অনেকদিন আগের কথা। ঘানার একটি গ্রামে আনানসি নামে এক মাকড়সা বাস করতো। সে ছিল খুব লোভী, নিজের কোনো জিনিস অন্য কারো সাথে ভাগ করতে চাইতো না। একদিন নিজের বাগান থেকে কিছু মিষ্টি আলু তুলে আনলো আনানসি। খুব যত্ন করে আলুগুলো রাঁধতে বসলো সে। রান্নার দারুণ সুবাসে ক্ষুধাটা যেন আরও চাগিয়ে উঠলো তার। রান্না শেষ করে কোনোমতে দুপুরবেলা খাবার সময় হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে লাগলো আনানসি।
যে-ই না দুপুরে খেতে বসেছে আনানসি, অমনি তার দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুরু হলো। এই অসময়ে কে আসলো ভেবেই খুব বিরক্ত হলো সে। খাবারের প্লেট সরিয়ে তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজা খুলে দিল সে। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে ছিল কচ্ছপ মহাশয়। অনেকক্ষণ ধরে বাইরে ঘোরাঘুরি করে ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত আনানসির ঘরে এসে আশ্রয় নিল কচ্ছপটি।
“হ্যালো আনানসি, কী রাঁধছো তুমি? বেশ সুস্বাদু কিছুর গন্ধ পাচ্ছি মনে হচ্ছে”, কচ্ছপটি আনানসির উদ্দেশে বলতে লাগলো।
নিরাসক্ত গলায় উত্তর দিল আনানসি, “হ্যাঁ, লাঞ্চের জন্য একটু মিষ্টি আলু রান্না করছি”।
কচ্ছপটি উৎসাহের সাথে বলল, “ওহ তাই? আমি তাহলে দুপুরের খাবারটা এখান থেকেই সেরে যাই? সারাদিনের ঘোরাঘুরিতে আমি খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছি আর ক্ষুধাও পেয়েছে বেশ”।
আনানসি তো তার খাবার শেয়ার করতে একদমই আগ্রহী ছিল না। কিন্তু ঘানার একটি নিয়ম আছে- দুপুরে বা রাতে খাওয়ার সময় কোনো অতিথি আসলে তাকে খালি মুখে ফেরত পাঠানো যাবে না। অগত্যা আনানসি আর কচ্ছপকে মানা করতে পারল না। তাই বলে কিন্তু এতো মজাদার খাবার কচ্ছপের সাথে ভাগ না করার ইচ্ছা আনানসির মন থেকে একটুও মুছে যায়নি। কাজেই সে ফন্দি আঁটতে থাকলো কী করে কচ্ছপের কাছ থেকে খাবারগুলো উদ্ধার করা যায়।
“এসো, আমরা একসাথে খেতে বসি”, কচ্ছপকে উদ্দেশ্য করে বলল আনানসি। দুজনে খাবার প্লেট সামনে নিয়ে চেয়ারে বসে পড়ল। কচ্ছপ খাবার মুখে দিতে যাবে এমন সময় আনানসি তাকে থামিয়ে দিলো।
“আরে আরে কী করছো? তুমি জানো না খাওয়ার আগে হাত ধুতে হয়? জলদি যাও, হাত ধুয়ে এসো”, তাড়াহুড়া করে বলল আনানসি। নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে খুবই লজ্জিত বোধ করলো কচ্ছপটি। সারাদিন ধরে হেঁটে তার হাত-পা খুবই নোংরা হয়ে গিয়েছিল। খাবার ফেলে রেখে পাশের নদী থেকে হাত-মুখ ধুয়ে আসলো সে। আনানসি তার জন্য অপেক্ষা না করেই খাওয়া শুরু করে দিয়েছিল। “আলুগুলো একদম ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল তাই আমি আর দেরি করলাম না। তুমিও খাওয়া শুরু করো এবার”, বলল আনানসি।
যা-ই হোক, এবারও খাবার মুখে তোলার আগেই কচ্ছপকে থামিয়ে দিল আনানসি। কারণ সেই একই। বেচারা কচ্ছপ নদী থেকে খাবার টেবিল পর্যন্ত আসতে আসতে আবারো হাত ময়লা করে ফেলেছে। কচ্ছপ এমনিতেই ক্ষুধার্ত ছিল, এই দৌড়াদৌড়িতে সে আরও ক্লান্ত হয়ে পড়লো। তারপরও কষ্ট করে উঠে গিয়ে নদী থেকে হাত ধুয়ে এবার খুব সতর্কতার সাথে বাড়ি ফিরলো সে। হাতে যেন ময়লা না লাগে তাই পরিষ্কার ঘাসের উপর দিয়ে হেঁটে আসে কচ্ছপ। কিন্তু টেবিলে পৌঁছেই সে দেখতে পেল এক টুকরো আলু ছাড়া আর সব খাবার শেষ করে ফেলেছে আনানসি। খুব অপমানিত বোধ করল কচ্ছপ। “লাঞ্চের জন্য তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। একদিন আমার বাড়িতে এসে খেয়ে যেও, দাওয়াত রইলো”, বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো কচ্ছপ। দারুণ খুশি আনানসি নিজের বুদ্ধিমত্তায় বাকবাকুম শুরু করে দিল।
কিছুদিন পরেই আনানসির মনে হলো দাওয়াত ফেলে রাখার কোনো মানেই হয় না। আর কচ্ছপের রান্নার হাত পুরো জঙ্গলময় বিখ্যাত। তাই সে কয়েকদিনের মধ্যেই রাতের খাবারের সময় গিয়ে উপস্থিত হলো কচ্ছপের বাড়িতে। “হ্যালো আনানসি, তুমি আসায় আমি অনেক খুশি হয়েছি। এসো আমরা খেতে বসি”, আনানসিকে বাড়ির ভিতরে ডাকলো কচ্ছপ। খিদের চোটে আনানসির আর তর সইছে না তখন, দৌড়ে কচ্ছপের কাছে গিয়ে খাবারের খোঁজ নিতে লাগলো সে। মৃদু হেসে কচ্ছপ আনানসিকে জানালো খাবারের জন্য তো তাকে কচ্ছপের বাড়িতে যেতে হবে। আর কচ্ছপের বাড়ি ছিল পানির নিচে। কিন্তু মাকড়সা আনানসি কীভাবে পানির নিচে পৌঁছাবে? তার চোখের সামনে দিয়েই আরামসে সাঁতার কেটে বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেলো কচ্ছপ।
আনানসি একের পর এক বুদ্ধি বের করতে লাগলো কী করে পানির নিচে পৌঁছানো যায়। লাফ দিয়ে, ডাইভ দিয়ে কতভাবেই না সে চেষ্টা করতে লাগলো! শেষ পর্যন্ত জ্যাকেটের পকেটে কিছু ভারি পাথর ঢুকিয়ে পানিতে নেমে পড়লো আনানসি। এক ডুবে সে পৌঁছে গেলো সোজা কচ্ছপের বাসায়। এতক্ষণের লাফালাফিতে প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত আনানসি যখন প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়তে যাবে খাবারের উপর তখনই তাকে থামিয়ে দিল কচ্ছপ। “প্রিয় আনানসি, তোমার জ্যাকেটটা খুলে ফেলো প্লিজ। আমাদের সমাজে জ্যাকেট পরে খেতে বসার কোনো নিয়ম নেই”, ভদ্রভাবে জানালো কচ্ছপ। আনানসি তাকিয়ে দেখলো কচ্ছপের গায়েও কোনো জ্যাকেট নেই। তাই আর কথা না বাড়িয়ে গায়ের জ্যাকেটটি খুলে ফেললো সে।
কিন্তু জ্যাকেট খোলার পরেই বাধলো আসল বিপত্তি। এতক্ষণ তো জ্যাকেটের ভিতরের পাথরের ভারে দিব্যি পানির ভিতরে বসে থাকতে পারছিলো আনানসি। কিন্তু জ্যাকেট খুলে ফেলার পর হালকা ওজনের ছোট্ট মাকড়সাটি সোজা পানির উপরে উঠে গেলো। সেখানে বসে বসেই দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে কচ্ছপের খাওয়ার দৃশ্য দেখতে লাগলো বেচারা।
আমার গল্পটি ফুরালো, নটে গাছটি মুড়ালো। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এখানে ‘মোরাল অফ দ্য স্টোরি’ কী? কাউকে ছোট করতে গেলে নিজেরও ছোট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে এমনটা তো অবশ্যই, এছাড়াও এই গল্পের চমৎকার আরেকটি দিক রয়েছে। এই গল্পটি শোনা যায় খোদ আনানসির জবানিতে। নিজেকে খলনায়কের চরিত্রে বসিয়ে এমন দারুণভাবে একটি শিক্ষামূলক গল্পকে উপস্থাপন করতে পারাটাও তো একটি শিল্প বৈকি!
বলছিলাম আনানসির কথা। আনানসি আফ্রিকান লোককাহিনীর একটি মজার চরিত্র। তুরস্কে যেমন রয়েছে মোল্লা নাসিরুদ্দিন হোজ্জা, গ্রীকদের আছে ঈশপ, আমাদের রয়েছে গোপাল ভাঁড়, ঠিক তেমনি আফ্রিকানদের আছে আনানসি। আফ্রিকার পশ্চিমাঞ্চল এবং ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে বেশ গুরুত্বসহকারে তার নাম নেয়া হয়। আনানসি, আনানসে, কুয়াকু আনানসি, আনানছি এসব নামেও পরিচিত তিনি। তাছাড়া আধুনিক বিশ্বে ন্যান্সি, আন্ট ন্যান্সি এ ধরনের চরিত্রেও দেখানো হয় তাকে। বস্তুত আনানসি একটি মাকড়সা, কিন্তু চাইলে তিনি মানুষের রূপও ধারণ করতে পারেন। যাবতীয় জ্ঞানের আধার হিসেবে বিবেচনা করা হয় আনানসিকে।
বর্তমান ঘানার আকান রাজ্যের মানুষের মুখে মুখে ফেরা গল্পের নাম ‘আনানসির গল্প’। আকান ভাষায় আনানসি মানে মাকড়সা। আকানরা তাদের এই গল্প ছড়িয়ে দিয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, সিয়েরা লিওন, নেদারল্যান্ড, সুরিনাম, বোনাইরে আরও অসংখ্য অঞ্চলে। মানুষের নানাভাবে নানা রূপে বর্ণনা করা হয় আনানসিকে। কোথাও তিনি খুব সাধারণ একটি মাকড়সা, কোথাও বা রীতিমতো জামা-কাপড় পরা মাকড়সা, কখনোবা একটি মাকড়সার শরীরে মানুষের মাথা বসিয়ে ভিন্ন রূপও দেয়া হয় আনানসির।
আনানসির গল্পগুলো কীভাবে আসলো তা নিয়েও সুন্দর একটি গল্প আছে। একদা পৃথিবীতে কোনো গল্প ছিল না। সব গল্প তখন জমা ছিল আকাশ-দেবতা নিয়ামের কাছে। আনানসি সোজা চলে গেল নিয়ামের কাছে আর জিজ্ঞেস করলো গল্প কিনতে কী মূল্য পরিশোধ করতে হবে। বেশ চড়া দাম চেয়ে বসলেন নিয়াম। আনানসি যদি অনিনি নামের পাইথন, চিতাবাঘ ওসেবো আর ভিমরুল মিব্রোকে নিয়ামের কাছে নিয়ে আসতে পারে তাহলেই সে গল্প নিয়ে পৃথিবীতে যেতে পারবে।
দৃঢ়প্রতিজ্ঞ আনানসি বেরিয়ে পড়লো শর্তপূরণের অভিযানে। শুরুতেই গেলো পাইথনের কাছে। পাইথনের গুহার সামনে যেয়ে চিৎকার করে বলতে লাগলো সে বিশ্বাস করে না পাইথন আকারে পাম গাছের চেয়েও বড়। কথাটা খুব আত্মসম্মানে লাগলো পাইথনের। পরীক্ষাস্বরূপ পাইথন আর পাম গাছকে পাশাপাশি দাঁড়াতে বলল আনানসি। পাইথন তো আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না, তাই সে নিজেই বুদ্ধি দিল তার লেজটা পাম গাছের সাথে আটকে দিতে। লেজ থেকে শুরু করে আস্তে আস্তে পুরো শরীরটাই গাছের সাথে বেঁধে ফেলে বুদ্ধিমান আনানসি। গাছসুদ্ধ পাইথনকে নিয়ামের হাতে তুলে দিয়ে আসে আনানসি।
এবার আসলো চিতাবাঘের পালা। আনানসি মাটিতে গভীর একটি গর্ত খুঁড়লো। সেই গর্তে পড়ে চিতাবাঘ তারস্বরে চিৎকার করতে লাগলো। আনানসি তখন তার জালের মধ্যে করে চিতাবাঘকে উপরে উঠানোর প্রস্তাব দিলো। খুশিমনেই রাজি হলো চিতাবাঘ। ঐ জালে জড়িয়েই বাঘকে সোজা নিয়ামের কাছে নিয়ে গেলো আনানসি।
ভিমরুলকে ধরার জন্য আনানসি একটি লাউয়ের খোল খালি করে তার উপরে কিছু লতাপাতা চাপা দিয়ে রাখে। এবার একটি কলাপাতায় আর তার নিজের মাথায় পানি ঢেলে আনানসি ভিমরুলকে ডেকে বলল বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে, সে যদি লাউয়ের খোলে আশ্রয় নেয় তাহলে আর ভেজার আর কোনো সম্ভাবনা থাকবে না। যে-ই না ভিমরুল লাউয়ের খোলায় ঢুকলো, ওমনি আনানসি তাকে নিয়ে চললো নিয়ামের কাছে। নিয়াম আনানসির কাজে খুব খুশি হয়ে তাকে গল্পের দেবতার আসনে আসীন করে দিলো।
পুরাণমতে, আনানসি আসলে আকাশদেবতা নিয়ামের ছেলে। বাবার হয়ে সে আগুন নিয়ন্ত্রণে বৃষ্টি নামায় আর অন্যান্য কাজ করে। আনানসির নিজের ছেলে-মেয়ের কথা কিছু কিছু গল্পে উল্লেখ করা হয়েছে। তার স্ত্রী মিস আনানসি বা মিস্ট্রেস আনানসি কিংবা শুধু আসো নামেই সুপরিচিত। কোনো কোনো অঞ্চলে সূর্য, চন্দ্র, তারার সৃষ্টিকর্তা হিসেবে আনানসির নাম পাওয়া যায়।
গল্পের বই থেকে শুরু করে কমিকস, সিনেমা, টেলিভিশন সিরিয়াল, গান, ভিডিও গেম কোথায় আনানসির দেখা পাওয়া যায় না! ডিসি কমিকসের জাস্টিস লীগ অফ আমেরিকা টিমকে মোকাবেলা করতে হয় আনানসির। প্যান্ডোরার বাক্স খুলতে গেলে ট্রিকস্টার আনানসিকে ধরার কঠিন লেভেল পার হতে হয়। এতো কিছুর ভিড়ে কিভাবে ভুলে যাবেন আনানসিকে? আনানসি তো আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবেই জড়িয়ে আছে!