আজকের ইতালি। সংস্কৃতিপ্রেমী ও ভ্রমণপিপাসু মানুষের অন্যতম প্রধান গন্তব্য ও প্রিয় স্থান।
ইতিহাসে দেশটির উত্থান-পতন আর রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির বৈচিত্র্য পরিপূর্ণভাবে বোঝার জন্য সম্ভবত একটি জীবন যথেষ্ঠ নয়। প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্য থেকে মধ্যযুগের ক্যাথলিক রোম, রেনেসাঁর ফ্লোরেন্স ও তার নতুন উদ্যম থেকে ভেনিসের বাণিজ্য বিস্তার- ইতালি যেন এক অর্থে সমস্ত বিশ্ব ইতিহাসের এক সংক্ষিপ্ত রূপ।
আজকের ইতালি সাহিত্য, শিল্পকলা ও বিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃত। তবে পৃথিবীর মানচিত্রে কিন্তু দেশটির আকার সবসময় এমন ছিলো না। বরং বিভিন্ন সময় বৈদেশিক শক্তির আধিপত্য দেশটির উপর চেপে বসেছিলো। তার বিরুদ্ধে সংগ্রামও কম হয়নি। উনিশ শতকে বিভিন্ন বিদেশী হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে এক জাতীয়তাবাদী সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে ইতালি এখনকার রুপ পেয়েছিলো। আর তার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জিউসেপ গ্যারিবল্ডির মতো এক কালজয়ী নেতা ও যোদ্ধা।
গ্যারিবল্ডির জন্ম ১৮০৭ সালে ইতালির নিস শহরে। যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, সেই সময় দেশটির বড় দুর্দিন চলছিলো। সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রান্সিস পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। ফরাসি বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সের প্রভাবে ইতালিতেও সমাজ ও রাষ্ট্রে আমূল পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগলো। ফলে দেশের প্রশাসন, আইন ও অর্থব্যবস্থায় নতুনের আবির্ভাব হতে লাগলো। ফ্রান্সে নেপোলিয়নের পতনের পর দেশটির অধিকাংশ অঞ্চল অস্ট্রিয়ার প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ শাসনের অধীনে চলে যায়। অস্ট্রিয়া ইতালির ঐক্যের পথে সবচেয়ে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।
সেসময় অনেক দেশপ্রেমিক চিন্তাবিদ ইতালির ঐক্যের জন্য কাজ করছিলেন। তবে সবার পদ্ধতি এক ছিলো না। ক্ষেত্রবিশেষে এসব পথ অনেক পরস্পরবিরোধীও ছিলো। ভিনসেঞ্জো গিওবের্তি চাইতেন পোপের অধীনে ইতালীয় রাজ্যগুলো নিয়ে একটি কনফেডারেশন হোক। আবার জিউসেপ মাজ্জিনি আর কার্লো কাত্তানিয়ো চাইতেন ফেডারেল রিপাবলিক ধাঁচের রাষ্ট্রব্যবস্থা। তবে শুনতে ভালো মনে হলেও তা সময়ের তুলনায় অগ্রবর্তী ছিলো। সেজন্য বেশিরভাগ ইতালীয় স্বাধীনতাকামী তাদের সাথে দ্বিমত করতেন।
এমন অবস্থায়ই গ্যারিবল্ডি বেড়ে উঠছিলেন। তার মা-বাবা তাকে পাদ্রী বানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার দুঃসাহসী মানসিকতা নাবিক জীবনের দিকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলো। ১৮৩৩ সালে মাজ্জিনি’র সমর্থক ‘ইয়ং ইতালি’ দলের সাথে তার পরিচয় হয়। সেই বছরই মাজ্জিনির সাথে পিডমেন্টের নাবিক বিদ্রোহের এক অভিযানে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। সেই অভিযান ব্যর্থ হয়েছিলো। জেনোয়ার আদালত তাকে প্রাণদণ্ড দেয়। তিনি ইতালি থেকে পালিয়ে নৌপথে দক্ষিণ আমেরিকা পাড়ি দিলেন।
এই দুঃসাহসী দেশকর্মী দক্ষিণ আমেরিকায়ও বিভিন্ন বিপ্লবী কাজে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ব্রাজিলে আশ্রয় নেবার সময় অ্যানিতা মারিয়া দাসিলভার সাথে তার পরিচয় হয়। অ্যানিতা ছিলেন ব্রাজিল সাম্রাজ্যের বিরোধী ‘রিওগ্র্যান্দিজ রিপাবলিক’ এর কর্মী। তিনি পরবর্তীতে গ্যারিবল্ডির জীবনসঙ্গীও হয়েছিলেন। ১৮৪২ সালে গ্যারিবল্ডি উরুগুয়ের গৃহযুদ্ধে অংশ নেন। এই গৃহযুদ্ধের মাধ্যমেই ইতালীর স্বাধীনতার অন্যতম কর্মী দল ‘রেডশার্ট’ এর জন্ম হয়।
দক্ষিণ আমেরিকায় থাকার সময়ও তিনি মাজ্জিনির সাথে যোগাযোগ রেখেছিলেন। মাজ্জিনি তখন লন্ডনে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছিলেন। ব্রাজিলে থাকার সময় বিদ্রোহী ইতালিয়ানদের সাথে যোগাযোগ করার ক্ষেত্রে মাজ্জিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন।
১৮৪৮ সালে গ্যারিবল্ডি তার অনুরাগী ‘রেডশার্ট’ দলের যোদ্ধাদের নিয়ে ইতালিতে ফিরে আসেন। সার্ডিনিয়ার রাজা চার্লস আলবার্টকে সহায়তার প্রস্তাব দিলেন। গ্যারিবল্ডির ভূমিকা জানা সত্ত্বেও তিনি তাকে ভালো চোখে দেখলেন না। সার্ডিনিয়ার আশা ত্যাগ করে তিনি মিলানে যাওয়া ঠিক করলেন। সেখানকার আঞ্চলিক সরকার তখন অস্ট্রিয়ার আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করছিলো। এই বছরের ২৩ মার্চ থেকে ইতালির প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। সার্ডিনিয়া রাজ্য এতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। সিসিলি ও মিলানে অস্ট্রিয়া বিরোধী আন্দোলন এই যুদ্ধে উৎসাহ যুগিয়েছিলো। কিন্তু ১৮৪৯ সালের ২২ আগস্ট এই যুদ্ধে সার্ডিনিয়া পরাজিত হলো।
গ্যারিবল্ডি তার বাহিনী নিয়ে রোমের পথে গেলেন। এই অঞ্চল ফ্রান্সের আধিপত্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলো। মাজ্জিনির আদেশে তিনি রোমের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব নিলেন। ফরাসি বাহিনীকে প্রথমত বীরত্বের সাথে মোকাবেলা করলেও কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে পিছিয়ে যেতে বাধ্য হন। অস্ট্রিয়ান, ফরাসী ও স্পেনীয় হামলার মুখে তিনি ইতালি ত্যাগ করে আবার আটলান্টিকের ওপারে পাড়ি জমান।
নিউ ইয়র্কের স্ট্যাটেন আইল্যান্ডে বিখ্যাত ইতালিয়ান-আমেরিকান বিজ্ঞানী এন্তোনিও মেচ্চির সাথে তার সাক্ষাৎ হয়। ১৮৫০ সালে তিনি ইংল্যান্ডে মাজ্জিনির সাথে সাক্ষাৎ করেন। ১৮৫৪ সালে তিনি ইতালিতে ফিরে আসেন। রাজনৈতিক সতর্কতার জন্য তিনি বেশ কিছুদিন কৃষকের জীবনযাপন করছিলেন।
১৮৫৯ সালে ইতালির দ্বিতীয় স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হলো। সার্ডিনিয়া ও ফ্রান্স অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে একত্রে যুদ্ধ ঘোষণা করলো। গ্যারিবল্ডি অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য ‘হান্টার্স অব দি আল্পস’ নামে একটি বাহিনী গঠন করলেন। এই যুদ্ধে শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে অজেয় বীরত্ব দেখালেও ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়ার মধ্যকার চুক্তির ফলে শেষ অবধি ইতালীয়দের আশা ব্যর্থ হয়।
১৮৬০ সালের এপ্রিল মাসে সিসিলি রাজ্যে রাজনৈতিক উত্তেজনা তৈরি হচ্ছিলো। গ্যারিবল্ডি এই সুযোগ কাজে লাগাতে চাইলেন। তিনি তার ‘রেডশার্ট’ দলের প্রায় এক হাজার সদস্য একত্রিত করলেন। পিয়েমন্তে ও লমবার্দো জাহাজে করে ১১ মে সিসিলিতে অবতরণ করলেন। শত্রুসেনার ১,৫০০ সৈন্যের বিরুদ্ধে তিনি ৮০০ সৈন্যের বাহিনী নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। ১৫ মে তিনি যুদ্ধে জয়লাভ করলেন। নিজেকে সিসিলির শাসক হিসেবে ঘোষণা করে সিসিলির অন্তর্গত পালের্মোর দিকে অগ্রসর হলেন। কিন্তু ফরাসি বাহিনী পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করে ফিরে এসে প্রবল বোমাবর্ষণ করতে লাগলো।
গ্যারিবল্ডির সংকট মুহূর্তে একজন ব্রিটিশ সেনানায়কের সৈন্যসহ আগমন দৈব সাহায্যের মতো কাজে এলো। এই মিলিত শক্তির কাছে ফরাসি বাহিনী পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করলো। এই বিজয় তার জন্য এক ঐতিহাসিক মাইলফলক হয়ে রইলো। বিভিন্ন বৈদেশিক শক্তি গ্যারিবল্ডিকে তার সাফল্যের জন্য অভিনন্দিত করলো। সিসিলি জয় করার পর তিনি মিসসিনিয়া প্রণালি অতিক্রম করে উত্তরের দিকে অগ্রসর হলেন। ৭ সেপ্টেম্বর নেপলসে প্রবেশ করার পর অধিবাসীদের কাছ থেকে অভূতপূর্ব সংবর্ধনা পেলেন।
১৮৬১ সালে সমগ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গৃহযুদ্ধে আক্রান্ত হলো। দেশটির ইউনিয়ন আর্মির একটি রেজিমেন্টের নাম ‘গ্যারিবল্ডি গার্ড’ রেখে সম্মান দেখানো হলো। তিনি নিজেও তার বাহিনীকে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের কাজে নিয়োজিত করলেন। গ্যারিবল্ডি ও লিংকন দুজনেই একে অন্যের গুণগ্রাহী ছিলেন।
১৮৬১ সালেই ‘কিংডম অব ইতালি’ কার্যত প্রতিষ্ঠা পেলো। পুরো দক্ষিণাংশ ভিক্টর ইমানুয়েলের হাতে ন্যস্ত করে গ্যারিবল্ডি তাকে রাজা হিসেবে সম্মানিত করলেন। এই বছরের ৭ নভেম্বর ইমানুয়েলের রাজকীয় বহরে তার পাশেই বসে গ্যারিবল্ডি জনতার অভিবাদন গ্রহণ করেছিলেন। তবে রাজা কিন্তু গ্যারিবল্ডির জনপ্রিয়তা খুব একটা ভালো চোখে দেখলেন না। বরং তার মধ্যে এক আমূল বিপ্লবীর ছায়া দেখে রাজা সতর্ক হয়ে থাকলেন।
গ্যারিবল্ডি এবার রোমের দিকে নজর দিলেন। ফ্রান্সের সাথে সহযোগিতার কারণে পোপ ও রোমান ক্যাথলিক চার্চের প্রতি তার বিতৃষ্ণা ছিলো। তার ইচ্ছে ছিলো রোম জয় করার। কিন্তু ইতালির রাজা ভিক্টর ইমানুয়েল প্রমাদ গুনলেন। তিনি নিজের বাহিনীকে আদেশ দিলেন গ্যারিবল্ডিকে প্রতিরোধ করতে। তিনি অ্যাসপ্রোমন্তের যুদ্ধে গুরুতর আহত হলেন। তাকে বন্দী করা হলো।
১৮৬৬ সালে ইতালির সাথে অস্ট্রিয়ার যুদ্ধ আরম্ভ হলো। রাজার আদেশে গ্যারিবল্ডি যুদ্ধে সেনানায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। কয়েকটি সংঘর্ষে সফলতা পাবার পর ১৮৬৭ সালে তিনি আবার রোমে অভিযান পরিচালনা করলেন। রাজা ইমানুয়েল এবারও গোপনে বাঁধা দিলেন। পবিত্র শহরকে রক্ষা করতে ফরাসি বাহিনী আক্রমণ করলো। আবারও তিনি বন্দী হলেন।
১৮৭০ সালে ফ্রান্সে সাময়িক বিপ্লব হলো। গ্যারিবল্ডি প্রুশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ফ্রান্সকে সহায়তা করলেন। যুদ্ধের কারণে রোম থেকে ফরাসি সৈন্য সরানো হলে ইতালীয় বাহিনী অনেকটা কষ্ট ছাড়াই রোম দখল করতে সমর্থ হলো।
গ্যারিবল্ডি একজন আজীবন বিপ্লবী ও সৈনিক ছিলেন। ইতালির স্বাধীনতা ও একত্রীকরণের জন্য তিনি জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তবে তার ক্ষমতার মোহ ছিলো না। তার চিন্তাধারা সমকালীন দেশপ্রেমিক চিন্তাবিদ ও সংগ্রামীদের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রসর ছিলো। যুদ্ধবিদ্যার ইতিহাসেও তিনি স্মরণীয়। গেরিলা যুদ্ধের কৌশল ও রণনীতিতে তাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়। ১৮৮২ সালের ২ জুন তিনি ইতালির ক্যাপ্রেরা অঞ্চলে মৃত্যুবরণ করেন।
গ্যারিবল্ডি সম্পর্কে আরও জানতে পড়ুন এই বইটি