আমাদের আজকের গল্প পেগি ডরিস হকিন্স নামে একজন চিত্রশিল্পীকে নিয়ে। মার্কিন এই নারী ছোটবেলা থেকেই চিত্রকলার প্রতি আগ্রহী। তখন থেকেই টুকটাক চিত্র এঁকে থাকেন। বয়স যখন ১০ বছর তখন থেকেই তিনি চিত্রকলার উপর ক্লাস নেয়া শুরু করেন। পরবর্তীতে প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে আর্ট ইন্সটিটিউট থেকে পড়াশোনা সম্পন্ন করেন। একপর্যায়ে ফ্রাঙ্ক রিকার্ড আলব্রিখ নামে একজন লোককে বিয়ে করেন। এখানে তার একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। কিন্তু বিয়েটি বেশিদিন টেকেনি। জীবনের চক্রে তাদের মধ্যে সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।
ছোট মেয়েটিকে নিয়ে তিনি বেরিয়ে আসেন এবং খাদ্য ও বাসস্থানের সমস্যায় পড়েন। জীবিকার তাগিদে চলে আসেন সান ফ্রান্সিসকোতে। প্রতিভাবান শিল্পীর জন্য এরকম অবস্থায় পড়া এবং এরকম সংগ্রাম চালিয়ে যাবার ব্যাপারটা একটু কষ্টকরই। এমন ঘটনা সবখানেই ঘটে থাকে। অনুসন্ধান করলে পাওয়া যাবে, আমাদের দেশেরই অনেক প্রতিভাবান আর্টিস্ট রিকশার পেছনের দৃশ্য বা বিজ্ঞাপনের ছবি কিংবা সিনেমার পোস্টার এঁকে এঁকে জীবিকা নির্বাহ করেছিল। পেগি ডরিস হকিন্স-এর বেলাতেও এমনই অবস্থা হয়েছিল। উপায় না দেখে তিনি এক ফার্নিচারের দোকানে কাজ নিয়েছিলেন। সেখানে খাট বিছানা শোকেস তথা কাঠের উপর নকশা বা ছবি আঁকার কাজ করে তার ও তার মেয়ের চলার জন্য কিছু টাকা উপার্জন করেন।
বাংলাদেশের একুশে বইমেলা বা ঢাকার বাণিজ্য মেলাতে দেখা যায় সারি সারি কয়েকজন চিত্রকর বসে আছে। কেউ যদি নিজের প্রতিকৃতি আঁকতে চায় তাহলে এদেরকে অল্প কিছু অর্থ দিয়ে সামনে বসে থেকেই আঁকিয়ে নিতে পারে। আঁকার দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে উপার্জন করে নেয়ার এই সংস্কৃতি সবখানেই আছে। ডরিস হকিন্স এর দেশেও আছে।
এমনই ছোটখাটো একটা চিত্র প্রদর্শনীতে নিজের আঁকা কিছু ছবি এবং আঁকার জন্য রঙ তুলি নিয়ে বসেছেন তিনি। উদ্দেশ্য অতিরিক্ত কিছু অর্থ উপার্জন করা। দুই কিংবা এক ডলারের বিনিময়ে মানুষের প্রতিকৃতি এঁকে দেন তিনি। ঘটনাচক্রে সেখানে দেখা হয় মেয়েদের সাথে ফ্লার্টরত একজন পুরুষ চিত্রশিল্পীর সাথে। নাম ওয়াল্টার কিন (Walter Keane)। কিন সাহেব নিজে থেকেই তার সাথে আলাপ জুড়ে দেয়। ফ্লার্টিংয়ের সময় লোকটিকে যতটা বাজে বলে মনে হয়েছিল এখানে কোনো এক কারণে ততটা বাজে মনে হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে নিঃসঙ্গতায় কাটানোর ফলেই হয়তো সঙ্গ লাভের আকাঙ্ক্ষায় ঐ লোকের ত্রুটিগুলো চোখ এড়িয়ে যায়। জ্যান্টলম্যান-সুলভ আচরণগুলোই চোখে ধরা দেয়। তাদের মাঝে সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং এক পর্যায়ে তা বিয়েতে গড়ায়।
বিয়ের পর ডরিস হকিন্সের নাম হয় মার্গারেট কিন। তখন পুরোদমে ছবি আঁকার সুযোগ তৈরি হলো। ছবিতে সাক্ষর হিসেবেও তিনি লিখতে থাকেন KEANE। ঘটনাক্রমে কিছুদিনের মাঝেই তার চিত্রগুলো দর্শকপ্রিয়তা লাভ করে। চিত্রকর্মের প্রায় সবগুলোতেই বড় চোখের শিশু বা প্রাণীর উপস্থিতি। চোখ আছে এমন সকল প্রাণীর চোখই বড় বড়। চোখগুলো আঁকতেনও খুব যত্ন নিয়ে। তিনি বলতেন, তার আঁকা বড় বড় চোখগুলো তার নিজেরই গভীর অনুভূতির প্রতিফলন। তিনি বলতেন চোখ হচ্ছে অন্তরের জানালা। অন্তরের ভেতর প্রবেশের পথ হচ্ছে চোখ, তাই চোখকে তিনি গুরুত্ব দিয়ে যত্ন করে আঁকেন। তার ভাষায় “The eyes I draw on my children are an expression of my own deepest feelings. Eyes are windows of the soul.”
কিন্তু সবকিছু সরল অংকের মতো হয় না। যে হবার কথা ছিল সবচেয়ে সাহায্যকারী বন্ধু ও কাছের মানুষ সে-ই হয়ে দাঁড়াল রাক্ষস। তার চিত্রকর্মগুলোর প্রদর্শনী ও বিক্রির কাজ করতো তার স্বামী। অন্যদিকে সারাদিন মগ্ন হয়ে বাসায় বসে ছবি আঁকতেন তিনি। তার এই অনুপস্থিতির সুযোগ নেয় স্বামী। চিত্রকর্মগুলোকে নিজের নামে চালিয়ে দিতে থাকে সে। দুজনের নাম কিন (Keane), ছবির নীচে তিনি সাক্ষর হিসেবেও লিখছেন কিন। ফলে নিজের বলে ক্রেডিট নিতে তেমন কোনো সমস্যা হয় না।
ঘটনা একসময় জেনে যান মার্গারেট। সবকিছু যখন জানতে পারেন তখন কিছু করার থাকে না আর। কারণ এই নামে ও পরিচয়ে ছবিগুলো বিক্রি হচ্ছে ভালো দামে। পরিবারের জন্য অর্থের দরকার। কী করবেন আর? নিজেরই তো পরিবার নিজেরই তো স্বামী। এই দিকগুলো দেখে তার ও তার মেয়ের নিরাপত্তার জন্য, বছরের পর বছর ঘরে বসে বসে বেগার খেটে যান। তার আঁকা চিত্র দিন দিন জনপ্রিয় হতে থাকে। জনপ্রিয়তা এতই বাড়তে থাকে যে তার চিত্রকর্ম এমনকি জাতিসংঘও কিনে নেয়। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে তার খ্যাতি। খ্যাতি ও চাহিদার সাথে পাল্লা দিয়ে সবার অন্তরালে থাকা মার্গারেট নামের নারীটির কষ্ট বাড়তে থাকে। চাহিদা বেশি বলে অধিক পরিমাণ কাজ করতে হয়। এমন অবস্থায় গিয়েছিল যে দিনে তাকে ১৬ ঘণ্টা করে কাজ করতে হয়েছিল। আর সকল মেধা ও পরিশ্রমের ফল ভোগ করে যাচ্ছিল অবিবেচক ও অকৃতজ্ঞ স্বামী ওয়াল্টার কিন।
তার স্বামী চাইলে এই সমস্যাটির সমাধান করতে পারতো। স্ত্রীকে ধীরে ধীরে তুলে নিয়ে আসতে পারতো। কিন্তু খ্যাতির আনন্দলিপ্সু এই লোকটি তা করেনি। ফলে তাদের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ শুরু হয়। সম্পর্কে চিড় ধরে। এরকম খেটে খেটে কোনোকিছু না পেয়ে কত বছর আর সহ্য করা যায়। ঐদিকে সে তার মিথ্যা খ্যাতিকে ব্যবহার করে পরনারী নিয়ে মত্ত। এরই মধ্যে একদিন ছোট এক মেয়ে এসে হাজির, মেয়েটি নাকি ঐ লোকটির কন্যা। সে যে আগে একটি বিয়ে করেছিল তা এতদিনেও জানায়নি তাকে। সবদিক থেকেই মার্গারেটের সাথে প্রতারণা করে যাচ্ছিল।
একটা সময় তাদের সম্পর্ক আর কোনোভাবেই টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। ১৯৬৪ সালে তিনি তার স্বামীর কাছ থেকে চলে আসেন এবং পরের বছর স্বামীকে তালাক দেন। এরপর সান ফ্রান্সিসকো ছেড়ে হাওয়াইতে চলে আসেন মেয়েকে নিয়ে। সেখানে ড্যান ম্যাকগাইয়ার নামে একজন লোকের সাথে পরিচিত হন, যিনি বিখ্যাত একটি পত্রিকার ক্রীড়া বিষয়ক সাংবাদিক। ১৯৭০ সালে তিনি ঐ লোকটিকে বিয়ে করেন। এই স্বামী তাকে প্রতারক ওয়াল্টারের বিরুদ্ধে মামলা করতে উৎসাহিত করে। ততদিনে তার মেয়েটিও বড় হয়ে গেছে। স্বামী ও মেয়ের উৎসাহে তিনি সিদ্ধান্ত নেন প্রাক্তন স্বামীর বিরুদ্ধে লড়বেন। ১৯৭০ সালে একটি বেতার সম্প্রচার কেন্দ্র থেকে সকলকে জানিয়ে দেন যে ‘কিন’ নামে যে বিখ্যাত আর্টিস্ট তার প্রকৃত কারিগর আসলে তিনি নিজে। এমনকি একটা সিঙ্গেল আর্টও ওয়াল্টার সাহেবের নয়। যুক্তরাষ্ট্রে বেতার অনেক জনপ্রিয়, তাই তার এই ঘোষণার সাথে সাথে বেশ তোলপাড় হয়ে গেল।
মামলা কোর্টে গেল। তখনও ওয়াল্টার দাবী করতে থাকে আর্টগুলো আসলে তার। বেশ কিছু জটিলতারও জন্ম হয়। ঐদিকে ততদিনে ওয়াল্টার কিন বেশ প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল। কোর্টে নানান নাটকের পর বিচারক কোনো সমাধানে আসতে না পেরে শেষে দুজনকেই কোর্টে বসে বড় চোখের ছবি আঁকতে বলেন। সময় এক ঘণ্টা। সরাসরি সকলের সামনে বড় চোখের ছবি আঁকতে পারলেই প্রমাণ হবে কে আসল আর্টিস্ট। মার্গারেট ৫৩ মিনিটে আঁকা শেষ করেন, এবং ওয়াল্টার হাতে ব্যথা এই অজুহাত দেখিয়ে পোর্ট্রেট সাদা রাখে। এর ফলে মার্গারেটের দাবীকৃত সবগুলো ছবির চিত্রকর হিসেবে সম্মাননা পান তিনি। প্রতারণা প্রমাণিত হওয়ায় কোর্ট মার্গারেটকে ৪ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণের রায় দেয়। মার্গারেট এখনো বেঁচে আছেন, এখনো ছবি আঁকেন। তার ওয়েবসাইট www.keane-eyes.com। চাইলে যে কেউই এখান থেকে তার আঁকা নতুন পুরাতন চিত্রকর্ম কিনতে পারবেন।
তার জীবনের এমন নাটকীয় ঘটনা নিয়ে বিশ্ববিখ্যাত পরিচালক টিম বার্টনের পরিচালনায় ২০১৪ সালে বিগ আইজ (Big Eyes) নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। চলচ্চিত্রে মার্গারেটের চরিত্রে অভিনয় করেন আরেক বিখ্যাত অভিনেত্রী এমি এডামস। প্রতারক ওয়াল্টার পরবর্তী জীবনে তেমন সুবিধা করে ওঠতে পারেনি। নারী নিয়ে আনন্দ উল্লাসে একসময় ভাটা পড়ে। টাকার উৎস তো যায়-ই সাথে সাথে টাকার ভাণ্ডারও ফুঁড়িয়ে যায়। শেষ বয়সে একদম পয়সাহীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে ওয়াল্টার কিন।