টারকুইনাস সুপারবাসকে নির্বাসন দেওয়ার মাধ্যমে, রোমে যবনিকাপাত হয় শেষ রাজার। এরপরও অবশ্য বেশ কয়েকবার ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছেন সুপারবাস, সেজন্য আক্রমণও করেন; কিন্তু ব্যর্থ হতে হয়ে তাকে।
রাজতন্ত্রকে তো ঝেঁটিয়ে সরানো হলো, এবার দেশ চলবে কীভাবে? এই প্রশ্নের জবাব দেবার জন্যই যেন দৃশ্যপটে আগমন হলো প্রজাতন্ত্র তথা রিপাবলিকের। আসলে রোমের সঙ্গে রিপাবলিক শব্দটা এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে যে এই দুটি শব্দের কোনো একটা শুনলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অন্যটার কথা মনে চলে আসে। রিপাবলিক সরকারের হাতে তুলে দেওয়া হয় নগর-রাষ্ট্রের শাসনভার।
তত্ত্বগত দিক থেকে সেই সরকারের প্রধান লক্ষ্য ছিল নাগরিকদের ইচ্ছার বাস্তবায়ন করা। কিন্তু বাস্তবে তার উপস্থিতি ছিল না।কিন্তু এভাবে বেশিদিন যায়নি। বাইরের কোনো আক্রমণে নয়, অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণেই পতন ঘটে রিপাবলিক রোমের। তারপর শুরু হয়ে সম্রাটদের শাসনামল।
তবে প্রজাতন্ত্রের সময়েই, খ্রিষ্টপূর্ব ৫১০ সন থেকে মোটামুটি খ্রিষ্টপূর্ব ৪৪ সনের মধ্যে রোমের অধীনে চলে আসে প্রায় পুরো ইতালিয়ান পেনিনসুলা। সেই সঙ্গে ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার অনেকটাও।
শুরুর দিনগুলো
টারকুইনাস সুপারবাসের নির্বাসনের পরবর্তী কিছু বছর রোমের জন্য ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাইরের আক্রমণ তো ছিলই, সেই সঙ্গে দমন করতে হয়েছে অভ্যন্তরীণ গোলযোগও। প্রথম একশোটা বছর কোনোরকম ধুঁকে-ধুঁকে রোম টিকে ছিল বললে অত্যুক্তি হবে না। সরকার ব্যস্ত ছিল শহরের ভেতরে রাজনৈতিক অস্থিরতার একটা যতি টানার কাজে।
ল্যাটিনদেরকে খ্রিষ্টপূর্ব ৪৯৬ সনে ব্যাটল অব রেজিলাস-এ হারিয়ে এবং ইপাইরাসের রাজা, পাইরাসের বিরুদ্ধে টিকে থেকে সুপারপাওয়ার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে রোম। নগরীটির এলাকা যতই বাড়তে থাকে, ততই পাল্লা দিয়ে মজবুত হতে থাকে রিপাবলিকের সামাজিক এবং রাজনৈতিক কাঠামো। ধীরে ধীরে উত্তর সাগর থেকে শুরে করে গল, জার্মানিয়া, হিসপানিয়া, গ্রিস, সিরিয়া এবং উত্তর আফ্রিকা চলে আসে প্রজাতন্ত্রের অধীনে।
সরকার-ব্যবস্থা
প্রজাতন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য ছিল সব নাগরিককে কোনো না কোনোভাবে নগর-রাষ্ট্র পরিচালনায় অন্তর্ভুক্ত করা। তবে নাগরিক বলতে কাকে বোঝানো হবে- সে ব্যাপারে ছিল দ্বন্দ্ব। প্রথমদিকে নাগরিক বলতে বোঝাত ১৫ বছরের বেশি বয়সী সেসব পুরুষদের, যারা রোমের আদিবাসী পরিবারের উত্তরসূরি। দাসদের থেকে নিজেদেরকে আলাদা করতে রোমের নাগরিকরা তাই টোগা নামের বিশেষ এক আলখেল্লা পরতো। অধিকাংশ টোগাই হতো সাদা রঙয়ের। পরবর্তীতে, সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হলে রোমান সম্রাটরা নিজেদের ‘ফার্স্ট সিটিজেন’ পরিচয় দিতে শুরু করে; টোগার রঙও পাল্টে হয়ে যায় বেগুনী।
নাগরিক অধিকারেও ছিল বৈষম্য। পূর্ণ নাগরিকরা ভোট দিতে পারতো, পারতো স্বাধীনদের বিয়ে করতে। ব্যবসা করারও অনুমতি ছিল তাদের। তবে কিছু নাগরিকের ভোটাধিকার ছিল না, অনেকে সরকারি কর্মকর্তা হতে পারতো না। আরেক শ্রেণির নাগরিক ছিল যারা কেবলমাত্র ভোট দিতে বা ব্যবসা করতে পারতো শুধু, সরকারি কর্মকর্তা হওয়া বা স্বাধীন নারীদের বিয়ে করার অধিকার তাদের ছিল না।
প্রজাতন্ত্রের শেষ দিকে অবশ্য যেসব পুরুষ দাস তাদের স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হতো তাদেরকে নাগরিক হিসেবে গণ্য করা শুরু হয়। এমনকি জাতিতে রোমান নয়, কিন্তু রোমের প্রতি বন্ধু ভাবাপন্ন এলাকার মানুষরাও নাগরিকত্ব লাভ করে।
রোমানরা এ সময়ে পুরোপুরি গণতান্ত্রিক না হলেও, ভোটের মাধ্যমে তাদের সরকারি কাজকর্ম পরিচালনা শুরু হয়। প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার শুরুর দিকে ক্ষমতা চলে আসে সম্ভ্রান্ত ও ধনী পরিবারগুলোর হাতে। এদেরকে তখন ডাকা হতো ‘প্যাট্রিসিয়ান’ নামে। এ শব্দটির উৎপত্তি প্যাট্রেস তথা বাবা থেকে। রাজনৈতিক কিংবা ধর্মীয় পদে আসীন হতে পারতো কেবল এই প্যাট্রিসিয়ানরা। অন্য নাগরিকরা ছিল ‘প্লেবিয়ান’। এদের কোনো ক্ষমতা ছিল না। হয়তো এভাবেই চলে যেতো দিন, কিন্তু আজ হোক কাল হোক, মানুষ তো দমন-নীতির বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াবেই।
দুই শ্রেণির মাঝে শুরু হয় ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। এদিকে সেনাবাহিনীর প্রায় সব সৈন্যই ছিল দ্বিতীয় শ্রেণির। তাই তারা প্রশ্ন তোলে- সব লাভ যদি ধনীদের হাতেই যায়, তাহলে যুদ্ধে জান খুইয়ে আমাদের লাভ কী? অবশেষে খ্রিষ্টপূর্ব ৪৯৪ সনে ধর্মঘটে চলে যায় প্লেবিয়ানরা, রোমের বাইরে অবস্থান নিয়ে দাবি আদায়ের আগে না সরার দৃঢ় সংকল্পের কথা জানিয়ে দেয়। অচিরেই মেনে নেওয়া হয় তাদের দাবি। প্লেবিয়ানরা লাভ করে তাদের নিজস্ব কাউন্সিল।
শাসন ব্যবস্থা
কনসিলিয়াম প্লেবিসের মাধ্যমে সাধারণ জনগণ সরকারের অংশে পরিণত হয়। রোমান প্রজাতন্ত্রে সরকারি কার্যক্রম পরিচালিত হতো ম্যাজিস্ট্রেট (কারসাস অনারিয়াম)-এর মাধ্যমে। এদিকে প্রশাসনিক ক্ষমতা ছিল দুজন কনসাল-এর হাতে। কমিটিয়া সেঞ্চুরিয়া কর্তৃক নির্বাচিত এই কনসালরা মাত্র এক বছরের জন্য শাসনকার্য সামলাতেন। পাশাপাশি সিনেটের প্রধান নির্বাচন, আইন প্রণয়নে সহায়তা এবং সেনাবাহিনী পরিচালনাও করতে হতো তাদের। ক্ষমতা যেন একজনের হাতে কুক্ষিগত না হয় সেজন্যই ছিল একাধিক কনসালের ব্যবস্থা।
শাসনকার্যে গতি আনার জন্য অপেক্ষাকৃত কম ক্ষমতাসম্পন্ন কিছু ম্যাজিস্ট্রেটও ছিলেন। এদের মধ্যে একজন হচ্ছেন প্রিয়েটর, যিনি বিচার-সংক্রান্ত সমস্ত দায়িত্ব পালন করতেন। কোয়েস্টর-এর কাজ ছিল অর্থনৈতিক দিক দেখা। এডিলের উপর ছিল রাস্তা, পানি, খাদ্য সরবরাহ, বাৎসরিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি দেখভাল করার দায়িত্ব।
তবে আরেকটা পদ ছিল, যার আশায় লালায়িত থাকত অনেকেই। সেন্সর। প্রতি পাঁচ বছর পরপর নির্বাচন হতো এই আসনে। আদমশুমারি পরিচালনা করা, নাগরিক এবং তাদের সম্পদের তালিকা দেখা ছিল এর প্রধান কাজ। যে ক্ষমতার কারণে এই পদ অনেকের কাম্য ছিল তা হচ্ছে খোদ সিনেট থেকে সদস্যকে সরিয়ে দিতে পারা।
আরেকটি পদ ছিল, নাম- ডিক্টেটর। এ পদে যিনি আসীন হতেন, তার হাতে তুলে দেওয়া হতো সব ক্ষমতা। একমাত্র জরুরী অবস্থায় কাউকে ঘোষণা করা হতো রোমের ডিক্টেটর হিসেবে। সাধারণত ছয় মাস স্থায়ী হতো তার পদ। রোমান ইতিহাসে বেশ কয়েকজনকে ডিক্টেটর বানানো হয়েছে। তাদের মধ্যে সর্বশেষ এবং সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যক্তিটি হলেন জুলিয়াস সিজার।
পতন
রোমান প্রজাতন্ত্রের পতনের অন্যতম কারণ হিসেবে ধরা হয়ে এর জড়তা। আকৃতিতে রোম বৃদ্ধি লাভ করলেও, প্রজাতন্ত্র তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারেনি। এর সর্বপ্রথম উদাহরণ হচ্ছে খ্রিষ্টপূর্ব ৯০ থেকে ৮৮ সাল পর্যন্ত চলমান সহিংসতা। এর কারণ- রোমান মিত্রদের নাগরিকত্বের দাবি। রোমান সিনেট একপর্যায়ে এসে তাদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়, দাস ব্যতীত ইতালিয়ান পেনিনসুলার সবাইকে নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। পরবর্তীতে জুলিয়াস সিজার ইতালিরা বাইরে, স্পেন এবং গলের অধিবাসীদেরকেও এতে অন্তর্ভুক্ত করেন।
এই সময়েই এক রোমান রাজনীতিবিদ এবং কবি, মার্কাস টিলিয়াস সিসেরো, আবিষ্কার করেন- প্রখ্যাত রোমান সিনেটর লুসিয়াস সার্জিয়াস ক্যাটিলিন গোপনে গোপনে রোমান সরকারের পতন ঘটাবার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন।
অভ্যন্তরীণ গোলযোগ এবং ষড়যন্ত্রের এই প্রচেষ্টা নজর কাড়ে তিনজন সামরিক ব্যক্তিত্বের- জুলিয়াস সিজার, নেইয়াস পম্পেই এবং মার্কাস লিসিনিয়াস ক্রাসাস। স্পার্টাকাসকে পরাজিত করে ততদিনে প্রবল খ্যাতি লাভ করেছেন ক্রাসাস। স্পেন এবং প্রাচ্যে যুদ্ধের কারণে পম্পেইও কম যান না। আর সিজারের দক্ষতা নিয়ে কারো কোনো প্রশ্নই নেই। তিনজনে মিলে তৈরি করেন প্রথম ট্রায়ামভিরেট (তিনজনের দল)। প্রায় এক দশক তারা নিয়ন্ত্রণ করেন সামরিক বাহিনীকে, কনসালের পদও ছিল তাদের ইচ্ছাধীন।
খ্রিষ্টপূর্ব ৫৯ সনে কনসালের পদ থেকে নিজেকে সরিয়ে গল এবং জার্মানিয়ায় সৈন্য নিয়ে অভিযান চালান সিজার। এদিকে রোমে বসেই স্পেনের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন পম্পেই। এদিকে পম্পেই এবং সিজারের মাঝে তৈরি হয় অস্থিরতা, দিনকে দিন তা বাড়তেই থাকে। সিজারের সুখ্যাতির প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন পম্পেই। এদিকে সিজার চাইছিলেন রাজনীতিতে ফিরতে। শেষ পর্যন্ত ফারসেলাসের যুদ্ধে উভয় পক্ষ মুখোমুখি হয়।
যুদ্ধে পরাজিত পম্পেই পালিয়ে যান মিশরে, যেখানে ত্রয়োদশ টলেমির হাতে প্রাণ হারান তিনি। ক্ষমতা দখল করেই সিজার নিজেকে ঘোষণা করেন ‘আমৃত্যু ডিক্টেটর’ হিসেবে। এভাবেই ঘটে প্রজাতন্ত্রের পতন, এবং তার ছাই থেকে জন্ম নেয় রোমান সাম্রাজ্য।