সম্রাট আকবর পাঠান সুলতানদের পরাস্ত করবার পরেও বাংলাতে মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়নি। গোটা প্রদেশ জুড়ে রাজত্ব করতেন ভূঁইয়া নামে পরিচিত সামন্তগণ। এরা জবরদস্ত শক্তিশালী ছিলেন এবং অন্তত ২০-২৫ বছর ধরে মুঘল আধিপত্যের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়েছিলেন। অবশ্য তাদের সেই প্রচেষ্টা মূলত নিজস্ব আধিপত্য টিকিয়ে রাখবার উদ্দেশ্যেই, আর সবাই একতাবদ্ধ হয়ে লড়তে পারেননি স্বার্থ সংঘাতের কারণে। তবে যা-ই হোক, বাংলায় বারো ভূঁইয়ার প্রতিরোধ ইতিহাসে দারুণ গুরুত্বপূর্ণ। আজকের আলাপ এক অন্যতম ভূঁইয়া প্রতাপাদিত্যকে নিয়ে।
বারো ভূঁইয়া কারা?
প্রাচীন ভারতে রাজার অধীনস্থ এলাকাকে ১২টি মণ্ডলে ভাগ করে শাসন করবার বিধান ছিল। পাঠানরা বাংলা দখল করবার পরে এ প্রথা বজায় রাখা হয়। পাঠান সেনানায়ক বা স্থানীয় হিন্দুদের কেউ কেউ বিরাট অঞ্চল জুড়ে প্রায় স্বাধীনভাবেই রাজত্ব করতেন, যুদ্ধবিগ্রহ বাধলে পাঠান সুলতানকে সৈন্য দিয়ে সাহায্যও করতেন। এই ভূঁইয়া নামক সামন্ত জমিদারদের সমর্থন ছাড়া বাংলার সিংহাসন হাতে রাখা ছিল অসম্ভব। ভূঁইয়াদের অঞ্চলগুলো আবার অসংখ্য ছোট জমিদারিতে ভাগ করা থাকত।
মুঘল সম্রাট আকবর ও পরবর্তী সময়ে জাহাঙ্গীর বারো ভূঁইয়াদের বিরুদ্ধে বহু দিন যুদ্ধ চালিয়েছিলেন। ভূঁইয়াদের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী নেতা ঈশা খান নিজে ছিলেন মুসলিম রাজপুত। বাঙালিদের মধ্যে যশোর অঞ্চলের প্রতাপাদিত্য, নোয়াখালির লক্ষ্মণমাণিক্য, বিক্রমপুরের চাঁদ রায় ও তার পুত্র কেদার রায়, বরিশালের রামচন্দ্র প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। ভুঁইয়াদের নিজস্ব নৌ ও গোলন্দাজ বাহিনী ছিল।
মুঘল সেনাদলের বৈশিষ্ট্য ছিল শক্তিশালী কামান বহর আর ভারি অস্ত্রসজ্জিত ঘোড়সওয়ার বাহিনী। ভারতের সমতল প্রান্তরে মুঘল কামান অপ্রতিদ্বন্দ্বী হলেও নদ-নদী আর জঙ্গলপূর্ণ বঙ্গীয় নিম্নভূমির জন্য এ সেনাদল উপযুক্ত ছিল না, ফলে ভূঁইয়া সামন্তদের দমন করতে বহু বছর লেগে যায়।
যশোহর রাজ্য
বাংলার শেষ স্বাধীন সুলতান দাউদ খান কররানী ঊড়িষ্যায় পালাবার সময় তার ধন-সম্পদের একটা বড় অংশ গচ্ছিত রাখেন হরিদাস (বিক্রমাদিত্য) এবং বসন্ত রায় (জানকীবল্লভ)-এর কাছে। দাউদের মৃত্যুর পর এই দুজন যশোর অঞ্চলে বিস্তৃত জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। বসন্ত রায় মোঘল নেতা টোডরমলকে বাংলার রাজস্ব নির্ণয়ে বিস্তর সাহায্য করায় টোডরমল খুশি হয়ে এই দুজনকে যশোর অঞ্চল দিয়ে দেন। কথিত আছে, গৌড়ের সম্পদ, অর্থাৎ যশ হরণ করে এই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা হওয়ায় নামকরণ করা হয় যশোহর। এর আগে (এবং বর্তমানেও) এ অঞ্চল যশোর নামে পরিচিত ছিল। বর্তমান সাতক্ষীরার ঈশ্বরীপুরে ছিল এই রাজ্যের রাজধানী।
প্রতাপাদিত্যের উত্থান
১৫৬০ সালে হরিদাসের পুত্র প্রতাপাদিত্যের জন্ম। তিনি ছিলেন অহংকারী ও উদ্ধত স্বভাবের; হরিদাস জমিদারির ১০ শতাংশ প্রতাপাদিত্যকে দেন, বাকি ৬ অংশ বসন্ত রায়ের অধীনে থাকে।
ঊড়িষ্যার পাঠানরা বিদ্রোহ করলে রাজা টোডরমল তাদের দমন করতে আসেন। প্রতাপাদিত্য তার সাথে যোগ দিয়ে প্রভূত বীরত্ব প্রদর্শন করেন। যৌবনে তিনি আগ্রা ও রাজস্থানে কিছুদিন ছিলেন। এখন ঊড়িষ্যায় বীরত্ব দেখিয়ে এবং টোডরমলের প্রশংসা পেয়ে তিনি আরো উগ্রমূর্তি ধারণ করলেন। হরিদাসের মৃত্যুর পর প্রতাপ তার খুড়ো বসন্ত রায় ও খুড়তুতো ভাই গোবিন্দকে হত্যা করে গোটা যশোহর রাজ্যের মালিক বনে যান। সুন্দরবন পরিষ্কার করে ধুমঘাটে গড়ে তোলেন শক্তিশালী দুর্গ আর রাজধানী।
সেকালে নিম্নবঙ্গ অঞ্চলে পর্তুগিজ আর আরাকানের মগ দস্যুরা বড় উৎপাত করত। প্রতাপ মগদের সাথে গোপনে মৈত্রী স্থাপন করেন ও পর্তুগিজদের অন্যতম নেতা কার্ভালহোকে বন্দী ও হত্যা করেন। উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা, নদীয়া, কুষ্টিয়া, বরিশালের কিছু অংশ আর দক্ষিণে একদম সমুদ্র পর্যন্ত অঞ্চল ছিল তার অধীনে। পর্তুগিজ আর পাঠান সৈন্যদের সাহায্যে শক্তিশালী নৌ ও গোলন্দাজ বাহিনী গড়া হলো, বহু পদাতিক আর হস্তীবাহিনীও ছিল প্রতাপের সেনাদলে। বাগদী আর কুকি জাতির বহু সৈন্য প্রতাপের সেনাদলে কাজ নিয়েছিল, যোদ্ধা হিসেবে এদের সুনাম ছিল। মাতলা, শিবসা, বেদকাশী, কলকাতার আশেপাশের অঞ্চলসহ অনেকগুলো স্থানে দুর্গ ও যুদ্ধ নৌকার কারখানা গড়ে তোলা হলো।
মানসিংহের সাথে যুদ্ধ
বসন্ত রায়ের পুত্র কচু রায় প্রতাপের বাড়বাড়ন্ত, বসন্ত রায়কে হত্যা প্রভৃতি অভিযোগ নিয়ে দরবারে নালিশ ঠুকলে রাজা মানসিংহ সৈন্যসামন্ত নিয়ে এগিয়ে এলেন। প্রতাপ ততদিনে নিজেকে স্বাধীন ঘোষণা করেছেন। মানসিংহের অধীনে পরাক্রান্ত মোঘল সেনাদল এগিয়ে আসছে শুনে বহু সেনাপতি ও জমিদার প্রতাপকে ছেড়ে মুঘল দলে চলে যান। মুকুন্দপুর নামক স্থানে গভীর পরিখা আর মাটির দুর্গ গড়ে প্রতাপ অবস্থান নিয়েছিলেন। ১৬০৩ সালে পরপর তিনটি যুদ্ধে প্রতাপকে পরাস্ত করেন মানসিংহ। প্রতাপ মোঘল অধীনতা স্বীকার করলে আকবরের রীতি অনুযায়ী তাকে নিজের রাজ্য ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
ইসলাম খানের সাথে সংঘাত
মানসিংহ বারো ভূঁইয়াদের অন্যতম ইশা খান, প্রতাপাদিত্য প্রভৃতির সাথে শান্তি স্থাপন করে ফিরে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই বাংলা আবার বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। দিল্লির তখতে তখন জাহাঙ্গীর। তিনি ইসলাম খানকে শক্তিশালী সেনাদল দিয়ে বাংলায় পাঠান। ইসলাম খান ছিলেন বদমেজাজী আর কঠোর প্রকৃতির মানুষ। ঈশা খানের পুত্র মুসা খান, মাসুম খান কাবুলী, ওসমান প্রভৃতি ভূঁইয়া ও আফগান সেনানায়কদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করবার আগে তিনি প্রতাপের নৌবহরের সাহায্য চান। প্রতাপ কিন্তু চুপ করে রইলেন। অগত্যা ইসলাম খান একাই বারো ভূঁইয়াদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে তাদের পরাস্ত করেন। ঢাকায় সুদৃঢ় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে এবার তিনি যশোহরকে শায়েস্তা করবার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। প্রতাপ বিপদ বুঝে শান্তি কামনা করলেও ইসলাম খান সাড়া দিলেন না।
সালকার যুদ্ধ
সাল ১৬১১। যমুনা আর ইছামতীর সংযোগস্থলে শক্তিশালী সালকা দুর্গ গড়ে প্রতাপের ছেলে উদয়াদিত্য অবস্থান নিলেন। তার সাথে ছিল খাজা কামাল আর দাউদের সেনাপতি কতলু খানের ছেলে জামাল খান। দুর্গের দু’পাশে নদী, বাকি দু’পাশে জলপূর্ণ খাল। যশোহরের নৌবহর বেশ শক্তিশালী ছিল, তাতে ছিল তিনশ যুদ্ধনৌকা। কামান ও সেনাবহরও ছিল শক্তিশালী। ঘুরাব নামক একাধিক কামান বসানো যুদ্ধনৌকা ছিল যশোহরের মূল শক্তি। মুঘলদের নৌবহর অপেক্ষাকৃত ছোট হলেও কামান-বন্দুকের বিবেচনায় তারাও অপ্রতিরোধ্য। ইছামতী বেয়ে মোঘল নৌবাহিনী অগ্রসর হলো, দুই তীর ধরে চলল মুঘল সেনাদল।
উদয়াদিত্য ও খাজা কামাল আচমকা আক্রমণ করে মুঘলদের হটিয়ে দেয়। কিন্তু তীরবর্তী সেনাদের তুমুল আক্রমণে এ সুবিধা বেশিক্ষণ থাকেনি। খাজা কামাল নিহত হলে যশোহর নৌবহর ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। উদয়াদিত্য কোনোক্রমে ৪২টি নৌকা নিয়ে পালান। জামাল খান কিছুক্ষণ প্রতিরোধ করে দুর্গ ছেড়ে পিছু হটেন।
খাগড়াঘাটের যুদ্ধ
প্রতাপের রাজধানী এবার বিপদাপন্ন, নৌবহরের অধিকাংশই উধাও। শেষ একটা চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য রাজা প্রতাপ প্রস্তুত হলেন। নৌবহরের অবশিষ্টাংশ আর ধুমঘাট দুর্গের কামানশ্রেণীর তীব্র আক্রমণে মোঘল আক্রমণ বারবার প্রতিহত হতে থাকে। তখন মোঘল গোলন্দাজ সেনাপতি মির্জা নাথান হাতি আর অল্প কিছু সৈন্য নিয়ে অপরপাশ থেকে দুর্গে আক্রমণ চালান। দুর্গের কামানশ্রেণী মির্জার দিকে ঘুরিয়ে নেওয়া হলে যশোহর নৌবহর অরক্ষিত হয়ে পড়ে। সংখ্যা আর শক্তিতে শ্রেয়তর মুঘল বাহিনী এই অবসরে প্রতাপের নৌবহরকে পরাস্ত করে দুর্গ দখল করে নেয়। প্রতাপ আত্মসমর্পণ করেন। তাকে বন্দী করে ঢাকায় নেওয়া হয়, সেখান থেকে আগ্রাতে পাঠাবার পথে বেনারসে প্রতাপাদিত্যের মৃত্যু হয়। বাংলার দুর্ধর্ষ ভূঁইয়াদের অন্যতমের এই হলো পরিণতি। তার ছেলে উদয়াদিত্য কিছু দিন মোঘলদের লুটপাট দেখে অল্প সৈন্যসামন্ত নিয়ে বিদ্রোহ করে নিহত হন। জামাল খান মুঘল পক্ষে যোগ দেন।
প্রতাপের রাজ্যের অবশেষ
নিম্নবঙ্গের লোনা আবহাওয়া, ঘন ঘন বন্যা, সুন্দরবনের আগ্রাসন প্রভৃতির ফলে প্রতাপের দুর্গ বা রাজধানীর খুব বেশি নিদর্শন টিকে নেই। সেকালে নিম্নবঙ্গে দুর্গ বানানো হতো মূলত মাটির, কামানের গোলার মুখে এই মাটির দুর্গ বা গড় বেশ ভালো প্রতিরোধ দিলেও সময়ের সাথে অদৃশ্য হয়ে যায়। তবে গড় মুকুন্দপুরের পরিখা, সুন্দরবন সংলগ্ন মন্দির আর ভবনের ধ্বংসাবশেষ, ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কামান প্রভৃতি বহু বছর পরেও পাওয়া গিয়েছে। প্রতাপের রাজ্য পরে নলডাঙ্গা, চাঁচড়া, কৃষ্ণনগরসহ নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। প্রতাপের স্ত্রী খাগড়াঘাটের যুদ্ধের পর পানিতে ডুবে আত্মহত্যা করেছিলেন। সুন্দরবন থেকে প্রতাপ যশোরেশ্বরী কালী মাতার বিগ্রহ এনে ঈশ্বরীপুরে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মন্দির ও বিগ্রহ আজও টিকে আছে। অন্নদামঙ্গল কাব্যসহ নানা লোকগীতিকা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বৌ ঠাকুরাণীর হাট’ উপন্যাসে প্রতাপ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্ররূপে এসেছেন।
[বারো ভূঁইয়া সম্বন্ধে বিস্তারিত জানতে পড়তে পারেন এই বইটি। অনলাইনে কিনতে ভিজিট করুন রকমারিতে।]