রোজা লুইস ম্যাকলি পার্কস (১৯১৩-২০০৫) ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন মানবাধিকারকর্মী যাকে ইউনাইটেড স্টেট কংগ্রেস অভিহিত করেছে ‘দ্য ফার্স্ট লেডি অব সিভিল রাইটস’ এবং ‘দ্য মাদার অব দ্য ফ্রিডম মুভমেন্ট’ হিসেবে। তার জন্মদিন ৪ ফেব্রুয়ারি, এবং তার পুলিশের নিকট গ্রেফতার হবার দিন ১ ডিসেম্বর, দুটোই রোজা পার্কস দিবস হিসেবে পালিত হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অমানবিক সব নীতির কারণে বছরের পর বছর অত্যাচারিত কৃষ্ণাঙ্গদের একজন হয়ে রোজা পার্কস বলেছিলেন, “আমরা অনেক দিন অত্যাচার সহ্য করেছি। যত দিন যাবে, এটা শুধু বাড়বেই। যত আমরা এমন আচরণ মেনে নেব, তত তারা আরও অত্যাচারী হবে।” কী করেছিলেন পার্কস গ্রেফতার হবার মত? কীভাবে তার গ্রেফতারের ঘটনা উজ্জীবিত করেছিল হাজারও মানুষকে মানবিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনে অংশ নেবার জন্য? আজকের লেখা আত্মমর্যাদাবোধে বলীয়ান সেই নারীকে নিয়ে।
১৯০০ সালে অ্যালবামা স্টেটের মন্টেগোমারি শহরে একটি বিশেষ আইন প্রণয়ন করল স্থানীয় সরকার। আইনটি হল বাসের সিটে যাত্রীদের বসার জন্য আসন বিন্যাসের ব্যাপারে। শহরের গণপরিবহনের আসনবিন্যাস হবে জাতিগত পার্থক্য অনুযায়ী- এই ছিল সেই আইনের মূলকথা! বাসের কনডাক্টরদেরকে ক্ষমতা দেয়া হল যে তারা সুবিধামত বাসের সিটগুলোকে ‘সাদা’ ও ‘কালো’ চামড়ার যাত্রীদের জন্য আলাদা আলাদা করে চিহ্নিত করে দিতে পারবে। সে সময় বাসের ড্রাইভারদের সবাই ছিল শ্বেতাঙ্গ। তারা তাদের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে শ্বেতাঙ্গ যাত্রীদের সমর্থনে এই আইনকে আরও কড়াভাবে বর্ণবিদ্বেষী কাজে লাগানোর উপায় বের করল। তারা এমন এক প্রথা চালু করল যে, আইনানুসারে সাদা ও কালোদের পৃথকভাবে বসানোর পরে, বাসে যদি শ্বেতাঙ্গদের জন্য বরাদ্দকৃত সিট পূর্ণ হয়ে গেছে এমন সময় কোনো সাদা চামড়ার যাত্রী উঠে, তাহলে কৃষ্ণাঙ্গ যাত্রীদের সিট থেকে উঠে গিয়ে সেই শ্বেতাঙ্গ যাত্রীকে বসতে দিতে হবে।
মন্টেগোমারির এই আইন অনুযায়ী প্রতিটি বাসের প্রথম চার সারির দশটি সিট কেবল শ্বেতাঙ্গদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। বাসের একেবারে পেছন থেকে শুরু করে চার সারির দশটি সিট বরাদ্দ ছিল কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য। এটুকু হল আইন। আর বাস ড্রাইভারদের সহায়তায় শ্বেতাঙ্গরা তৈরি করল মাঝখানের ষোলটি সিটের জন্য নিজেদের বর্ণবাদী প্রথা। সে অনুযায়ী, মাঝখানের সামনের অংশে বসবে শ্বেতাঙ্গরা, পিছনের অংশে বসবে কৃষ্ণাঙ্গরা।
একটা ছোট বোর্ড ধরনের জিনিস থাকত বাসে, যেটাকে ড্রাইভারেরা সুবিধামত জায়গায় বসিয়ে চিহ্নিত করে দিত কোন সারি পর্যন্ত শ্বেতাঙ্গ যাত্রীরা বসবে। যদি এমন হত যে, শ্বেতাঙ্গ যাত্রীদের সিট পূর্ণ হয়ে যাবার পর আরো কোনো শ্বেতাঙ্গ বাসে উঠেছে, তখন সেই বোর্ডটা পিছিয়ে আনা হত প্রয়োজনমত, সাদাদের সারি চিহ্নিত করে দেওয়ার জন্য। যদি এমন হত, পুরো বাস পূর্ণ, কোনো শ্বেতাঙ্গ যাত্রী উঠেছে, তাহলে কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে সবার সামনের সারির চারজন যাত্রীকেই উঠে পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে যেতে হত, কারণ সাদা আর কালো পাশাপাশি বসতে পারবে না। আর এমন অবস্থায় কৃষ্ণাঙ্গ যাত্রী উঠলে তাকে পিছনে এসে দাঁড়িয়ে থাকতে হত, আর দাঁড়াবার জায়গাও না থাকলে বাস থেকে নেমে যেতে হত।
শুধু তাই নয়, এমনকি শ্বেতাঙ্গ যাত্রীরা সামনের সিটগুলো পূর্ণ করে ফেলার পর তাদের মাঝখান দিয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের হেঁটে পেছনের দিকে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল! বরং এমন অবস্থায় কোনো কৃষ্ণাঙ্গ বাসে উঠতে চাইলে তাকে প্রথমে সামনের দরজা দিয়ে উঠে ড্রাইভারের কাছে ভাড়া দিতে হত। এরপর আবার বাস থেকে নেমে বাসের পেছনের দরজা দিয়ে উঠে তার জন্য নির্ধারিত অংশের সিটে বসতে হত বা ঐটুকুর মধ্যেই দাঁড়িয়ে থাকতে হত। মাঝে মাঝেই এমন হত, কোনো কৃষ্ণাঙ্গ যাত্রী সামনের দরজা দিয়ে উঠে ভাড়া দিয়ে আবার নেমে পেছনের দরজা দিয়ে উঠবার আগেই ড্রাইভার বাস ছেড়ে দিত। দীর্ঘ দিন ধরেই এই আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আসছিল কৃষ্ণাঙ্গরা, কিন্তু তাদের দাবি পূরণ হয় নি।
১৯৪৩ সালের এক দিন। রোজা পার্কস বাসে উঠে ভাড়া দিলেন। এরপর বাসের ভেতর দিয়ে হেঁটে পেছনের দিকে এগিয়ে যেতে চাইলেন। বাসের ড্রাইভার জেমস এফ ব্লেইক তাকে ডেকে বলল, এভাবে যাওয়া যাবে না, বাস থেকে নেমে গিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে উঠতে হবে। পার্কস নামলেন বাস থেকে। পেছনের দরজা দিয়ে উঠতে যাবেন, তার আগেই ব্লেইক বাস ছেড়ে দিল। তখন বৃষ্টি পড়ছিল। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে পরের বাসের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন পার্কস। ঠিক করলেন, আর কখনও ব্লেইকের বাসে উঠবেন না।
দীর্ঘ ১ যুগ পরের কথা। ১৯৫৫ সাল। প্রতি বছরের মত সেবারেও তীব্র বর্ণবিদ্বেষ থেকে কালোদের নানান উপায়ে হত্যা চলছিল। সে বছর মে মাসে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল কালোদের অধিকার আন্দোলনের নেতা জর্জ ওয়াশিংটন লি’কে। আগস্টে গুলি করে মারা হয় আন্দোলনের আরেক কর্মী ল্যামার স্মিথকে। একই মাসে প্রচণ্ড রকম পেটানোর পর গুলি করে হত্যা করা হয় ১৪ বছরের কিশোর এমেট টিলকে। নভেম্বরের ২৭ তারিখে রোজা পার্কস অংশ নেন মন্টেগোমারিতে কৃষ্ণাঙ্গদের এক সমাবেশে, সেখানে বর্ণনা করা হয় কীভাবে হত্যা করা হয়েছিল এই মানুষগুলোকে সেই নির্মমতার কাহিনী।
এর চার দিন পর, ডিসেম্বরের ১ তারিখ, বৃহস্পতিবার। সন্ধ্যা তখন ৬টা। সারা দিনের কাজের শেষে রোজা পার্কস অপেক্ষা করছেন বাসের জন্য। মন্টেগোমারি সিটি লাইন কোম্পানির একটা পুরনো চেহারার বাস এল। পার্কস উঠে পড়লেন সেই ক্লিভল্যান্ড এভিনিউ বাসে। ভাড়া মিটিয়ে তিনি এসে বসলেন শ্বেতাঙ্গ যাত্রীদের সিট যেখানে শেষ হয়েছে ঠিক তার পেছনের পঞ্চম সারির একটি সিটে। সেই চিহ্ন দেয়ার বোর্ডটি তখন ঐ চতুর্থ সারি পর্যন্তই রাখা ছিল। তখনও পার্কস খেয়াল করেননি, বাসের ড্রাইভারের সিটে আছে জেমস ব্লেইক, এক যুগ আগে যে তাকে ফেলে চলে গিয়েছিল বৃষ্টির মধ্যে।
বাস চলছে। এক সময় শ্বেতাঙ্গদের সবগুলো সিট পূর্ণ হয়ে গেল। এম্পায়ার থিয়েটারের সামনে বাসের তিন নম্বর স্টপেজ। সেখানে থামার পর বাসে উঠল কয়েকজন সাদা চামড়ার যাত্রী। তাদের বসবার জায়গা নেই তখন। ড্রাইভার ব্লেইক খেয়াল করল সেটা। সে উঠে এসে চিহ্ন দেয়ার বোর্ডটা এক সারি পিছিয়ে দিল, মানে পার্কস যে সারিতে বসে আছেন সেটা এখন সাদাদের সারি, উঠতে হবে তাকে। সেখানে বসে থাকা কৃষ্ণাঙ্গদের বলল ব্লেইক, “গা ঝারা দিয়ে একটু তাড়াতাড়ি ওঠো, এই সিটগুলো লাগবে।” এই বলে সেখান থেকে ওদের উঠে যাওয়ার জন্য হাত দিয়ে ইশারা করতে লাগল সে। পরে স্মৃতিচারণের সময় পার্কস বলেছিলেন, “যখন সেই ড্রাইভার এগিয়ে এল আমাদের দিকে, হাত নেড়ে নেড়ে আমাদের উঠে যেতে বলতে লাগল, মনে হচ্ছিল আমার শরীরটা শীতের রাতের চাদরের মত করে জড়সড় করে মুড়িয়ে রাখি।”
ব্লেইকের কথা মত ঐ সারির তিনজন উঠে গেল। বসে রইলেন পার্কস। তাকে আবার উঠে যেতে বলল ব্লেইক। ঠিক সেই মুহূর্তে পার্কসের মনে পড়তে লাগল এমেট টিলের কথা, কদিন আগেই যার কথা শুনেছিলেন সেই সমাবেশে, যাকে পিটিয়ে পিটিয়ে আধমরা করে ফেলার পর গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। এবারেও সিট ছেড়ে উঠলেন না পার্কস, শুধু একটু সরে জানলার পাশের সিটে গিয়ে বসলেন।
ব্লেইক রেগে গেছে ততক্ষণে। সাদাদের পাশে কালো কারো বসারও ‘নিয়ম’ নেই। সে বলে উঠল, “তুমি দাঁড়াচ্ছ না কেন?” পার্কস শান্তভাবে জবাব দিলেন, “আমার মনে হয় না আমার দাঁড়ানোর কোনো দরকার আছে।” ব্লেইক বলল এবার, “ঠিক আছে। যদি তুমি না দাঁড়াও, আমি পুলিশ ডাকব এবং তোমাকে গ্রেফতার করাব।” পার্কস জবাব দিলেন, “তোমার ইচ্ছে হলে করো।” পরবর্তীতে এক সাক্ষাৎকারে পার্কস বলেছিলেন, “তখন আমি ভাবছিলাম, সেবার, এবং সেটাই হবে শেষবার, যেবার আমি জেনে নেব একজন মানুষ ও রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে আসলে কী কী অধিকার আমার আছে।”
ব্লেইক পুলিশ ডাকল। একজন পুলিশ অফিসার গ্রেফতার করল পার্কসকে। তিনি সেই পুলিশকে জিজ্ঞেস করলেন কেন তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পুলিশটি জবাব দিল, “আই ডোন্ট নো। বাট দ্য ল ইজ দ্য ল, আন্ড ইউ আর আন্ডার এরেস্ট।” পার্কস পরে বলেছিলেন, “আমি শুধু জানতাম, যেহেতু আমাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে, তাহলে সেটাই ছিল আমার জন্য শেষবারের মত বাসের অমন অপমানকর যাত্রা।”
যদিও পার্কস কেবলমাত্র সাদাদের জন্য বরাদ্দকৃত সিটে বসেননি, বরং কালোদের সিটেই বসেছিলেন, তবুও তার বিরুদ্ধে মন্টেগোমারির সেই বাসের সিটবিন্যাসের অমানবিক আইনটি ভঙ্গের অভিযোগে মামলা করা হল। সেদিন সন্ধ্যায় তাকে জামিনে বের করে আনলেন কালোদের অধিকার আন্দোলনের সংগঠন National Association for the Advancement of Colored People এর মন্টেগোমারি অঞ্চলের প্রেসিডেন্ট এডগার নিক্সন ও পার্কসের বন্ধু ক্লিফোর্ড ডার। ক্লিফোর্ড ডার ছিলেন সাদা চামড়ার এক আইনজীবী, তিনি পার্কসের আইনজীবী হিসেবে পরবর্তীতে মামলা লড়েন।
এর আগেও বেশ কয়েকবার কিন্তু এমন ঘটনা ঘটেছিল। তবে কোনো বারেই সেগুলো বড় আন্দোলনের রূপ নেয়নি। ১৯৪৪ সালে মার্কিন সেনাবাহিনীর একজন সেকেন্ড লেফট্যানেন্ট জ্যাকি রবিনসন একই ভাবে টেক্সাসের এক শ্বেতাঙ্গ আর্মি অফিসারের সাথে বচসায় জড়ান এবং সিট ছেড়ে দিতে অস্বীকৃতি জানান। পরে কোর্ট মাশাল হলেও ছাড়া পান রবিনসন। এরপর তিনি হয়েছিলেন বিখ্যাত বেসবল খেলোয়াড় যিনি প্রথম আফ্রিকান আমেরিকান হিসেবে মেজর লিগে খেলার মাধ্যমে বেসবলের মেজর লিগে কালোদের না খেলানোর বর্ণবাদী প্রথা চিরতরে দূর করেছিলেন।
১৯৫৩ সালে লুইজিয়ানার ব্যাটন রুজ শহরে একই রকম অধ্যাদেশ জারি হয়। সেখানে বাসের সামনের অংশ সাদাদের জন্য সংরক্ষিত ছিল এবং সে অংশটি খালি থাকলেও কালো যাত্রীরা সেখানে বসতে পারত না, দরকার হলে দাঁড়িয়ে যেতে হত। রেভারেন্ড থিওডর জুডসন জেমিসনের নেতৃত্বে ইতিহাসের প্রথম বাস বয়কট কর্মসূচী পালিত হয় এই অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে। ব্যাটন রুজের কোনো কৃষ্ণাঙ্গ যাত্রী বাসে চড়েন নি একটানা আট দিন। সাধারণত বাসের যাত্রীদের ৮০ ভাগই হত কৃষ্ণাঙ্গ। তাই আট দিনের বয়কট কর্মসূচির পর তাদের দাবি মানতে বাধ্য হয় স্থানীয় সরকার, অধ্যাদেশ পরিবর্তিত হয়। নতুন আদেশ অনুযায়ী শ্বেতাঙ্গরা সামনে থেকে এবং কৃষ্ণাঙ্গরা পেছন থেকে বাসে বসা শুরু করবে সব সিট পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত। তবে একেবারে সামনের সারি সাদাদের জন্য এবং একেবারে পেছনের সারি কালোদের জন্য বরাদ্দ থাকবে। তবে কোনো ক্রমে সাদাদের পাশে কোনো কালো যাত্রী বসতে পারবে না। ব্যাটন রুজের বাস বয়কট ছিল পরবর্তী আন্দোলনের জন্য একটি বড় ধাপ।
১৯৫৫ সালের মার্চে ক্লডেট কোলভিন নামক এক হাই স্কুল পড়ুয়া ১৫ বছর বয়সী কিশোরী মন্টেগোমারিতে এক শ্বেতাঙ্গকে বাসের সিট ছেড়ে দিতে অস্বীকৃতি জানায়। এরপর তাকে গ্রেফতার করে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে জোর করে নামানো হয় বাস থেকে। একই বছরের এপ্রিলে গ্রেফতার করা হয়েছিল অরেলিয়া ব্রাউডারকে। মন্টেগোমারিতে বাসে সাদাদের জন্য নির্ধারিত সিটে বসার অপরাধে তাকে জরিমানা করা হয়েছিল।
পার্কসের গ্রেফতার হবার ঘটনা যেন এত দিন চলে আসা আন্দোলনের ক্ষোভের আগুনকে স্ফুলিঙ্গের মত জ্বালিয়ে তুলল। বাস বয়কটের সিদ্ধান্ত নিলেন কৃষ্ণাঙ্গ নেতারা। উইমেনস পলিটিকাল কাউন্সিল নামের একটি সংগঠন ৩৫,০০০ হ্যান্ডবিল ছাপাল বয়কটের আহ্বান জানিয়ে। ডিসেম্বরের ৪ তারিখ রাতে কৃষ্ণাঙ্গদের চার্চগুলোতে সবাই সমবেত হয়ে একাত্ম হলেন বয়কটের ঘোষণায়, সিদ্ধান্ত নেয়া হল ভদ্র আচরণ নিশ্চিত করা, কালো ড্রাইভার নিযুক্তি এবং মাঝখানের সিটগুলোতে আগে আসলে আগে বসার ভিত্তিতে বাসের আসন বরাদ্দ করা- এই তিন দাবি মেনে না নেয়া পর্যন্ত বাস বয়কট করবেন তারা। আন্দোলনের শুরুতে ঘোষণা দিয়ে শুধু এক দিন বাস বয়কটের সিদ্ধান্ত নেয়া হল।
পরদিন ৫ ডিসেম্বরে পার্কসের বিচারে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে মোট ১৪ ডলার জরিমানা করা হয়। পার্কস রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন এবং আনুষ্ঠানিক ভাবে আদালতে প্রথম বারের মত বর্ণভিত্তিক আসন পৃথকীকরণ ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করেন। সেদিন ছাপানো হ্যান্ডবিলগুলো বিলি করা হয় গোটা শহরে। হ্যান্ডবিলে সোমবার দিন বাস বয়কটের আহ্বান জানানো হয়। বৃষ্টি উপেক্ষা করে বাস বয়কটের আন্দোলনের একাত্ম হন প্রতিটি কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ। কালোদের চালানো ক্যাবগুলো বাসের ভাড়ার মতই ১০ পয়সা হিসেবে নিয়ে যাত্রীবহন করে। শহরের ৪০ হাজার কৃষ্ণাঙ্গের প্রায় সবাই হেঁটে চলাচল করে, অনেকেরই অন্তত ৩০ কিলোমিটার হাঁটতে হয় সে দিন।
এক দিনের সফল বাস বয়কটের পর আন্দোলনের কৌশল নিয়ে আলোচনায় বসলেন নেতারা, যেখানে উপস্থিত ছিলেন পার্কসও। বয়কট চালিয়ে নিয়ে আন্দোলন জোরদারের উদ্দেশ্যে একটি সংগঠন গঠন করা হল, নাম হল মন্টেগোমারি ইম্প্রুভমেন্ট এসোসিয়েশন। এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন পরবর্তীতে কিংবদন্তীতে পরিণত হওয়া কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, যিনি সে সময় আন্দোলনের সংগঠক হিসেবে ছিলেন একেবারেই নতুন।
১৯৫৬ সালের ফেব্রুয়ারির ১ তারিখে একটি মামলা দায়ের করেন আইনজীবী ফ্রেড ডেভিড গ্রে যেটাতে বাদি ছিলেন অরেলিয়া ব্রাউডার, ক্লডেট কোলভিন সহ আরও তিন নারী এবং বিবাদী ছিলেন মন্টেগোমারির মেয়র উইলিয়াম গেইল। বাদিদের একজন ছিলেন শ্বেতাঙ্গ জিনেট রিজ যাকে ক্রমাগত হত্যার হুমকি দিচ্ছিল উগ্রবাদী শ্বেতাঙ্গ সংগঠনগুলো, পরে তাকে বাদির তালিকা থেকে সরিয়ে নেয়া হয়। পার্কসের মামলাটি আলাদাভাবে চলতে থাকায় তাকে আর এ মামলায় বাদি করা হয়নি।
এদিকে বয়কট শুরু হল পুরোদমে। বাস মালিক আর শহরের সরকার ভেবেছিল কত দিনই বা আর এই কালোগুলো বাস ব্যবহার না করে থাকতে পারবে। তাদের চিন্তাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বয়কট চলতে লাগল দিনের পর দিন। যাদের গাড়ি ছিল তারা ফ্রি রাইড দিয়ে অন্যদের সহায়তা করতে লাগল। কৃষ্ণাঙ্গরা হাঁটতে লাগল প্রতি দিন মাইলের পর মাইল। কৃষ্ণাঙ্গ ক্যাব চালকেরা তাদের জন্য ভাড়া নিতে লাগল ১০ পয়সা করে। একে ঠেকাতে আইন জারি হল, কোনো ক্যাব চালক ৪৫ পয়সার কম ভাড়া নিতে পারবে না।
কৃষ্ণাঙ্গদের চার্চগুলো থেকে সারা দেশে অর্থ সংগ্রহ করা হল এই আন্দোলনের জন্য। অল্প ব্যবহৃত জুতা সংগ্রহ করা হল কারণ হাঁটতে হাঁটতে তাদের জুতা ক্ষয়ে যেত অল্প সময়েই। আন্দোলনের নেতা এডগার নিক্সন ও মার্টিন লুথার কিং এর বাড়িতে বোমা মারা হল। কিং তখন ক্ষিপ্ত কর্মীদের শান্ত করলেন অহিংসার পথে এগুনোর আহ্বান জানিয়ে। বয়কটের সময় যেসব গাড়ি ব্যবহৃত হচ্ছিল সেগুলোর বীমা কোম্পানিগুলো গাড়ির বীমা বন্ধ করে দিল স্থানীয় সরকারের চাপে পড়ে। তখন বয়কটের নেতারা ‘লয়েড অব লন্ডন’ নামক এক কোম্পানির ব্যবস্থা করলেন এই গাড়িগুলোর বীমা করার জন্য।
টানা বয়কটের কারণে বাসগুলো অচল হয়ে পড়ে রইল। বাসের কোম্পানিগুলো বিশাল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হল। মার্টিন লুথার কিং সহ ৯০ জন নেতার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হল ব্যবসায় বাধা সৃষ্টির অভিযোগে। তারা একত্রে আত্মসমর্পণের জন্য হাজির হলেন।
কিং কে ৫০০ ডলার জরিমানা আর অনাদায়ে ৩৮৬ দিন কারাদণ্ড দেয়া হল। তিনি কারাবরণ করলেন। দুই সপ্তাহ পর কারাগার থেকে বের হয়ে তিনি ঘোষণা দিলেন, “আমি আমার অপরাধের জন্য গর্বিত। অবিচারের বিরুদ্ধে আমার লোকদের সাথে অহিংস আন্দোলনে যোগ দেয়াটাই ছিল আমার অপরাধ।” সারা দেশে এই আন্দোলনের সমর্থনে দাঁড়ালো মানুষ।
সারা দেশে মানুষের অব্যাহত সমর্থনের চাপ বাড়তে লাগল। জুনের ৪ তারিখে ডিসট্রিক্ট কোর্টে রায় হল, আলবামার মন্টেগোমারির এই আইন অসাংবিধানিক। আলবামা রাজ্য থেকে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হল। এদিকে বয়কট চলতে লাগল। নভেম্বরের ১৩ তারিখে সুপ্রিম কোর্টে আগের রায় বহাল রাখল। সংবিধানের ‘ফোরটিনথ এমেন্ডমেন্ট’ অনুসারে সমঅধিকারের নিশ্চয়তার বিরুদ্ধে এই আইনকে অসাংবিধানিক ঘোষণা দেয়া হল।
এভাবে একটানা ৩৮১ দিন চলার পর ১৯৫৬ সালের ডিসেম্বরের ২০ তারিখে বয়কট শেষ হল। মন্টেগোমারিতে আবার অধ্যাদেশ জারি হল, বাসে কোনো কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি যে সিটে ইচ্ছে সে সিটে বসে যেতে পারবেন। সফল হল গণআন্দোলন।
পার্কসের গ্রেফতার হবার ঘটনা আফ্রিকান-আমেরিকানদের অধিকারের ব্যাপারে আন্তর্জাতিকভাবে সাড়া তৈরি করেছিল। মার্টিন লুথার কিং ১৯৫৮ সালে তার ‘Stride Toward Freedom’ বইয়ে লিখেন, “পার্কসের গ্রেফতার হওয়াটা এই আন্দোলনের মূল কারণ ছিল না, কিন্তু মূল প্রভাবক ছিল। আন্দোলনের কারণ নিহিত ছিল অনেক গভীরে, ছোট ছোট অবিচারের ঘটনায়।” তিনি আরও লিখেন, “আসলে কেউ কখনও বুঝতে পারবে না কেন পার্কস সেদিন এমন আচরণ করেছিলেন যদি না সে বুঝতে পারে সহ্যের শেষ সীমা কখন ছাড়িয়ে যায়। যদি না তার নিজের কখনও চিৎকার করে বলে উঠতে হয়, ‘আমি আর পারছি না’।”
রোজা পার্কসের গ্রেফতার হবার পর দীর্ঘদিনের এক অত্যাচারী সিদ্ধান্তের সমাপ্তি ঘটে মানুষের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। মানুষের বিরুদ্ধে মানুষের এই অত্যাচার আজকের পৃথিবীতেও চলছে অজস্র স্থানে। যারা এমন অন্যায়ের শিকার, যারা সহ্য করে চলেছেন দিনের পর দিন মুখ বুজে, তাদের জেগে ওঠার জন্য রোজা পার্কস ছিলেন অনন্য উদাহরণ।
পার্কস তার আত্মজীবনী ‘My Story’ তে লিখেন, “লোকে প্রায়ই বলে, আমি নাকি সেদিন খুব ক্লান্ত ছিলাম বলে আমার সিট ছাড়ছিলাম না। কথাটা সত্য নয়। আমি শারীরিকভাবে ক্লান্ত ছিলাম না, অন্য দিন কাজের শেষে আমি যে পরিমাণ ক্লান্ত থাকি সেদিন ততটুকুও ছিলাম না। আমার বয়স বেশি ছিল না। যদিও অনেকের ধারণা আমি তখন বৃদ্ধ ছিলাম। আমার বয়স ছিল মাত্র বিয়াল্লিশ। আমি শুধু একটা কারণে ক্লান্ত ছিলাম। আমি ক্লান্ত ছিলাম ছাড় দিতে দিতে।” রোজা পার্কস শিখিয়ে গিয়েছিলেন, ছাড় না দিয়ে প্রতিরোধ করলে মানুষের মুক্তি আসবেই।