২০১৮ সালের ২৬ জানুয়ারি আল-কায়েদার ঘাঁটিতে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল দক্ষিণ ইয়েমেনের আল-সাইদ এলাকার এক ১৪ বছর বয়সী কিশোর, আব্দুল্লাহ সালেহ বিন আলউইয়া। তার অন্তর্ধান রহস্য এবং তার সন্ধানে তার পরিবারের অভিযানের এ ঘটনাটি তদন্ত করেছেন বার্তাসংস্থা এপির মিসরীয় অনুসন্ধানী সাংবাদিক ম্যাগি মাইকেল এবং ইয়েমেনি ভিডিও প্রতিবেদক মাদ আল-জিকরি।
পুলিৎজার পুরস্কার জয়ী এই প্রতিবেদনটি অবলম্বনে আব্দুল্লাহর কাহিনী নিয়ে পড়ুন আমাদের তিন পর্বের সিরিজের দ্বিতীয় পর্ব। আর সবগুলো পর্ব পড়তে পারবেন এখান থাকে: ১ম পর্ব, ২য় পর্ব, ৩য় পর্ব।
আব্দুল্লাহর বাবার নাম সালেহ বিন আলউইয়া। পেশায় তিনি একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার। সাবধানতার জন্য রাতের বেলা তিনি ট্যাক্সি নিয়ে চলাফেরা করতেন না। কিন্তু দিনের বেলা কখনো কখনো ট্যাক্সি নিয়ে দক্ষিণ ইয়েমেনের সবচেয়ে বড় শহর এডেন পর্যন্তও চলে যেতেন। চার বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধের প্রভাবে দরিদ্র রাষ্ট্র ইয়েমেনে যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষ অর্ধাহারে, অনাহারে দিন কাটাচ্ছে, সেখানে এই ট্যাক্সিটির কল্যাণে সালেহ তার পরিবার নিয়ে মোটামুটি ভালোভাবেই দিন অতিবাহিত করছিলেন।
মোহসানা ও সালেহ দম্পতির ছেলেমেয়ে মোট আটজন। চার ছেলে আর চার মেয়ে। সালেহ তার ৮ বছর বয়সী ছোট ছেলে আব্দুস সালাম বাদে বাকি সব ছেলেকেই গাড়ি চালানো শিখিয়েছেন। কিন্তু তিনি চাইতেন না আব্দুল্লাহ তার মতো ট্যাক্সি ড্রাইভার হোক। তিনি সব সময় আব্দুল্লাহকে পড়াশোনার জন্য তাগিদ দিতেন। তিনি আব্দুল্লাহকে বলতেন, “তুমি শুধু মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা কর, সংসারের চিন্তা তোমাকে করতে হবে না।”
আব্দুল্লাহ ছিল মোহসানা ও সালেহ দম্পতির মিরাকল চাইল্ড। আব্দুল্লাহ যখন গর্ভে, তখন মোহসানার কিছু শারীরিক জটিলতা ছিল। সাত মাস গর্ভধারণের পর তিনি জমজ সন্তানের জন্ম দেন। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই একটি ছেলে মারা যায়। তার শারীরিক অবস্থাও ছিল আশঙ্কাজনক। তাছাড়া হাসপাতালে সে সময় কোনো ইনকিউবেটরও ছিল না। ডাক্তাররা মোটামুটি নিশ্চিত ছিলেন, আব্দুল্লাহও বেশিদিন বাঁচবে না।
কিন্তু আব্দুল্লাহ বেঁচে গিয়েছিল। মোহসানা তাকে সারাক্ষণ পরম যত্নে আগলে রাখতেন। কাউকে তার কাছে ভিড়তে দিতেন না। তিনি তাকে শহরের দোকান থেকে কেনা বেবি ফর্মুলা খাওয়াতেন। তাকে উষ্ণ রাখার জন্য শরীরে মাখন মেখে দিতেন এবং তুলা দিয়ে জড়িয়ে রাখতেন। ছয়মাস পরম যত্নে লালন-পালনের পর অবশেষে আব্দুল্লাহর জীবনের শঙ্কা কেটে যায়। কিন্তু ১৪ বছর পর তাদের সেই আদরের ছেলেই আজ নিঁখোজ।
বেলা ১০টার পর থেকেই আব্দুল্লাহর বাবা-মা আশেপাশের গ্রামগুলোতে খোঁজ করতে শুরু করেন। তারা প্রাদেশিক রাজধানী আতাক শহরে বসবাসরত পরিচিতজনদেরকেও ফোন করেন কেউ আব্দুল্লাহকে দেখেছে কিনা জানার জন্য। কিন্তু না, কেউ আব্দুল্লাহ সম্পর্কে কিছু জানে না। শেষপর্যন্ত তারা সিদ্ধান্ত নেন, তারা নিজেরাই শহরে যাবেন আব্দুল্লাহকে খুঁজতে।
দুপুরের দিকে আব্দুল্লাহর বড় ভাই জায়েদ এবং এক ভগ্নীপতি নাবিল বের হয় আব্দুল্লাহকে খুঁজতে। তারা দুজনেই ইয়েমেনি সেনাবাহিনীর সদস্য। দুজনেই হুথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধের ফ্রন্টলাইন থেকে এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে বাড়িতে এসেছিল। যাত্রাপথে তারা প্রতিটি সেনাচৌকিতে থেমে আব্দুল্লাহর চেহারার বর্ণনা দিয়ে জিজ্ঞেস করতে থাকে কেউ এরকম একটি ছেলেকে দেখেছে কিনা।
কয়েকটি চেকপয়েন্ট পার হওয়ার পর আতাক শহরের শেষ প্রান্তের একটি চেকপয়েন্টে কর্মরত এক সেনা সদস্য জানাল, সে এরকম একটি ছেলেকে একটা জীপে করে যেতে দেখেছে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল জায়েদ এবং নাবিল। তারা অন্তত এটা নিশ্চিত হতে পেরেছে যে, আব্দুল্লাহ জীবিত অবস্থাতেই এতদূর এসেছিল।
খবর শুনে আব্দুল্লাহর বাবা সালেহ তার ট্যাক্সি নিয়ে আতাক শহরে চলে আসেন। তার সাথে যোগ দেয় তাদের আত্মীয়-স্বজনদের অনেকে। তারা আতাকের আশেপাশের বাজারে, ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে, রাস্তায় রাস্তায়, অলিতে-গলিতে আব্দুল্লাহর সন্ধানে অভিযান চালায়। কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে আসার পরেও কোনো সন্ধান না পেয়ে ব্যর্থ হয়ে তারা সালেহ’র এক ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে ওঠে।
মোহসানা বাসায়ই ছিলেন। জায়েদ তাকে ফোন করে জানায়, এখনও আব্দুল্লাহর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। মোহসানা তাকে উপদেশ দেন, রাতটা অপেক্ষা করার জন্য। কারণ রাতের বেলা অচেনা পাহাড়ি এলাকায় চলাফেরা করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তার ভাষায়, “অঘটনগুলো সব রাতের বেলাতেই ঘটে।”
ওদিকে আব্দুল্লাহ তখন আরো দূরে মুসাইনা শহরের পাহাড়ের উপর আল-কায়েদার ঘাঁটিতে ঘুমানোর চেষ্টা করছে। ঘুমানোর আগে এক আল-কায়েদা সদস্য তাকে এবং তার বন্ধুকে একটি মোবাইল ফোন দিয়েছিল তাদের বাবা-মায়ের কাছে মেসেজ পাঠানোর জন্য। আব্দুল্লাহ লিখেছিল, “আমি আল-কায়েদার সাথে আছি। কাল সকালেই ফিরে আসব। আমার খোঁজে এসো না তোমরা।”
ম্যাসেজটি আব্দুল্লাহর বাবার ফোনে এসে পৌঁছার সাথে সাথেই তিনি ঐ নম্বরে কল ব্যাক করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ততক্ষণে আল-কায়েদা সদস্যটি তার ফোন বন্ধ করে দিয়েছে। সালেহ সিদ্ধান্ত নিলেন, তাদেরকে এখনই আল-কায়েদার ঘাঁটিতে গিয়ে আব্দুল্লাহকে উদ্ধার করতে হবে। কারণ যত দেরি হবে, আব্দুল্লাহকে ফিরিয়ে আনার সম্ভাবনা ততই হ্রাস পেতে থাকবে।
একবার কেউ আল-কায়েদার হাতে গিয়ে পড়লে সেখান থেকে উদ্ধার পাওয়া খুবই কঠিন। তাকে হয়তো ব্রেইন ওয়াশ করে হুথিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পাঠানো হবে অথবা বুকে বোমা বেঁধে আত্মঘাতী হামলা করতে পাঠানো হবে। এসব কিছু না ঘটলেও হয়তো আমেরিকান ড্রোনের আঘাতেই তার মৃত্যু ঘটবে। সালেহ’র এক ভ্রাতুষ্পুত্রের ভাষায়, “আল-কায়েদার ঘাঁটি থেকে সবগুলো পথই যায় মৃত্যুর দিকে!”
স্ত্রীর নিষেধ সত্ত্বেও সেই রাতের বেলাই সালেহ আবার তার ট্যাক্সিতে গিয়ে উঠলেন। সাথে এলো জায়েদ, নাবিল এবং তার দুই ভ্রাতুষ্পুত্র আলি ও খালেদ। তখনো অল্প কিছু দোকান-পাট খোলা ছিল। সেখান থেকে খোঁজ-খবর নিয়ে তারা বুঝতে পারলেন, ছেলে দুইটিকে মুসাইনা শহরের পাহাড়ের উপর আল-কায়েদার ঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
সালেহ জীবনে কখনো মুসাইনা শহরে যাননি। সেখানে তার ছেলেকে খুঁজে বের করার জন্য বা খুঁজে পেলেও আল-কায়েদার কাছ থেকে ছাড়িয়ে আনার জন্য যে স্থানীয় প্রভাব প্রয়োজন, সেটা সালেহ’র ছিল না। তবে মুসাইনা শহরের আশেপাশের অল্প কিছু পরিবারের সাথে তার পূর্ব পরিচয় ছিল। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, সেই পরিবারগুলোর একটি, আল-তোলসি পরিবারের কাছে গিয়ে তিনি সাহায্য চাইবেন।
আল-তোলসি পরিবারের ভাইদের মধ্যে একজনের আল-কায়েদার সাথে সম্পর্ক ছিল। কিন্তু সালেহ এবং তার আত্মীয়রা যখন তাদের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছলেন, তখন সে ঘরে ছিল না। ছিল তাদের অপর ভাই, মোবারক। মোবারকের আল-কায়েদার সাথে কোনো সম্পর্ক ছিল না। সে মৌমাছি চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করত। একইসাথে সে ছিল স্থানীয় মসজিদের মুয়াজ্জিন।
মোবারক তাদেরকে আমন্ত্রণ জানাল। রাতের খাবার খেতে বসে সালেহ তাকে ব্যাখ্যা করলেন তারা কেন এসেছেন এবং কী চান। মোবারক তাদেরকে সাহায্য করতে রাজি হলো। সে বলল, রাতে বের হওয়া ভীষণ বিপজ্জনক। তবে পরদিন সকালেই সে তাদেরকে নিয়ে আল-কায়েদার ঘাঁটিতে গিয়ে আব্দুল্লাহকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে।
কিন্তু সালেহ ছিলেন নাছোড়বান্দা। তিনি বারবার তাকে অনুরোধ করতে লাগলেন সেই রাতেই বের হওয়ার জন্য। সকালে গেলে হয়তো আব্দুল্লাহকে আর না-ও পাওয়া যেতে পারে। তার পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত রাজি হলো মোবারক। তার সাথে যোগ দিল স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগে অধ্যয়নরত তার এক ভ্রাতুষ্পুত্র, নাজিব। রাত দশটার সময় শুরু হলো তাদের যাত্রা।
মুসাইনা শহরের শেষ প্রান্তে, আল-কায়েদার পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছে তারা আল-কায়েদার এক স্থানীয় প্রহরীকে খুঁজে বের করল। সে ছিল মোবারকের গোত্রেরই সদস্য। তার মাধ্যমে মোবারক পাহাড়ের উপরের ঘাঁটিতে সংবাদ পাঠাল, পাশের শহর থেকে তার এক বন্ধু এসেছে যে তার ছেলেকে ফেরত চায়।
প্রহরীটি তাদের বার্তা নিয়ে উপরে চলে গেল। আর পাহাড়ের নিচে ট্যাক্সির ভেতর অপেক্ষা করতে লাগল সালেহ ও মোবারকসহ তাদের সাত সদস্যের অনুসন্ধানী দলটি। দূর আকাশে মার্কিন ড্রোনটি তখনও মৃদু গুঞ্জনে উড়ে চলছে বিরতিহীন।
কী ঘটেছিল সালেহদের ভাগ্যে? তারা কি আব্দুল্লাহকে ফিরে পেয়েছিল? সে প্রশ্নের উত্তর আমরা জানব এই সিরিজের তৃতীয় এবং সর্বশেষ পর্বে। আর সবগুলো পর্ব পড়তে পারবেন এখান থাকে: ১ম পর্ব, ২য় পর্ব, ৩য় পর্ব।