সাল ১৯২৭। সেসময় পেরুর এক আর্কিওলজিস্ট তোরিবিও মেহিয়া কেসপ ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন দক্ষিণ পেরুর এক শুষ্ক মালভূমি অঞ্চলে। অঞ্চলটি নাজকা মরুভূমি নামেই অধিক পরিচিত। হঠাৎ-ই তার চোখে পড়ে দূরে অপেক্ষাকৃত নিচু অঞ্চলে কিছু অদ্ভুত রেখা। কেউ যেন রেখাগুলো দিয়ে কিছু অতিকায় জ্যামিতিক নকশা তৈরি করেছে মরুভূমির বুক চিরে। এর প্রায় বছর তিনেক বাদে এক পাইলট ওই শুষ্ক অঞ্চলের উপর দিয়ে যেতে যেতে তারও চোখে পড়ে মরুভূমির বুকে ওই জটিল নকশাগুলো। যেন কোন শিল্পী বিস্তীর্ণ অঞ্চলের পাথুরে বুকে এঁকে রেখেছে কোনো এক প্রাচীন সংকেত।
এরপর কেটে গেল অনেক বছর। তখন ১৯৩৯ সাল। পেরুর রাজধানী লিমা শহরে এক আর্কিওলজিক্যাল কনফারেন্সে তোরিবিও ওই রহস্যময় রেখাগুলোর কথা আবার উল্লেখ করেন। সকলের মনে এবার তীব্র কৌতূহল জাগে। সেই সময় একজন আমেরিকান ঐতিহাসিক পল কসক কাজ করেছিলেন পেরুতেই। তার গবেষণার বিষয় ছিল পেরুসহ বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতার সেচ-প্রণালী ব্যবস্থা। নাজকা রেখা সম্পর্কে জানতে পেরে তারও বেশ দারুণ কৌতূহল জাগে। তিনি একটা প্লেন ভাড়া করে নিজের চোখে দেখতে গেলেন ওই রহস্যময় নকশা।ঐ অদ্ভুত নকশা দেখেই তিনি চুপ মেরে থাকলেন না, এই রেখার রহস্য উদঘাটনে উঠে পড়ে লাগলেন। এই সময় তার সঙ্গে যোগ দেন জার্মান গণিতজ্ঞ ও আর্কিওলজিস্ট মারিয়া রাইখ। এই দুজন শুরু করেন নাজকা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা।
নাজকা লাইন আসলে কী? লিমা শহর থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দক্ষিণের উষর মরুভূমি জুড়ে রয়েছে এই নাজকা লাইন। এই মরুভূমিতে বালির অস্তিত্ব নেই, আছে বাদামি রঙের অসংখ্য আলগা পাথর। আর সেই পাথরের বুক চিরে রয়েছে এই প্রাচীন রহস্য। এই মরুভূমির প্রায় ৫০০ বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে ১০ হাজারেরও বেশি অতিকায় রেখা রয়েছে।
এই রেখা দিয়ে কোথাও তৈরি হয়েছে বিরাট বিরাট জ্যামিতিক নকশা, কোথাও বা তৈরি হয়েছে ফুল, গাছ, বিভিন্ন প্রাণী, এমনকি মানুষের প্রতিকৃতিও। এই চিত্রগুলো এতই বড় যে সামনে থেকে দেখলে এগুলোকে রেখা ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। ভূমি থেকে অনেকটা উপরে উঠলে আস্তে আস্তে চোখে পড়ে ওই রেখাগুলো একে- অপরের সাথে জুড়ে গড়ে তুলেছে নানা রকম নকশা এবং আদল। বিশেষজ্ঞদের মতে এগুলো তৈরি করা হয়েছে প্রায় আজ থেকে তিন হাজারেরও বেশি বছর আগে। যা কিনা প্রাচীন নাজকা ও প্যারাকাস সংস্কৃতির সাক্ষ্য বহণ করে।
নাজকা রেখা দিয়ে তৈরি চিত্র বা নকশাগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। জিওগ্লিফস এবং বায়োমরফস। বায়োমরফস বলতে বুঝায় জীবজগৎ অর্থাৎ পশু- পাখি বা গাছপালার ছবি। যেমন: হামিংবার্ড, মাকড়শা, হনুমান এবং মানুষের ছবি। আর জিওগ্লিফস অর্থ জ্যামিতিক আকৃতি। নাজকার উপর প্রায় শতাধিক এমন জ্যামিতিক নকশা চোখে পড়ে। আশ্চর্যের বিষয় এই যে এই চিত্রগুলো আকারে বেশ বড়। কোন কোন চিত্র প্রায় ২০০ মিটার অঞ্চল জুড়ে গড়ে উঠেছে।
কিভাবে তৈরি হল নাজকা রেখা? নাজকা মরুভূমিতে অবস্থিত হওয়ায় এটি আয়রন অক্সাইড পাথরে আবৃত। এর নিচে রয়েছে চীনাপাথরের মাটি। নাজকা লাইন তৈরি হয়েছে এই পাথুরে জমি খুঁড়ে। রেখাগুলো প্রায় চার থেকে ছয় ইঞ্চি গভীর। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, প্রাচীন হট এয়ার বেলুন থেকে বা পাহাড়ের উপর থেকে সার্ভের মাধ্যমে আঁকা হয় নাজকা লাইনস। এই যুক্তি অনেকেই মানতে নারাজ।
কারা আকঁল এই রেখা? প্রশ্ন জাগাটাই স্বাভাবিক। অনেকের মতে ইনকা সভ্যতার শুরু এই এলাকা থেকে। ইনকা সভ্যতার মানুষের মেধা, শ্রম এবং সময় ব্যয় করে এই রেখাগুলো তৈরি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। আরেকদল গবেষকদের মতে, জ্ঞান এবং প্রযুক্তিগত দিক থেকে উন্নত এলিয়েনরা সেই প্রাচীন সময়ে এইসব রেখাচিত্র অঙ্কন করে গেছে পেরুতে।
আরো একটি বিষয় ব্যাপক বিস্ময় জাগায় । এত বছর আগে তৈরি এই লাইন আজও একইভাবে রয়েছে কীভাবে? এর উত্তর প্রকৃতি। বিভিন্ন ধরণের প্রাকৃতিক শক্তি যেমন নদী, বায়ু, হিমবাহ ইত্যাদি তাদের নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত ভূমি রূপের নানা পরিবর্তন ঘটায়। নাজকা মরূভূমি অঞ্চল এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। এই অঞ্চল অত্যন্ত শুষ্ক। সারাবছরই এ অঞ্চলের তাপমাত্রা থাকে ২৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। বৃষ্টি নেই বললেই চলে। ফলে হাজার হাজার বছর ধরে নাজকা রেখা গুলো একই রকম থেকে আজ ও মানুষের মনে বিস্ময় জাগিয়ে রেখেছে।
তবে কী উদ্দেশ্যে মাইলের পর মাইল এই রেখা খনন করা হয়েছে? তা নিয়েও বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে রয়েছে নানা মত। প্রথমেই আসা যাক পল কসকের কথায়। তার মতে নাজকা লাইনের সঙ্গে জ্যোতির্বিদ্যার এক গভীর সম্পর্ক রয়েছে। নাজকা নাকি বিরাট এক পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র। তিনি মনে করতেন নাজকা রেখাগুলো নাকি তারা মন্ডলের প্রতিরূপ। আবার অনেক গবেষকই মনে করেন, এগুলোর তৈরির পিছনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ধর্মীয় কারণ জড়িত। মনে করা হয় এই রেখাগুলো হয়ত কোনো ধর্মীয় উপাচারের অঙ্গ। হয়তো আকাশ থেকে ঈশ্বরের দৃষ্টি আকর্ষণ করানোর জন্যেই প্রাচীন পেরু বাসিন্দারা এমন অতিকায় বিচিত্র নকশা বানিয়েছিলেন। আবার অনেকে মনে করেন, পানির সন্ধানে পাওয়া যেতে পারে সেরকম স্থান গুলোকে সংযুক্ত করতেই রেখাগুলো আঁকা হয়। এর সপক্ষে জোরালো যুক্তি পাওয়া না গেলেও প্রাচীন রুক্ষ, শুষ্ক পেরু অঞ্চলের কথা ভাবলে এরকম সম্ভাবনা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
আবার অনেকে মনে করেন, নাজকা লাইনের সাথে প্রাচীন টেক্সটাইল শিল্পের যোগসূত্র আছে। কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন ওই বিশাল লম্বা রেখাগুলো প্রাচীন মানুষেরা লুম হিসেবে ব্যবহার করত। এই সুতো দিয়েই নাকি প্যারাকাস সংস্কৃতিতে নাকি মমি আবৃত করা হত।
এসবের মধ্যে সুইস লেখক এরিক ফন দানিকেনের তত্ত্বটি বেশ জনপ্রিয়। ১৯৬৪ সালে তার লেখা বই ‘চ্যারিয়টস অফ গড’-এ তিনি জানান যে, প্রাচীনকালে ভিন গ্রহের প্রাণীরা নাকি পৃথিবীতে আসতো। এই লাইনগুলো ছিল তাদের স্পেসশিপের রানওয়ে। ভবিষ্যতে যাতে তারা পথ চিনে ফিরে আসতে পারে সেই কারণে নাকি প্রাচীন পেরুর বাসিন্দারা আরও বিভিন্ন নকশা অংকন করেন। বর্তমান সময়ের রানওয়ে এবং নাজকা লাইনের মধ্যে যে সাদৃশ্য রয়েছে তার ওপর ভিত্তি করে দানিকেনের তত্ত্বকে একেবারে উপেক্ষা করার কোন জো নেই।
এতো বিশাল এলাকা জুড়ে পাথর কেটে এমন নিখুঁত রেখা টানা সহজ কাজ নয়। যদিও এর নির্মাণে কত সময় ব্যয় হয়েছে তা পরিস্কার নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এতো বিশাল এলাকায় শ্রমসাধ্য কাজ অল্প দিনে হয়নি। প্রজম্মের পর প্রজম্ম ধরে বিশালাকার রেখাগুলো তৈরি করা হয়েছে।
নাজকা রেখা নিয়ে বিভিন্ন গবেষকদের গবেষণা এখনও শেষ হয়নি। যদিও সঠিক উত্তর এখনো আমাদের অজানা। আর অজানা বলেই তো এত রহস্য, এত প্রশ্ন। সবারই আশা, এর উত্তর একদিন মিলবেই। ততদিন কল্পনায় নানা সম্ভাবনার কথা ভেবে দেখতে ক্ষতি কি!