ইতিহাস অর্থ হলো মানুষের অতীত ঘটনা ও কার্যাবলীর অধ্যয়ন। আর ইতিহাস বলতে মূলত লিখিত ইতিহাসকেই বোঝানো হয়ে থাকে। অর্থাৎ ইতিহাসের সূচনা হয়েছে তখন থেকে, যখন মানুষ লিখতে শিখেছে। কিন্তু লিখতে শেখার আগেও পৃথিবীর বুকে মানুষের অস্তিত্ব ছিল। সেই সময়টিকে বলা হয়ে থাকে প্রাগৈতিহাসিক যুগ। অর্থাৎ পৃথিবীর বুকে মানুষের উদ্ভব থেকে শুরু করে লেখা আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত যে সময়কাল, সেটিই হলো প্রাগৈতিহাসিক যুগ।
পৃথিবীর বয়স ধরা হয়ে থাকে ৪.৫ বিলিয়নের মতো। তবে পৃথিবীর বুকে হোমো স্যাপিয়েন্সদের বিবর্তন শুরু হয়েছে আড়াই মিলিয়ন বছর আগে। আর যদি আধুনিক মানুষের উদ্ভব সম্পর্কে ধারণা করা হয়, তবে সেটিও ঘটেছে ২,০০,০০০ থেকে ৩,০০,০০০ বছর আগে। যদি আমরা তর্কের খাতিরে ধরেও নিই যে আধুনিক মানুষের উদ্ভব ঘটেছে ২,০০,০০০ বছর আগে, তার মানে এই সময়কালে পৃথিবীতে আগমন ঘটেছে আপনার অন্তত ৬,০০০ প্রজন্মের পূর্ব-পুরুষদের। এছাড়া এটি যিশুখ্রিস্ট ও রোমান সাম্রাজ্যের সময়কালেরও ১০০ গুণ, কিংবা সর্বপ্রাচীন লিখিত ইতিহাসের চেয়েও ৪০ গুণ অতীত।
প্রত্নতত্ত্ববিদরা মিশর থেকে আবিষ্কার করেছেন এমন কিছু লিখিত দলিল, যেগুলো খ্রিস্টপূর্ব ৩,২০০ অব্দের সময়কার। এর চেয়ে প্রাচীন লিখিত দলিল আর কোথাও পাওয়া যায়নি। তাই আমরা ধরে নিতে পারি, ইতিহাসের সূচনা হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব ৩,২০০ অব্দেই। এর আগ পর্যন্ত, অর্থাৎ পৃথিবীর বুকে আধুনিক মানুষের আগমন থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৩,২০০ অব্দ পর্যন্ত পুরো সময়টাই প্রাগৈতিহাসিক যুগ। এভাবেও বলা যায়, পৃথিবীতে মানবসভ্যতার আগমনের পরের মোট ৪১ ভাগের ৪০ ভাগ সময়কাল প্রাগৈতিহাস, আর বাকি ১ ভাগ ইতিহাস।
তাহলে ভেবে দেখুন, ইতিহাসের সূচনা ঘটার আগেও পৃথিবীতে মানুষের সাথে কত কিছুই না ঘটে গেছে। তারা কত সুখ-দুঃখের সাক্ষী হয়েছে, কত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে, কত সাম্রাজ্যের উত্থান ও পতন দেখেছে, আবার কত সভ্যতাকে দেখেছে কালের গহ্বরে চিরতরে হারিয়ে যেতে।
তবে প্রাগৈতিহাসিক যুগের অনেক ঘটনা সম্পর্কেও কিন্তু আমরা জানতে পেরেছি। নিশ্চয়ই কৌতূহল হচ্ছে, ইতিহাস রচনার আগের সময়কার ইতিহাস কীভাবে জানা সম্ভব! প্রশ্নটি অবান্তর নয়, এর যুক্তিসঙ্গত উত্তর রয়েছে। প্রাগৈতিহাসিক যুগের ইতিহাস কোথাও রচিত না হলেও, সে সময়ের ইতিহাস জানা যায় বিভিন্ন ধ্বংসাবশেষ ও শিল্প নিদর্শনের মাধ্যমে।
তাহলে এবার চলুন পাঠক, প্রাগৈতিহাসিক যুগের নানা ধ্বংসাবশেষ ও শিল্প নিদর্শনের মাধ্যমে যেসব তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে, সেগুলোর ভিত্তিতেই আমরা জেনে নিই প্রাগৈতিহাসিক যুগের প্রধান তিনটি সময়কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
প্রস্তর যুগ
প্রস্তর যুগকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করা যায়: প্রত্নপ্রস্তর যুগ, মধ্য-প্রস্তর যুগ, এবং নব্য-প্রস্তর যুগ। এই যুগেই প্রথম মানুষের পূর্বপুরুষেরা (খ্রিস্টপূর্ব ৩০,০০০ অব্দের দিকে) কৃষিকাজ ও খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে বিভিন্ন অস্ত্র ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার শুরু করে। তারা শিকার-সংগ্রহের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে ক্রমশ সভ্যতার গোড়াপত্তন ঘটাতে থাকে। এই যুগের শুরুর দিকে আধুনিক মানুষের পাশাপাশি প্রায় সমবৈশিষ্ট্যসম্পন্ন, হোমো গণের অন্তর্ভুক্ত নিয়ান্ডারথাল ও ডেনিসোভানরা বাস করত, যারা বর্তমানে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
পৃথিবীতে মানুষের আগমনের পর থেকে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১০,০০০ অব্দ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল প্রত্নপ্রস্তর যুগ। এ যুগের মানুষেরা শুরুর দিকে বাস করত গুহায়। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে তারা সাধারণ কুঁড়েঘর বা তাঁবুতে থাকতে শুরু করে। তারা সাদামাটা পাথর ও পশুর হাড়কে যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার শুরু করে, এবং পাখি ও বুনো জন্তু শিকারের জন্য অপরিপক্ব পাথর দিয়ে কুঠারও তৈরি করত। শিকার করা জন্তুর মাংসকে আগুনে পুড়িয়ে খেত তারা। সেই সাথে মাছ শিকার করত, গাছ থেকে বিভিন্ন ফলমূল এবং বীজ সংগ্রহ করত।
প্রস্তরযুগেই প্রথম শিল্পের নিদর্শনও পাওয়া যায়। এ যুগের মানুষেরা বিভিন্ন খনিজ পদার্থ, মাটি, পোড়ানো হাড়-মাংস ও কয়লাকে পানি, রক্ত, পশুর চর্বি ও গাছের কড়ার সাথে মিশিয়ে মানুষ, পশুপাখিসহ নানা ধরনের চিহ্ন খোদাই করত। এছাড়া তারা পাথর, কাদামাটি, এবং পশুর হাড় ও শিংয়ে ছোট ছোট দেহাকৃতি ফুটিয়ে তুলত।
এ যুগের সমাপ্তির মাধ্যমেই ইতি ঘটে সর্বশেষ বরফ যুগেরও, যার ফলে অনেক বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যায়, জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে, এবং মানুষ তাদের আদি-নিবাস ছেড়ে যাযাবর হতে শুরু করে।
মধ্যপ্রস্তুর যুগে (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১০,০০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৮,০০০ অব্দ) মানুষেরা ছোট ছোট পাথরের যন্ত্রপাতি ব্যবহার শুরু করে, যেগুলো পালিশ করা তো থাকতই, এমনকি অনেক সময় বল্লম বা তীর হিসেবে সেগুলোর সাথে সংযুক্ত থাকত পশুর শিং, হাড় কিংবা গাছের কাঠ। যাযাবর মানুষেরা নদী কিংবা জলাশয়ের ধারে অস্থায়ী নিবাস গড়ে তুলে সেখানে বাস করত। কিন্তু যখন থেকে কৃষিকাজের গোড়াপত্তন ঘটল, মানুষ এক জায়গায় স্থায়ীভাবে বসবাসের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করল, এবং সেজন্য বিভিন্ন গ্রামীণ সভ্যতা গড়ে তুলতে লাগল।
সর্বশেষ নব্যপ্রস্তুর যুগে (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৮,০০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৩,০০০ অব্দ) প্রাচীন মানুষেরা তাদের শিকারি-সংগ্রাহক পরিচয় পুরোপুরি মুছে ফেলতে শুরু করে, এবং কৃষিকাজের মাধ্যমে একস্থানে স্থায়ী হয়ে খাদ্য উৎপাদনের দিকে মনোনিবেশ করে। তারা বিভিন্ন পশুকে পোষ মানায়, এবং খাদ্যশস্য উৎপাদন করে। এ যুগে তারা আরো পালিশকৃত ও মসৃণ কুঠার, কাস্তে, বাটালি ব্যবহার শুরু করে কৃষিজমি কর্ষণের কাজে। কৃষিকাজের সুবিধার্থে তারা অপেক্ষাকৃত সমতল ভূমিকে বাসের জন্য বেছে নেয়, পাশাপাশি খেয়াল রাখে যেন কৃষিজমির থেকে নিকটস্থ জলাশয়ের দূরত্ব খুব বেশি না হয়। এ যুগে মানুষ গৃহনির্মাণসহ অন্যান্য বিভিন্ন শিল্পে পূর্বাপেক্ষা ব্যাপক উন্নতি ঘটায়। মৃৎশিল্প, সেলাই ও তাঁতশিল্প এ যুগে এসে হয় আরো উন্নত ও সমৃদ্ধ।
ব্রোঞ্জ যুগ
ব্রোঞ্জ যুগের স্থায়িত্ব ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩,০০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১,৩০০ অব্দ পর্যন্ত। এ সময়কালে ধাতুর ব্যবহারে ব্যাপক উন্নতি ঘটে। ব্রোঞ্জ, কপার ও টিনের আকরিকের মিশ্রণের মাধ্যমে উন্নত ধাতু তৈরি হয়। অপেক্ষাকৃত শক্ত, টেকসই ও মজবুত এই ধাতু পাথরের বিকল্প হিসেবে আবির্ভূত হয়। এর ফলেই ষাঁড় দিয়ে হালচাষ ও চাকা আবিষ্কারের ক্ষেত্র তৈরি হয়।
এ যুগে স্থাপত্যকলা ও শিল্পে বিশেষ উন্নতি ঘটে। একাধারে যেমন কামাররা চাকা প্রস্তুত করতে শিখে যায়, তেমনই কাপড় তৈরিতেও আসে অভূতপূর্ব সাফল্য। উল দিয়েই বেশিরভাগ কাপড় তৈরি করা হতে থাকে, যা পরবর্তীতে আবার হরেক রকমের পোশাকে রূপান্তরিত করা হয়। বাসস্থান হয়ে যায় গোল, যেখানে একটি বৃত্তাকার পাথরের দেয়ালের সাথে থাকে ছাদ ও অগ্নিকুণ্ড। এভাবে আধুনিক গ্রামের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে, এবং ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে শহর।
সংগঠিত সরকারব্যবস্থা, আইনকানুন ও যুদ্ধ-বিগ্রহের সূচনা ঘটে এ যুগেই। এছাড়া সংগঠিত ধর্ম পালনের সূচনাও মোটা দাগে ঘটে এ যুগ থেকেই। প্রাচীন মিশরীয়রা তাদের বিখ্যাত পিরামিড সৃষ্টিও করে এ সময়ে। প্রথম লিখিত দলিল, যেমন হায়ারোগ্লিফ এবং পেট্রোগ্লিফও এ যুগেরই নিদর্শন।
লৌহ যুগ
লোহাকে উত্তপ্ত করা ও পুনর্গঠনের বিদ্যা যখন মানুষ আয়ত্ত্ব করে, তখন থেকেই যাত্রা শুরু হয় লৌহ যুগের (আনুমানিকভাবে খ্রিস্টপূর্ব ১,৩০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৯০০ অব্দে)। তখনকার দিনে সোনার চেয়েও অধিক মূল্যবান হিসেবে বিবেচিত হতো লোহা, এবং ব্রোঞ্জ উৎপাদনের চেয়ে লোহা পেটানো ছিল অপেক্ষাকৃত সহজ।
ইস্পাতের নানা অস্ত্র ও যন্ত্রপাতির পাশাপাশি এ যুগে মানুষ স্থাপত্যকলায়ও পারদর্শী হয়ে ওঠে। চার ঘর বিশিষ্ট বাসস্থান থেকে শুরু করে জন্তু-জানোয়ারের জন্য পৃথক আস্তাবল, কিংবা পাহাড়ের উপর দুর্গ কিংবা প্রাসাদ, মন্দির এবং বিভিন্ন ধর্মীয় অবকাঠামো, এই সবকিছুই গড়ে ওঠে এ যুগে। বুনিয়াদি নগর পরিকল্পনাও শুরু হয় এ সময়।
কৃষিকাজ, শিল্প ও ধর্ম হয়ে ওঠে আগের চেয়েও অনেক বেশি বাস্তবসম্মত। লেখনী পদ্ধতির জনপ্রিয়তায় লিখিত দলিলের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, এবং শুরু হয় প্রাথমিক ঐতিহাসিক আমলের। আর এভাবেই পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে বিদায় নেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ।
ইতিহাসের চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/