতেন। তাদের অঙ্গভঙ্গি নিয়েও সমালোচনা করতেন। অ্যাবি হফম্যানকে শুধুমাত্র কোর্টরুমে হাসার অপরাধেই অতিরিক্ত সাত দিনের কারাদণ্ড দেন। তিনি জুরিদেরকে কিছু অকাট্য প্রমাণ দেখা থেকে বিরত রাখেন, যা বিবাদী পক্ষকে সাহায্য করতে পারত। এর মাঝে ছিল টম হেইডেনের লেখা ডকুমেন্ট, যেখানে শিকাগো আন্দোলন শান্তিপূর্ণভাবে করার কথা লেখা হয়েছিল।
বিচারপতি হফম্যানের সবচেয়ে বড় অবিচারের শিকার ছিলেন ববি সিল। তিনি প্রকৃতপক্ষে শিকাগো ছিলেন মাত্র চার ঘণ্টার জন্য। সেখানে একটি ভাষণ দেওয়ার জন্যই গিয়েছিলেন শুধু। কিন্তু তাকেও এই মামলায় আসামি করা হয়। কিন্তু তিনি বাকি সাত জনের আইনজীবীর সাথে মামলা চালাচ্ছিলেন না। এই কারণে এই মামলার আসামি আট জন হলেও একে শিকাগো সেভেন বলা হয়। তার আইনজীবী ছিলেন চার্লস গ্যারি। কিন্তু তিনি অসুস্থ থাকায় আদালতে উপস্থিত থাকতে পারেননি। তাই বিচারপতি হফম্যান তাকে আদালতে নিজের বক্তব্য উপস্থাপনের সুযোগও দেননি।
হফম্যানের সাথে প্রায়ই সিলের কথা কাটাকাটি হতো। ২৯ অক্টোবর একপর্যায়ে রাগে চিৎকার করে সিল বলে উঠেন, “মিথ্যাবাদী পচে যাওয়া বর্ণবাদী শুকর!” তখন কোর্টরুমে চিৎকার করার জন্য সিলের শাস্তি বাড়াতে সেগুলো রেকর্ডে রাখতে বলেন। আইনজীবী কান্সটলার তখন বাদী পক্ষের আইনজীবী রিচার্ড শুলজের পূর্ববর্তী সময়ে চিৎকার করার কথাও মনে করিয়ে দেন। কিন্তু সেক্ষেত্রে হফম্যান বলেন, “সে (শুলজ) যদি সত্য বলে থাকে, তাহলে তার গলা চড়ানোর জন্য আমি দায়ী করতে পারি না।”
ববি সিলকে তখন মুখ ও হাত-পা বেঁধে আদালতে রেখে বিচারকার্য পরিচালনা করা হয়। পরবর্তীতে অবশ্য মামলা ত্রুটিপূর্ণ থাকায় খারিজ হয় (মিসট্রায়াল)। মামলা চলাকালীন সময়ে জুরিবোর্ডের দুই সদস্য (জুরর) হুমকি দিয়ে লেখা চিঠি পান যাতে লেখা থাকে “তোমাদের ওপর নজর রাখা হচ্ছে”। বলা হয়েছিল চিঠিটি ববি সিলের ব্ল্যাক প্যান্থারের কাছ থেকে পাঠানো, কিন্তু এটা স্পষ্ট জালিয়াতি ছিল। বিবাদী পক্ষ থেকেও বলা হয় এটা সরকারের পক্ষ থেকে বানানো চিঠি। কারণ জুরিবোর্ডের এই দুই সদস্য ছিলেন সবচেয়ে নিরপেক্ষ এবং সৎ। তখন একজন নারী সদস্য জুরিবোর্ড থেকে সরে দাঁড়ান। বিচারপতি হফম্যানের বিরুদ্ধে এখানেও তাদেরকে জুরি বোর্ড ত্যাগ করার জন্য প্রভাবিত করার অভিযোগ ছিল।
আদালতের রায়
১৯৭০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রহসনের বিচারের রায় হয়। সাত জনকেই পাঁচ হাজার ডলার জরিমানা করা হয়। পাঁচ জনের বিরুদ্ধে দাঙ্গায় প্ররোরচনা দেওয়ার জন্য অভিযুক্ত করা হয়। ফ্রয়েন্স এবং ওয়েইনারকে সব মামলা থেকে খালাস দেওয়া হয়। সবার বিরুদ্ধে সর্বমোট ১৭৫টি আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হয়।
বিবাদী পক্ষের আইনজীবী কুন্সটলারকে চার বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এর মাঝে ছিল বিচারপতিকে ‘মহামান্য’ না বলে মিস্টার হফম্যান ডাকা এবং আদালতকে মধ্যযুগীয় বর্বর নির্যাতন কক্ষ বলার মতো ‘অপরাধ’।
হেইডেনকে এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় সিলকে নির্যাতনের প্রতিবাদ করায়। ববি সিলকে নির্যাতনের পাশাপাশি চার বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অ্যাবি হফম্যানকে কোর্টরুমে হাসার জন্য আট মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারিতে ফেঁসে গেলে এই মামলার রায়ও পরিবর্তিত হয়ে যায়। তখন ভিন্ন বিচারক দিয়ে মামলা পরিচালনা করায় বিচারপতি হফম্যানের পক্ষপাতিত্ব বের হয়ে আসতে থাকে। প্রায় তিন হাজার সাক্ষীর ২০ হাজার পৃষ্ঠার সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে স্পষ্ট হয় যে, সেদিনের দাঙ্গা শুরু করেছিল শিকাগো পুলিশ, আন্দোলনকারী কর্মীরা নয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৭২ সালের ২১ নভেম্বর সবাইকেই মামলা থেকে খালাস দেওয়া হয়। সরকারও পরে এটা নিয়ে আর মামলা চালাতে আগ্রহী ছিল না।
এই মামলার মাধ্যমে আমেরিকার তখনকার সরকারের বর্ণবাদ, কর্তৃত্ববাদসহ অনেক কদর্য রূপ বের হয়ে আসে। মূলত ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আর বামপন্থীদের শাস্তি দেওয়ার জন্যই এই সাজানো বিচারকার্য পরিচালনা করা হয়েছিল।
ডেলিংগার বলেন,
আমাদের সাথে যে অবিচার হয়েছে, তা ভিয়েতনামী জনগণ আর এদেশের কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর নির্যাতনের তুলনায় তুচ্ছই মনে হবে।
রুবিন বলেছিলেন,
আমি আনন্দিত আমাদের বিচার ব্যবস্থার আসল রূপ উন্মোচন করতে পেরেছি বলে। কারণ দেশের লক্ষ লক্ষ আদালতের মাধ্যমে রাস্তা থেকে তুচ্ছ কারণে বা বিনা কারণে ধরে আনা কৃষ্ণাঙ্গদের জেলে ঢুকানো হয়। তাদের কথা কেউ জানে না। তাদের কথা সবাই ভুলে যায়। সাংবাদিকরাও তাদের কোনো খবর গুরুত্ব দেয় না। আমরা এই অন্ধকার দিকটা উন্মোচন করতে পেরেছি। এখন মানুষ তাদের নিয়ে জানতে আগ্রহী হবে, কী করা হচ্ছে তাদের সাথে।
সিনেমার সাথে বাস্তব ঘটনার মিল-অমিল
নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাওয়া দ্য ট্রায়াল অব শিকাগো সেভেন সিনেমাটি পরিচালনা করেন অ্যারন সরকিন। সিনেমাটি ২০২০ সালে এসে মুক্তি পেলেও এর কাজ শুরু হয় ২০০৭ সালে। পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গ সরকিনের সাথে যোগাযোগ করেন এই ট্রায়াল নিয়ে সিনেমা করার জন্য। সরকিন তখন একটি খসড়া লিখে রাখেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি আর স্পিলবার্গ দুজনই অন্য প্রজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে সিনেমাটি তখন আর আলোর মুখ দেখেনি।
সরকিন ষাটের দশকের রাজনীতি আর সেই ট্রায়ালের ওপর লেখা অসংখ্য বই পড়েন। স্ক্রিপ্ট লেখার জন্য ট্রায়ালের আসামি হেইডেনের সাথেও বেশ কয়েকবার আলোচনা করেন। ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় তিনি পুনরায় সিনেমাটি নিয়ে আগ্রহ বোধ করেন। এবার তিনি নিজেই পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নেন।
সত্য ঘটনা থেকে যেমন অনেক কিছু ধার করেছেন, নাটকীয়তার খাতিরে বাড়তি অনেক কিছু যোগ করেছেন। এখানে প্রকৃত ঘটনার সাথে সিনেমার সাদৃশ্য আর অমিলগুলো নিয়ে বলা হবে। যারা সিনেমাটি দেখেননি, তাদের সতর্ক করা হচ্ছে যে এই প্যারায় সিনেমার বেশ কিছু স্পয়লার দেওয়া আছে।
- আদালতে বিচারক জুলিয়াস হফম্যানের আচরণ যেমন বিতর্কিত ছিল, বিবাদীরাও কম যাননি। সিনেমায় দেখা যায় অ্যাবি হফম্যান চরিত্রে অভিনয় করা সাচা ব্যারন কোহেন এবং জেরি রুবিন চরিত্রে অভিনয় করা জেরেমি স্ট্রং একদিন আদালতে হাজির হন আইনজীবীদের গাউন পরে। এটা আসলেই ঘটেছিল। তবে সিনেমায় যেভাবে গাউনের নিচে তাদেরকে পুলিশের ইউনিফর্ম পরতে দেখা গেছে, বাস্তবে সেটা ছিল না।
- সিনেমায় দেখা যায় জেরি রুবিনকে এক নারী গুপ্তচর ‘হানি ট্র্যাপ’ এর ফাঁদে ফেলে। বাস্তবে এমন কিছু হয়নি।
- টম হেইডেন চরিত্রে অভিনয় করা এডি রেডমেইনকে দেখানো হয়েছে আদলতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে ট্রায়ালের প্রথম দিন চুল কেটে এসেছে। রুবিন আর হফম্যানের প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করছে। বাস্তবে হেইডেন ছিলেন বিপ্লবী, কট্টর বামপন্থী। ষাটের দশকের ‘দ্য নিউ লেফট’ আন্দোলনের মূল পরিকল্পনাকারীদের একজন ছিলেন তিনি।
- ববি সিলকে সত্যি সত্যিই আদালতে বেঁধে রাখা হয়েছিল। সিনেমায় দেখা যায় তাকে বেঁধে রাখার সাথে সাথেই বাদী পক্ষের আইনজীবী রিচার্ড শুলজের চরিত্রে অভিনয় করা জোসেফ গর্ডন-লেভিট এসে বিচারক হফম্যানকে বলছেন মিসট্রায়ালের কথা। বাস্তবে সিলকে তিন দিন এভাবে আদালতে বেঁধে রাখা হয়েছিল।
- সিনেমায় ডেভিড ডেলিংগার চরিত্রে অভিনয় করা জন ক্যারল লিঞ্চ আদালতের কক্ষে এক পুলিশ সদস্যকে ঘুষি মারেন। বাস্তবে সেরকম কিছু হয়নি।
- সিনেমার শেষের দিকে আদালতের রায় ঘোষণার দিন হেইডেন চরিত্রে অভিনয় করা এডি রেডমেইনকে ভিয়েতনাম যুদ্ধে নিহত সেনাদের নাম পড়তে দেখা যায়। এটা ছিল চিরায়ত হলিউড সিনেমার নাটকীয়তা। বাস্তবে এটা ঘটেছিল আরো পূর্বে ১৯৬৯ সালের ১৫ অক্টোবর। সেটা হেইডেন পড়েননি, পড়েছিলেন ডেলিংগার। বিচারপতি হফম্যান থামিয়ে দেওয়ার পর তিনি কেবল অল্প কয়েকটা নামই পড়তে পেরেছিলেন। এমনকি ঘটনাটা যদি সরকিনের সিনেমার মতোও হতো, বাদী পক্ষের আইনজীবী শুলজ কখনোই সিনেমার মতো নিহত সেনাদের শ্রদ্ধা জানাতে দাঁড়াতেন না। নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক জে অ্যান্থনি লুকাসের মতে তিনি ছিলেন সরকারের হাতের পুতুল।
সেই আট জনের বর্তমান অবস্থা
টম হেইডেন: টম হেইডেন ২০১৬ সালে ৭৬ বছর বয়সে মারা যান। আমেরিকার নাগরিক অধিকার আন্দোলন ও যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের নেতা থেকে একসময় মূল ধারার রাজনীতিতে যোগ দেন। তিনি ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট অ্যাসেম্বলিতে এক দশক এবং ক্যাসিফোর্নিয়া স্টেট সিনেটে আট বছর দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি অকসিডেন্টাল কলেজ ও হার্ভার্ড ইন্সটিটিউট অব পলিটিক্সে শিক্ষকতা করেন। এছাড়া তিনি ১৭টি বইও লিখেন। তিনি তিন বার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার মধ্যে হলিউড অভিনেত্রী জেন ফন্ডার সাথে ১৭ বছর সংসার করেন।
অ্যাবি হফম্যান: তিনি সেই ট্রায়ালের পর অনেক বছর লোক চক্ষুর আড়ালে ছিলেন। তাকে আবার ১৯৮০ সালে দেখা যায়। বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতা করতেন আর কৌতুকাভিনেতা হিসাবে কাজ করতেন। তিনি বিষণ্নতায় ভোগছিলেন। ১৯৮৯ সালে ৫২ বছর বয়সে বারবিচুরেট ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করেন।
জেরি রুবিন: জেরি রুবিন ওয়াল স্ট্রিটে কাজ করতে যান। ১৯৯৪ সালে ৫৬ বছর বয়সে তিনি একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় নিহত হন।
ববি সিল: ৮৩ বছর বয়স্ক ববি সিল বর্তমানে টেক্সাসের লিবার্টিতে থাকেন। ১৯৭৩ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার ওকল্যান্ডের মেয়র পদে নির্বাচনে দাঁড়ান তিনি। নয় জন প্রার্থীর মধ্যে তিনি হন দ্বিতীয়। রাজনীতির প্রতি একসময় তার বিতৃষ্ণা চলে আসে। এরপর তিনি লেখালেখিতে মন দেন। ১৯৭৮ সালে তার আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘আ লোনলি রেজ’ লিখেন।
রিনি ডেভিস: ৮০ বছর বয়স্ক রিনি ডেভিস বর্তমানে কলোরাডোর বোয়েরথোডে থাকেন। তিনি ‘ফাউন্ডেশন ফর আ নিউ হিউমিনিটি’ নামে কলোরাডোভিত্তিক একটি আত্মোন্নয়নমূলক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।
ডেভিড ডেলিংগার: অভিযুক্তদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ ব্যক্তি। ২০০৪ সালে ৮৮ বছর বয়সে তিনি মারা যান। তিনি ‘ফ্রম ইয়েল টু জেল: দ্য লাইফ স্টোরি অব আ মোরাল ডিসেনটার’ নামে একটি বই লিখেন।
জন ফ্রয়েন্স: ৮১ বছর বয়স্ক জন ফ্রয়েন্স ইউসিএলএ ফিল্ডিং স্কুল অব পাবলিক হেলথের অ্যামিরেটাস অধ্যাপক। তিনি অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেলথ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের একটি বিভাগের পরিচালক হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন।
লি ওয়েইনার: ৮১ বছর বয়স্ক লি ওয়েইনার বর্তমানে আমেরিকার কানেকটিকাটে থাকেন। তিনি সেই মামলার কয়েক বছর পর ইহুদি অধিকার আদায়ের কর্মী হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। রাশিয়ান ইহুদিদের জন্য প্রতিবাদে অংশ নেন। এইডসের গবেষণার জন্য ফান্ড বৃদ্ধির জন্যও আন্দোলনে অংশ নেন। সম্প্রতি তিনি ‘কন্সপিরেসি টু রায়ট: দ্য লাইফ অ্যান্ড টাইমস অব ওয়ান অব দ্য শিকাগো সেভেন‘ নামে একটি বই লিখেছেন।