১৯১৮ সালে সংগঠিত স্প্যানিশ ফ্লুয়ের প্রাদুর্ভাবে গোটা বিশ্বে প্রায় ৫০ মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরণ করে। পরিসংখ্যান বলছে, এখন অবধি মানবসভ্যতায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিসাধন করা মহামারী এটি। স্প্যানিশ ফ্লুয়ের প্রাদুর্ভাবে শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই মৃত্যুবরণ করে ৬,৭৫,০০০ নাগরিক। তখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছিল। এখন অবধি পাওয়া সবথেকে বিশ্বস্ত সূত্র বলছে, পোর্ট রিলের সেনাঘাঁটিতে ১৯১৮ সালের ৪ মার্চ তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম স্প্যানিশ ফ্লু আক্রান্ত রোগীর সন্ধান পাওয়া যায়।
বর্তমানে করোনাভাইরাসের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে ঠিক একই কায়দায় সেকালেও অঞ্চলভেদে নানানরকম পন্থা অবলম্বন করা হয়েছিল। সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সরকার প্রশাসনের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। স্বাস্থ্যবিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী জনসমাগম হয় এমন জায়গায় রুমাল, ডিসপোজেবল টিস্যু ব্যবহারের নির্দেশনা দেয়া হতো। কিন্তু বিতর্ক শুরু হয় যখন স্বাস্থ্যবিভাগ মার্কিন নাগরিকদের মাস্ক ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করে। পশ্চিমা রাজ্যগুলো থেকে সর্বপ্রথম মাস্কবিরোধী কথাবার্তা ছড়াতে থাকে। মাস্ক পরিধানকে তারা ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের চোখে দেখতো। তবে যুদ্ধ চলাকালে মাস্কের বিরুদ্ধাচরণ করা অঞ্চলের লোকেরা একটা সময় ভীতসন্ত্রস্ত হয়েছিল এবং বুঝতে পেরেছিল এর গুরুত্ব সম্পর্কে। স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করায় সেকালে সানফ্রানসিসকো, ডেনভার, সিয়াটেল, ফিনিক্সের মতো শহরের উপর নানারকম নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
তবুও অভিযোগ কমেনি দেশটিতে। কেউ কেউ সরাসরি বলাবলি করছিল মাস্ক ব্যবহার অস্বস্তিকর, অকার্যকর এবং অলাভজনক। কর্মকর্তারাও মাস্ক ছাড়াই জনসম্মুখে ঘোরাফেরা করতেন এবং ধরাও খেতেন। বিশ্বযুদ্ধ শেষে মানুষ সামান্যতম সময়ের জন্য মনেই করেনি যে মাস্ক ব্যবহার করা দরকার। বিরোধীরা একটা পর্যায়ে ‘অ্যান্টি-মাস্ক লীগ’ নামক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে সানফ্রানসিসকো থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে। আর এভাবেই মহামারীর মতো সময়েও দেশটিতে মাস্ক ব্যবহার নিয়ে পক্ষপাতিত্ব শুরু হয়। ফলশ্রুতিতে বড়সড় মূল্য দিতে হয় দেশটিকে। আজ আমরা আলোচনা করব মাস্ক নিয়ে সৃষ্ট বিতর্ক নিয়ে।
মাস্ক তৈরির উপকরণ নিয়ে বিতর্ক
বর্তমান সময়ে চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত লোকজন যে N95 মাস্ক ব্যবহার করছে সেটি তখন আবিষ্কৃত হয়নি। তবে সে সময় সার্জিক্যাল মাস্কের প্রচলন ছিল উল্লেখযোগ্য। দূষণজনিত সমস্যা প্রতিরোধে ব্যবহৃত সার্জিক্যাল মাস্ক তৈরি হতো গজ কাপড় দিয়ে। এছাড়াও ফ্লু জাতীয় রোগের জন্য একই মাস্ক ব্যবহারের পরামর্শ দিতেন চিকিৎসকরা। ১৯১৮ সালের প্রথমদিকে স্প্যানিশ ফ্লু যখন ছড়াতে থাকে তখন রেড ক্রসের সেচ্ছাসেবীরা এই ধরণের মাস্ক তৈরি করে বিনামূল্যে বিতরণ করতে থাকে। এছাড়াও সংবাদপত্রে এই গজ মাস্ক তৈরির নিয়মকানুন সম্পর্কে লোকজনকে অবহিত করা হতো।
পত্রিকাগুলো মানুষকে বাড়িতে মাস্ক তৈরির যে নিয়মকানুন শিখিয়েছিল সেটির বিভিন্নরকম প্রয়োগ দেখিয়েছিল মার্কিনীরা। ১৯১৮ সালের অক্টোবরের কোনো একদিন সিয়াটেল ডেইলি টাইমস হেডলাইন করেছিল “ইনফ্লুয়েঞ্জা নতুন ফ্যাশন দাঁড় করিয়েছে।” মূলত সিয়াটেল শহরের নারীরা জালের মাস্ক পরিধান করে রাস্তায় বেরিয়ে ঘোরাঘুরি করতো। মাস্ক ব্যবহারে শহরের মানুষ নিজেদের পছন্দমত উপকরণ ব্যবহার করতে লাগল যা চলমান মহামারী প্রতিরোধে তেমন কোনো সাহায্যই করেনি। বরঞ্চ মাস্ক আরও ফ্যাশনেবল করে তৈরি হতে থাকে।
মার্কিনীরা যখন মাস্ক নিয়ে নানারকম কারুকাজ করছিল তখন দেশটির স্বাস্থ্যবিভাগের সঙ্গে গবেষকদের দ্বন্দ্ব শুরু হয় গজ কাপড়ের তৈরি মাস্কের কার্যকারিতা নিয়ে। এমন বিতর্কের মাঝে বিস্ফোরক বক্তব্য দেন ডেট্রয়েটের স্বাস্থ্যপ্রধান জে. ডব্লিউ ইনচেস! তার মতে, মাস্কের ভেতরের ছিদ্রগুলো ফ্লু মোকাবেলায় যথেষ্ট নয়। জনসমাগম হয় এমন জায়গায় গজ মাস্ক কার্যকরী নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি। যদিও ফিনিক্স শহরের বেশিরভাগ নাগরিক স্বাস্থ্যবিধি এবং নির্দেশনা অনুসারে মাস্ক ব্যবহার করেছিল। তবে কিছু লোক ধূমপানের উদ্দেশ্যে মাস্কে ছোট্ট ফুটো করে রাখত। এতে করে মাস্কটি পুরোপুরি কার্যকারিতা হারিয়ে বাতিল হয়ে যেত।
গজ কাপড় দিয়ে তৈরি হলেও যখন একে সঠিকভাবে পরিধান করা হতো তখন এটি কিছুটা হলেও কার্যকরী ভূমিকা পালন করতো। প্রকৃতপক্ষে খুব কম মার্কিন নাগরিকই মাস্ক সঠিকভাবে ব্যবহার করতেন। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের ঔষধের ইতিহাস ও গবেষণা কেন্দ্রের সহকারী অধ্যাপক আলেক্স নাভারো অবশ্য এর জন্য বড় এবং ছোট শহরের জীবনযাত্রাকে দায়ী করেন। তার মতে, সে সময় স্বেচ্ছাসেবকরা মানুষকে মাস্ক পরিধানের ব্যাপারে নানাভাবে প্ররোচিত করতো। তবে শহরের মানুষের জন্য সামাজিক নিয়মকানুন কিছুটা শিথিল ছিল। বেশিরভাগই একে ভাল চোখে দেখতো না।
মাস্ক বর্জনকারীদের সাজা
নানারকম কারণ দেখিয়ে মাস্ক ব্যবহারে অপারগতা প্রকাশ করা নাগরিকদের জন্য বিভিন্ন মেয়াদী সাজার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মূলত বৈজ্ঞানিক বিষয়াবলী অবিশ্বাস এবং মাস্ক পরিধানে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ না করায় অনেকে তখন মাস্ক বর্জন শুরু করেন। ওয়াশিংটনের পুগেট সাউন্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ন্যান্সি ব্রিস্টোর মতে উগ্র মেজাজের গুমোট লোকজনই বেশিরভাগ সময় মাস্কের বিরুদ্ধাচরণ করতেন। প্রতিনিয়ত তাদের বিরুদ্ধে নানা রকম অভিযোগ লিপিবদ্ধ হতো। ন্যান্সি আমেরিকায় স্প্যানিশ ফ্লু নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেছেন। তিনি বলেন,
অনেক লোক বিরুদ্ধাচরণ করতো কারণ তারা বলাবলি করতো মাস্ক পরে লোকজন একে অপরকে ভয়ভীতি দেখানোর চেষ্টা করে। এবং সে সময় কর্তৃপক্ষ তাদেরকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করতো। তবে আমি মনে করি এটি নেহাতি একটি অজুহাত ছিল। কারণ অনেকেই চাইতো না কেউ মাস্ক পরিধান করুক।
মাস্ক অধ্যাদেশ জারি হওয়ার পর কিছু লোক বলাবলি করছিল যে, এটি নাগরিক স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করছে। বস্তুত মাস্ক ব্যবহারের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে কিছুটা সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়েছিল ঠিকই, তবে যেভাবে একে বর্জনকারীরা উপস্থাপন করছিল তেমন কিছুই ঘটেনি। অনেকেই মনে করতো মাস্ক মানুষকে নিরাপত্তার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি যোগান দেয়। এমনটা সঠিক তখনই যখন মানুষ অন্যসব স্বাস্থ্যবিধি না মেনে শুধুমাত্র মাস্ক ব্যবহার নিয়ে মাতামাতি করে।
মাস্ক অধ্যাদেশ জারি হওয়ার পর শাস্তি হিসেবে জরিমানা, কারাবন্দিত্ব এবং পত্রিকায় অপরাধীর নাম ছাপানোর প্রচলন শুরু হয়। এতে করে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় ছোটখাট আন্দোলন সংগঠিত হতে থাকে। নতুন অধ্যাদেশ জারির কিছুদিনের মাথায় সানফ্রানসিসকোতে ভয়ানক ঘটনা ঘটে। স্বাস্থ্যবিভাগের একজন কর্মকর্তার নির্দেশ অমান্য করে মাস্ক পরতে অস্বীকৃতি জানায় একজন মার্কিন নাগরিক। সঙ্গে সঙ্গে তাকে গুলি করে হত্যা করেন তিনি। সেই সঙ্গে দুজন প্রত্যক্ষদর্শীকেও গুলি করেন ঐ কর্মকর্তা। এই ঘটনার পর নড়েচড়ে বসে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা।
মাস্ক বিরোধীদের মধ্যে সানফ্রানসিসকোর অনেক রাজনৈতিক নেতাও সেকালে আলোচনায় ছিলেন। বক্সিং ম্যাচ চলাকালে একজন পুলিশ কর্মকর্তার তোলা ছবিতে দুজন সুপারভাইজার, কংগ্রেসের একজন সদস্য, একজন আইনজীবী, নৌবাহিনীর এডমিরাল, সানফ্রানসিসকোর প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এবং মেয়র ধরা পড়েন। তাদের কারো মুখেই মাস্ক ছিল না। পরবর্তীতে অবশ্য পুলিশের নিকট জরিমানা দিয়েই কারাবাস থেকে নিস্তার পেয়েছিলেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এবং মেয়র। স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ৫ ডলার এবং মেয়র ৫০ ডলার জরিমানা প্রদান করেন। যদিও অন্যান্য মাস্ক বর্জনকারীদের মতো তাদেরকে কারাগারে না পাঠানোয় বেশ সমালোচিত হয় সানফ্রানসিসকোর পুলিশ প্রশাসন।
বিশ্বযুদ্ধের পর মাস্ক ব্যবহারে মার্কিনীদের অনীহা
সানফ্রানসিসকোতে প্রথম মাস্ক অধ্যাদেশ তথা আইনটি ১৯১৮ এর অক্টোবরে শুরু হয়ে নভেম্বরে শেষ হয়। মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ায় নাগরিকদের একটি অংশ মাস্ক ব্যবহারের কোনো কার্যকারিতা খুঁজে না পেয়ে একে বর্জনের আহ্বান জানায়। অতঃপর ১৯১৯ সালের জানুয়ারিতে সানফ্রানসিসকো শহরে আবারও তীব্রভাবে স্প্যানিশ ফ্লুয়ের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এতে করে দ্বিতীয়বারের মতো মাস্ক পরিধানের আইন জারি করে শহর কর্তৃপক্ষ। কিন্তু আগেরবারের চেয়ে এবার বড়সড় বাধাবিপত্তি লক্ষ্য করা যায়।
মাস্কবিরোধী একদল লোক কয়েজন চিকিৎসককে সঙ্গে নিয়ে প্রায় ২,০০০ লোক জড়ো করে জনসম্মুখে সভার আয়োজন করে। মূলত এটি ছিল অ্যান্টি মাস্ক লীগের সক্রিয় কর্মসূচি। আলেক্স নাভারোসহ আরও অনেক মার্কিন গবেষক এই মাস্কবিরোধীদের কার্যক্রমের বিষয়ে মন্তব্য করেছেন। সবাই একটি বিষয়ে উপনীত হয়েছেন যে, বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের মাঝে তখন আর আগের মতো দেশপ্রেম কাজ করতো না। মহামারী ছড়ানোর পর প্রথমদিকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাকে দেশপ্রেমের অংশ ভাবা মার্কিনীরাই যুদ্ধ শেষে মাস্কবিরোধী সংগঠনে যোগ দেয়। তবে এটি সত্য যে সানফ্রানসিসকোতে প্রচুর বহিরাগত লোকের প্রবেশ ঘটতো। তবুও অন্যান্য শহরে এত সংখ্যক মাস্কবিরোধী মতাদর্শের লোকের দেখা মেলেনি।
স্টোনি ব্রোক ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের বিশিষ্ট অধ্যাপক ন্যান্সি টোমিস ১৯১৮-১৯ সালের মহামারীতে গণস্বাস্থ্য বিষয়ক সরঞ্জামাদি সম্পর্কে ব্যাপক লেখালেখি করেছেন। তার মতে, সেকালে মাস্ক ব্যবহারে বিপক্ষে গোপনে অনেকেই কথা বলতো এবং ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। যদিও এটি ব্যাপকতা পায়নি, যার কৃতিত্ব যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সরকার প্রশাসনের। তবে এটিও সত্য যে মাস্ক অধ্যাদেশ বাতিলের পর মার্কিন নাগরিকদের মাস্ক ব্যবহার করতে দেখা যেত না। বরঞ্চ তারা মাস্ক ছাড়াই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করত। ১৯১৮ সালে গজ কাপড়ের তৈরি মাস্কগুলো কেমন কার্যকর ছিল সেটি আজও নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। কিন্তু একটা বিষয় নিশ্চিত- যেসব অঞ্চলের মানুষ মহামারীর সময় সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতো তারা পরবর্তীতে অল্প সময়ের মধ্যেই ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পেরেছিল। আর এমন অসংখ্য উদাহরণ শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রেই পাওয়া যায়।