১৯৪১ সাল। চারদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উন্মাদনা। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে শোক, বীরত্ব, হার-জিতের হাজারো গাঁথা। চলছে অনুপ্রবেশ, দখল আর প্রতিরক্ষার লড়াই। ইতিহাস কালজয়ী এমন অনেক ঘটনার সাক্ষী। ফ্রান্সের নরম্যান্ডিতে মিত্রবাহিনীর অবতরণ, মিডল্যান্ডের বিমান লড়াই, নাৎসি শিল্পপতি অস্কার শিন্ডল্যারের সহায়তায় ১২০০ ইহুদীর প্রাণরক্ষা এমন কতশত ঘটনাই না ইতিহাসবেত্তারা স্মরণে রেখেছেন। কিন্তু আবহমান কালের খরস্রোতে যুদ্ধবন্দী বাতানের সেবিকাদের অবদান ও ত্যাগের কথা কি কারো মনে পড়ে? এই লেখা বাতানের সেই ৭৭ জন যোদ্ধা সেবিকাদের নিয়ে যারা আজ থেকে ৮০ বছর পূর্বে যুদ্ধ বিধ্বস্ত মানবহৃদয়ে দেবীর স্থান দখল করেছিলেন।
ঘটনাস্থল ফিলিপাইনের ‘বাতান’ দ্বীপ। মার্কিন সেনা ও নৌ বাহিনীর সেবিকা (Nurse) দলের ৭৭ জন সদস্য জাপানি সৈন্যদলের হাতে যুদ্ধবন্দী হিসেবে ধরা পড়েন। যুদ্ধবন্দী হিসেবে ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলায় স্থানান্তর করার পর সেবিকার দল শুধুমাত্র যে নিজেদের মানসিক শক্তির কঠিন পরীক্ষা দিয়েছেন তা নয় বরং যুদ্ধবন্দী ও আহত সৈন্যদের সেবার অপরূপ দৃষ্টান্তও দেখিয়েছেন। ইতিহাসের পাতায় ব্যাটেলিং বেলেস নামে তারা পরিচিত ।
কেমন ছিলো ফিলিপাইনের যুদ্ধক্ষেত্রে সেই সেবিকাদের সংগ্রাম?
সামরিক ইতিহাসবেত্তা ও ফিলিপাইন সমরাস্ত্র জাদুঘরের প্রাক্তন তত্ত্বাবধায়ক হোসে কোস্তাদিয়ো (Jose Custodio) এর ভাষ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী ও নৌবাহিনীতে কর্মরত সেবিকাদের দল প্রথম যখন ফিলিপাইনে পৌঁছায় সেসময় ফিলিপাইনকে তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য Pearl of the Orient বা প্রাচ্যের মুক্তা বলা হতো। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ফিলিপাইনে মিত্রবাহিনীর দখল বজায় থাকায় প্রাথমিক অবস্থায় সেবিকারা যেন একরকম ছুটি কাটাচ্ছিলেন। সেবিকাদের প্রথম ঠিকানা ছিল তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের নৌঘাঁটি ক্যাভিটের স্যাংলি পয়েন্টের কানকৌউ নৌ হাসপাতাল ও স্টার্নবার্গ
জেনারেল হাসপাতাল, ম্যানিলা। মার্কিন লেখিকা এলিজাবেথ নর্ম্যান তার প্রকাশিত বই, “We Band of Angels: The Untold Story of American Nurses Trapped on Bataan by the Japanese” এ লিখেছেন, “সেসময় বাতানে অবস্থানরত সেবিকাদের তেমন কোনো কাজের চাপ ছিলো না। দিনের অনেকটা সময়ই তারা গলফ খেলে, রৌদ্রস্নান করে বা ফিলিপিনো গৃহকর্মীদের ব্যতিব্যস্ত করেই কাটিয়ে দিতেন। কিন্তু সেবিকাদের অলস ও সুখে সময় কাটানোর মেয়াদ যেন হঠাৎ করেই ফুরিয়ে যায়।
কেমন ছিল সেসব দিন? তার বিবরণ পাওয়া যায় ফিলিপাইনে দায়িত্বরত যোদ্ধা সেবিকা জোসেফিন নেসবিটের বয়ানেও। সামরিক সেবিকা দলের সদস্যরূপে এটি ছিলো জোসেফিনের দ্বিতীয়বারের মতো ফিলিপাইন ভ্রমণ।
ডিসেম্বর ৮ সাল ১৯৪১। ঘটনাস্থল ম্যানিলার স্টার্নবার্গ হাসপাতাল। রাত্রিকালীন দায়িত্ব শেষ করে জোসেফিন বিশ্রাম নিতে যাচ্ছিলেন। খবর আসলো মার্কিন নৌঘাঁটি পার্ল হারবার জ্বলে উঠেছে জাপানের রাজকীয় বিমানবাহিনীর চোরাগোপ্তা বোমা হামলায়। ১৯টি রণতরী বিধ্বস্ত। হাজারের উপর সেনাসদস্য ও নাবিক নিহত। এই সংবাদে শিউরে ওঠেন সেবিকারা। আতঙ্কিত সেবিকাদের জোসেফিন বিশ্রামে পাঠান। কারণ তিনি আশঙ্কা করেছিলেন এবার হয়তো তাদের মুখোমুখি হতে হবে হাজারো আহত ও বিপর্যস্ত সৈনিকের।
যাদের দায়ভার নিতেই এসেছেন এই সেবিকারা। জোসেফিনের আশঙ্কা অমূলক ছিলো না। পার্ল হারবার হামলার মাত্র ১০ ঘন্টা পর জাপান রাজকীয় বিমানবাহিনীর ধ্বংসাত্মক বোমা হামলার আঁচ এসে পৌঁছায় ফিলিপাইনের মিত্রবাহিনী অধ্যুষিত এলাকায়। মূহুর্মূহু বোমা হামলায় কেঁপে উঠে ম্যানিলা। বিমান হামলায় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় লুজান দ্বীপের ক্লার্ক বিমানঘাঁটিও। ক্লার্ক বিমানঘাঁটি থেকে নিয়ে আসা শতের উপর আহত সৈনিকের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়েন সেবিকারা।
পরবর্তী ৪টি বছর ৫৭ বছর বয়সী মার্কিন সামরিক বাহিনীর ক্যাপ্টেন মড ডেভিডসন ও ৪৯ বছর বয়সী নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট লরা কবের নেতৃত্বে টিকে থাকার লড়াইয়ে লিপ্ত হয় ৮৮ জন সামরিক ও ১১ জন নৌ সেবিকা।
ঠিক তিন সপ্তাহ পর ইংরেজি নববর্ষের প্রথম রাতে এই সাহসী সেবিকারা ২২৪ জন ফিলিপিনো ও মার্কিন সেনাকে ৯২ জন বেসামরিক সদস্য সহ এস.এস মাকটান নামক অস্ট্রেলিয়াগামী জাহাজে তুলে দিতে সক্ষম হয়। তাদের সাথে যোগ দেন দুইজন যোদ্ধা সেবিকা। বাকিরা থেকে যান ক্যাভাইট ও ম্যানিলায়।
যখন জেনারেল ডগলাস ম্যাকআর্থার মিত্রবাহিনীকে বাতান ও করিগেডর দ্বীপপুঞ্জে সাময়িক পিছু হটার নির্দেশ দেন, তখন প্রথমবারের মতো সামরিক বাহিনীতে নিয়োজিত যোদ্ধা সেবিকাদের বাতানের যুদ্ধক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনে প্রেরণ করা হয়। নৌ বাহিনীর নিয়োজিত যোদ্ধা সেবিকারা ম্যানিলার স্টার্নবার্গ জেনারেল হাসপাতালে পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায় রয়ে যায়। কিন্তু ভাগ্যের বিড়ম্বনায় নির্দেশ আসার পূর্বেই জাপান সামরিক বাহিনী ম্যানিলা দখল করে নেয়। দিনটি ছিলো জানুয়ারির ২ তারিখ, ১৯৪২ সাল।
বাতানের যোদ্ধা সেবিকা যারা সামরিক বাহিনীর দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন, তারা যুদ্ধক্ষেত্রের স্যাঁতস্যাঁতে ও উষ্ণ জঙ্গলে একটি ফিল্ড হাসপাতাল নির্মাণ করেন। প্রাথমিক অবস্থায় তাদের লড়াই ছিলো মশা, ম্যালেরিয়া ও আমাশয়ের বিরুদ্ধে। এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও তারা সেবা করে চলেছিলেন আহত সৈনিকদের। খোলা আকাশের নিচে যুদ্ধে আহত সৈনিকদের জন্য পাতা ছিলো সারিবদ্ধ বিছানা। খোলা আকাশের নিচে খোলা হয়েছিলো ১৮টি ওপেন ওয়ার্ড। মাত্র ৪ মাসের ব্যবধানে ৬,০০০ আহত সৈনিকের চিকিৎসায় সহায়তা করতে হয়েছিলো সামরিক সেবিকাদের। এমনও সময় গিয়েছে যে, আহত সৈনিকদের ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় অনবরত বোমার আঘাতের মোকাবেলা করতে হয়েছে।
চরম প্রতিকূল পরিস্থিতির মাঝেও ফার্স্ট লেফটেন্যান্ট জোসেফিন নেসবিট নিজ কর্তব্য হতে বিচ্যুত হননি। যখন খাদ্য ভান্ডারে টান পড়ে তিনবেলার খাবারের মজুত দুই বেলায় এসে ঠেকে, সেই মুহূর্তেও জোসেফিন ও তার তত্ত্বাবধানে থাকা যোদ্ধা সেবিকারা অনাহারে- অর্ধাহারে আহতদের সেবা করে যান। যোদ্ধা সেবিকাদের কাছে জোসেফাইন ছিলেন সঞ্জীবনীর উৎস যার অনুপ্রেরণায় কেটে যেতো শত ক্লান্তি, দায়িত্বে থাকা যেতো অবিচল।
১৯৪২ সালে এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধে প্রতিপক্ষের জোরালো আক্রমণে মিত্রবাহিনী বাতান হতে পিছু হটে ম্যানিলা সৈকতের কোরিগেডর দ্বীপপুঞ্জে আশ্রয় নেয়। যোদ্ধা সেবিকাদের নতুন কর্মক্ষেত্র হয় ম্যালিন্টা সুড়ঙ্গের অভ্যন্তরে ভূগর্ভস্থ হাসপাতাল। এপ্রিলের ৯ তারিখে বাতানের মিত্রবাহিনীর দ্বারা বিতাড়িত মার্কিন সৈন্যদল প্রতিপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
১৯৪২ সালের ৩ মে, ১২ জন যোদ্ধা সেবিকা ইউএসএস স্পিয়ার ফিস সাবমেরিনে চড়ে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমান। বাকিরা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে থেকে যান ম্যালিন্টা সুড়ঙ্গে আহতদের সেবায়। এদিকে দ্বীপের উপরিভাগে জাপানি বিমানবাহিনীর ক্রমাগত বোমাবর্ষণ অব্যাহত থাকে। অবশেষে মে মাসের ৬ তারিখে কোরিগেডর দ্বীপপুঞ্জে প্রতিপক্ষ জাপানী সামরিক বাহিনীর হাতে মিত্রবাহিনীর পতন ঘটে। এদিকে সকল মার্কিন সৈন্য ও যোদ্ধা সেবিকারা যুদ্ধবন্দী হয়ে পড়েন।
যুদ্ধবন্দী হিসেবে তাদের স্থান হয় ম্যানিলার সান্তো টোমাস বন্দী শিবিরে। সেখানে ফার্স্ট লেফটেন্যান্ট জোসেফিনের সাথে সাক্ষাত ঘটে তার পূর্বতন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন মড ডেভিডসনের। বন্দী শিবিরে তারা দুইজন একত্রিত হয়ে যুদ্ধবন্দীদের জন্য হাসপাতাল পরিচালনা করেন। জাপানী সৈন্যরা যুদ্ধবন্দীদের শাস্তি স্বরূপ প্রতিদিনের খাবারে ৭০০ ক্যালরি কমিয়ে দেয়। কিন্তু তাতেও তারা সেবিকাদের মনোবল ভাঙ্গেনি। ক্যালরির অভাব পূরণের জন্য তারা মাটি, গাছের শিকড়, ফুল ও কোল্ড ক্রিমের মিশ্রণ ব্যবহার করতেন।
যুদ্ধবন্দী থাকাকালে তাদের স্মরণ করে হলিউডে নির্মিত হয় দেশপ্রেম ও রোমান্টিক ঘরানার বেশ কিছু চলচ্চিত্র। এমনই একটি চলচ্চিত্র হলো অভিনেত্রী ক্লডেট কোলবার্ট অভিনীত So Proudly We Hail। কিন্তু চলচ্চিত্র থেকে বাস্তবতার গল্পটি বেশ ভিন্ন ছিলো বলেই দাবী করেন ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা হেলেন ক্যাসিয়ানি নেস্টর। ১৯৯৯ সালে সাংবাদিকদের সাথে সাক্ষাতকারকালীন তিনি বলেন, যুদ্ধবন্দী হিসেবে থাকার মাঝে কোনো রোমান্টিকতা নেই। তবুও জাতির জানা উচিত যুদ্ধক্ষেত্রেও নারীরা তাদের দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করতে সক্ষম।
১৯৪৫ সালের জানুয়ারিতে মিত্রবাহিনী জাপানী সৈন্য বাহিনীকে পরাজিত করে পুনরায় ফিলিপাইন দখল করে। তার কিছুদিন পর সকল যুদ্ধবন্দীর সাথে জোসেফিন, ডেভিডসন, ক্যাসিয়ানি সহ মোট ৭৭ জন যোদ্ধা সেবিকা মুক্তিলাভ করেন। হাজারো অত্যাচারের মাঝেও হার মানেননি তারা, বেঁচে ছিলেন শেষ পর্যন্ত, যেখানে হাজারো মার্কিন ও ফিলিপিনো সৈন্য মৃত্যুর কাছে হার মেনেছেন।