১৯৪৫ সালের আগস্ট মাস চলছিলো তখন। বিশ্ববাসী অবাক হয়ে প্রতিদিন দেখে যাচ্ছে ক্ষমতালিপ্সু কিছু মানুষের হাতে পড়ে তাদের সুন্দর পৃথিবীটা কীভাবে নরকে পরিণত হচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিশাপে প্রতিটি নতুন দিনই যেন নতুন জীবন ফিরে পাওয়ার মতো ঘটনা ছিলো অনেকের কাছে।
এমনই এক পরিস্থিতিতে জাপানের নাগাসাকিতে সপরিবারে থাকতেন ২৯ বছর বয়সী নৌ প্রকৌশলী সুতোমু ইয়ামাগুচি। যুদ্ধের ভীতি তাকেও স্পর্শ করেছিলো। কিন্তু জীবন বাঁচাতে দরকার খাদ্য, আর সেই খাদ্য ঘরে আনতে দরকার অর্থ। তাই জীবিকার প্রয়োজনে সেই বছরের গ্রীষ্মে তিন মাস জুড়ে ইয়ামাগুচি ছিলেন হিরোশিমায়। মিতসুবিশি হেভি ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতেন তিনি।
পুরো তিন মাস ইয়ামাগুচি আর তার সহকর্মীদের উপর দিয়ে বেশ কাজের চাপ গিয়েছিলো। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে নতুন নতুন তেলের ট্যাঙ্কারের ডিজাইন করতে হতো তাদের। বাকিদের মতো তিনিও অপেক্ষা করছিলেন ছুটির জন্য। কবে ছুটি পাবেন, কবে প্রিয়তমা হিসাকোকে আবারো নিবিড় সান্নিধ্যে পাবেন, কবে তাদের একমাত্র শিশুপুত্র কাতসুতোশিকে জড়িয়ে ধরে মুখটাকে চুমোয় ভরিয়ে দিতে পারবেন- এমন নানা চিন্তা সবসময়ই আচ্ছন্ন করে রাখতো তাকে।
অবশেষে সেই কাঙ্ক্ষিত দিনটি এলো আগস্ট মাসের ৬ তারিখে। ব্যাগ গুছিয়ে আকিরা ইওয়ানাগা ও কুনিয়োশি সাতো নামক আরো দুজন সহকর্মীর সাথে সেদিন বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরোলেন ইয়ামাগুচি। রেলস্টেশনে যাবার সময় ইয়ামাগুচির মনে পড়লো তিনি ভুলে হান্কো অফিসের কোয়ার্টারেই রেখে চলে এসেছেন। উল্লেখ্য, হান্কো এমন একটি স্ট্যাম্প যা যাতায়াতের জন্য লাগতো। সাথে সাথেই সহকর্মীদের অপেক্ষা করতে বলে কর্মস্থলের দিকে ছুট লাগালেন ইয়ামাগুচি।
সকাল সোয়া আটটা বাজছিলো তখন। ইয়ামাগুচি হেঁটে চলেছেন মিতসুবিশির শিপইয়ার্ড ধরে। হঠাৎ করেই আকাশ দিয়ে একটি প্লেন চলে যাওয়ার শব্দ শুনলেন তিনি। অভ্যাসবশত উপরের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলেন আমেরিকান বি-২৯ মডেলের প্লেনটি থেকে প্যারাস্যুটে বেঁধে কী যেন ফেলে দেয়া হয়েছে আকাশ থেকে। সাথে সাথেই আকাশ জুড়ে যেন বয়ে যায় প্রচন্ড এক আলোর ঝলকানি, ইয়ামাগুচি পরবর্তীকালে যেটিকে তুলনা করেছিলেন ‘ম্যাগনেসিয়ামের বিশাল বড় এক ঝলকানি’র সাথে। জীবন বাঁচাতে পাশে থাকা এক ডোবাতেই ঝাঁপ দিলেন তিনি। কানে তালানো প্রচণ্ড এক শব্দ তাকে কিছুক্ষণের জন্য বধির করে দিলো। বিষ্ফোরণ পরবর্তী শকওয়েভ তাকে তুলোর মতোই বাতাসে তুলে ফেললো, এরপর ছুড়ে দিলো একটু দূরেই থাকা এক আলুর ক্ষেতে। বোমা হামলার স্থানের দু’মাইলের কাছাকাছি ছিলেন তিনি।
পরবর্তীকালে ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য টাইম্সকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ইয়ামাগুচি জানান, “আমি জানি না ঠিক কী ঘটেছিলো। আমি মনে হয় কিছুক্ষণের জন্য অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। যখন চোখ মেলে তাকালাম, তখন সবকিছুই অন্ধকার লাগছিলো, আর আমি বেশি কিছু দেখতেও পাচ্ছিলাম না। এটা ছিলো সিনেমা হলে অনেকটা সিনেমা দেখার মতোই, যখন শূন্য ফ্রেমগুলো কোনো শব্দ ছাড়াই একের পর এক যেতে থাকে।” চারদিকের ধুলাবালি সকালের সূর্যটাকেও যেন ঢেকে দিয়েছিলো। ইয়ামাগুচির নিজের পুরো শরীরও ধুলোবালিতে মাখামাখি হয়ে গিয়েছিলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে পিলে চমকে উঠলো তার। কারণ সেখানে তখন জেগে উঠেছে মাশরুমের মতো বিশাল বড় এক মেঘ! বেচারার হাত-মুখ বেশ ভালোভাবেই পুড়ে গিয়েছিলো। এছাড়া দু’কানের পর্দাও ছিড়ে গিয়েছিলো তার।
এবার আশেপাশে তাকাতে লাগলেন তিনি, বুঝতে চাইলেন চারপাশের ধ্বংসের মাত্রা সম্পর্কে। একটু পরেই তার নজরে এলো ইওয়ানাগা আর সাতোর দেহ দুটো; মৃত নয়, জীবিত। তবে সেই দুজনও বেশ আহত হয়েছিলেন। অবশেষে সেদিন নাগাসাকি যাওয়ার পরিকল্পনা বাদ দেন তারা। রাতটা আতঙ্কের মাঝেই কাটিয়ে দেন এক এয়ার রেইড শেল্টারে। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বাড়ি ফেরার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন তারা, কারণ পরিবারের সদস্যদের অবস্থা সম্পর্কে এক অজানা আশঙ্কা ঘিরে ধরেছিলো তাদের সবাইকেই। সৌভাগ্যবশত শোনা গেলো ট্রেন চলাচল সচল রয়েছে।
ইয়ামাগুচি, ইওয়ানাগা আর সাতো বেরিয়ে পড়লেন ট্রেন স্টেশনের উদ্দেশ্যে। কিন্তু দিনের আলোয় চারদিকে তারা যা দেখতে পেলেন, সেসবের জন্য মোটেও মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন না তারা। চারদিকে জায়গায় জায়গায় ধিকিধিকি করে আগুন জ্বলছিলো, ভবনগুলো পরিণত হয়েছিলো একেকটা ধ্বংসস্তূপে, পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া আর গলিত লাশের মিছিল ছিলো পুরো রাস্তা জুড়েই! ব্রিজগুলো একেবারে ধসে পড়েছিলো। একবার তাদেরকে একটি নদী তাই সাঁতরে পার হতে হয়। কিন্তু সেটাও স্বাভাবিক সাঁতরানো ছিলো না। কারণ নদী জুড়ে ভেসেছিলো সারি সারি মৃতদেহ। স্বজাতির সেসব মৃতদেহকে পাশ কাটিয়েই এগিয়ে যেতে হয় তাদের। ট্রেন স্টেশনে পৌঁছে এমন আরো অনেকেরই দেখা পেয়ে যান ইয়ামাগুচি। বোমা হামলায় সবাই ছিলো আহত, ধ্বংসের প্রাবল্য সবাইকে করে দিয়েছিলো হতভম্ব। এমন শোকার্ত মানুষদের দল নিয়েই ট্রেনটি হিরোশিমা ছেড়ে যাত্রা শুরু করে নাগাসাকির উদ্দেশ্যে।
ততক্ষণে ভয়াবহ এ হামলার কথা জেনে গেছে পুরো বিশ্ব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সবাই জানলো পারমাণবিক বোম নামক ভয়াবহ এক দৈত্যকে বশে এনেছে দেশটি। সেই দৈত্যের অভিশাপেই ছাড়খার হয়ে গেছে হিরোশিমার সবকিছু। ট্রুম্যান সেদিন পারমাণবিক বোমা হামলা সম্পর্কে বলেছিলেন, “It is a harnessing of the basic power of the universe, the force from which the sun draws its power has been loosed against those who brought war to the Far East”। সেদিন প্রশান্ত মহাসাগরীয় টিনিয়ান দ্বীপ থেকে ‘এনোলা গে’ নামক বি-২৯ মডেলের বোমারু বিমানটি প্রায় দেড় হাজার মাইল উড়ে গিয়েছিলো ৪,৪০০ কেজি ভরের ‘লিটল বয়’ পারমাণবিক বোমটি নিক্ষেপ করতে। নামে ‘লিটল’ হলে কী হবে, কাজে মোটেও হেলাফেলার কিছু ছিলো না বোমটি। এর ধ্বংসক্ষমতা ছিলো ১৫ কিলোটন টিএনটির সমতুল্য। হিরোশিমায় সেদিনের আক্রমণে প্রায় ২০,০০০ এর মতো সেনা এবং ৭০,০০০-১,২৬,০০০ এর মতো সাধারণ মানুষ মারা গিয়েছিলো। এমন ভয়াবহ হামলার পরেও অনুশোচনার লেশমাত্র ছিলো না ট্রুম্যানের মনে। উল্টো জাপান যদি আত্মসমর্পন না করে তাহলে এর সম্ভাব্য ফলাফল সম্পর্কে তিনি হুমকি দিয়ে জানান, “a rain of ruin from the air, the like of which has never been seen on this earth”।
৮ আগস্ট সকালবেলাতেই নাগাসাকিতে এসে পৌঁছেন ইয়ামাগুচি। এরপর চিকিৎসা নিতে ছুটে গেলেন এক হাসপাতালে। সেখানে ইয়ামাগুচির চিকিৎসা করেছিলেন তারই এক বাল্যবন্ধু। তবে বন্ধুকে দেখে শুরুতে চিনতে পারেন নি সেই চিকিৎসকও। আর চিনবেনই বা কীভাবে? ইয়ামাগুচির শরীর তখন পোড়া দাগে ভরে গিয়েছে। এমনকি তার পরিবারও শুরুতে তাকে চিনতে পারে নি। ব্যান্ডেজে বাঁধা পোড়া শরীর নিয়ে যখন তিনি ঘরে প্রবেশ করেন, তখন তার মা তাকে ‘ভূত’ বলে মনে করেছিলেন!
শরীরের অবস্থা তেমন সুবিধার না হলেও অফিস কামাই দিতে চাচ্ছিলেন না ইয়ামাগুচি। তাই ৯ আগস্ট সকালে সেই অসুস্থ শরীর নিয়েই কোনোমতে অফিসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন তিনি। সেখানে যাবার পর কোম্পানির ডিরেক্টর তাকে বলেন হিরোশিমার অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত জানাতে। তিনি যখন সেই ঘটনাগুলো বর্ণনা করছিলেন, তখন অনেকেই তার দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো। মাত্র একটা বোমা হামলা যে পুরো শহরকে এভাবে ধ্বংস করে দেবে, তা যেন কেউই বিশ্বাস করতে পারছিলো না। এক সিনিয়র অফিসার তো তাকে ‘পাগল’ বলেও সম্বোধন করে বসেন! ইয়ামাগুচি যখন এ আলাপগুলো করছিলেন, তখনই নাগাসাকিতে ফেলা হয় দ্বিতীয় পারমাণবিক বোমাটি। আবারো আকাশে আলোর ঝলকানি দেখে তিনি বুঝে যান যে ৬ আগস্টের ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। তাই সাথে সাথেই মাটিয়ে শুয়ে পড়েন তিনি। শকওয়েভে মুহূর্তের মাঝেই জানালার ভাঙা কাচ আর ধুলোবালিতে ঘরটা ভরে যায়। তখনকার মানসিক অবস্থা সম্পর্কে পরবর্তীতে দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, “আমি ভেবেছিলাম মাশরুমের মেঘটা আমাকে অনুসরণ করে বুঝি হিরোশিমা থেকে এখানে চলে এসেছে!”
নাগাসাকিতে ফেলা পারমাণবিক বোমাটির নাম ছিলো ‘ফ্যাট ম্যান’। এর বিধ্বংসী ক্ষমতা ছিলো লিটল বয়ের থেকেও বেশি। ৪,৬৭০ কেজি ভরের ফ্যাট ম্যানের ধ্বংসক্ষমতা ছিলো ২১ কিলোটন টিএনটির সমতুল্য। তবে নাগাসাকির পাহাড়ি প্রকৃতি সেখানকার জনগণকে বোমার আঘাত থেকে রক্ষা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলো। তাই বিধ্বংসী ক্ষমতা বেশি হলেও ফ্যাট ম্যানের আঘাতে মারা যায় ৩৯,০০০-৮০,০০০ এর মতো মানুষ, যদিও এ সংখ্যাটাও কোনো অংশেই কম নয়।
বিষ্ফোরণের প্রভাবে ইয়ামাগুচির ব্যান্ডেজ খুলে এসেছিলো। এবারও তিনি বিষ্ফোরণ কেন্দ্রের মাত্র দুই মাইলের কাছাকাছি ছিলেন। তবে উপরওয়ালা চেয়েছিলেন ইয়ামাগুচি বেঁচে থাকুক, তাই সৌভাগ্যক্রমে এবারও তার প্রাণপাখিটা খাঁচার ভেতরেই রয়ে গেলো!
মিতসুবিশির বিধ্বস্ত ভবন থেকে বেরিয়ে ইয়ামাগুচি সর্বশক্তি জড়ো করে ছুটতে লাগলেন বাড়ির দিকে। এক অজানা আশঙ্কায় বারবার কেঁপে উঠছিলো তার বুক। বাড়িতে গিয়ে দেখলেন তাদের বাড়ির একাংশ একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছে। ভয় পেয়ে গেলেন তিনি, ভাবলেন এই বুঝি সব শেষ! কিন্তু এবারও উপরওয়ালা রক্ষা করেছিলেন ইয়ামাগুচির পরিবারকে। বিষ্ফোরণের কিছু আগে স্ত্রী হিসাকো স্বামীর পোড়ার জন্য মলম আনতে বাইরে গিয়েছিলেন। তাই বিষ্ফোরণে বাড়ি ধসে পড়লেও তার কিছুই হয় নি।
আস্তে আস্তে ইয়ামাগুচির শরীরে তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব প্রকাশ পেতে শুরু করলো। তার চুলগুলো পড়ে যেতে থাকলো, হাতের ক্ষতগুলো গ্যাংগ্রিনের রুপ ধারণ করলো, নিয়মিতই বমি হতে থাকলো তার। আগস্টের ১৫ তারিখ জাপানের সম্রাট হিরোহিতো যখন জাপানের আত্মসমর্পনের ঘোষণা দেন, তক্ষণও ইয়ামাগুচি একটি আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলেন।
সৌভাগ্যবশত ইয়ামাগুচি আস্তে আস্তে অনেকটাই সেরে ওঠেন। যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে প্রথমে তিনি দখলদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীতে অনুবাদক হিসেবে, পরে কিছুদিন স্কুল শিক্ষক হিসেবেও চাকরি করেন। পরবর্তীতে তিনি আবারো তার আগের কর্মস্থল মিতসুবিশিতে ফিরে যান। ১৯৫৭ সালে জাপান সরকার পারমাণবিক বোমা বিষ্ফোরণে বেঁচে যাওয়াদের ‘হিবাকুশা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। যদিও বর্তমানে এ শব্দটি দ্বারা কেবল ১৯৪৫ সালে পারমাণবিক বোমা বিষ্ফোরণে বেঁচে যাওয়াদেরই বোঝানো হয়, তবে এর আভিধানিক অর্থ ‘বিস্ফোরণে আক্রান্ত জনগণ’। ইয়ামাগুচি অবশ্য কেবল নাগাসাকিতে থাকার স্বীকৃতিই পান। এটা নিয়ে তার তেমন মাথাব্যথা ছিলো না। তিনি যে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছেন এটাই তার কাছে মুখ্য ছিলো। অতীত ভুলে সামনের দিকে এগোতে চেয়েছিলেন তিনি।
তবে এমন চাইলেই কি আর এমন দুঃসহ অতীত ভোলা যায়? ইয়ামাগুচিও পারেন নি। বয়স যতই বাড়তে থাকে, তার মাঝে অতীতের সেই দুঃসহ স্মৃতি ততই মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। আশি বছর বয়সে তাই নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে ইয়ামাগুচি একটি আস্ত বই-ই লিখে ফেলেন, নাম ‘ইকাসারেতেইরু ইনোচি’। বিভিন্ন জায়গায় পারমাণবিক বোমের ভয়াবহতা নিয়ে বক্তব্য প্রদানের জন্য আমন্ত্রণ পেতে থাকেন তিনি। বিখ্যাত সিনেমা পরিচালক জেমস ক্যামেরন এবং লেখক চার্লস পেল্লেগ্রিনোও এসেছিলেন তার সাথে দেখা করতে। ২০০৬ সালে ইয়ামাগুচি নিউ ইয়র্কে যান। সেখানে পারমাণবিক অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণের ব্যাপারে জাতিসংঘে এক চমৎকার ভাষণ দেন তিনি।
শুরুতে লোকে জানতো ইয়ামাগুচি শুধুমাত্র নাগাসাকির হামলা থেকেই বেঁচে গেছেন। ইয়ামাগুচিও এতেই সন্তুষ্ট ছিলেন। তবে একসময় এসে তার মনে হলো লোকে যদি জানবেই, তবে সত্যটাই নাহয় জানুক। এই ভাবনা থেকেই ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে জাপান সরকারের কাছে দুটো বোমা হামলা থেকেই বেঁচে যাওয়া ব্যক্তি হিসেবে নিজের স্বীকৃতি দাবি করেন তিনি। সরকারও মার্চ মাসে তাকে স্বীকৃতি দিয়ে দেয়। তবে এটা ভুলেও ভাবা যাবে না যে ইয়ামাগুচিই ছিলেন দুই পারমাণবিক বোমা হামলার শিকার হবার পরও বেঁচে যাওয়া বিশ্বের একমাত্র ব্যক্তি। প্রকৃতপক্ষে এমন মানুষের সংখ্যা মোট ১৬৫ জন। তবে ইয়ামাগুচিই দু’বার হামলা থেকে বেঁচে যাবার স্বীকৃতি চাওয়ায় এটি কেবল তার ভাগ্যেই জুটেছিলো। ফলে ‘নিজয়্যু হিবাকুশা’ বা ‘দু’বার বিষ্ফোরণে আক্রান্ত ব্যক্তি’ নামক উপাধি শুধুমাত্র তারই রয়েছে।
২০০৯ সালে ইয়ামাগুচি জানতে পারেন তার শরীরে ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে, পাকস্থলীর ক্যান্সার। অবশেষে ২০১০ সালের ৪ জানুয়ারি পরপারে পাড়ি জমান তিনি। ইয়ামাগুচি চলে গেছেন ঠিকই, তবে ইতিহাসের পাতায় রয়ে গেছে তার অভিজ্ঞতা, যে অভিজ্ঞতা যুগ যুগ ধরে আগত-অনাগত লক্ষ-কোটি মানুষকে শুনিয়ে যাবে পারমাণবিক অস্ত্রের ভয়াবহতার করুণ কাহিনী। কিন্তু অর্থলোভী, ক্ষমতালিপ্সু, তথাকথিত উন্নত বিশ্বের শাসকেরা কি তার সেই বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু শিক্ষা নিয়েছেন?