এই প্রজন্মের মানুষ মধ্যপ্রাচ্য এবং পশ্চিমাদের ইতিহাস কমবেশি জেনেই বড় হয়েছে কিংবা হচ্ছে। প্রাচীন গ্রিসের দিগ্বিজয়ী যোদ্ধা অ্যালেকজান্ডার দ্য গ্রেট, পার্সিয়ান সাইরাস, রোমান সাম্রাজ্যের জুলিয়াস সিজারের নাম শোনেনি, এমন লোক পাওয়া দুষ্কর। পশ্চিমের ইতিহাস নিয়ে বিস্তর ঘাঁটাঘাঁটির কারণে পুবের ইতিহাস নিয়ে অনেকেই হয়তোবা জানেন না কিংবা কখনও জানার প্রয়োজন মনে করেননি।
সময়ের পরিক্রমায় এ অঞ্চলে অনেক বিখ্যাত শাসকের আগমন ঘটেছিল। আর তাদের শাসনামলে সামরিক বাহিনীর কয়েকজন যোদ্ধা যুদ্ধজয় করে ভুবনবিখ্যাত হয়েছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার সামরিক বাহিনীকে বিদায় জানিয়ে পরবর্তী জীবনে দীর্ঘ সাম্রাজ্যের শাসনকার্যও পরিচালনা করেছিলেন। যদিও পূর্ব এশিয়ার এসব বিখ্যাত সামরিক বাহিনীর সফল যোদ্ধাদের নিয়ে পশ্চিমাদের কোনো আগ্রহ ছিল না। কিন্তু এশিয়ান হিসেবে এশিয়ার ইতিহাস জানা আমাদের কর্তব্য।
আজ পূর্ব এশিয়ার সফলতা, যুদ্ধজয়ে শীর্ষে থাকা ১০ জন কমান্ডারকে নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো। এ তালিকায় দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার যোদ্ধাদের বিশেষভাবে স্থান দেয়া হয়েছে।
১. ই সান সিন (১৫৪৫-১৫৯৮)
পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে সফল অ্যাডমিরাল ই সান সিন। কোরিয়ান নৌবাহিনীর অন্যতম সফল প্রধান এবং একজন সাহসী যোদ্ধা হিসেবে তিনি বিখ্যাত ছিলেন। ঐতিহাসিক ইমজিন যুদ্ধে তিনি কোরিয়ান নৌবাহিনীর নেতৃত্বে দেন। অ্যাডমিরাল সান সিন তার কর্মজীবনে সর্বমোট ২৩টি যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। অসাধারণ রণকৌশল এবং যোদ্ধাদের সংঘবদ্ধ করে প্রতিটি যুদ্ধে তিনি জয়লাভ করেন। নৌসেনাদের অবাক করে দিয়ে যুদ্ধ চলাকালে গভীর সমুদ্র পাড়ি দিতেও ভয় পেতেন না এই যোদ্ধা।
অ্যাডমিরাল সান সিনের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ ছিল হানস্যান্ডোর যুদ্ধ। সেবার জাপানিদের আগ্রাসন রুখতে কোরীয় নৌবাহিনীর ৫৬টি যুদ্ধজাহাজ নিয়ে কোরীয় উপকূলে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেয় তার নৌসেনারা। অন্যদিকে, ঐ সময় জাপানিদের ৭৩টি জাহাজে প্রায় দেড়গুণ বেশি যোদ্ধা ছিলো। যদিও শেষপর্যন্ত সান সিনের সামরিক কৌশলের কাছে পরাস্ত হয় জাপানিরা। যুদ্ধে জাপানিদের ৪৭টি যুদ্ধজাহাজ পুরোপুরি ধ্বংস হয় এবং ৯,০০০ যোদ্ধা নিহত হয়। এছাড়াও ১২টি জাহাজ আটক করে কোরিয়ান সৈন্যরা। অন্যদিকে, কোরিয়ান নৌবাহিনীর মাত্র ১৯ জন সদস্য নিহত হলেও একটি জাহাজেরও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
তবে মাইওংনিয়াংয়ের যুদ্ধটি ছিল অ্যাডমিরাল ই সান সিনের জীবনের সবচেয়ে সফলতম এবং স্মরণীয় যুদ্ধ। ১৫৯০ এর দশকের শেষেরদিকে অনুষ্ঠিত ঐ যুদ্ধে জাপানিদের লজ্জাজনকভাবে পরাজিত করে তার সেনারা। জাপানিরা ৩৩৩টি জাহাজ নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও সান সিনের রণকৌশলের বিপক্ষে টিকে থাকতে পারেনি। তাদের প্রায় ১২৩টি যুদ্ধজাহাজ ধ্বংস হয় এবং ১৮,০০০ সৈন্য নিহত হয়। অন্যদিকে, কোরিয়ানদের কোনো জাহাজের ক্ষয়ক্ষতি না হলেও ৩৬ জন যোদ্ধা নিহত হয়।
একজন সুকৌশলী নেতার পাশাপাশি ই সান সিন ছিলেন একজন আবিষ্কারক। ইতিহাসবিদদের মতে, তিনিই সর্বপ্রথম কচ্ছপ জাহাজ নামক একধরনের যুদ্ধজাহাজ তৈরি করেন, যার উপরিভাগ ঢাকা থাকতো। জাহাজগুলোর অগ্রভাগে কাঠের তৈরি ড্রাগন মূর্তি ছিল। সেগুলো দিয়ে রণক্ষেত্রে ধোঁয়া তৈরি করা হতো। কোনো কোনো ইতিহাসবিদের মতে, সম্মুখযুদ্ধের সবরকম রণকৌশল, আচমকা আক্রমণ রুখে দেওয়ার কৌশল এবং সেগুলো মোকাবেলার একাগ্রতা পৃথিবীর অল্প কয়েকজন যোদ্ধার মাঝেই পরিলক্ষিত হয়। এসব গুণে গুণান্বিত যোদ্ধাদের মধ্যে নেপোলিয়ন ছিলেন সবচেয়ে বেশি সফল এবং সুদক্ষ।
পশ্চিমের হোরাটিও নেলসনের বিপরীতে পুবের ই সান সিন ছিলেন সবচেয়ে সফলতম অ্যাডমিরালদের একজন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য নেলসনের অর্জন সান সিনের চেয়ে অনেকাংশে কম। তবে ই সান সিনের দুর্ভাগ্য ছিল তিনি জোসেন রাজবংশের শাসনামলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তা না হলে আজকের দিনে তার সবগুলো যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ ইতিহাসের পাতায় সুস্পষ্টভাবে লেখা থাকত, যেমনভাবে তিনি কোরিয়ার সর্বকালের সেরা যোদ্ধা হিসেবে এখন অবধি সম্মান অর্জন করছেন।
২. চেঙ্গিস খান (১১৬২-১২২৭)
এশিয়ান হয়েও পশ্চিমাদের নিকট সুপরিচিত ছিলেন মঙ্গোলীয় এই কিংবদন্তি যোদ্ধা। তিনি ছিলেন ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মঙ্গোলীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি তার শাসনামলে মধ্য এশিয়া, পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, পশ্চিম ইউরোপ এবং ইউরেশিয়া অঞ্চলের প্রায় সকল এলাকা দখল করেন। বর্তমান সময়ের ইরান অবধি তার রাজত্ব ছিল। এতে করে ইউরোপের বিভিন্ন সাম্রাজ্যের শাসকেরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। কথিত আছে যে, অনেক বিখ্যাত শাসক বিনা যুদ্ধে তার কাছে নতি শিকার করতে দামি উপহার পাঠিয়ে শান্তিচুক্তি করতে চাইত।
প্রায় সব সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের নিজস্ব প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাহিনী থাকলেও চেঙ্গিস খানের বাহিনী ছিলো একেবারেই ভিন্ন। তিনি মঙ্গোলিয়া এবং এর পাশ্ববর্তী অঞ্চলের উপজাতিদের একত্র করে শক্তিশালী বাহিনী গড়ে তুলতেন। কথিত আছে, তিনি যেখানে যুদ্ধ জয় করতেন, সেখানকার উপজাতিদেরও তার সৈন্যবাহিনীতে যোগদানে আহ্বান করতেন। ইতিহাসবিদদের মতে, এই বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাকালে চেঙ্গিস খানের সৈন্যদের হাতে প্রায় চার কোটি লোক নিহত হয়।
মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারীরা চীন, পার্সিয়া এবং রাশিয়া অবধি নিজেদের সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে পেরেছিল। যদিও তাদের কেউই চেঙ্গিস খানের মতো শক্তিশালী শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেনি। দুঃখজনক হলেও সত্য, তিনি বেঁচে থাকাকালীন নিজের কোনো ছবি আঁকাননি, যার কারণে ইতিহাসবিদরা তাকে নিশ্চিতভাবে শনাক্ত করতে পারেনি। সুবিশাল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা এবং বীর যোদ্ধা চেঙ্গিস খান ১১৬২ সালে বৈকাল হ্রদের পাশ্ববর্তী অঞ্চল জন্মগ্রহণ করেন এবং ১২২৭ সালের ১৪ আগস্ট চীনে মৃত্যুবরণ করেন।
৩. সান জু (খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৪-৪৯৬)
মধ্যযুগীয় বিখ্যাত সকল যোদ্ধার কাছে যুদ্ধকৌশল রপ্তের অন্যতম প্রধান বই ছিলো ‘দ্য আর্ট অভ ওয়ার’। বিখ্যাত চীনা সামরিক বাহিনীর কমান্ডার সান জু খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে বইটি লেখেন। সে সময় চীন প্রায় ছয় থেকে সাতটি ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যে বিভক্ত ছিল। ফলে প্রায়ই তারা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ত। এতে করে অর্থনৈতিকভাবে বেশ দুঃসময় পার করছিল চীনারা।
সান জু তার বিখ্যাত বইটিতে যুদ্ধের নানাবিধ বিষয় নিয়ে পর্যালোচনা করেন। বইয়ে যুদ্ধের ফলাফলের উপর ভূখণ্ডের প্রভাব বিস্তারিত তুলে ধরেন তিনি। এছাড়াও একটি যুদ্ধে শাসকশ্রেণি এবং কমান্ডারদের করণীয় বিষয়গুলোও বুঝিয়ে দেন। বইটিতে সান তজু যুদ্ধের পূর্বে শত্রুবাহিনীর অবস্থান পর্যবেক্ষণ, গুপ্তচরবৃত্তি, কেমন সৈন্য মোতায়েন রয়েছে- তা পর্যবেক্ষণ করার জন্য বিশেষভাবে নজর দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। তার বিখ্যাত উক্তিটি হলো,
“আগে শত্রুকে জানুন, পরে নিজেকে জানুন। তাহলে আপনি পরাজয়ের আশঙ্কা ছাড়াই একশত যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারবেন।”
রাজনৈতিক চেতনা এবং সামরিক নীতির মধ্যে ঘনিষ্ঠতা তৈরিতে বইটির কিছু তথ্য আধুনিক রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। মাউ সে তুং এবং চীনা কমিউনিস্টরা জাপানিদের বিপক্ষে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে আর্ট অভ ওয়ারে উল্লিখিত কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। একইভাবে তারা চীনা জাতীয়তাবাদীদেরও তাড়ান। ইতিহাসবিদদের দাবি সান তজুর বইটি স্বয়ং নেপোলিয়ন এবং টোকুগাওয়া আইয়াসুর মতো যোদ্ধারাও অনুসরণ করতেন।
৪. কোয়াং ট্রাং (১৭৫৩-১৭৯২)
খুব অল্প সময়ে ভিয়েতনামের আদিবাসী মানুষদের নিকট বীরের সম্মান পাওয়া মানুষটি কোয়াং ট্রাং। মাত্র ৪০ বছরের জীবনে লড়েছেন ভিয়েতনামকে রক্ষার্থে, পরবর্তীতে নিজের সাম্রাজ্য দীর্ঘায়ত করার জন্য সিংহাসনের মায়া ত্যাগ করে ছুটেছিলেন ভিয়েতনামের উত্তর থেকে দক্ষিণ অঞ্চলে। প্রথমদিকে সামরিক বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও পরবর্তী সময়ে তিনি তেই সন সাম্রাজ্যের সম্রাটও হয়েছিলেন। তার আয়ুষ্কাল কম হলেও একজন যোদ্ধা থেকে কমান্ডার, সেখান থেকে সম্রাট হওয়ার পুরো পথটা ছিলো যুদ্ধময়।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে ভিয়েতনামের লি সাম্রাজ্যটি দু’ ভাগে বিভক্ত ছিলো। উত্তর অংশ নিয়ন্ত্রণ করতো ত্রিনহ বংশ এবং দক্ষিণ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ ছিলো গুয়েন বংশের হাতে। একই সাম্রাজ্যে দুই বংশের শাসন যেমন দেশের মানুষের মাঝে পার্থক্য গড়ে দিয়েছিল, তেমনি নিজেদের মধ্যে নতুন নতুন বিরোধ সৃষ্টি করে। উভয় পক্ষই রাজার নিকট নিজেদের শক্তিমত্তা প্রকাশ করার জন্য প্রায়শই যুদ্ধে লিপ্ত হতো। পরবর্তী সময়ে দু’পক্ষের ছোটখাটো বিরোধগুলো ভয়াবহ বিদ্রোহে রূপ নেয়। কমান্ডার কোয়াং ট্রাং বিখ্যাত ‘তে সান’ বিদ্রোহের নায়ক ছিলেন। সেবার তার নেতৃত্বাধীন বাহিনী ত্রিনহ বংশকে পরাজিত করে পুরো ভিয়েতনাম দখল করে নেয়। শেষপর্যন্ত তৎকালীন লি রাজবংশকে হটিয়ে তে সান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন কোয়াং ট্রাং এবং তার বাহিনী।
ভিয়েতনামের নতুন সাম্রাজ্যের রাজা হন তার ভাই। তিনি পর্যায়ক্রমে উত্তর এবং দক্ষিণাঞ্চলে ত্রিনহদের দখলে থাকা ছোট শহরগুলোর দখল নেন। অন্যদিকে পরাজিত হয়ে চীনের সামরিক হস্তক্ষেপ চান লি রাজবংশের তৎকালীন শাসক। যদিও চীনের সামরিক অভিযান সেবার সফল হয়নি। চীনারা যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ফিরে গিয়েছিলো। নিজের ভাইদের নিয়ে গড়া তে সান সাম্রাজ্যের পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখা কোয়াং ট্রাং সিংহাসনে বসেছিলেন মাত্র চার বছর। ভিয়েতনাম দখলের পরেও সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে সবসময় সামরিক বাহিনী নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন তিনি।
১৭৮৮ সালে সিংহাসনে বসলেও ১৭৯২ সালে মাত্র ৪০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন পূর্ব এশিয়ার এই কিংবদন্তি যোদ্ধা। মৃত্যুর কারণ হিসেবে হৃদরোগকেই উল্লেখ করেছিলেন সে সময়ের ইতিহাসবিদরা। তার মৃত্যুর পর আরও প্রায় একশত বছর ভিয়েতনাম শাসন করেছিলেন তে সান রাজবংশের শাসকরা। যদিও তাদের কেউই তার পরিকল্পনা অনুযায়ী ভিয়েতনামকে এগিয়ে নিতে পারেনি। সর্বশেষ ১৮৮৪ সালে ভিয়েতনামে আনুষ্ঠানিকভাবে তে সান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। তবে আধুনিক ভিয়েতনামে কোয়াং ট্রাং জাতীয় বীরের সম্মান পেয়ে থাকেন।
৫. কোওন ইউল (১৫৩৭-১৫৯৯)
১৫৯২ সাল থেকে ১৫৯৮ সাল পর্যন্ত গোটা কোরিয়া লড়েছিল শক্তিশালী জাপানের বিরুদ্ধে। নিজেদের উপকূল রক্ষার্থে সেকালে কোরিয়ানরা নিজেদের সর্বস্ব নিয়েই লড়াই করেছিল। ঐতিহাসিক ইমজিন যুদ্ধে যে কয়জন কোরিয়ান জেনারেল বীরত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, তাদের মধ্যে কোওন ইউল অন্যতম একজন। তার যুদ্ধকৌশল এবং সাহসিকতা কোরিয়ানদের মনোবল বাড়াতে সাহায্য করেছিল। কোওন সর্বপ্রথম আলোচিত হন ইচি এবং হেনগজু যুদ্ধ জয়ের পরে। ইচিতে তিনি মাত্র ১,০০০ যোদ্ধা নিয়ে ১০,০০০ জাপানির বিরুদ্ধে লড়াই করেন। যুদ্ধে জয়লাভ করার পাশাপাশি তার সেনারা জেওলান প্রদেশ দখলমুক্ত করতে সক্ষম হয়।
হেনগজুতে জেনারেল কোওন প্রায় ২,৮০০ সৈন্য নিয়ে জাপানি কমান্ডার কাতো কিয়ামাসার নেতৃত্বাধীন ৩০,০০০ সৈন্যের মোকাবেলা করেন। ঐ যুদ্ধে প্রায় ১০,০০০ জাপানি সেনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জেনারেল কোওন ইউল পর পর দুই যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের কারণে পরবর্তী সময়ে উচ্চপদস্থ কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। মূলত তার নেতৃত্বে জয়লাভ করা দুটো যুদ্ধই জাপানের বিপক্ষে ঐতিহাসিক ইমজিন যুদ্ধে জয়লাভের ক্ষেত্রে বড়সড় ভূমিকা পালন করেছিল। ১৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করা বীর যোদ্ধা জেনারেল কোওন ইউল ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।
৬. কশাকু তগো হিয়াচিরো (১৮৪৮-১৯৩৪)
কশাকু তগো হিয়াচিরো জাপানের ইতিহাসের অন্যতম সফল অ্যাডমিরাল। তিনি সর্বপ্রথম আলোচনায় আসেন রুশ-জাপানিজ যুদ্ধের সময়টাতে। চীন এবং এর পাশ্ববর্তী অঞ্চলে রাশিয়ান আগ্রাসনের ফলেই এই যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে। এই যুদ্ধের ইতিহাস যেমন সুদীর্ঘ তেমনি জাপান জড়িত হওয়ার কারণও বিভিন্ন। রুশ-জাপানিজ যুদ্ধে জাপানি নৌবাহীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন কশাকু তাগি হিয়াচিরো। মূলত তার রণকৌশল আর সাহসিকতার কারণে যুদ্ধে জয়লাভ করে বাড়ি ফিরেছিল জাপানি নৌসেনারা।
১৯০৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি রাতে কোনোপ্রকার ঘোষণা ছাড়াই অ্যাডমিরাল তাগো হিয়াচিরো পোর্ট আর্থুরে হামলা চালান। চীনের সঙ্গে বিতর্কিত চুক্তিতে এই বন্দরটি অবৈধভাবে দখল করে রেখেছিল রাশিয়া। মূলত এই অঞ্চলের উপর নিয়ন্ত্রণ জোরদার এবং উপনিবেশকদের পূর্ব এশিয়ায় বসতি স্থাপনে সাহায্য করাই ছিলো রাশিয়ানদের উদ্দেশ্য। মে মাস অবধি কোরিয়ান উপকূলে দু’পক্ষের খণ্ডযুদ্ধ চলেছিল। অতঃপর পহেলা মে রাশিয়া পরাজয় মেনে নেয়। শেষপর্যন্ত এ যুদ্ধে ২০,০০০ বেসামরিক চীনা নাগরিক মৃত্যুবরণ করে।
রুশ-জাপানিজ নৌযুদ্ধে সর্বমোট ১,১০০ জাপানি নৌসেনা নিহত হয়। অন্যদিকে, রাশিয়ানরা ৭,০০০ সৈন্যের মধ্যে ২,৫০০ জনকে হারায়। প্রকৃতপক্ষে এ যুদ্ধে রাশিয়ার পাশাপাশি গোটা পশ্চিমা বিশ্বের পরাজয় ঘটেছিল। জাপান পশ্চিমাদের সামরিক শক্তির মাধ্যমে পূর্বদিকে বেশিদূর অগ্রসর না হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিল। সেইসাথে দেশটি পশ্চিমাদের আগ্রাসন ও উপনিবেশিক দেশগুলোর বিরুদ্ধে নিজেদের অভিযানের শুভসূচনা ঘটায়। এই যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের কারণে অ্যাডমিরাল কশাকু তগো হিয়াচিরোকে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করে জাপান। সেইসাথে তাকে প্রাচ্যের নেলসন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
৭. হান শিঝং (১০৮৯-১১৫১)
হান শিঝং ছিলেন চীনের সং সাম্রাজ্যের একজন সফল সেনাপ্রধান। তিনি সেকালে যুদ্ধকৌশল, হাতিয়ার উন্নতকরণ সহ আরও অনেক অনেক যুগান্তকারী কর্মসাধন করে গেছেন, যা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন যুদ্ধে সফলভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল। জেনারেল হান তার নেতৃত্বাধীন সেনাদের ধনুক এবং বর্ম তৈরিতে পরিবর্তন আনেন। ভারি হাতিয়ার ও বর্মযুদ্ধে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে বলে তিনি সেকালের ধাতুবিদদের ডেকে হালকা ধনুক ও বর্ম তৈরির কার্যক্রম হাতে নেন।
জীবদ্দশায় তার সবচেয়ে বড় সফলতা ছিলো জুর্চেন আক্রমণ প্রতিহত করা। সেকালে সং রাজবংশের উপর বহিরাগত, দখলদার জুর্চেনরা অতর্কিত হামলা চালায়। যদিও তারা বুঝতে পারেনি, সংদের রক্ষার জন্য কেউ একজন সবসময় প্রস্তুত রয়েছেন। জেনারেল হান শিঝং জুর্চেন বাহিনীকে হটিয়ে সাম্রাজ্য এবং রাজবংশের সবাইকে নিরাপদ রাখেন।
৮. ইওলজি মান্ডেয়ক
ইওলজি মান্ডেয়ক একজন বিখ্যাত কোরিয়ান সেনাপ্রধান। গোগুরয়েও সুই যুদ্ধের সময় তিনি কোরিয়ান সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন। যুদ্ধটি দুই ধাপে কোরিয়ার গোগুরয়েও এবং চীনের সুই সাম্রাজ্যের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমবার দু’পক্ষের মধ্যকার যুদ্ধ বাধে ৫৯৮ সালে। সেবার সমঝোতায় পৌঁছাতে পারলেও এর এক যুগ পর আবারও দু’পক্ষের রেষারেষি শুরু হয়। দ্বিতীয় দফায় এই যুদ্ধটি ৬১২-৬১৪ সাল অবধি স্থায়ী হয়।
যুদ্ধে চীনাদের তুলনায় ইওলজি মান্ডেয়কের সৈন্যরা ছিলো খুবই সামান্য। চীনের ১০ লাখ সৈন্যের বিপরীতে কোরিয়ানদের সৈন্য সংখ্যা ছিলো মাত্র তিন লাখ। যদিও যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায় জেনারেল ইওলজির রক্ষণাত্মক রণকৌশলের কারণে। তিনি তার রণকৌশলের মাধ্যমে গোগুরয়ে সাম্রাজ্য রক্ষা করার পাশাপাশি সুই রাজবংশের পতন ঘটিয়েছিলেন।
৯. লি লই
সবচেয়ে বেশি সময় ধরে ভিয়েতনাম শাসন করেছিল লি রাজবংশ। এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা লি লই ছিলেন একজন সফল যোদ্ধা। প্রথম পর্যায়ে তিনি সংগ্রামী জীবন কাটান। একজন সফল যোদ্ধা থেকে সফল শাসক হওয়ার পেছনে রয়েছে অনেক সুদীর্ঘ গল্প। ১৪০৭ সালে চীনের মিং ভিয়েতনামে আক্রমণ করে। সে আক্রমণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশটি। রাস্তাঘাট, জমিজমা সবকিছুই ধ্বংস করে দেয় চীনারা।
১৪১৮ সালে লি লই গুটিকয়েক তরুণ এবং সেনাসদস্যকে নিয়ে গোপনে অভিযান পরিচালনার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ধীরে ধীরে নিজের বাহিনীকে শক্তিশালী করে তোলেন তিনি। বিভিন্ন জায়গায় খণ্ডযুদ্ধে জয়লাভ করতে থাকে তার সেনারা। অতঃপর, ১৪২৭ সালে মিং বাহিনীকে পরাজিত করে ভিয়েতনামের দায়িত্বভার নিজের কাঁধে তুলে নেন লি লই। পরবর্তী সময়ে তার উত্তরসূরীরা ১৭৪৪ সাল পর্যন্ত ভিয়েতনামে লি রাজবংশের শাসনক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছিলো। পূর্ব এশিয়ার ইতিহাসে তার মতো দেশপ্রেমিক যোদ্ধা দ্বিতীয়জন পাওয়া যাবে কি না, তা বলা মুশকিল।
১০. তোকুগাওয়া ইয়াসু (১৫৪৩-১৬১৬)
জাপানের ইতিহাসের সর্বশেষ সামরিক সরকারের শাসনকালের স্থায়িত্ব ছিল প্রায় ২৫০ বছর। এটি তোকুগাওয়া শোগুনেট হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত ছিলো। তোকুগাওয়া ইয়াসু এটি প্রতিষ্ঠা করেন। তার হাত ধরেই জাপান যুদ্ধভাবাপন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থা থেকে সাময়িক সময়ের জন্য মুক্তি পেয়েছিল। ইয়াসু টয়োটোমি বংশের অনুগত বাহিনী সহ আরও কয়েকটি শক্তিশালী গোষ্ঠীকে পরাজিত করে এই শাসনব্যবস্থা প্রচলন ঘটান তিনি।
৭৩ বছরের জীবনে তিনি ৯০টির মতো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ইমজিন যুদ্ধে কোরিয়ার বিপক্ষে পরাজয়ের কারণে জাপানের সর্বস্তরের মানুষের মাঝে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ করেন তিনি। জনসাধারণের মনোবল ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে তোকুগাওয়া ইয়াসু সবাইকে একতাবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান এবং একতাবদ্ধ জাপান গড়ার প্রস্তুতি নিতে বলেন। তার আহ্বানে তখন জাপানের সর্বস্তরের মানুষ সাড়া দিলেও পরবর্তী সময়ে তার উত্তরসূরীরা তার মতো করে সবকিছু পরিচালনা করতে পারেনি।
ইতিহাসের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/