১৯৯৬ সাল থেকে ২০০২ সাল, পুরো বিশ্বকে নাড়িয়ে দেওয়া সেই সময়কার অন্যতম একটি সংঘাত ছিল আফ্রিকার মহাযুদ্ধ (The Great African War) যার সূচনা ঘটে প্রথম কঙ্গো যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। যে লক্ষ্য পূরণের উদ্দেশ্যে যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল সেটি শেষ পর্যন্ত অপূর্ণ থেকে যায়। কিন্তু আন্তর্জাতিক সৈন্যসামন্তের অংশগ্রহণে সার্বভৌমত্ব লংঘনের পাশাপাশি বয়ে গিয়েছিল মৃত্যুর মিছিল।
ডেমোক্রাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর পূর্ব পাশে ছিল সংঘাতটির মূল পটভূমি। বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণ ছিল এই সংঘাতে। কেউ করেছিল দেশের সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য, আবার কেউ করেছিল বিপুল সম্পদের তাড়নায়। কঙ্গোর মানুষদের জন্য যুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতিও কম পীড়াদায়ক ছিল না। প্রায় দুই দশক আগে ঘটে যাওয়া একটি যুদ্ধের পরিণতি যে কতটা যন্ত্রণা বয়ে আনবে সেটা কঙ্গোর পূর্ব-পীড়িত জনগণ হয়তো আন্দাজও করতে পারেনি।
আজকের কঙ্গো পূর্বে বেলিজিয়ামের ঔপনিবেশিক শাসনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। অনেক অত্যাচার ভোগ করার পর ১৯৬০ সালে তারা স্বাধীনতা অর্জন করে। তৎকালীন জনগণ ভেবেছিল হয়তো এর ফলে তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে। কিন্তু তখন সূচনা হয় একটি অতি অবহেলিত শাসনামলের। মবুতু সেসে সেকো (Mobutu Sese Seko) রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর দেশের নাম পালটে রাখলেন জাইর। এই দীর্ঘদিনের একনায়ক সবসময় চিতাবাঘের চামড়া দিয়ে বানানো টুপি পরে থাকতেন এবং বিপুল অর্থ আত্মসাতে মগ্ন ছিলেন। অন্যদিকে জনগণ দেখছিল দেশ ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
১৯৭০ থেকে ১৯৮০র দশকের মধ্যে আন্তঃশহর রাস্তাগুলো অযত্নে-অবহেলায় গাড়ি চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে। একই সাথে টেলিফোন যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে এবং ডাকযোগাযোগ ব্যবস্থার কিছু অবশিষ্ট ছিল না বললেই চলে। বিভিন্ন শহরে প্রশাসনিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। এমনকি সরকারি বিচার ব্যবস্থাও কার্যকর রইলো না। তার পরিবর্তে গ্রামীণ পঞ্চায়েতের মতো প্রথাগত অকার্যকর বিচার ব্যবস্থা চালু হলো। হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত ঔষধ ও কর্মকর্তা না থাকায় মানুষ সেবার অভাবে মারা যেতে থাকলো।
পূর্ব দিকের শহর গোমা এবং দক্ষিণ দিকের শহর লুবুমবাশি চলে গিয়েছিল সীমান্তবর্তী পাশের দেশের অর্থনৈতিক দখলে। হোটেলগুলোতে যেখানে আগে রমরমা ব্যবসা চলতো, সেখানে সেই সময় যেন পোকামাকড়ের বসবাস ছিল। অনেকে ভেবেছিল মবুতুর শাসনামল উন্নত ভবিষ্যৎ বয়ে আনবে কারণ বিদেশ থেকে মেধাবী প্রবাসীরা দেশে ফিরে আসছিল এই উন্নয়নে অংশগ্রহণ করার জন্য। কিন্তু তাদেরকেও হতাশ হতে হলো। ১৯৯০ এর দশকে কঙ্গোর মানুষ আর কোনো ভরসা না পেয়ে মবুতুর পতন আশা করতে থাকলো। তারা ভেবেছিল মবুতুর পতন ঘটলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। অবশেষে প্রথম কঙ্গো যুদ্ধের মধ্য দিয়ে মবুতুর পতন ঘটে।
আফ্রিকা মহাদেশে ঔপনিবেশিক শাসনের সমাপ্তির পর যে সীমারেখা তৈরি করা হয়েছিল তা কোনোরকম জাতিগত ও সংস্কৃতিগত বিষয় মাথায় না রেখেই করা হয়েছিল। তাই উপনিবেশিক শাসন শেষ হওয়ার পর উলটো সমস্যা আরো বেড়েই চলছিল। তারা এমনভাবে দেশগুলো ভাগ করেছিল যে মানুষের মধ্যে জাতিগত ও অন্যান্য দিক দিয়ে সংঘাত লেগেই থাকতো। যেমনটি আমরা আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে দেখেছি। ভারত, পশ্চিম পাকিস্তান ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষেত্রে যেমনটি ঘটেছিল সেরকমই ঘটেছে আফ্রিকায়।
রুয়ান্ডার গণহত্যা সম্পর্কে হয়তো অনেকেই জানি যেখানে সংখ্যাগুরু হুতু জনগণ নির্মমভাবে সংখ্যালঘু তুতসি জনগণের উপর গণহত্যা চালায়। এতে প্রচুর তুতসি এবং পরবর্তীতে হুতু জনগণ প্রাণ বাঁচিয়ে রুয়ান্ডা ছেড়ে আশেপাশের দেশগুলোতে চলে যেতে থাকে। বিশেষ করে যখন আরপিএফ অর্থাৎ তুতসিদের সামরিক বাহিনী রুয়ান্ডার হুতু সরকারকে দমন করে ফেলে তখন বেশিরভাগ হুতু জনগণ শরণার্থী হয়ে কঙ্গোতে আশ্রয় নেয়। সেখানে তারা ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করার চেষ্টা করছিল। তাদের মধ্যে গণহত্যায় অংশগ্রহণ করা প্রচুর চরমপন্থী সামরিক বাহিনীর লোকও ছিল। এই পটভূমিটি বিশেষভাবে প্রথম কঙ্গো যুদ্ধ সূচনায় ভূমিকা রেখেছে।
লরেন্ট কাবিলা ছিলেন কঙ্গোর স্বাধীনতার জন্য তৈরি গণতান্ত্রিক সৈন্যবাহিনী জোটের প্রধান নেতা। কাবিলা ও তার সমর্থক, কয়েকটি দেশের সেনাবাহিনী ও আরো কিছু দল মিলে এই জোট গড়ে তোলা হয়। প্রত্যেকটি পক্ষ তাদের নিজেদের স্বার্থে এই জোটে যোগ দিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল উগান্ডা ও রুয়ান্ডা।
রুয়ান্ডার পরিস্থিতি ততদিনে কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পর তুতসিরা পুনরায় নিজ দেশে হুতুদের সড়িয়ে আধিপত্য বিস্তার এবং গণহত্যার বিচারের জন্য লড়াই শুরু করে। রুয়ান্ডা এই জোটে অংশগ্রহণ করার আগ্রহ প্রকাশ করার পেছনে একটা কারণ হচ্ছে, কঙ্গো সীমান্তে বেশ কিছু গেরিলা বাহিনী (যাদের মধ্যে হুতু চরমপন্থীরাও ছিল) বেশ উৎপাত শুরু করেছিল। যাদের অগ্রগতি ধীরে ধীরে রুয়ান্ডা, বিশেষ করে তুতসিদের জন্য হুমকিস্বরূপ হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছিল। এর কারণ তাদের মধ্যে পূর্বের হুতু সরকারের ও সেনাবাহিনীর চরমপন্থীরা মবুতু সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে উঠছিল। তাদেরকে দমানোর জন্য রুয়ান্ডা কাবিলাকে সাহায্য করার মাধ্যমে কঙ্গোর ভেতরে প্রবেশ করে গেরিলা বাহিনীগুলোকে পিছু হটতে বাধ্য করে। যার সূচনা ঘটে ১৯৯৬ সালের অক্টোবরে দক্ষিণ কিভুতে সংঘটিত বানিয়ামুলেঙ্গে বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে।
অন্যদিকে উগান্ডারও প্রায় একই রকম উদ্দেশ্য ছিল। একটি সুদান সমর্থিত দল সীমান্তে সহিংসতা ও অপরহণের মতো কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছিল এবং উগান্ডা তাদেরকে দমানোর চেষ্টা করছিল। তাছাড়া কাবিলার নিজের সমর্থকদের মধ্যে কঙ্গোলিজ তুতসিরাও ছিল যারা একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠন করে পার্শ্ববর্তী তুতসি শাসিত রুয়ান্ডাকে অভয় দিতে চাচ্ছিল। এই সম্পূর্ণ জোটটি কঙ্গোর তৎকালীন একনায়ক মবুতুর সরকারের পতনের জন্য গড়ে উঠে যেটিকে এএফডিএল (Alliance of Democratic Forces for the Liberation of Congo-Zaire, or AFDL) হিসেবে অভিহিত করা হয়। এই জোটের বিরুদ্ধে মবুতুর পক্ষে লড়াই করার জন্য মাঠে ছিল কিছু বিদ্রোহী দল, এংগোলার একটি বাহিনী (ইউনিটা), বুরুন্দির একটি বাহিনী (এফডিডি) এবং কিছু ভাড়াটে বিদেশি সৈনিক।
১৯৯৬ সালের ডিসেম্বর নাগাদ কঙ্গোর পূর্বাংশ এই জোট দখলে নিয়ে নেয়। অতঃপর ১৯৯৭ সালের মে মাসে তারা রাজধানী কিনশাসার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে এবং অবশেষে ১৬ মে মবুতু সেসে সেকোর পতন ঘটে। এরপর দেশটির নাম পালটে জাইর থেকে পুনরায় পূর্বের নাম ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব দ্যা কঙ্গো রাখা হয় এবং সেপ্টেম্বরের দিকে লরেন্ট কাবিলা কঙ্গোর রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেশ পরিচালনা করা শুরু করে।
এরই দ্বারা যুদ্ধ শুরু হওয়ার আট মাস পর প্রথম কঙ্গো যুদ্ধের অবসান ঘটে। এই যুদ্ধের হতাহতের সঠিক সংখ্যা নিয়ে অনেক সংশয় ও জল্পনা-কল্পনা রয়েছে। তবে কেউ কেউ ধারণা করছে সংখ্যাটি কয়েক লাখ হতে পারে।
ঠিক তার পরপরই দ্বিতীয় কঙ্গো যুদ্ধের পটভূমি তৈরি হতে থাকে এবং আবারো দেশটি আরেকটি সংঘাতের কবলে পড়ে যায়।