যেভাবে থামলো মুঘলদের অন্তর্দ্বন্দ্ব

কিল্লা-এ-জাফর বা জাফর দুর্গে অসুস্থাবস্থাতেই সম্রাট নাসিরুদ্দিন মুহম্মদ হুমায়ুন কাবুল পতনের খবর পেলেন।

কাবুলের পতনে সম্রাট কিছুটা হতাশ হয়ে পরলেন। এভাবে যদি কাবুল নিয়েই তাকে ব্যস্ত থাকতে হয়, তাহলে নিজের হারানো সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার তিনি কীভাবে করবেন?

সম্রাটকে তাই এবার বেশ কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিতে হলো। তিনি বাদাখশানের সুলেমান মির্জার সাথে বিরোধ মিটিয়ে ফেলার উদ্যোগ নিলেন। কারণ, একইসাথে দুটি বড় যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ চালানো সম্রাটের জন্য তখন অসম্ভব ছিলো।

যা-ই হোক, সুলেমান মির্জাকে বাদাখশান ফিরিয়ে দিয়ে ১৫৪৭ সালের জানুয়ারির দিকে সম্রাট জাফর দুর্গ ত্যাগ করে কাবুলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। এদিকে রওয়ানা হওয়ার কয়েকদিন পরেই কুচ বেগের পিতা শের আফগান সম্রাটের বাহিনী থেকে পালিয়ে গিয়ে কামরান মির্জার দলে যোগ দিলেন।

এই ঘটনা সম্রাট এবং সম্রাটের বাহিনীকে বেশ বড় একটা ধাক্কা দিলো। যুদ্ধ শুরুর আগেই সম্রাটের যোদ্ধারা হতাশ হয়ে পড়লো।

এদিকে সম্রাট তালিকানের কাছাকাছি গিয়ে তুষারপাতের জন্য কয়েকদিনের জন্য আটকে রইলেন। তুষারপাত কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে আসলে সেনাবাহিনীসহ সম্রাট কান্দাহারে গিয়ে কয়েকদিন বিশ্রাম নিলেন। বাহিনীর যোদ্ধাদের মনোবল ফিয়ে আনতে এ বিশ্রামটুকু প্রয়োজন ছিলো।

কয়েকদিন পরেই সম্রাট কান্দাহার থেকে কাবুলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। সম্রাটের কাবুল অভিমুখে যাত্রার কথা কামরান মির্জার অজানা ছিলো না। তাই তিনি কাবুল থেকে কিছুটা দূরে ‘দেহ-আফগানান’ নামক স্থানে সম্রাটের বাহিনীকে বাঁধা দিতে আগে থেকেই অবস্থান নিলেন।

সড়কপথে কান্দাহার থেকে ‘দেহ-আফগানান’ যেতে এখন সময় লাগে মাত্র ৩ ঘন্টা; Image Source: Google Map

দুই বাহিনী মুখোমুখি হলো। কামরান মির্জা প্রথমেই পাঠালেন শের আফগানকে। কামরানের জবাবে শের আফগানকে মুকাবিলা করতে সম্রাট হিন্দাল মির্জাকে প্রেরণ করলেন।

সংক্ষিপ্ত যুদ্ধে শের আফগান হিন্দাল মির্জার নিকট শোচনীয় পরাজয় বরণ করলো। শের আফগানের বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে এদিক সেদিক পালিয়ে গেলো। তবে শের আফগান পালাতে পারলো না। তাকে বন্দী করে সম্রাটের নিকট উপস্থিত করা হলো। সম্রাট তাকে মৃত্যুদন্ড দিলেন। মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হলো। তবে হিন্দাল মির্জার অনুরোধে শের আফগানের সাথে বন্দী হওয়া যোদ্ধাদের ক্ষমা করে দেয়া হলো।

এদিকে ছোটখাট আরো কিছু সংঘর্ষের পর কাবুলে কামরান মির্জার প্রতিরোধ ভেঙে পড়লো। সম্রাট কাবুল নগরী দখল করে নিলেন। কামরান মির্জা পালিয়ে যেতে পারেন এই আশঙ্কায় পালানোর সবগুলো রাস্তাতেই নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হলো। কামরান মির্জার পালানোর কোনো উপায়ই যেন আর না থাকে, সেটা নিশ্চিত করতে কাবুলের আশেপাশে করাচা খান মুঘল যোদ্ধাদের ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিলেন।

এদিকে পলায়নের উপায় না পেয়ে কামরান মির্জা আশ্রয় নিলেন কাবুলের বালা হিসার দুর্গে। নির্বাসিত দ্বিতীয় মুঘল সম্রাট নাসিরুদ্দিন মুহম্মদ হুমায়ুন এবার বালা হিসার অবরোধ করলেন।

সম্রাট হুমায়ুন; Artist: Kailash Raj

প্রমাদ গুণলেন কামরান মির্জা। তিনি স্পষ্টতই জানেন সম্রাট হুমায়ুনের সাথে সম্মুখ লড়াইয়ে তিনি টিকে থাকবেন না। টিকে থাকার জন্য তাই তিনি একটি মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ে অবতীর্ণ হলেন।

বাদাখশান অভিযানে যাওয়ার পূর্বে সম্রাটের বেশিরভাগ আমীর আর যোদ্ধারা তাদের পরিবার-পরিজনদের কাবুল দুর্গে সুরক্ষিত অবস্থায় রেখে গিয়েছিলেন। এমনকি সম্রাটের স্ত্রীরাও কাবুল দুর্গের অভ্যন্তরে ছিলেন।

যা-ই হোক, কামরান হুমায়ুনের আমীর আর যোদ্ধাদের পরিবারকে বন্দী করে তাদের উপর চাপ তৈরি করলেন। ইঙ্গিত স্পষ্ট। হয় হুমায়ুনের সঙ্গ ছাড়ো, নয়তো নিজের পরিবারের আশা ছেড়ে দাও।

১৮৭৯ সালে তোলা বালা হিসার দুর্গের একটি ছবি; Image Source: Wikimedia Commons

কামরানের এ ঘৃণ্য পদ্ধতি একেবারে মাঠে মারা যায়নি। নিজেদের পরিবার রক্ষায় মির্জা সনজর বারলাস, ইস্কান্দার সুলতান, মীর মুর্শিদসহ আরো বেশ কিছু আমীর সম্রাট হুমায়ুনকে ত্যাগ করে কামরানের দলে এসে যোগ দিলো। এতে ব্যাপক উৎসাহিত হয়ে কামরান মির্জা নির্যাতনের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিলেন।

বাবুস বেগের নাবালক ৩ সন্তানকে হত্যা করে তাদের মৃতদেহ বাজারে ঝুলিয়ে দেয়া হলো। এমনকি তার স্ত্রীকে ধর্ষণের জন্য লোক পাঠানো হলো। সম্রাটের আরেক আমীর মুহম্মদ কাসিমের স্ত্রীর স্তনে লোহার আংটা লাগিয়ে দুর্গের ফটকে ঝুলিয়ে হত্যা করা হলো।

মুহূর্তেই দুর্গের ভেতরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো।

 

এদিকে বাইরে থেকে কামরানের নির্যাতনের সংবাদ শুনে সম্রাট দুর্গের পতন তরান্বিত করতে কামান দাগানো শুরু করলেন। কামরান জানেন, কামানের মুকাবিলা করার মতো তেমন কোনো প্রতিরোধ ব্যবস্থা তার হাতে নেই। তবে অন্য একটি উপায় তিনি ভেবে দেখলেন। কাবুল দুর্গের পতনের পর হুমায়ুনপুত্র শিশু আকবর আবারও কামরানের হস্তগত হয়ে গিয়েছিলো। কামরান এবার সেই সুযোগটিই নিলেন। তিনি শিশু আকবরকে মাহাম আগার কোলে দিয়ে তাদের দুর্গের প্রাচীরের উপর বসিয়ে দিলেন।

সম্রাট এবার বাধ্য হলেন কামানের গোলাবর্ষণ বন্ধ করতে।

তবে কঠোর অবরোধের কারণে দুর্গের অভ্যন্তরের পরিস্থিতিও বেশ নাজুক ছিলো। এই কাবুল দুর্গের ভেতরেই আটকে গিয়েছিলেন রাজপরিবারের অনেক সদস্য। তাদের মাঝে উল্লেখযোগ্য ছিলেন সম্রাট হুমায়ুনের জীবনী ‘হুমায়ুননামা’ গ্রন্থের লেখিকা গুলবদন বেগম। তিনি তার এই বিখ্যাত বইয়ে সেই দুঃসময়ের কথাগুলো লিখে গেছেন। তিনি লিখেছেন,

‘মির্জা কামরানের সৈন্যরা দুর্গের বাইরে এসে যুদ্ধ করতো। দুই পক্ষেই হতাহতের সংখ্যা বাড়তে থাকে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাদশাহর (সম্রাট হুমায়ুন) বাহিনী জয়ী হতো। একসময় মির্জা কামরানের বাহিনী দুর্গের বাইরে আসার সাহস হারিয়ে ফেলে।

অন্যদিকে দুর্গের ভেতরে থাকা বাদশাহের বেগম, অন্যান্য স্ত্রীলোক, শিশু আর সাধারন মানুষের নিরাপত্তার কথা ভেবে বাদশাহ কামান দাগানো বন্ধ করেন।’

অবরোধের সময় সম্রাট দুর্গের মাঝে থাকা মহিলা ও শিশুদের জন্য কিছু সাহায্য প্রেরণ করেছিলেন। গুলবদন বেগম লিখেছেন,

‘বাদশাহ অবরুদ্ধ মহিলাদের জন্য নয়টি ভেড়া, সাতটি গোলাপজল ভর্তি পাত্র, লেবুর পানি আর সাত সেট কাপড় পাঠালেন। এছাড়া বাদশাহ পত্র লিখে দুর্গবাসীদের আশ্বস্ত করলেন। তিনি তাদের জানালেন, তাদের দুঃখের কথা তিনি বুঝতে পারছেন। এ কারণে কিছুদিনের জন্য অবরোধ শিথিল করা হবে।’

গুলবদন বেগম রচিত ‘হুমায়ুননামা’ গ্রন্থটির ইংরেজি অনুবাদের প্রচ্ছদ; Image Source: Amazon.in

এদিকে দুর্গ আর দুর্গের বাইরে যখন এসব ঘটনা ঘটছে, তখন জমীনদাওয়ার থেকে উলুগ মির্জা, কান্দাহার থেকে শাহ কুলি সুলতান, কিলাত থেকে কাসিম হুসেন খান নিজেদের যোদ্ধাসহ সম্রাটের সাথে এসে যোগ দিলেন। সম্রাটের সহযোগীতায় বাদাখশান থেকেও কিছু যোদ্ধা এসে যোগ দিলো। এতে সম্রাটের বাহিনীর মনোবল আরও চাঙ্গা হলো। অন্যদিকে কামরান মির্জা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলেন।

কামরান মির্জা আরেকবার তার কৌশল পাল্টালেন। কঠোরতা ত্যাগ করে এবার তিনি কোমল হওয়ার চেষ্টা করলেন। সমস্ত অত্যাচার নির্যাতন বন্ধ করে দিয়ে অর্থের বিনিময়ে সবার সমর্থন লাভের চেষ্টা করলেন। কিন্তু দুর্গের অভ্যন্তরে থাকা সবাই বুঝে গিয়েছিলো কামরান মির্জা আবারও কাবুলের নিয়ন্ত্রণ হারাতে যাচ্ছেন।

এ অবস্থায় সম্রাট হুমায়ুনের সাথে থাকাই বেশি লাভজনক। সুতরাং কামরান মির্জা ব্যর্থ হলেন।

বর্তমানে বালা হিসার দুর্গ; Image Source: Wikimedia Commons

দুর্গ রক্ষা অসম্ভব বিবেচনা করে দুর্গ অবরোধের ৩ মাস পর ১৫৪৭ সালের ২৭ এপ্রিল কামরান মির্জা বালা হিসার দুর্গ ত্যাগ করে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে গেলেন। কামরান পালিয়ে যাওয়ার পর হুমায়ুন দুর্গ দখল করলেন।

বালা হিসার দখল করে সম্রাটের যোদ্ধারা বেপরোয়াভাবে দুর্গে লুটপাট চালাতে লাগলো। সম্রাট তাতে বাঁধা দিলেন না। কারণ ততদিনে দুর্গের অধিবাসীদের দ্বিমুখীতায় তিনি বেশ বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। জওহর আবতাবচির মতে, সম্রাট তাদের আদর্শহীন আর সুযোগসন্ধানী মনে করতেন, যারা অর্থের বিনিময়ে যে কাউকেই সঙ্গ দিতে ইচ্ছুক ছিলো।

সারারাত লুটপাট চললো। পরের দিন সম্রাট লুটপাট নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একটি আদেশপত্র জারি করলেন। এই আদেশ শোনার পর যারা লুটপাট চালিয়ে যাবে, তাদের কঠোর শাস্তি প্রদানের কথাও বললেন তিনি। মুহূর্তেই লুটপাট থেমে গেলো।

 

কাবুল থেকে পালিয়ে কামরান মির্জা বাদাখশানের সুলেমান মির্জার কাছে সাহায্যের জন্য গেলেন। কিন্তু সম্রাট হুমায়ুনের সাথে চুক্তিবদ্ধ থাকায় তিনি কামরানকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিলেন।

অন্য কোনো জায়গা থেকে সাহায্য লাভের কোনো উপায় না পেয়ে কামরান মির্জা মুঘলদের চিরশত্রু উজবেকদের সাথেই হাত মেলালেন! বাদাখশান থেকে সোজা বলখে গিয়ে তিনি পীর মুহাম্মদ খাঁয়ের কাছে সাহায্য চাইলেন। পীর মুহাম্মদ খাঁ চিরশত্রু মুঘলদের নিজেদের মাঝেই যুদ্ধে জড়িয়ে দেয়ার সুযোগটি হাতছাড়া করলেন না।

উজবেকদের সাথে কামরান মির্জার চুক্তি হলো। শর্তানুসারে উজবেকরা কামরানকে কাবুল আর বাদাখশান অধিকার করার জন্য পর্যাপ্ত সাহায্য প্রদান করবে। বিনিময়ে কামরানকে উজবেকদের জন্য বাদাখশান ছেড়ে দিতে হবে।

উজবেকদের সাহায্যপুষ্ট হয়ে কামরান মির্জা অল্প কিছুদিনের মাঝেই একে একে জাফর দুর্গ, বগলান, কিশম আর তালিকান অধিকার করে ফেললেন।

এদিকে কামরানের পিছু নিতে সম্রাট হুমায়ুন ইতোমধ্যেই হিন্দাল মির্জা আর করাচা খানকে প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু উজবেক সহায়তা লাভ করায় কামরান মির্জার শক্তি বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছিলো। এই ব্যাপারটির জন্য করাচা খান আর হিন্দাল মির্জা প্রস্তুত ছিলেন না। ফলস্বরূপ কামরানের কাছে পরাজিত হয়ে তাদের পিছু হটতে হলো।

বাদাখশান থেকে একের পর এক দুঃসংবাদ আসতে থাকায় সম্রাট হুমায়ুন বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। কামরানকে এখনই পরাজিত করতে না পারলে আরও বড় কোনো দুঃসংবাদ শুনতে হতে পারে, এই আশঙ্কায় সম্রাট ১৫৪৭ সালের মাঝামাঝির দিকে নিজেই বাদাখশানের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লেন। কিন্তু প্রচন্ড শীত আর ভয়ঙ্কর তুষারপাতের কারণে তাকে কাবুলের ফিরে যেতে হলো।

আবহাওয়ার এই বৈরিতা কামরান মির্জার বেশ কাজে দিলো। সম্রাটের অনুগত বেশ কিছু আমিরকে কামরান নিজের পক্ষে টেনে নিতে সক্ষম হলো। এদের মাঝে করাচা খান থেকে শুরু করে বাবুস বেগ আর ইসমাইল বেগ দুলহাইয়ের মতো বিশ্বস্ত আমীররাও ছিলেন! আরও ছিলেন মুসাহিব খান আর মুসাহিব খান।

 

সম্রাট হুমায়ুনের পক্ষে আর বসে থাকা সম্ভব হলো না। পরের বছরের (১৫৪৮) জুনের মাঝামাঝির দিকে কাশিম খান মৌজির কাছে কাবুল দুর্গ রক্ষার ভার দিয়ে তিনি আবারও কাবুল ত্যাগ করলেন।

যাত্রাপথে কোথাও তেমন বিলম্ব না করে সম্রাট কারাবাগ, কারাবাগ থেকে গুলবাহার হয়ে হিন্দকুশ পাড়ি দিয়ে আন্দরাব দুর্গের কাছে এসে ঘাটি গাড়লেন। হিন্দাল মির্জাও কুন্দুজ থেকে এখানে মূল বাহিনীর সাথে যোগ দিলেন। আন্দরাব দুর্গ উল্লেখযোগ্য কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই আত্মসমর্পণ করলো।

আসন্ন যুদ্ধের জন্য কামরান ছক সাজিয়ে ফেললেন। করাচা খানকে তালিকান দুর্গে মোতায়েন করে কামরান নিজে কিশম আর জাফর দুর্গের কাছাকাছি ঘাটি গাড়লেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার পিছু ছাড়লো না। বেগি নদীর তীরে তিনি সম্রাট হুমায়ুনের নিকট শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে সমস্ত যুদ্ধসামগ্রী আর রসদ পেছনে রেখে তালিকানে গিয়ে আশ্রয় নিলেন।

কামরানের বেশ কিছু সৈন্য সম্রাটের বাহিনীর হাতে বন্দী হয়েছিলো। সম্রাট তাদের সবাইকে হত্যা করতে নির্দেশ দিলেন। কামরানের যোদ্ধাদের যখন হত্যা করা শুরু হলো, সম্রাট তখন এই অনর্থক রক্তপাত দেখে বেশ কষ্ট পেলেন। তিনি কামরান মির্জাকে উদ্দেশ্য করে একটি পত্র লিখলেন। জওহর আবতাবচী তার ‘তাজকিরাতুল ওয়াকিয়াত’ গ্রন্থে এই পত্রটি উল্লেখ করেছেন। সম্রাট লিখলেন,

‘হে আমার নির্দয় ভ্রাতা, তুমি এ কী অনাচার শুরু করেছ? যে রক্তপাত এখন হচ্ছে, তার জন্য শুধুমাত্র তুমিই দায়ী। হাশরের দিনে এর জন্য তোমাকে (আল্লাহর কাছে) জবাবদিহি করতে হবে।’

মির্জা কামরান এই পত্রের জবাব দিলেন মাত্র দুই লাইনে। তিনি লিখলেন,

‘সাম্রাজ্য হচ্ছে এমন এক সুন্দরী তরুণী, তরবারির সাহায্য ছাড়া যার ওষ্ঠে চুম্বন করা যায় না।’

সম্রাট হুমায়ুন তালিকান অবরোধ করলেন। কামরান মির্জা পড়লেন বিপদে। মুখে বড় বড় কথা বললেও অবরোধ সামলানোর মতো প্রস্তুতি তার ছিলো না। তার মূল সমস্যা ছিলো দুটি। এক, বেশিদিন অবরোধ সামলানোর মতো রসদ তিনি তালিকানে মজুদ করতে পারেননি। দুই, কঠোর অবরোধের কারণে বাইরে থেকে কোনো সাহায্য আসার রাস্তাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। এমনকি উজবেকদের নিকট থেকেও কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছিলো না।

কামরান বুঝলেন তার পতন নিশ্চিত। শেষ চেষ্টা হিসেবে সন্ধি প্রস্তাব নিয়ে মীর আরব মক্কীকে সম্রাটের কাছে পাঠালেন।

সম্রাটও অনর্থক এই রক্তপাত এড়াতে চাইছিলেন। কয়েকটি শর্তে এই সন্ধি প্রস্তাবটি স্বাক্ষরিত হলো। সেগুলোর মাঝে উল্লেখযোগ্য দুটি শর্ত ছিলো- এক, সম্রাট হুমায়ুনের নামে খুতবা পড়াতে হবে, এবং, দুই, কাউকে কিছু না জানিয়ে কামরানকে মক্কার দিকে যাত্রা করতে হবে।

 

আগস্ট মাসের ১৭ তারিখে অবরোধ তুলে নেয়া হলো।

সম্রাট হুমায়ুন তালিকানে বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করলেন। সদরে মাওলানা আবদুল বাকি সম্রাটের নামে খুতবা পাঠ করলেন। অন্যদিকে কামরান মির্জা চুপি চুপি মক্কার পথে যাত্রা শুরু করলেন।

তালিকানে প্রবেশ করে সম্রাট সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন। এমনকি তার বিদ্রোহী আমিরদেরও ক্ষমা করা হলো। কামরান মির্জা তালিকান ছেড়ে কিছুদূর যাওয়ার পরেই এই সাধারণ ক্ষমার ঘোষণার সংবাদ শুনলেন। তিনি আশাবাদী হয়ে উঠলেন। কামরান মির্জা তার ভাই হুমায়ুনের একমাত্র দুর্বলতার খবরটি বেশ ভালোই জানেন। মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে তিনি তালিকানে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।

কামরানের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের সংবাদ দূতের মাধ্যমে সম্রাটের নিকট গিয়ে পৌঁছালো। সম্রাট কিছুক্ষণ ভাবলেন। এরপর উত্তর দিলেন,

‘সে (কামরান) তার ভাইকে দেখতে আসবে। এ তো ভালো কথা

সম্রাট তার এ মৌন সম্মতি যে শুধু মুখেই জানালেন তা না, তিনি তার এই বিদ্রোহী ভ্রাতাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে আসতে একে একে তিনটি দলকে পাঠালেন। প্রথম দলে ছিলেন রাজদরবারের আমিরবর্গ। এদের মাঝে উল্লেখযোগ্য হলেন মুনিম খান আর তরদি বেগ।

দ্বিতীয় দলে ছিলেন রাজপরিবারের সাথে সম্পর্কযুক্ত ব্যক্তিবর্গ। এই দলে উল্লেখযোগ্য ছিলেন কাসিম হুসেন সুলতান আর খিজির খাজা সুলতান।

আর তৃতীয় দলে গেলেন স্বয়ং হিন্দাল মির্জা আর আসকারি মির্জা। সাধারণ ক্ষমার আওতায় আসকারি মির্জাও ইতোমধ্যেই ক্ষমা পেয়ে গিয়েছিলেন।

পরিণত বয়সে যুবরাজ মির্জা হিন্দাল। তবে ছবিটি আসলেই মির্জা হিন্দালের কি না, তা নিশ্চিত নয়; Image Source: Wikimedia Commons

যা-ই হোক, একে একে তিনটি দলের উষ্ণ অভ্যর্থনায় সিক্ত হয়ে কামরান মির্জা ইশকিমিশারায় সম্রাটে সামনে উপস্থিত হলেন।

দীর্ঘ অন্তর্দ্বন্দ্ব আর অনর্থক যুদ্ধ-বিগ্রহের পর দুই ভাইয়ের এই মিলন মুহূর্তটি বেশ আবেগময় ছিলো।

কামরান মির্জা তৎকালীন রীতি অনুযায়ী গলায় একটি রুমাল বেঁধে অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে সম্রাটের সামনে গেলেন। এর অর্থ তিনি সমস্ত দোষ স্বীকার করে নিচ্ছেন। সম্রাট তৎক্ষণাত উঠে গিয়ে ভাইকে ধরে নিজের পাশে বসালেন। কামরান মির্জা তার অতীতের কৃতকর্মের জন্য নিজের অনুশোচনা প্রকাশ করলেন।

এরপর এক পেয়ালা শরবত আনা হলে সম্রাট অর্ধেক পান করলেন আর বাকি অর্ধেক কামরানকে দিলেন। উপস্থিত সবাই যেন স্বস্তির শ্বাস ছাড়লেন।

ভাইয়ে ভাইয়ের লড়াইয়ে অনেক রক্তপাত হয়েছে। আক্ষরিক অর্থে বলতে গেলে নিজেরাই নিজেদের রক্ত ঝরিয়েছে। এবার বোধ হয় বিভীষিকাময় সেই দিনগুলোর অবসান ঘটলো!

 

দুই ভাইয়ের মিলন উপলক্ষে দুই দিন ধরে উৎসব হলো। উৎসব শেষ হওয়া মাত্রই অধিকৃত সমস্ত ভূখন্ড ভাই আর আমীরদের মাঝে বন্টন করে দিয়ে ১৫৪৮ সালের ৫ অক্টোবর কাবুলে গিয়ে পৌঁছালেন।

বন্টন প্রক্রিয়ায় হিন্দাল মির্জা পেলেন কুন্দুজ, ঘোরি, বকলান, কাহমর্দ, ইশকামিশ আর নারিন। সুলেমান মির্জা আর ইব্রাহীম মির্জা পেলেন কিল্লা-এ-জাফর, তালিকানসহ আশেপাশের বেশ কিছু অঞ্চল। আর নিজেদের ভরণপোষণ মেটানোর জন্য কামরান মির্জা আর আসকারি পেলেন যথাক্রমে কুলাব আর কুরাতিগিন।

সম্রাট হুমায়ুন তার নির্বাসিত জীবনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করেছিলেন। এই ছবিটিতে সেসব অবস্থান উল্লেখ করা হয়েছে; Image Source: farbound.net

হুমায়ুন দয়া দেখিয়ে তার ভাইদের সাথে শান্তি স্থাপন করলেন। এ কথা অনেকটা স্পষ্ট করেই বলা যায়, তার এ ভাইদের অসহযোগীতা আর অনর্থক বিদ্রোহী মনোভাবের জন্যই হিন্দুস্তানে সম্রাট তার সাম্রাজ্যের মূল ভূখন্ডটুকুই হারিয়ে বসেছেন। তবে সৌভাগ্যের বিষয়, হয়তো সম্রাটের ভাগ্যের চাকা এবার ঘুরতে শুরু করেছে।

ভাইদের সাথে মিটমাটের সংবাদ যখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো, তখন যারা মুঘলদের এ অন্তর্দন্দ্ব থেকে লাভবান হচ্ছিলো, তারা শঙ্কিত হয়ে উঠলো। দ্রুত তারাও সম্রাটের সাথে সদ্ভাব করার জন্য উপহারসহ দূত প্রেরণ করতে লাগলো।

এদিকে সম্রাটকে কিছুটা স্থিতাবস্থায় পেয়ে কাশ্মীর থেকে হায়দার মির্জা হিন্দুস্তানে চূড়ান্ত আক্রমণ চালানোর প্রস্তাব জানিয়ে পত্র লিখলেন। তবে সম্রাট তখনো প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি আরও কিছুটা সময় নিতে চাইলেন। কাবুল আর এর আশেপাশে তার অধিকৃত ভূখণ্ড এখনও সুরক্ষিত নয়। উজবেকরা এ অঞ্চলে ঝামেলা করার চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে তারা তো তার বিরুদ্ধে কামরানকে সহায়তা পর্যন্ত করে বসেছে।

সম্রাট তাই এবার বলখের দিকে নিজের দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন। সম্রাটকে হিন্দুস্তান পুনরুদ্ধার করতে হবে, এটা সত্য। তবে হিন্দুস্তান পুনরুদ্ধার করার পর পেছন থেকে পুরনো ঝামেলার কারণে তা যেন আবার হাতছাড়া হয়ে না যায়, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।

[এই সিরিজের পূর্বের প্রকাশিত পর্বটি পড়ুন এখানে। সিরিজের সবগুলো লেখা পড়তে চাইলে ক্লিক করুন এখানে।]

Description: This article is in Bangla language. It's a short discussion about the internal conflict of Mughal's and how it was stopped.

References:

1. মোগল সম্রাট হুমায়ুন, মূল (হিন্দি): ড হরিশংকর শ্রীবাস্তব, অনুবাদ: মুহম্মদ জালালউদ্দিন বিশ্বাস, ঐতিহ্য প্রকাশনী, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০০৫

2. তাজকিরাতুল ওয়াকিয়াত, মূল: জওহর আবতাবচি, অনুবাদ: চৌধুরী শামসুর রহমান, দিব্য প্রকাশ, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ (চতুর্থ মুদ্রণ)

3. হুমায়ুননামা, মূল: গুলবদন বেগম, অনুবাদ: এ কে এম শাহনাওয়াজ, জ্ঞানকোষ প্রকাশনী, প্রকাশকাল: জানুয়ারি, ২০১৬

Featured Image: Wikimedia Commons

Related Articles

Exit mobile version