২০১৫ সালের ২০ অক্টোবর। ওয়ার্ল্ড জায়নিস্ট কংগ্রেসে বক্তব্য দেওয়ার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু। বক্তব্যের একটি অংশে তিনি দাবি করে বসলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদীদের উপর যে গণহত্যা চালানো হয়েছিল, তার মূল পরিকল্পনা আসলে হিটলারের ছিল না। তার দাবি অনুযায়ী, হিটলার চেয়েছিলেন শুধু ইহুদীদেরকে জার্মানি থেকে বের করে দিতে। কিন্তু জার্মানি থেকে বের করে দিলে জায়গা না পেয়ে ইহুদীরা ফিলিস্তিনে গিয়ে উঠবে- এই অযুহাত দেখিয়ে ইহুদীদেরকে পুড়িয়ে মারার ব্যাপারে হিটলারকে নাকি প্ররোচিত করেছিলেন সে সময়ের ফিলিস্তিনের জাতীয়তাবাদী নেতা এবং জেরুজালেমের গ্র্যান্ড মুফতি আলহাজ মোহাম্মদ আমিন আল-হুসেইনি!
কট্টরপন্থী নেতানিয়াহুর বক্তব্য কখনোই বিশ্ব পরিমণ্ডলে খুব একটা নিরপেক্ষ হিসেবে গ্রহণযোগ্য ছিল না, কিন্তু সেদিনের বক্তব্যের প্রতিবাদ করতে বাধ্য হয়েছিল অনেক ইহুদীও। এমনকি, জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের মুখপাত্র পর্যন্ত নেতানিয়াহুর ঐ বক্তব্যের পর ইহুদী হত্যায় তার দেশের নাৎসিদের দায় পুনরায় স্বীকার করে নিয়েছিলেন। নেতানিয়াহুর বক্তব্যটি ছিল মূলত দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ইতিহাস বিকৃতিরই একটি ধারাবাহিকতা, যেখানে ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের উপর তাদের অবৈধ দখলদারিত্বকে একপ্রকার বৈধতা দেওয়ার জন্য ফিলিস্তিনিদেরকে সন্ত্রাসী হিসেবে উপস্থাপন করে এবং তা করতে গিয়ে নিজেদের সকল অপরাধ আড়াল করার চেষ্টা করে। নেতানিয়াহু ব্যাপারটিকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে ফিলিস্তিনি মুফতিকে দোষারোপ করতে গিয়ে প্রকারান্তরে হিটলারকেই দায়মুক্তি দিয়ে দিয়েছেন।
নেতানিয়াহুর দাবির মধ্যে শুধু একটা অংশই ছিল সঠিক। তা হলো, মুফতি আমিন আল-হুসেইনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে হিটলারের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। শুধু সাক্ষাৎ না, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটি বড় সময় জুড়েই তিনি জার্মানিতে অবস্থান করেছিলেন। সে সময় তিনি একাধিকবার নাৎসি অফিসারদের সাথে মিলিত হয়েছিলেন, তাদের সাথে মিলে ব্রিটিশ এবং ইহুদীদের বিরুদ্ধে জার্মান-আরব যৌথ অভিযানের পরিকল্পনা করেছিলেন। এমনকি নাৎসি বাহিনীর পক্ষ হয়ে লড়াই করা প্রথম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ব্রিগেড থার্টিন্থ ওয়াফেন মাউন্টেইন ডিভিডশন অব দ্য এসএস হ্যান্ডস্কার গঠনেও তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। বসনিয়ার মুসলমান যোদ্ধাদেরকে তিনিই প্ররোচিত করেছিলেন নাৎসি বাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য। কিন্তু ইহুদীদের গণহত্যায় মুফতির সম্পৃক্ততা ছিল এরকম কোনো প্রমাণ ইতিহাসে পাওয়া যায় না।
পূর্ববর্তী একটি লেখায় আমিন আল-হুসেইনির উত্থান সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে দেখা গিয়েছিল, মুফতি আমিন তার রাজনৈতিক জীবনের একটা বড় অংশই ব্রিটিশদের সাথে সংঘর্ষে না গিয়ে বরং সমোঝতার মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট ছিলেন। সে সময় তাদের কাছে তিনি মধ্যপন্থী হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। কিন্তু ব্রিটিশদের জায়নবাদ ঘেঁষা নীতির ফলে ফিলিস্তিনে ইহুদী অভিবাসী ও বসতির সংখ্যা এবং জায়নবাদী ইহুদীদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে অন্যান্য ফিলিস্তিনি নেতাদের মতোই মুফতি আমিনও বুঝতে পেরেছিলেন, এর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে অচিরেই ফিলিস্তিনকে ইহুদীদের হাত থেকে রক্ষা করার সর্বশেষ সুযোগও হাতছাড়া হয়ে যাবে। ফলে তিনি তার মধ্যপন্থী নীতি থেকে ধীরে ধীরে সরে আসেন এবং আন্দোলনের মাধ্যমে নিজেদের অধিকার আদায়ের পথ গ্রহণ করেন।
১৯৪৬ সালে স্থানীয় আরব গোত্রগুলোর প্রধানদের সাথে মিলে মুফতি আমিন আল-হুসেইনি আরব হায়ার কমিটি গঠন করেন। আরব হায়ার কমিটি ইহুদীদের অভিবাসন ঠেকানোর দাবিতে ফিলিস্তিন জুড়ে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়। তারা একইসাথে ব্রিটিশ প্রসাশনকে ট্যাক্স প্রদান বন্ধ করে দেওয়ার জন্যও ফিলিস্তিনের নাগরিকদেরকে নির্দেশ দেয়। মুফতির ডাকা ধর্মঘট খুব দ্রুতই রূপ নেয় আন্দোলন এবং সশস্ত্র বিদ্রোহে, যা আরব বিদ্রোহ নামে পরিচিত হয়। বিদ্রোহ দমনে ব্রিটিশরা বিপুল পরিমাণ সৈন্য নিয়োগ করে, যাদের সাথে যোগ দেয় ইহুদীদের গুপ্ত সন্ত্রাসী সংগঠন হাগানা এবং ইরগুনের সদস্যরাও। চার মাস ব্যাপী চলমান এ বিদ্রোহে প্রায় আড়াইশো ব্রিটিশ এবং তিনশ ইহুদীর বিপরীতে নিহত হয় অন্তত ৫ হাজার ফিলিস্তিনি এবং আহত হয় আরো ১৫ হাজার।
আরব বিদ্রোহের সময়ই ব্রিটিশদের সাথে মুফতি আমিনের সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি ঘটে। ১৯৩৭ সালে ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনকে ভাগ করার প্রস্তাব দিলে অন্যান্য ফিলিস্তিনি নেতার পাশাপাশি মুফতি আমিনও তা প্রত্যাখ্যাত করেন। ফলে ব্রিটিশ সরকার তাকে মুসলিম সুপ্রিম কাউন্সিল-এর সভাপতির পদ থেকে পদচ্যুত করে। তার নেতৃত্বাধীন আরব হায়ার কমিটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং এর নেতাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। মুফতি কিছুদিন হারাম শরিফের ভেতরে আত্মগোপন করে থাকেন এবং পরবর্তীতে ছদ্মবেশ ধরে লেবাননে পালিয়ে যান। পরবর্তী বছরগুলোতে তিনি সেখান থেকেই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন পরিচালনা করতে থাকেন।
দীর্ঘদিন ধরে চলমান আরবদের আন্দোলন সামাল দেওয়া ব্রিটিশদের জন্য কঠিন হয়ে উঠছিল। তাছাড়া সে সময় হিটলারের ইউরোপ আক্রমণের সম্ভাবনাও জোরালো হয়ে উঠছিল। ব্রিটিশরা বুঝতে পারছিল, তাদেরকে যদি ইউরোপের দিকে মনোনিবেশ করতে হয়, তাহলে ফিলিস্তিনে আরবদের দাবি-দাওয়া আংশিক হলেও মেনে নিতে হবে। ফলে ১৯৩৯ সালে ব্রিটিশরা একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে, যেখানে ফিলিস্তিনিদের অনেকগুলো দাবি মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। এই শ্বেতপত্রে ইহুদী অভিবাসন, ইহুদীদের জমি ক্রয়ের পরিমাণ প্রভৃতি সীমিত করে দেওয়া হয় এবং ফিলিস্তিনে একটি আরব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। মোটের উপর শ্বেতপত্রের শর্তগুলো আরবদের পক্ষে ছিল। তবে পক্ষে থাকলেও ব্রিটিশদের অতীতের প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করার সংস্কৃতির সাথে তিনি পরিচিত। তাই মুফতি এই শ্বেতপত্র প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে ব্রিটিশদের সাথে তার সমঝোতার পথ চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে পৃথিবী কার্যত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ এলাকাই তখন ছিল মিত্র শক্তিগুলোর দখলে। মুফতি আমিন সে সময় অবস্থান করছিলেন ব্রিটিশদের মিত্র ফরাসীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা লেবাননে। সেখানকার ফরাসী শাসকদের সাথে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটলে তিনি ইরাকে গিয়ে আশ্রয় নেন। এ সময় তিনি ইরাকের স্থানীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। তিনি ইরাকের ব্রিটিশ বিরোধী সরকারের সাথে মিত্রতা স্থাপন করেন এবং সেখান থেকে প্যান-আরব বিপ্লবের মাধ্যমে ফিলিস্তিন মুক্ত করার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। ইরাকের রাজনীতিবিদদের মধ্যস্থতায় এ সময় তিনি ব্রিটিশ-বিরোধী অক্ষ শক্তি, বিশেষ করে ইতালি এবং জার্মানির সাথে যোগাযোগ শুরু করেন। তার আশা ছিল, ফিলিস্তিন মুক্ত করার সংগ্রামে হয়তো তাদের সাহায্য পাওয়া যাবে।
মুফতির এসব কর্মকাণ্ড ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক শাসনের জন্য ছিল বড় ধরনের হুমকি। একইসাথে আরব বিপ্লবের ধারণাটি জর্ডাননসহ অন্যান্য ব্রিটিশদের মিত্র রাজপরিবারগুলোর জন্যও ভয়ের কারণ ছিল। ফলে জর্ডানের তৎকালীন আমীর আব্দুল্লাহ মুফতি আমিনকে হত্যার জন্য গুপ্তঘাতক নিয়োগ করেন। একই সময় ব্রিটিশরাও তাকে হত্যার সুযোগ খুঁজতে থাকে। তাকে হত্যার জন্য গুপ্তঘাতক প্রেরণ করে ফিলিস্তিনের জায়নবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন ইরগুনও। ফলে ইরাকে থাকা মুফতি আমিনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে। এ সময় ব্রিটিশরা পুনরায় আক্রমণ করে ইরাক দখল করে নিলে ১৯৪১ সালের শেষ দিকে মুফতি পারস্যে পালিয়ে যান। কিন্তু পারস্যও মিত্রবাহিনীর দখলে চলে গেলে তিনি প্রথমে ইতালিতে এবং পরবর্তীতে জার্মানিতে গিয়ে আশ্রয় নেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ শাসনের অধীনে থাকা বিভিন্ন দেশের অনেক রাজনৈতিক দল এবং অনেক ব্যক্তি অক্ষ শক্তির সাথে মিত্রতা স্থাপন করেছিলেন। তাদের অনেকেই হয়তো হিটলারের সব নীতির সাথে একমত ছিলেন না, কিন্তু দখলদার ব্রিটিশ বাহিনীকে পরাজিত করে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তাদের কাছে তখন জার্মানিই ছিল সবচেয়ে বড় কৌশলগত মিত্র। মুফতি আমিন আল-হুসেইনিও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলনে সহায়তার জন্য নাৎসি বাহিনীর সাথে মিত্রতা স্থাপন করেন। ১৯৪১ সালের ২৮ নভেম্বর তিনি হিটলারের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তাদের উভয়ের সাধারণ শত্রু ব্রিটিশ এবং জায়নবাদী ইহুদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে হিটলারের সহায়তা কামনা করেন।
মুফতি আমিনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা অর্জন। আর সেজন্যই তিনি ব্রিটিশদের শত্রু জার্মানদের সাথে মিত্রতা স্থাপন করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন অক্ষশক্তির কাছ থেকে বেলফোর ঘোষণার মতো পাল্টা একটি ঘোষণা আদায় করতে, যেখানে যুদ্ধ শেষে অক্ষশক্তির জয় হলে ফিলিস্তিনে আরব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার প্রতিশ্রুতি থাকবে। হিটলার অবশ্য তার এ প্রস্তাবে রাজি হননি, কারণ তিনি তখনো মধ্যপ্রাচ্যে ব্রিটিশ ও ফরাসীদের সাথে সংঘর্ষে যেতে আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু তিনি মুফতিকে আশ্রয় দিয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে ব্রিটিশ বিরোধী যুদ্ধে মুফতির প্রভাব এবং প্রচারণাকে কাজে লাগিয়েছিলেন।
জার্মানিতে থাকা অবস্থায় মুফতি আমিন নিয়মিত রেডিওতে আরবদের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ ও ইহুদী বিরোধী প্রচারণা চালাতেন। তিনি নাৎসিদের পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করার জন্য বসনিয়ার মুসলিমদেরকেও প্ররোচিত করেছিলেন এবং তাদের সমন্বয়ে একটি মুসলিম-প্রধান ব্রিগেড তৈরিতে ভূমিকা রেখেছিলেন। আরব-জার্মানদের কিছু যৌথ অপারেশনের পরিকল্পনাতেও মুফতির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
জার্মানিতে অবস্থানকালে নাৎসিবাহিনীর পক্ষে বিভিন্ন প্রচারণা এবং কিছু অপারেশনে অংশ নিলেও তিনি ইহুদীদের উপর গণহত্যায় সাহায্য করেছিলেন বলে কোনো প্রমাণ ইতিহাসে পাওয়া যায় না। বিশেষ করে হিটলারকে গণহত্যায় প্ররোচিত করার ব্যাপারে মুফতির বিরুদ্ধে যে অভিযোগ নেতানিয়াহু তুলেছিলেন, সেটি যে সম্পূর্ণ মিথ্যা, তা ইতিহাস থেকেই প্রমাণিত। হিটলারের সাথে মুফতির সাক্ষাতের অনেক আগেই লিথুয়ানিয়া এবং ইউক্রেইনে কয়েক লাখ ইহুদীকে হত্যা করা হয়েছিল। তাছাড়া বিশ্বযুদ্ধ শেষে ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালে মুফতি আমিনের বিরুদ্ধেও তদন্ত করা হয়েছিল। কিন্তু তার বিরুদ্ধে গণহত্যায় সহযোগী হিসেবে কোনো প্রমাণ পাওয়া না যাওয়ায় কোনো অভিযোগ গঠন করা হয়নি, কিংবা বিচারের সম্মুখীনও করা হয়নি।
তবে এ কথা সত্য যে, মুফতি আমিন জানতেন হিটলার ইহুদীদের উপর গণহত্যা চালাচ্ছিল। এবং সেটা জেনেও তিনি যুদ্ধে তার সাথে মিত্রতা স্থাপন করেছিলেন। তবে সেটি তিনি করেছিলেন ইহুদীদেরকে নির্মূল করার জন্য নয়, বরং ব্রিটিশদেরকে পরাজিত করে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য। তিনি বিশ্বমানবতার চেয়ে তার নিজের জনগণের স্বাধীনতাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন।
তবে তার রেডিওর ভাষণগুলো নিয়ে সমালোচনা আছে। যুদ্ধের সময় দেওয়া ভাষণগুলোতে তিনি জায়নবাদী এবং সাধারণ ইহুদীদের মধ্যে পার্থক্য করেননি। সকল ইহুদীদেরকেই উচ্ছেদ করতে এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ফিলিস্তিনিদেরকে আহ্বান জানিয়েছিলেন। তার এ ধরনের বক্তব্যের ফলেই পরবর্তীতে তার বিরোধীরা তাকে ইহুদী বিদ্বেষী এবং গণহত্যা সমর্থনকারী হিসেবে প্রচারণা চালানোর সুযোগ পায়।
মুফতি আমিন আল-হুসেইনির রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো কতটুকু সময়োপযোগী ছিল, তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে বিতর্ক আছে। অনেকেই মনে করেন, তার অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তই ভুল ছিল। প্রথম জীবনে তিনি জায়নবাদের বিস্তারের সুদূরপ্রসারী প্রভাব বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন এবং ব্রিটিশদের সাথে সমঝোতায় গিয়ে জায়নবাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। পরবর্তীতে ব্রিটিশদের প্রস্তাবিত শ্বেতপত্রের সুযোগ গ্রহণ করতেও তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। সর্বশেষ তিনি হিটলারের পক্ষ অবলম্বন করে নিজেকে আন্তর্জাতিকভাবে কিছুটা হলেও বিতর্কিত করেছেন।
তবে পশ্চিমা গণমাধ্যম এবং ইতিহাসবিদরা মুফতি আমিনকে গণহত্যায় সহযোগী হিসেবে দেখাতে চাইলেও এবং তার কৃতিত্বকে খাটো করতে চাইলেও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামে তার প্রভাব অনস্বীকার্য। যুদ্ধের পর বাকি জীবনের অধিকাংশ সময়ই তার কেটেছিল মিসরে নির্বাসিত অবস্থায়। সেখান থেকেই তিনি ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তার প্রভাব ব্যবহার করে মিসরকে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। মুফতি আমিনের সংগ্রাম অনুপ্রাণিত করেছে পরবর্তীকালের ফিলিস্তিনের জাতীয়তাবাদী নেতাদেরকেও। ফিলিস্তিনি মুক্তি সংগ্রামের নেতা ইয়াসির আরাফাত, যিনি নিজেও বৃহত্তর হুসেইনি পরিবারের সদস্য, মুফতি আমিনকে তার আদর্শ এবং নায়ক হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
ফিচার ইমেজ: Wikimedia Commons