টানা পাঁচ মাস, এক সপ্তাহ, এবং তিন দিন ধরে চলা ব্যাটল অব স্তালিনগ্রাদ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী লড়াই। ১৯৪২ সালের আগস্ট মাস থেকে শুরু করে ১৯৪৩ এর ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত স্থায়ী ছিল এই যুদ্ধ। লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল প্রায় পাঁচ মাস ধরে চলা এই যুদ্ধে। যুদ্ধাহত, বন্দী এবং নিঁখোজ মানুষের সংখ্যা ছিল অগণিত। সবকিছু মিলিয়ে ‘ব্যাটল অব স্তালিনগ্রাদ’ পরিচিতি পায় আধুনিক ইতিহাসের অন্যতম ধ্বংসাত্মক এক যুদ্ধ হিসেবে।
ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, স্তালিনগ্রাদের ওই যুদ্ধে প্রায় পাঁচ লক্ষের মতো সোভিয়েত সৈন্য মৃত্যুবরণ করেন। আরও অনেককেই মেনে নিতে হয় পঙ্গুত্ব এবং যুদ্ধবন্দী হবার অভিশাপ। বিপুল পরিমাণ বেসামরিক জনগণকে হতে হয় ঘরছাড়া। স্তালিনগ্রাদের সেই ভয়াবহ যুদ্ধে অক্ষশক্তির ক্ষয়-ক্ষতিও কম হয়নি। তাদের পক্ষের প্রায় তিন লক্ষের মতো সৈন্য প্রাণ হারায়। সোভিয়েতদের হাতে যুদ্ধবন্দী হয় বিপুল পরিমাণ জার্মান।
স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের যে পরিমাণ সৈন্য হতাহত হয়, তা সমগ্র যুদ্ধে মিত্রশক্তির সামগ্রিক হতাহতের সংখ্যার ৩ শতাংশ। সমগ্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যে পরিমাণ আমেরিকান সৈন্য মারা যায়, এক ‘ব্যাটল অব স্তালিনগ্রাদেই’ তার চেয়ে বেশি সোভিয়েত সৈন্য মৃত্যুবরণ করে।
পাঁচ মাসব্যাপী স্থায়ী স্তালিনগ্রাদের সেই যুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল এবং জার্মানির পতনের পথ সুগম করেছিল। যুদ্ধ চলাকালে তোলা কিছু ছবি আজও আমাদের সেই যুদ্ধের ভয়াবহতা মনে করিয়ে দেয়। ‘ব্যাটল অব স্তালিনগ্রাদে’ তোলা এরকমই কিছু ছবি নিয়ে সাজানো হয়েছে আজকের এই লেখা।
স্তালিনগ্রাদ শহরের দিকে অগ্রসরমান একটি জার্মান ট্যাঙ্ক।
যুদ্ধ চলাকালে স্তালিনগ্রাদের একটি ভবন গোলার আঘাতে দাউ দাউ করে জ্বলছে। জীবন বাঁচাতে বিক্ষিপ্তভাবে ছুটোছুটি করছে মানুষ। কালো ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে শহরের আকাশ।
বোমা বর্ষণের ফলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে একটি সোভিয়েত রেললাইন। পুনরায় সেটিকে চলাচল উপযোগী করে তুলতে সেখান থেকে জঞ্জাল সরানোর কাজে ব্যস্ত রয়েছেন কয়েকজন নারী কর্মী।
স্তালিনগ্রাদে যুদ্ধের ভয়াবহতা এতটাই তীব্র ছিল যে, বেশিরভাগ সময়ই সৈন্যরা তাদের মৃত সহযোদ্ধাদের লাশ দাফন করার সময় পর্যন্ত পাননি। রাশিয়ার তীব্র শীতে অনেক লাশ ঢাকা পড়ে গিয়েছিল বরফের চাদরে। এরকমই কয়েকজন নাম না জানা সৈনিকের বরফে ঢাকা পড়া লাশ দেখা যাচ্ছে ওপরের ছবিতে।
একটি ধ্ববংসপ্রাপ্ত যুদ্ধবিমান পড়ে আছে স্তালিনগ্রাদের বুকে। পেছনে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ধ্বংসপ্রাপ্ত বিরানভূমি।
স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধে ঠিক কতজনের মৃত্যু হয়েছে তা সঠিক ভাবে জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হয়, দুই পক্ষ মিলিয়ে এই সংখ্যা কয়েক মিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে। দুই পক্ষেরই যুদ্ধ বন্দী হওয়া সৈন্যের সংখ্যাও বিপুল। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রায় দশ হাজারের বেশি সৈন্যকে বন্দী করে জার্মানিতে নিয়ে যাওয়া হয়।
যুদ্ধের রূঢ় বাস্তবতায় নিঃঙ্গতাই যেন চিরসঙ্গী। নিজের প্রিয় বাদ্যযন্ত্র ‘চেলো (Cello)’ হাতে একজন নিঃসঙ্গ মিউজিশিয়ান হেঁটে যাচ্ছেন অজানা গন্তব্যে। পেছনে পড়ে রয়েছে একদা সদা ব্যস্ত স্তালিনগ্রাদের শূন্য রাস্তা।
জার্মান যুদ্ধবিমানগুলোর মূহুর্মূহু বোমাবর্ষণে স্তালিনগ্রাদ শহর পরিণত হয়েছিল ধ্বংসস্তুপে।
যুদ্ধে নিজেদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও শেষ পর্যন্ত লড়ে যায় সোভিয়েত সৈন্যরা। লক্ষ লক্ষ সহযোদ্ধা মাটিতে লুটিয়ে পড়লেও যুদ্ধের ময়দান থেকে পিছপা হয়নি সোভিয়েত ইউনিয়ন। ছবিতে এমনই একজন অদম্য সোভিয়েত সৈন্যকে দেখা যাচ্ছে, যিনি যুদ্ধের ধ্বংসস্তুপের মাঝেও উঁচিয়ে ধরেছেন সোভিয়েত পতাকা।
স্তালিনগ্রাদ শহরে ফেলা অসংখ্য বোমার মধ্যে কিছু কিছু অবিস্ফোরিত থেকে গেছে। এরকমই একটি অবিস্ফোরিত বিশালাকৃতির জার্মান গোলা পরীক্ষা করে দেখছেন একজন সোভিয়েত সৈন্য।
ব্যাটল অব স্তালিনগ্রাদে বিপুল পরিমাণ ট্যাঙ্কের ব্যবহার ছিল লক্ষণীয়। জার্মান বাহিনী এ যুদ্ধে ব্যবহার করেছিল ‘Mark 3H‘, ‘Mark 4H’, ‘Stug 3’ ইত্যাদি মডেলের ট্যাঙ্ক। অন্যদিকে সোভিয়েত সেনাবাহিনীর মধ্যে ‘T-34’, ‘KV-1’ ইত্যাদি মডেলের ট্যাঙ্কের ব্যবহার ছিল উল্লেখযোগ্য।
যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিমূহুর্তে জীবণের ঝুঁকি নিয়ে লড়ে গিয়েছিলেন দুই পক্ষের সৈনিকেরা। সবসময়ই ছিল বোমা হামলার আশঙ্কা।
প্রিয় শহরের ধ্বংসস্তুপের ওপর দাঁড়িয়ে শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়াই করেছে প্রতিটি সোভিয়েত সৈন্য। ছবিতে শহর রক্ষার কাজে নিয়োজিত এমনই দুজন সৈন্যকে দেখা যাচ্ছে।
ইতিহাসের অন্যতম রক্তক্ষয়ী এই যুদ্ধ যেমন কেড়ে নিয়েছিল অসংখ্য মানুষের প্রাণ, তেমনি চিরস্থায়ী ক্ষতের চিহ্ন রেখে গিয়েছিল বিপুলসংখ্যক মানুষের শরীরে। ছবিতে একজন সোভিয়েত সৈন্য যুদ্ধের ময়দানে তার আহত সহযোদ্ধার শুশ্রুষায় ব্যস্ত। অন্যরা তখনও যুদ্ধ করেই যাচ্ছিল শত্রুপক্ষের সাথে।
যুদ্ধের নির্মম বাস্তবতায় যখন কোনো সৈনিকের মৃত্যু এসে উপস্থিত হয়, তখনো থেমে থাকে না যুদ্ধ। এই ছবিটি যেন তারই বাস্তব উদাহরণ। স্তালিনগ্রাদের বুকে পড়ে রয়েছে নাম না জানা এক সৈনিকের মৃতদেহ। পেছনে আরও প্রাণ হরণের নেশায় ছুটে চলেছে ট্যাঙ্ক বহর।
যুদ্ধের ময়দানে সৈনিকের পাশাপাশি সংবাদ বহনকারীদের গুরুত্বও অনেক। এমনই একজন সোভিয়েত যুদ্ধ সংবাদদাতা ফ্রন্টলাইনে পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু ভয়াবহ বোমা বর্ষণের কারণে তার যাত্রা থেমে আছে আপাতত।
তীব্র শীত জেঁকে বসেছে। তার ওপর চলছে ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহতম যুদ্ধ। এসবের মধ্যেই একজন সোভিয়েত সৈনিক নিজের নোটবুকে টুকে নিচ্ছেন যুদ্ধের প্রয়োজনীয় তথ্য।
রাশিয়ার তীব্র ঠান্ডায় টিকে থাকাই দায়! অথচ তার মধ্যেই যুদ্ধ করতে হয়েছিল সৈনিকদের। কিন্তু তারাও তো মানুষ। তাই একটুখানি উষ্ণতার আশায় আগুন জ্বালিয়ে তার চারপাশে ভিড় করেছে কিছু সোভিয়েত সৈন্য।
চারদিক তুষারে আবৃত হয়ে আছে। কিন্তু সেজন্য তো আর যুদ্ধ থেমে থাকবে না। তাই পুরু তুষারের স্তর অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে সোভিয়েত সৈন্যরা।
তুষারের মধ্যে শত্রুর চোখ এড়ানোর জন্য সাদা রঙের বিশেষ ধরনের পোশাক পরিহিত অবস্থায় তিনজন সোভিয়েত সৈন্য। তাদের মধ্যে সর্ববামের জন হলেন বিখ্যাত সোভিয়েত স্নাইপার ভাসিলি যেইস্টেভ।
জার্মান সৈন্যরা স্তালিনগ্রাদ আক্রমণ করার মধ্য দিয়ে যে ভয়াবহ যুদ্ধের সূচনা করে তা এক সময় শহরের ছোট ছোট রাস্তা থেকে শুরু করে বিধ্বস্ত দালানের ফাঁক-ফোকর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।
স্তালিনগ্রাদের বিধ্বস্ত রাস্তায় শত্রুর দিকে অস্ত্র তাক করে আছেন কয়েকজন রেড আর্মির সৈনিক।
একসময়ের সাজানো গোছানো শহর পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তুপে। তার মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন কয়েকজন সোভিয়েত সৈন্য।
স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধে পাঁচ লক্ষের মতো সোভিয়েত সৈন্য প্রাণ হারিয়েছিলেন। আহত, যুদ্ধবন্দী এবং নিখোঁজ মিলিয়ে এই সংখ্যা এক মিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে। অবশ্য তাদের আত্মদান বৃথা যায়নি। এত এত প্রাণের বিনিময়েই একসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে পুরোপুরি বিতাড়িত করা সম্ভব হয় হিটলার বাহিনীকে।
লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অবশেষে ১৯৪৩ সালে জার্মান বাহিনীর হাত থেকে পুরোপুরি মুক্ত হয় স্তালিনগ্রাদ শহর। ছবিতে দেখা যাচ্ছে সদ্য মুক্ত হওয়া শহরের বাসিন্দাদের বাধঁভাঙ্গা উচ্ছ্বাস।
যুদ্ধ শেষে জার্মানসহ অক্ষশক্তির সৈন্যদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অজানা গন্তব্যে।
যুদ্ধবন্দী রোমানিয়ান সৈন্যদের বিশাল বহর।
নাৎসি বাহিনী শহর ছেড়ে চলে যাবার পর স্তালিনগ্রাদের বাসিন্দারা ফিরে এসেছে নিজেদের আবাসভূমিতে। যুদ্ধের ফলে সৃষ্টি হওয়া যাবতীয় জঞ্জাল সরিয়ে নতুনভাবে জীবন শুরুর স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে স্তালিনগ্রাদবাসী।
যুদ্ধের ফলে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়া স্তালিনগ্রাদ বিমানবন্দরের অবস্থা।
যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। জার্মানরা ছেড়ে গেছে শহর। এখন তো ঘরে ফেরাই যায়!