সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর তিনি জানিয়েছেন, তিনি শুধু সুস্থই নন, বরং খুবই ‘স্থিতিশীল মেধাবী’! যদিও জনমত জরিপে মোটেও সেটির কোনো প্রতিফলন দেখা যায় না। ট্রাম্প যে আদতে কোনো সুস্থির ব্যক্তি নন, তা বুঝতে কোনো জনমত জরিপের দরকার নেই, তার ‘টুইট’গুলোই যথেষ্ঠ। বলাই বাহুল্য এমন অহংকারী, আত্মমগ্ন রাষ্ট্রনায়কদের কোনো অভাব নেই পৃথিবীতে, এদের অস্তিত্ব সারা বিশ্বেই রয়েছে, নানা সময়েই এরা ত্রাসের ন্যায় আবির্ভূত হয়ে তাণ্ডব চালিয়েছে নিজ দেশে।
ইদি আমিন
সত্তরের দশকের সবচেয়ে ঘৃণ্য স্বৈরশাসক উগান্ডার প্রেসিডেন্ট ইদি আমিনকে বলা হয় এযাবৎকালের সবচেয়ে কাণ্ডজ্ঞানহীন আর উন্মাদ একনায়ক। মজার ব্যাপার হলো, ইদি আমিনের বলা অনেক উক্তির সাথে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অনেক কথা আর হাবভাব পুরোপুরি মিলে যায়, কমেডিয়ান ট্রেভার নোয়ার এই কমেডি শোতে একবার ঢুঁ মেরে দেখে আসতে পারেন।
ধারণা করা হয়, ইদি আমিন তার শাসনামলে প্রায় এক লক্ষ থেকে পাঁচ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছেন। এদের সবাই ছিল রাজনৈতিক বিরোধী আর ভিন্নমতালম্বী। ‘৭৭ সালে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে তার স্বভাব পুরোপুরি উন্মাদের ন্যায় ধারণ করে। তিনি নিজেকে স্কটল্যান্ডের রাজা হিসেবে দাবি করতেন, নিজেই নিজেকে ডক্টরেট ডিগ্রিধারী বলে ঘোষণা দেন। তার পদবী ছিল ‘মহামহিম, আজীবন রাষ্ট্রপতি, ফিল্ড মার্শাল আল হাজ্জ ডক্টর ইদি আমিন দাদা, VC, DSO, MC, পৃথিবীর সকল প্রাণী ও মাছের প্রভু এবং আফ্রিকায় এবং উগান্ডায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিজেতা’!
জোসেফ স্ট্যালিন
পাকানো, চাড় দেয়া গোঁফের অধিকারী জোসেফ স্ট্যালিন ছিলেন পুরো সোভিয়েত ইউনিয়নের হর্তাকর্তা, তার কথাই শুরু এবং শেষ। কঠোরভাবে ভিন্নমতালম্বীদের দমন তো ছিল সাধারণ ব্যাপার, ‘গুলাগ’ নামের কুখ্যাত জেলখানা ছিলো জোসেফ স্ট্যালিনের তৈরি। যেখানে বন্দীদের দিয়ে জোরপূর্বক কষ্টসাধ্য শ্রমিকের কাজ করিয়ে নেওয়া হতো। স্ট্যালিনের এই ‘গুলাগ’ জেলখানাগুলোতে ১৯২০-৫৬ পর্যন্ত প্রায় ১৫ থেকে ৩০ মিলিয়ন বন্দী মারা যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তার ছেলে লেফট্যানেন্ট ইয়াকোভ জার্মান বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। এসময় জার্মান বাহিনী সোভিয়েতদের হাতে বন্দী তাদের এক ফিল্ড মার্শালকে ফেরত চায় স্ট্যালিনের ছেলেকে ফেরত দেওয়ার বিনিময়ে। জবাবে স্ট্যালিন বলেছিলেন, “আমি একজন লেফট্যানেন্টের বিনিময়ে একজন মার্শালকে দিতে পারি না”। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও স্ট্যালিনের এই গুণ পেয়েছেন ! ট্রাম্পের ছেলে রাশিয়ার সাথে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে অভিযুক্ত হলে তিনিও বলেছেন, “আমি ছেলেকে নিয়ে এফবিআই এর সাথে কোন আপস করব না”।
চেঙ্গিস খান
চেঙ্গিস খান মগজের দিক থেকে ছিলেন তার নিজের জমানার ‘আইনস্টাইন’, অন্তত তার কৌশলী সমরবিদ্যার কারণে মানুষের সে রকমই অভিমত। মধ্যযুগের নির্দয়, অপরাজেয় এই সম্রাট সেই সময় পুরো পৃথিবীর ভূখন্ডের প্রায় ১২ মিলিয়ন বর্গ মাইল জায়গা দখল করে নিয়েছিলেন তার লৌহমুষ্ঠি আর ক্ষ্যাপাটে মাথা দিয়ে। চেঙ্গিস খান তার সমগ্র সমর জীবনে তৎকালীন পৃথিবীর মোট জনগোষ্ঠির প্রায় ১১% হত্যা করে সাফ করে দিয়েছিলেন তার সাম্রাজ্য দখলের নেশায়।
এডলফ হিটলার
হিটলারের নামের আগে-পরে কোনো বিশেষণের দরকার নেই। পুরো ইউরোপের প্রায় ষাট লক্ষ ইহুদী ধর্মাবলম্বী মানুষকে হত্যা করা হয় শুধু হিটলারের ‘জাতিগত শুদ্ধিকরণ’ কর্মসূচী বাস্তবায়নে। হিটলার পদ্ধতিগতভাবে ইহুদীদের হত্যা করতে বানিয়েছিলেন অসংখ্য ‘কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প’, এসব ক্যাম্পে গণহারে ইহুদীদের ধরে এনে নানা নির্মম পদ্ধতিতে হত্যা করাই ছিলো মূল উদ্দেশ্য। হিটলারই বাধিয়েছিলেন ২য় বিশ্বযুদ্ধ, আর যার ফলে ঘটে কোটি খানেক মানুষের প্রাণহানী।
মুয়াম্মার গাদ্দাফী
নানারকম বিচিত্র কাণ্ডকারখানার জনক লিবীয় প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফি প্রায় হাজারখানেক রাজনৈতিক ভিন্নমতালম্বীকে হত্যার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নের অভিযোগ আছে গাদ্দাফির বিরুদ্ধে।
এছাড়াও ১৯৮৮ সালে প্যান আমেরিকান এয়ারলাইন্সের ১০৩ নম্বর ফ্লাইটে টাইম বোমা দিয়ে মাঝ আকাশে বিস্ফোরণে ধ্বংস করার অভিযোগও আছে গাদ্দাফির বিরুদ্ধে, এই বিস্ফোরণে ২৫৯ জন যাত্রীর সবাই নিহত হয়। পরে এই অভিযোগ স্বীকার করা হয় এবং ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোকে প্রায় ২.৭ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণও দেন গাদ্দাফি।
ভ্লাড দ্যা ইম্পেলার ওরফে ‘ড্রাকুলা’
কোনো রক্তপিপাসু নিষ্ঠুর শাসকের চরিত্র যখন ‘ড্রাকুলা’র মতো কল্পকাহিনীর জন্ম দিতে পারে তখন তাকে প্রতিভাবান না বলে উপায় নেই। ১৫ শতাব্দীতে বর্তমান রোমানিয়ায় জন্ম নেওয়া এই সম্রাট ছিলেন পুরো ইউরোপের ত্রাস। ১৫ শতকের পুরো সময়টা জুড়ে মানুষকে শাস্তি ও হত্যার নিষ্ঠুর ও বিচিত্র পদ্ধতি প্রয়োগের জন্যে ইনি কুখ্যাত। বিশেষ করে কাঁটায় গেঁথে অর্থাৎ শূলে চড়িয়ে মানুষ মারতে বোধহয় তিনি খুবই পছন্দ করতেন। ইতিহাসবিদদের অনেকের অভিমত, আইরিশ লেখক ব্রাম স্টোকারের অমর সৃষ্টি ‘ড্রাকুলা’ চরিত্রটি ভ্লাড দ্য ইম্পেলারের দ্বারা অনুপ্রাণিত !
কিম জং ইল
উত্তর কোরিয়ার বর্তমান প্রধান কিম জং উনের বাবা কিম জং ইলের মেধার কোনো তুলনা হয় না, তিনি তার দেশের মানুষকে আয়োজন করে ঘোষণা দিয়ে জানিয়েছেন যে তিনি কখনোই মল-মূত্র ত্যাগ করেন না, কারণ তার মল-মূত্র ত্যাগের দরকার হয় না ! তিনি তার দেশের আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ করেন এবং তিনি হ্যাম বার্গারের আবিষ্কারক! কিম জং ইল একজন চলচ্চিত্রপ্রেমীও বটে, তিনি ১৯৭৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়া চলচ্চিত্র পরিচালক শিন সাং অকে’কে উত্তর কোরিয়ায় অপহরণ করে আনেন ‘গডজিলা সিনেমার সমাজতান্ত্রিক সংষ্করণ’ তৈরি করতে !
কিম জং ইলের শাসনামলে কতজন মানুষকে হত্যা করে গুম করা হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া মুশকিল। তবে জানা যায়, দুই লক্ষ মানুষ তার কারাগারে বন্দী ছিল সেসময়। তার শাসনামলকে বিবেচনা করা হয় বিশ্বের সবচেয়ে দমনমূলক সরকার হিসেবে। কিম জং ইলের বিরুদ্ধে ১৯৯০ সালের দুর্ভিক্ষকে প্রলম্বিত করার অভিযোগও আছে।
সাদ্দাম হোসেন
ইরাকের সাবেক স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেন ছিলেন সাহিত্যানুরাগী, নিজে বেশ কিছু উপন্যাস আর কবিতা লিখেছেন তিনি। তবে কবিতা রচনার পাশাপাশি নিজ দেশেই বোমা বর্ষণ, রাসায়নিক গ্যাস হামলা করে হাজার পাঁচেক মানুষ মেরে ফেলাও সাদ্দাম হোসেনের জন্যে বেশ স্বাভাবিক কাজ ছিল। সেই সাথে নিজের ছেলেদের প্রতিও ছিল তার অনেক স্নেহ, তাই ছোট ছেলে উদয় হোসেন বিয়ের অনুষ্ঠানে ফুর্তি করে ছোঁড়া গুলিতে বেশ কজন নিহত হলে তাতেও ছেলের প্রতি স্নেহের কোনো ঘাটতি দেখা দেয়নি।
সাদ্দাম হোসেনের অপরাধ তালিকা বেশ দীর্ঘ। যার মধ্যে আছে ১৯৭৪ সালের দাওয়া পার্টির নেতাদের হত্যা, ‘৮০ সালে হাজারখানেক কুর্দিদের হত্যা ও নির্বাসনে পাঠানো, ‘৮৮ সালে গ্যাস হামলা চালিয়ে আনুমানিক পঞ্চাশ হাজার থেকে এক লক্ষ মানুষ হত্যা করা ও ‘৯০ সালে কুয়েত দখল করে নেওয়া। এমনকি ১৯৯০ সালে নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে ‘মার্শ আরব’ নামক আদিবাসীদের বাস্তুভিটা ভাসিয়ে দেওয়া হয়।
বেনিতো মুসোলিনি
মুসোলিনিকে আলাদা করে ফ্যাসিষ্ট বলার দরকার নেই, কারণ ফ্যাসিবাদ নামক উগ্র রাজনৈতিক মতবাদটি মূলত তারই তৈরি করা। এই মতবাদের মূল কথাই হলো নৈরাজ্য, সন্ত্রাসবাদ আর গায়ের জোরে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করা।
মুসোলিনি ছোটবেলাতে স্কুলে থাকতেই দুজন সহপাঠী আর শিক্ষককে ছুরিকাঘাত করে তার স্বভাবের ধরন বুঝিয়ে দিয়েছিল। মুসোলিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের পাশে দাঁড়িয়ে ইতালিকে অক্ষশক্তির অন্যতম সদস্যে পরিণত করে। যুদ্ধ শেষে অবশ্য দেশের ক্ষিপ্ত জনতা তার লাশ মিলান শহরে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখে।
অপ্রকৃতিস্থ সম্রাট ক্যালিগুলা
৩৭ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাট ক্যালিগুলাকে ইতিহাসবিদরা বিবেচনা করেন পুরোপুরি উন্মাদ হিসেবে। অপ্রয়োজনীয় কাজে অর্থ খরচ আর যৌনতা, এই দুই জিনিস নিয়েই সময় কাটত তার। এছাড়াও বিনা কারণে হত্যাকাণ্ড, সৈন্যদের অযৌক্তিক অভিযানে পাঠানো আর রাজপ্রাসাদকে অবাধ যৌনপল্লী বানিয়ে ফেলার মতো কাণ্ডও ঘটান এই রোমান সম্রাট। তবে তার সবথেকে স্মরণীয় হয়ে থাকা ব্যাপারটি হলো, ক্যালিগুলা তার প্রিয় পোষা ঘোড়াকে রাষ্ট্রদূত বানাতে চেয়েছিলেন!
ফিচার ছবি- nydailynews