ঘুম ভেঙে নিজেকে আবিষ্কার করলেন মাটির কয়েক ফুট নিচে, একটি কফিনের ভেতরে, বন্দী অবস্থায়। বেঁচে আছেন আপনি, অথচ মর্ত্যে আপনার কোনো অস্তিত্বই নেই। মৃত হিসেবে শেষকৃত্য সম্পন্ন করে আত্মীয়-স্বজনরা দাফন করে দিয়েছে আপনাকে। একবার কল্পনা করে দেখুন তো, কী হাল হবে আপনার তখন! কয়েক দশক আগেও যখন চিকিৎসাবিজ্ঞান এতোটা উন্নত হয়নি, সে সময় এই ঘটনাগুলো ছিল রীতিমতো বিভীষিকার মতো সত্য। তথাকথিত মৃতব্যক্তি কবরে তার চেতনা ফিরে পেয়েছে, এমন বেশ কিছু ঘটনার নজির রয়েছে ইতিহাসে। কেমন ছিল তাদের অভিজ্ঞতা? চলুন তবে জেনে আসা যাক।
নাতালিয়া প্যাস্টারনেক
সাইবেরিয়ার অধিবাসী নাতালিয়া প্রায়ই তার পোষা কুকুরটিকে নিয়ে জঙ্গলের দিকে হাঁটতে বের হতেন। ২০১৫ সালের মে মাসের এক বিকেলে বার্চ গাছের রস সংগ্রহ করতে একাই বেরিয়ে পড়েন তিনি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেদিনই জঙ্গলে তার সাথে দেখা হয়ে যায় মানুষখেকো ভাল্লুকের। নাতালিয়াকে আক্রমণ করে বসে জন্তুটি, থেঁতলে দেয় তার দুটি পা। হাতের কাছে একটি গাছের ডাল পেয়ে তা দিয়েই ভালুকটিকে মারতে থাকেন নাতালিয়া। কিন্তু অত বড় ভাল্লুকটি সামান্য একটি গাছের ডালের কাছে পরাজয় স্বীকার করবে কেন? অতঃপর খুব শীঘ্রই হার মানতে বাধ্য হন নাতালিয়া, অজ্ঞান হয়ে যান তিনি।
নাতালিয়া এখনো বেঁচে আছে এটুকু হয়তো বুঝতে পেরেছিল ভাল্লুকটি। পরে খাওয়া যাবে মনে করে মাটিতে গর্ত খুঁড়ে নাতালিয়াকে দাফন করে দেয় সে। মারাত্মক আহত নাতালিয়ার জ্ঞান ফিরে আসলেও তিনি বুঝতে পারছিলেন না কী করা উচিত তখন। জঙ্গলের মধ্যে চিৎকার করে কাউকে ডেকে লাভ হবে না, এটুকু তিনি জানতেন। তাছাড়া চিৎকার-চেঁচামেচিতে যদি ভাল্লুকটিই ফিরে আসে, সেই ভয়েও চুপ করে পড়ে থাকেন তিনি। কবরের মাটি কিছুটা সরিয়ে বাতাস ঢোকার রাস্তা বের করে নেন শুধু। এভাবে কেটে যায় এক রাত।
পরদিন সেই জঙ্গলে শিকার করতে আসে একদল শিকারি। সদ্য খোঁড়া মাটির ঢিবি দেখে কৌতূহলী হয়ে ভেতরে উঁকি দেন তারা। ময়লা-আবর্জনার মধ্যে আবিষ্কার করেন নাতালিয়ার আহত দেহ। কোনোমতে তিনি শুধু ‘ভাল্লুক’ শব্দটি উচ্চারণ করেন কয়েকবার, তা থেকেই পুরো ঘটনা বুঝতে পারেন শিকারিরা। দুজন মিলে টেনে বের করেন নাতালিয়াকে, আর বাকিরা চলে যান ভাল্লুক শিকার করতে। পুরোপুরি চেতনা ফিরে পাবার পর নাতালিয়ার প্রথম প্রশ্ন ছিল, “ভাল্লুকটা কি এখনো বেঁচে আছে?”
এই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে কয়েক মাস সময় লাগে নাতালিয়ার। তিনি যে বেঁচে ফিরতে পারবেন এ কথা নাকি ভাবতেই পারেননি কবরে থাকা অবস্থায়। সারাক্ষণ ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছেন যেন আরেকটিবার পৃথিবীর আলো দেখার সুযোগ পান। ভাল্লুকটি তার খাবার খুঁজে পাওয়ার আগেই শিকারিরা তাকে পেয়ে গেছে, সেজন্য ঐ শিকারিদের আর নিজের ভাগ্যকে বারংবার ধন্যবাদ দেন তিনি।
টম গ্রুয়েন
১৮৪৫ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ১৮৫২ সাল পর্যন্ত আয়ারল্যান্ড জুড়ে চলতে থাকে নিদারুণ এক দুর্ভিক্ষ। প্রায় এক মিলিয়ন মানুষ মারা যায় এই দুর্ভিক্ষে। বিপুল সংখ্যক মৃতদেহ দাফন করার মতো পর্যাপ্ত জায়গা বা সময় কোনোটাই ছিল না কবর খননকারীদের হাতে। এতো দ্রুত কাজ করতে হচ্ছিল তাদের যে, বেশ বড় ধরনের কিছু ভুল করে ফেলেন তারা। সে সময় এমনই এক মর্মান্তিক ভুলের শিকার হন টম গ্রুয়েন। ভুলবশত তিন বছরের বাচ্চা ছেলেটিকে দাফন করে দেয় গণকবর দিতে থাকা গোরখোদকরা। বেঁচে ফিরে আসে বাচ্চাটি আর নিজ হাতে জায়গা করে নেয় ইতিহাসে।
আশেপাশের সবাই মনে করেছিল মারা গেছে গ্রুয়েন, কাজেই দ্রুত হাতে তাকে দাফন করে দেয় তারা। যেহেতু তখন গণকবরের ব্যবস্থা করা হচ্ছিল, সবার জন্য জায়গার ব্যবস্থা করতে গিয়ে কোদালের আঘাতে টমের দুই পা-ই ভেঙে ফেলে গোরখোদকরা। অজ্ঞান টম এসবের কিছুই বুঝতে পারেনি, জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে সে আবিষ্কার করে আরও অসংখ্য মৃতদেহের সাথে, মাটির নিচে। ভাঙা পা নিয়ে কোনোমতে টেনে-হিঁচড়ে এগোতে থাকে সে। দু হাত দিয়ে উপরের মাটি সরিয়ে বেরিয়ে আসে কবর থেকে।
এই ঘটনার দ্বিতীয় একটি সংস্করণ আছে, কেউ কেউ মনে করেন কোদাল দিয়ে পা ভাঙার সময় গুঙিয়ে ওঠে টম। কাজেই তাকে আর কবর দেয়া হয় না। তবে টম গ্রুয়েন নিজেই এই গল্পটির সত্যতা নাকচ করে দেন। অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে জীবন ফিরে পেলেও, পা দুটো আর কখনো ভালো হয়নি তার। লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটতেন তিনি। ১৮৯০ সালে সরকারের কাছে আবেদন জানান কৃত্রিম পায়ের ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্য। নিজের অকাল সমাধি সম্পর্কে একটি কবিতা লিখে গেছেন তিনি,
I rose from the dead in the year ’48
When a grave at the Abbey had near been my fate,
Since then for subsistence I have done all my best
Though one shoe points eastward and the other points west.
মাইক মিনি
মাইক মিনিকে মানসিকভাবে অপ্রকৃতস্থ বলে দাবি করলেও বোধহয় আপত্তি জানানোর মতো লোক খুব একটা খুঁজে পাওয়া যাবে না। এতক্ষণ আমরা যাদের কথা শুনছিলাম, তাদের তুলনায় একটু ব্যতিক্রমী তিনি। মদের দোকানের পরিবেশক আইরিশ এই ব্যক্তি কবরে থাকার অভিজ্ঞতা কেমন তা জানতে নিজেই নিজের জন্য কবর খোঁড়েন। তিনি যে কী বোঝার চেষ্টা করছিলেন তা বোঝাটা একটু কষ্টকর হলেও টানা ৬১ দিন মাটির নিচে কাটিয়ে জীবিত ফিরে আসা এই ব্যক্তি গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লিখিয়েছিলেন ঠিকই।
মিনির ইচ্ছা ছিল কফিনে করে তাকে কবরে রেখে আসা হোক, ঠিক যেমনটা করা হয় মৃতব্যক্তির বেলায়। মিনির বন্ধুরা তার ইচ্ছা পূরণ করতে ১৯৬৮ সালে লন্ডনের এক গোরস্থানে রেখে আসেন তাকে। কফিনের ভেতরে ছোট একটি ছিদ্র রাখা হয়, যাতে কার্বন ডাই অক্সাইডের বিষক্রিয়ায় সত্যি সত্যি মারা না যান তিনি। ঐ ছিদ্র দিয়েই খাবার আর পানি পাঠানো হতো তার জন্য। বলা যায়, বন্ধুদের পকেট থেকে বেশ বড় অঙ্কের টাকা খসিয়ে নিজের খায়েশ মিটিয়ে ছিলেন মিনি!
৬১ দিন পর মাটির নিচ থেকে উঠে আসেন মিনি। চোখে ছিল সানগ্লাস, যাতে আলোর তীব্রতা তার দৃষ্টিশক্তির কোনো ক্ষতি করতে না পারে। পরবর্তীতে মাটির নিচে থাকার দিনগুলোকে মিশকালো অন্ধকার আর একাকিত্বের সাথে যুদ্ধ হিসেবে বর্ণনা করেছেন তিনি। আর কিছুদিন থাকলে নির্ঘাত পাগল হয়ে যেতেন বলে মনে হয়েছিল তার। যদিও বন্ধুদের দাবি, তিনি আসলেই একজন বদ্ধ উন্মাদ, নাহলে এমন কাজ কেউ করে! তবে গিনেস বুকের যে রেকর্ডের জন্য এত কিচ্ছা, গিনেস কর্তৃপক্ষ কিন্তু পরে তা বাতিল করে দিয়েছে। জীবননাশক কোনো পাগলামিকে রেকর্ড হিসেবে আখ্যা দিতে নারাজ তারা। অতঃপর জলে গেল মিনির সব অভিজ্ঞতা।
কম্পটনের শিশুটি
২০১৫ সালের নভেম্বরে কম্পটনের রাস্তা ধরে গল্প করতে করতে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন দুই নারী। হঠাৎ একদম ছোট্ট শিশুর কান্নার শব্দ কানে আসে তাদের। শব্দের উৎস সন্ধান করতে করতে বিস্ময়ের সাথে আবিষ্কার করলেন বাচ্চাটির কান্নার শব্দ আসছে মাটির নিচ থেকে। তাড়াহুড়া করে পুলিশকে ফোন করেন তারা। কর্তৃপক্ষ এসে মাটির নিচ থেকে একটি নবজাতক মেয়ে শিশুকে জীবিত উদ্ধার করে।
এক বা দুদিন বয়স ছিল বাচ্চাটির। দ্রুত তাকে নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যায় পুলিশ ও উদ্ধারকর্মীরা। মজার ব্যাপার হলো, বাচ্চাটির গায়ে জড়ানো ছিল একটি হাসপাতালের কম্বল। তার মানে ঐ হাসপাতালেই জন্ম হয় তার। গোয়েন্দারা সেই হাসপাতালে গিয়ে খোঁজখবর নিতেই বেরিয়ে পড়ে বাচ্চার মায়ের পরিচয়। তাকে ধরিয়ে দিতে ৫০ হাজার ডলার পুরষ্কারের ঘোষণা দেয় কর্তৃপক্ষ। কাজেই তাকে খুঁজে বের করতেও খুব বেশি সময় লাগে না।
পরবর্তীতে সন্তানকে বিপদের মুখে ঠেলে দেয়া এবং হত্যার প্রচেষ্টার অপরাধে ঐ নারীকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠিয়ে দেয় পুলিশ। বাচ্চাটি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে। কবরে তার দিন কীভাবে কাটছিল জানে না সে। পৃথিবীর আলো ঠিকমতো দেখার আগেই যে বীভৎসতার শিকার সে হয়েছে, তা না জানাটাই তার জন্য ভালো।