আমরা সবাই জানি, প্লেন আকাশে উড়বে আর বিমানবন্দরে অবতরণ করবে। কোনো কোনো অ্যাকশন মুভিতে হয়তো এই নিয়ম মানা না-ও হতে পারে। কিন্তু বাস্তব জীবনে সবসময় আমরা এ জিনিসটাই দেখে এসেছি। কিন্তু প্লেন যদি অবতরণ করে কোনো সমুদ্রে কিংবা নদীতে, তাহলে আমাদের অবাক হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। এ ধরনেরই একটা ঘটনা ঘটেছিলো আজ থেকে আট বছর আগে ২০০৯ সালের ১৫ জানুয়ারী। ফ্লাইটের নাম ‘ইউএস এয়ারওয়েস ১৫৪৯’। প্লেনের কল নেইম ছিলো ‘ক্যাকটাস ১৫৪৯’। প্লেনের পাইলট চেসলি সালেনবার্গার, ডাকনাম ‘সালি’ এবং কো-পাইলট জেফরি স্কিলস।
১৫ জানুয়ারী প্লেন রুটিনমাফিক লগার্ডিয়া থেকে শার্লটের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। সব রুটিন চেকআপ শেষ করে ক্যাপ্টেন বললেন প্লেন ওড়ার জন্য প্রস্তুত। ঘড়িতে তখন বিকাল তিনটা চব্বিশ মিনিট। যাত্রীরা তখন ঠিকঠাকভাবে বসার পর হয়তো চিন্তা করছিলেন প্লেন থেকে নেমে তারা কী কী করবেন! ভিকি বেন হার্ট সেই প্লেনের একজন যাত্রী এবং পেশায় ব্যবসায়ী। তিনি বাসায় যাচ্ছেন তার স্বামী ও বাচ্চাদের সাথে দেখা করতে। তার মেয়ে পুরো সপ্তাহ ধরে হোমওয়ার্ক তৈরি করেছে মাকে দেখানোর জন্য ।
শার্লট পৌঁছতে দু’ঘণ্টা সময় লাগে। যাত্রীরা হয়তো ঘড়ি ধরে ঠিক করে রেখেছিলেন কখন পৌঁছবেন। কিন্তু ওড়ার তিন মিনিটের মধ্যে প্লেনটি বিপদের সম্মুখীন হয়। প্লেন তখন ২,৮১৮ ফুট উপরে। কানাডিয়ান হাঁসের ঝাঁক প্লেনের উপর আছড়ে পরে। ক্যাপ্টেন সালির মতে হাঁসগুলো বিকট শব্দে প্লেনের উপর আছড়ে পড়ছিলো। একেকটা শব্দ যেন বজ্রপাতের মতো! হাঁসগুলো প্লেনের দু’পাশের ইঞ্জিনে ঢুকে যায়। ফলে ইঞ্জিন ব্লেডগুলো ভেঙ্গে আগুন ধরে যায়। প্লেনের যাত্রী এবং ক্রুদের মতে বিকট শব্দ হচ্ছিলো। তারা ইঞ্জিন থেকে আগুনের ফুলকি বের হতে দেখেন, আর পাওয়া যায় জ্বালানির গন্ধ। তারপর নিস্তব্ধতা।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সালি ও তার সহযোগী বুঝতে পারেন প্লেনের দুটি ইঞ্জিনের একটিও কাজ করছে না। যাত্রীদের মতে প্লেনে এক ধরণের নীরবতা বিরাজ করছিলো। এমনিতে প্লেনে ইঞ্জিনের যে আওয়াজ থাকে তার কিছুই ছিলো না। যাত্রীরা বুঝতে পারছিলেন যে কিছু গোলমাল হয়েছে। তবে এই গোলমাল কতটুকু তা কেউই আন্দাজ করতে পারে নি। ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আরও উনিশ সেকেন্ড প্লেনটি উপর দিকে উঠতে থাকে। প্লেন ৩,০৬০ ফুট উপরে ওঠার পর আর উপরে উঠার কোনো শক্তি নেই। এখন নিচে নেমে যাওয়ার পালা। ৬৬ টন ওজনের এই প্লেনটি তখন দ্রুততার সাথে নেমে যেতে থাকে। হাতে সময় কম! প্লেন চলছে ঘনবসতি পূর্ণ এলাকার মধ্য দিয়ে। ক্যাপ্টেন সালি বিকাল তিনটা ছাব্বিশ মিনিটে কন্ট্রোল রুমে মে ডে কল দিয়ে জানালেন,
“ক্যাকটাস ১৫৩৯ বলছি (উত্তেজনার ফলে ১৫৪৯ এর বদলে হয়তো ১৫৩৯ বলে ফেলেছিলেন)। পাখি আঘাত হেনেছে। দুটি ইঞ্জিনই বিকল হয়ে গিয়েছে। আমরা লগার্ডিয়াতে ফিরে যাচ্ছি।”
এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার পেট্রিক হার্টেন লগার্ডিয়ার সব প্লেনের উড্ডয়ন বন্ধের নির্দেশ দিলেন এবং ক্যাকটাস ১৫৪৯-কে রানওয়ে ১৩-তে অবতরণের জন্য বললেন। ক্যাপ্টেন সালি উত্তর দিলেন, “সম্ভব নয়।” সালি ভাবলেন, নিউজার্সির টেটারবরো এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করা হয়তো সম্ভব হবে। কন্ট্রোলাররা রানওয়ে ১ এ অবতরণের অনুমতি দিলেন। সালি উত্তর দিলেন,
“আমরা এটা করতে পারবো না। আমাদের হাডসনে অবতরণ করতে হবে।”
হাডসন আমেরিকার নিউ ইয়র্ক ও নিউ জার্সির ভেতর দিয়ে বহমান একটি নদী। ক্যাপ্টেন সালি হাডসনে ল্যান্ড করার জন্য মনস্থির করলেন। কিন্তু সামনে উপস্থিত হলো আরেক বাঁধা। ৬০০ ফুট উঁচু জর্জ ওয়াশিংটন ব্রিজ। সালি খুব দক্ষতার সাথে ব্রিজের মাত্র ৯০০ ফুট (প্রায়) উপর দিয়ে পার হলেন। যাত্রীদের মতে তারা জানালা দিয়ে দেখছিলেন প্লেন ধীরে ধীরে বিল্ডিঙের চেয়ে নিচুতে নেমে যাচ্ছে। যাত্রীদের অনেকেই মনে মনে ঠিক করে নিয়েছেন যে তারা মারা যেতে যাচ্ছেন। যেন শুধুই সময়ের অপেক্ষা। হঠাৎ ক্যাপ্টেনের গলার আওয়াজ শোনা গেলো। বললেন,
“Brace for impact”
এটা এমন এক সঙ্কেত যা কেউই শুনতে চায় না। প্লেনের ক্রুরাও প্রথমবারের মতো এ সঙ্কেত শুনলেন তাদের জীবনে। এর মানে হচ্ছে প্লেন ক্রাশ করতে যাচ্ছে, তার জন্য প্রস্তুত হন। Brace এমন একটি শারীরিক অবস্থান, যার ফলে বড় ধরণের কোনো দুর্ঘটনায় গুরুতর আঘাতপ্রাপ্তের সংখ্যা কমে যায়।
ঘোষণার নব্বই সেকেন্ড পরে বিকাল ৩টা ৩১ মিনিটে প্লেনের স্থান হয় এয়ারপোর্টের পরিবর্তে হাডসন নদীতে। প্লেনের পিছনে থাকা এক ক্রুয়ের মতে ল্যান্ডিংটা অনেক শক্ত ছিলো। প্রথমে প্লেনের লেজ পানিতে নামে। তারপর বাকি প্লেনটিকে পানিতে নামিয়ে দেন ক্যাপ্টেন সালি। ধীরে ধীরে প্লেন থেমে যায়। ক্যাপ্টেন সালি জেনেশুনেই ফেরি ও নৌকার কাছাকাছি জায়গায় প্লেন ল্যান্ড করান। সালি ককপিটের দরজা খুলে বের হন এবং সবাইকে প্লেন থেকে বের হয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। প্লেনের চারটি এক্সিট দরজা খুলে দেয়া হয় এবং রাফগুলো খুলে দেয়া হয়। বাম দিকের রাফটি কাজ করছিলো না। অনেকে ভয় পাচ্ছিলেন প্লেন হয়তো বিস্ফোরিত হবে। তাই তারা নদীতে ঝাঁপ দেয়। চারদিকের ফেরিকে উদ্ধারের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। কয়েক মিনিটের মধ্যে দুটি ফেরি প্লেনের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। ফেরির ধার প্লেন থেকে অনেক উপরে থাকায় মই ব্যবহার করা হয়। সালি প্রথমে বিমানের পাখায় থাকা যাত্রীদের উদ্ধারের জন্য বলেন। ধীরে ধীরে যাত্রীদের উদ্ধার করা হয়। সেদিন ১৪০ জন অগ্নিনির্বাপক কর্মী, পুলিশ, হেলিকপ্টার সহ সারা শহরের সম্পূর্ণ শক্তি একসাথে উদ্ধার কাজে লেগে পড়েন। পুরো শহর যেন তার সর্বোচ্চটাই দিয়েছিলো ঐ দিন। না হলে এমন অসম্ভব সম্ভব হলো কী করে।
ঐ প্লেনে একজন হুইল চেয়ারে ছিলেন। তিনি সহ বাকি ১৫৪ জন যাত্রীই বেঁচে গিয়েছিলো অলৌকিকভাবে। ক্যাপ্টেন সালি সবার শেষে প্লেন থেকে বের হন। পাঁচজন খুব গুরুতরভাবে আহত হন। একজনের চোখে প্লেনের জ্বালানী চলে যাওয়ায় তাকে পরবর্তীতে চশমা পড়তে হয়। কিন্তু যাত্রীদের মূল ভোগান্তি তখনও বাকি ছিলো। এই ঘটনার পরে অনেকেই পোস্ট ট্রমাটিক ডিসঅর্ডারে ভোগেন। ক্যাপ্টেন সালিকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো, আপনি ঐ ঘটনার পর কান্না বা চিৎকার করে দুঃখ ভোলার চেষ্টা করেছিলেন? সালি উত্তর ছিলো,
“না। এটা অনেক ধারাবাহিকভাবে আমার অভিজ্ঞতার সাথে যুক্ত হয়েছে। আমি তখনই স্বস্তি পেয়েছিলাম যখন আমি হাসপাতালে থাকাকালীন সময়ে পুরষ্কার পেলাম। তখন এটা নিশ্চিত হলাম যে প্লেনের সবাই রক্ষা পেয়েছেন মৃত্যু থেকে।”
তাকে এক সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, প্লেনের দুটি ইঞ্জিনই যখন বিকল হয়ে যায়, তখন প্লেনের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকে কিনা! সালি উত্তরে বলেন, “জ্বি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আমরা প্লেনের সম্মুখমুখী বেগকে কাজে লাগিয়েছিলাম এক্ষেত্রে।”
যখন সব কাজ শেষ হলো, তখন ন্যাশনাল ট্রান্সপোর্ট সেফটি বোর্ড এই ঘটনার পর্যালোচনা শুরু করলো। তারা কম্পিউটার সিমুলেশনের মাধ্যমে বুঝতে চাইলেন প্লেনটি লগার্ডিয়া কিংবা টেটারবরো এয়ারপোর্টে অবতরণ করতে পারতো কি না! সিমুলেশনে দেখা যায় ১৩ বারের মধ্যে ৭ বার লগার্ডিয়াতে অবতরণ সম্ভব হয়। আর দুই বারের মধ্যে একবার টেটারবরো এয়ারপোর্টে অবতরণ সম্ভব হয়। কিন্তু সিমুলেশনগুলোতে পাখি আঘাত হানার সাথে সাথেই তা এয়ারপোর্টের জন্য রওনা হয়। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে তা সম্ভব নয়। কারণ পরিস্থিতি বুঝতে ও সিদ্ধান্ত নিতে সময় লাগবে যা সিমুলেশনে বিবেচনায় আনা হয় নি। ফলে এই সিমুলেশনগুলোকে অবাস্তব বলা হয়। সবশেষে বোর্ড এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, সালির হাডসনের অবতরণের সিদ্ধান্তটি সঠিক ছিলো। বোর্ড সদস্যদের মতে এই জরুরি অবতরণ ছিলো ‘বিমান চালনার ইতিহাসে সবচেয়ে সফল অবতরণ’।
Guild of Air Pilots and Air Navigators প্লেনের সব ক্রুদের মাস্টার মেডেল প্রদান করেন। এ ঘটনার পরই ক্যাপ্টেন সালিসহ প্লেনের বাকি ক্রু সবাই খুব বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। বিশেষ করে ক্যাপ্টেন সালি। নানা টিভি চ্যানেলে তার ডাক পড়তে থাকে। এই ঘটনাটি নিয়ে ক্লিন্ট ইস্টউড ‘Sully’ নামে একটি মুভিও বানান। মুভিতে সালি চরিত্রে অভিনয় করেন বিখ্যাত অভিনেতা টম হ্যাঙ্কস।
এ ঘটনাটি ইতিহাসের পাতায় ‘মিরাকল অন হাডসন’ নামে স্থায়ীভাবে নিজের জায়গা করে নিয়েছে।
ফিচার ইমেজ- KEVIN H