অপরাধীকে শাস্তি দেয়া হোক- এমনটা চায় সবাই। তবে আজকালকার দিনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি অর্থাৎ মৃত্যুদন্ড কার্যকরের বেলায় প্রায় একই ধারা অনুসরণ করে থাকে। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় চোখ পড়লে বিস্ময়ে মুখ হাঁ হয়ে যেতে বাধ্য। কারণ তখনকার দিনে একজন অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এতটাই ভয়াবহ অত্যাচার পদ্ধতির দ্বারস্থ হতো, যা আজকের দিনের কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। ফেলে আসা দিনের কল্পনাতীত সেসব নির্যাতনের কাহিনী দিয়েই সাজানো হয়েছে আজকের পুরো লেখা।
গামলা
অপরাধীকে একটি গামলায় এমনভাবে রাখা হতো যাতে তাদের মাথাটিই শুধু বাইরে থাকে। এরপর একজন প্রহরী এসে তার মুখে মধু ও দুধ মেখে দিয়ে যেতো! ফলে অল্প সময়ের মাঝেই মাছি এসে সেখানে জড়ো হতো। তাকে নিয়মিতভাবেই খাবারদাবার দেয়া হতো এবং শেষ পর্যন্ত নিজের মলমূত্রের মাঝেই গামলায় থেকে মৃত্যুবরণ করতে হতো অপরাধীকে।
পিতলের ষাঁড়
বন্দী নির্যাতনের জন্য এ ষাঁড়টি ব্যবহৃত হতো প্রাচীন গ্রীসে। একটি দরজা দিয়ে অপরাধীকে ঢুকিয়ে তারপর সেটি বন্ধ করে দেয়া হতো। এরপর নিচে থেকে জ্বালিয়ে দেয়া হতো আগুন। উত্তাপে পিতলের তৈরি এ ষাঁড়টি গনগনে লাল বর্ণ ধারণ করার আগপর্যন্ত আগুন জ্বলতেই থাকতো। তারপর আগুন নেভানো হতো। ততক্ষণে ভেতরে থাকা মানুষটি যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে পুড়ে মারা যেতো। আর ভেতরে আটকে পড়া তার সেই আর্তনাদ অনেকটা ষাঁড়ের গর্জনের মতোই শোনা যেতো।
শূলে চড়ানো
এক্ষেত্রে দোষী ব্যক্তিকে তীক্ষ্ম ফলা বিশিষ্ট মোটা একটি দন্ডের উপর জোর করে বসিয়ে দেয়া হতো। এরপর ধীরে ধীরে দন্ডটি উপরের দিকে উঠাতে থাকলে অপরাধীর নিজের ওজনেই আস্তে আস্তে দন্ডটি তার শরীর ভেদ করে ঢুকতে থাকতো ছবির মতো করে। এভাবে একজন ব্যক্তির মারা যেতে ৩ দিন পর্যন্ত সময় লাগতো। এ ধরণের শাস্তি প্রদানের ব্যাপারে বেশ কুখ্যাত ছিলেন ভ্লাদ দ্য ইম্পেলার। কথিত আছে, একবার তিনি খেতে খেতে ২০,০০০ মানুষকে শূলে চড়িয়ে তা উপভোগ করেছিলেন।
কাঁটা
একটি বেল্টে দুই প্রান্তে কাঁটা বিশিষ্ট এ জিনিসটি আটকে তা অপরাধীর গলায় পরিয়ে দেয়া হতো। কাঁটার একদিক থাকতো তার চিবুকের নিচে, অপরদিক স্টার্নামে। এরপর দোষী ব্যক্তিকে ঝুলিয়ে দেয়া হতো। গলায় দ্বিমুখী কাঁটা আটকে থাকায় বেচারা সারাক্ষণ গলা সোজা করে রাখতে বাধ্য হতো। ঘুম আসলেই খবর ছিলো!
কাঁটার মালা
কাঠ কিংবা ধাতব পদার্থের তৈরি এ মালাও পরানো হতো দোষীর গলায়। ফলে মাথা নিচু করা, খাওয়াদাওয়া করা কিংবা শোয়া- কোনোকিছুই করতে পারতো তা তারা।
ক্রুশবিদ্ধকরণ
এক্ষেত্রে একজন ব্যক্তিকে কাঠের তক্তায় চড়িয়ে বেঁধে রাখা হতো কিংবা তার হাতে পেরেক গেঁথে আটকে রাখা হতো। এভাবে বেশ কিছুদিন রাখার ফলে শ্বাসরোধ হয়ে একসময় মৃত্যু ঘটতো দন্ডিত ব্যক্তির।
লেড স্প্রিঙ্কলার
প্রথমে গলিত সীসা, আলকাতরা, গরম পানি কিংবা গরম তেল দিয়ে পূর্ণ করা হতো যন্ত্রটি। তারপর অপরাধীর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ঢেলে দেয়া হতো সেগুলো। ফলে যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে একসময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তো বেচারা।
আয়রন মেইডেন
লোহার তৈরি এ কেবিনেটের দরজার ভেতরের দিকে কাঁটার মতো অংশ থাকতো। অপরাধীকে একবার ভেতরে ঢুকিয়ে দিলেই কাঁটার কারণে তার পক্ষে আর নড়াচড়া করা সম্ভব হতো না। তখন অপর পাশ থেকে প্রশ্নকর্তা তাকে নানা বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতেন আর দরকার মনে করলে সেসব খাঁজকাটা অংশ দিয়ে খোঁচাও দিতেন।
কফিন টর্চার
মধ্যযুগের অত্যন্ত পরিচিত এক নির্যাতন পদ্ধতি ছিলো এ কফিন টর্চার। লোহার তৈরি এসব খাঁচায় একজন মানুষকে ঢুকিয়ে তার উপর নির্যাতন করা হতো বলেই এরুপ নামকরণ। কাউকে সেই খাঁচায় ঢুকিয়ে তারপর ছবির মতো করেই গাছ কিংবা অন্য কোনো অবলম্বন থেকে ঝুলিয়ে রাখা হতো। তাদের মৃতদেহ শবভূক পাখিদের খাদ্যে পরিণত হবার আগপর্যন্ত সেখানে থাকা লাগতো দুর্ভাগাদের।
থাম্বস্ক্রু
থাম্বস্ক্রু বা পিলিউইঙ্কস নামে পরিচিত এ যন্ত্রটি ব্যবহার করা হতো মধ্যযুগে, বন্দীদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায়ের উদ্দেশ্যে। উপরের হাতলটি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ভেঙে দেয়া হতো হাত ও পায়ের আঙুল। এতেও কাজ না হলে এরই বড় ভার্সন ব্যবহার করে ভাঙা হতো অপরাধীর কনুই ও হাঁটু। আর যদি তাতেও কাজ না হতো, তাহলে হেড ক্রাশার মানে মাথা ভেঙে গুড়ো গুড়ো করে দেয়ার চলও ছিলো।
গিলোটিন
গিলোটিনের মাধ্যমে মৃত্যুদন্ড কার্যকর পদ্ধতি মানব ইতিহাসে বেশ কুখ্যাত এক বিষয়। এ পদ্ধতিতে একটি দড়িতে প্রথমে ধারালো ব্লেড আটকে ঝুলিয়ে রাখা হতো। এরপর অপরাধীর মাথা ফ্রেমে জায়গামতো রেখে দড়ি ছেড়ে দিলেই দেহ থেকে আলাদা হয়ে যেতো মাথাটি। এতক্ষণ ধরে যেসব নির্যাতনের কথা বললাম, তার মাঝে গিলোটিনে মৃত্যুই সবচেয়ে দ্রুত কার্যকর হওয়ায় আগেকার দিনে এটাকেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সবচেয়ে ‘মানবিক’ উপায় হিসেবে গণ্য করা হতো!
র্যাক
মধ্যযুগে পৃথিবীতে যত রকম নির্যাতন চালু থাকার কথা জানা যায়, তার মাঝেই র্যাকের ব্যবহারকেই ধরা হয়ে থাকে সবচেয়ে নির্মম। এর উপরে ও নিচে দুটি করে মোট চারটি দড়ি থাকতো। অপরাধীকে সেখানে এনে তার হাত-পা ছবিতে দেখানো উপায়ে বেঁধে ফেলা হতো। এরপর একজন নির্যাতনকারী এসে দোষী ব্যক্তির হাত-পায়ের কাছে থাকা হ্যান্ডেলগুলো ঘোরাতে শুরু করতো। এভাবে লোকটির হাত-পা ছিঁড়ে আসার আগপর্যন্ত চলতো এ নির্যাতন!
জিহ্বা কেটে ফেলা
আদালত যদি দোষী ব্যক্তির জিহ্বা কাটার রায় দিতো, তাহলে ব্যবহার করা হতো কেচির মতো দেখতে এ জিনিসটি। অবশ্য এর আগে মাউথ ওপেনার ব্যবহারের মাধ্যমে জোর করে দন্ডিত ব্যক্তির মুখ খুলে রাখার ব্যবস্থাও নেয়া হতো।
ইঁদুরের হাতে মৃত্যু
আগেকার দিনের নৃশংসতার আরেক ভয়াবহ নমুনা ছিলো এ নির্যাতন। এ পদ্ধতিতে বন্দী ব্যক্তির পেটের উপর একটি বাক্স বেঁধে এর ভেতর কিছু ইঁদুর ছেড়ে দেয়া হতো। বাক্সটির সবদিক বন্ধ থাকলেও শুধু বন্দীর শরীরের সংস্পর্শে থাকা অংশ খোলা থাকতো। এরপর বাক্সের আশেপাশে থেকে প্রচন্ড উত্তাপ দেয়া হতো। তখন পালানোর আর কোনো জায়গা না পেয়ে ইঁদুরগুলো বন্দীর শরীরের ভেতরেই মাংস খেয়ে খেয়ে ঢুকতো!
সিমেন্টের জুতা
সিমেন্টের জুতার আগমন ঘটেছিলো আমেরিকান মাফিয়াদের হাত ধরে। তারা যখন কোনো শত্রু, বিশ্বাসঘাতক কিংবা গোয়েন্দাকে শেষ করে দিতে চাইতো, তখন তার পা দুটো প্রথমে আংশিক পোড়া কাঠের ব্লকের মাঝে রাখতো। এরপর সেই ব্লকটিকে তারা বালু-সিমেন্টের মিশ্রণ দিয়ে ভরে দিতো। কিছুক্ষণ পর সেই মিশ্রণটি শুকিয়ে গেলে দোষী ব্যক্তিটি সেখানেই আটকা পড়তো। এরপর তাকে ফেলা দেয়া হতো কোনো জলাশয়ে। সেখানেই সলিল সমাধি হতো তার।
ক্যাথেরিন হুইল
কোনো অপরাধীকে যদি খুব ধীরে ধীরে মারার দরকার হতো, তাহলে ক্যাথেরিন হুইল নামক এ জিনিসটির শরণাপন্ন হতেন বিচারকেরা। এজন্য দোষীকে ব্যক্তিকে প্রথমে বড়সড় একটি কাঠের চাকার স্পোকের সাথে দৃঢ়ভাবে বাঁধা হতো। এরপর সেই চাকাটি আস্তে আস্তে ঘোরানো হতো। একই সময়ে একজন লোক হাতুড়ি দিয়ে অপরাধীর শরীরের নানা জায়গায় নির্মমভাবে পেটাতে থাকতো। হাড়গোড় ভেঙে একাকার হয়ে গেলে তাকে সেখানেই ফেলে রাখা হতো। কখনো আবার উঁচু পোলে ঝুলিয়ে রাখা হতো যাতে পাখিরা এসে তাকে খেয়ে যায়। এভাবেই একসময় মারা যেত অপরাধী ব্যক্তিটি।
করাত
করাত দিয়ে কাউকে মারতে গেলে তাকে ছবির মতো উল্টো করে ঝোলানো হতো। এরপর শরীরের মাঝ বরাবর তার দেহটি কাটা হতো। যন্ত্রণার মাত্রা বাড়িয়ে দিতে অধিকাংশ সময়ই তার পেট পর্যন্ত কাটা হতো। ফলে নিদারুণ যন্ত্রণার স্বাদ বেশ কিছুক্ষণ ভোগ করে তবেই মৃত্যু ঘটতো অপরাধীর।