জৌলুস হারিয়েছে আব্বাসীয় খিলাফত। সেই বীরত্ব আর বিশাল সাম্রাজ্য তাদের আর নেই। সাম্রাজ্যের মধ্যে একাধিক স্বাধীন রাজ্যের বিস্তার ঘটেছে। এ সমস্ত রাজ্য আর দুর্বল হয়ে পড়া আব্বাসীয় খিলাফতের অধীনে থাকতে রাজি নয়। নিজেদেরকে স্বাধীন বলে ঘোষণাও দিয়েছেন অনেকে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড়, শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ খাওয়ারিজম সাম্রাজ্য। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-সাহিত্য, অর্থনীতি এবং আধুনিকতায় মুসলিম বিশ্বের মধ্যে খাওয়ারিজম সাম্রাজ্য তখন সবচেয়ে উঁচু অবস্থানে।
খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যের শাসক তখন সুলতান আলাউদ্দিন খাওয়ারিজম শাহ। এ সাম্রাজ্যের সীমানা পৌঁছে গেছে আব্বাসীয়দের রাজধানী বাগদাদের অতি সন্নিকটে। তাই আব্বাসীয়রা খাওয়ারিজমদের দেখে ভীত ও শঙ্কিত হয়ে পড়ল। আব্বাসীয় খলিফা নাসির তখন সুলতান আলাউদ্দিনের সাথে জড়িয়ে পড়লেন প্রকাশ্য বিরোধে।
১২১৯ সালের ঘটনা। মঙ্গোলিয়ান স্তেপ থেকে লুটেরা গোত্রগুলোকে একত্র করে পৃথিবীর ইতিহাসে এক অন্ধকার অধ্যায়ের সূচনা করলেন চেঙ্গিস খান। দুর্ধর্ষ ও বর্বর এই মঙ্গোলরা তখন মধ্য এশিয়ার অনেক অঞ্চল দখল করে নিয়েছে। মঙ্গোলদের বর্বরতা এত বেশি ছিল যে সেকালের কোনো এক ভাষাবিদ তাদের পৈশাচিকতা দেখে বলেছিলেন,
তারা এলো, সবকিছু খুঁড়ে ফেলল, জ্বালিয়ে দিল, লুটে নিল, এরপর চলে গেল।
এই একটি বাক্যের মধ্য দিয়েই মঙ্গোলদের ভয়াবহতা সম্পর্কে অনুধাবন করা যায়।
খাওয়ারিজম সাম্রাজ্য যখন জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং প্রভাব-প্রতিপত্তিতে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন আব্বাসীয় খলিফা নাসির শঙ্কিত হয়ে উঠলেন। প্রতিপক্ষকে দমন করতে আশ্রয় নিলেন ঘৃণ্য এক পদক্ষেপের। খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর জন্য খলিফা নাসির চিঠি লিখলেন চেঙ্গিস খানের কাছে।
আগে থেকেই সুলতান আলাউদ্দিনের সঙ্গে শত্রুতা ছিল চেঙ্গিস খানের। এবার তিনি সুযোগ পেয়ে বসলেন। মঙ্গোলিয়ান স্তেপ থেকে উঠে আসা দুর্ধর্ষ ও লুটেরা বাহিনীগুলোকে একত্র করে গড়ে তোলা হয়েছে মঙ্গোল বাহিনী। বর্বরতা চালিয়ে একের পর এক খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধ শহরগুলোকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে থাকল তারা। মুসলিম সাম্রাজ্যগুলোতে শুরু হয়ে গেল ইয়াজুজ-মাজুজ আতঙ্ক। প্রতিরোধ দূরে থাক, আতঙ্কে পালিয়ে যেতে লাগল সবাই। মঙ্গোলদের মনে করা হলো অপরাজেয়। সুলতান আলাউদ্দিন নিজেও রেহাই পাননি মঙ্গোল-আতঙ্ক থেকে। বছরের পর বছর ধরে মঙ্গোলদের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়িয়েছেন তিনি। শেষপর্যন্ত তার মৃত্যুও হয় পলাতক অবস্থায়, কাস্পিয়ান সাগরের এক নির্জন দ্বীপে।
মৃত্যুর আগে পুত্র জালালুদ্দিনকে তিনি সুলতান ঘোষণা করে যান। ক্ষমতা গ্রহণ করেই জালালুদ্দিন স্রোতের বিরুদ্ধে মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যের আহ্বান জানান, সেনা সংগ্রহ শুরু করে দেন। তিনি তার পিতার মতো ভীতু ছিলেন না। কিছুদিন শাসনকার্য পরিচালনা করার পর তার ভাই রোকনুদ্দিন ক্ষমতার জন্য বিদ্রোহ করেন। জালালুদ্দিন ভাইয়ের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে আফগানিস্তানের পথ ধরলেন।
বিভিন্ন শহর ঘুরে তিনি সৈন্য সংগ্রহ করতে থাকেন। চেঙ্গিস খানের বিরুদ্ধে মুসলিমদের এক করতে থাকেন। এ খবর পৌঁছে যায় চেঙ্গিস খানের কাছে। তিনি বুঝতে পারেন, সুলতান আলাউদ্দিনের মতো তার পুত্র জালালুদ্দিনের সঙ্গে লড়াই করা এতটা সহজ হবে না। সুলতান জালালুদ্দিনও বুঝতে পারছিলেন, চেঙ্গিস খানের সঙ্গে মুখোমুখি লড়াই করে তাকে শিক্ষা দেওয়ার আগে মঙ্গোলদের অগ্রযাত্রা থামানো যাবে না। কিন্তু প্রাণান্ত চেষ্টা করেও সুলতান তখন পর্যন্ত কয়েক হাজারের বেশি সৈন্য সংগ্রহ করতে পারেননি।
এ সময় সুলতান আমু দরিয়ার পাড় ধরে সিস্তান, বলখ এবং কান্দাহার অঞ্চলে ভ্রমণ করেন। মঙ্গোলদের একটি দল কান্দাহার অবরোধ করলে সুলতানের বাহিনী নিঃশব্দ চিতার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের উপর। অতর্কিত হামলায় দিশেহারা হয়ে মঙ্গোলরা পালাতে থাকে। পালানোর রাস্তাতেও সুলতানের বাহিনী মোতায়েন করা ছিল। এ যুদ্ধে প্রায় সকল মঙ্গোল সেনা নিহত হয়। এটাই ছিল মুসলমানদের হাতে মঙ্গোলদের প্রথম পরাজয়।
এরপর সুলতান জালালুদ্দিন তার সৈন্য বাহিনী নিয়ে গজনি অভিমুখে রওনা দেন। এখানে স্থানীয় কয়েকজন শাসক সেনাবাহিনী নিয়ে যোগ দেয় সুলতানের সাথে। সব মিলিয়ে সুলতানের বাহিনীতে তখন সমবেত হয় প্রায় লক্ষাধিক সৈন্য। এদিকে কান্দাহারের পরাজয়ের কথা কানে গেলে তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন চেঙ্গিস খান। সময় নষ্ট না করে তিনি বিশাল এক মঙ্গোল বাহিনীকে পাঠান গজনি অভিমুখে।
সুলতান জালালুদ্দিন সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। তিনি অবলম্বন করলেন এক ভিন্ন পদ্ধতি। প্রত্যেকবার মঙ্গোলরা আক্রমণ করেছে, আর সুলতান প্রতিরোধ করেছেন। কিন্তু সুলতান সিদ্ধান্ত নিলেন, এবার তারা মঙ্গোলদের উপর প্রথম অতর্কিত হামলা চালাবেন। সুলতান তার বাহিনী নিয়ে গজনি থেকে বের হয়ে ‘বলক’ নামক স্থানে মঙ্গোলদের মুখোমুখি হলেন। মঙ্গোলদের সৈন্যসংখ্যা ছিল সুলতানের সেনার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।
যে আতঙ্কে কাঁপছে সমগ্র বিশ্ব, যারা ইউরোপ থেকে চীন এবং আরাল সাগর থেকে ইরাক পর্যন্ত তৈরি করেছে মৃত্যুর বিভীষিকা, সাক্ষাৎ সেই আতঙ্কের সামনে অস্ত্রের ঝনঝনানি তুলে দিলেন সুলতান জালালুদ্দিন। শুরু হয়ে গেল তুমুল যুদ্ধ। কয়েকদিন ধরে যুদ্ধ চলার পরেও জয়ের পাল্লা কোনোদিকে হেলে পড়ল না। চতুর্থ দিন তীব্র আক্রোশ নিয়ে একে অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সুলতানের বাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে মঙ্গোলরা এবার যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে পালাতে লাগল। খুব অল্প সংখ্যক মঙ্গোল সৈন্যই কচুকাটা হওয়ার হাত থেকে বাঁচতে পেরেছিল।
এ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সুলতান প্রমাণ করলেন, মঙ্গোলরা অপরাজেয় নয়। বিজয় সংবাদ মুসলিম বিশ্বের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে গেল। এভাবে কয়েকটি যুদ্ধে সুলতান জালালুদ্দিনের কাছে নাস্তানাবুদ হলো মঙ্গোলরা। চেঙ্গিস খান ক্রমশই আতঙ্কিত হয়ে উঠলেন সুলতান জালালুদ্দিনের ব্যাপারে। মাত্র ২৫ বছরের এক যুবকের কাছে বারবার হেরে যাচ্ছে ‘অপরাজেয়’ চেঙ্গিস বাহিনী। এ তিনি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না। ইউরোপ, মধ্য এশিয়া, চীন থেকে মুখ ঘুরিয়ে পূর্ণ মনোযোগ দিলেন সুলতানকে শায়েস্তা করার জন্য।
খোদ চেঙ্গিস খান এবার তার পূর্ণ শক্তি নিয়ে এগিয়ে এলেন জালালুদ্দিনকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য। জালালুদ্দিন বুঝতে পারলেন, এ যুদ্ধ হবে তার জন্য বাঁচা-মরার লড়াই। তিনি তার বাহিনী নিয়ে কাবুল থেকে সামনের দিকে এগিয়ে পারওয়ান প্রদেশ অবস্থান নিলেন। চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে মঙ্গোলদের পুরো শক্তি এবার এগিয়ে আসছে পারওয়ানের দিকে। সুলতান জালালুদ্দিনকে দেখে চেঙ্গিস খান ভীতসন্ত্রস্ত ছিলেন। তাই তিনি নিজে যুদ্ধের ময়দানে আসলেন না, দায়িত্ব দিলেন তার পুত্র তোলি খানকে। নিজে অবস্থান নিলেন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে একটু দূরে।
১২২১ সালের কোনো এক বসন্তে, পারওয়ানের ময়দানে শুরু হয়ে গেল তুমুল যুদ্ধ। অস্ত্রের ঝঙ্কারে পুরো ময়দান মুখরিত হয়ে উঠল। প্রথম দিন যুদ্ধে মঙ্গোলরা সুবিধা করতে পারল না। রাতে তারা একটি আশ্চর্য ফন্দি আঁটল। নিহত সেনাদের লাশ ময়দানের একটু দূরে নিয়ে গেল, তারপর লাঠি পুঁতে লাঠির সঙ্গে এই লাশগুলো বেঁধে দাঁড় করিয়ে রাখল। এমন হাজার হাজার লাশকে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার ফলে দূর থেকে মনে হচ্ছিল, এখানে অনেক সেনা দাঁড়িয়ে আছে।
সুলতান জালালুদ্দিন ভেবে বসলেন, হয়তো বড় কোনো বাহিনী এসে মঙ্গোলদের সাথে যোগ দিয়েছে। কিন্তু তিনি ভীতসন্ত্রস্ত হলেন না। পরদিন যুদ্ধের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। সুলতানের অনন্য যুদ্ধকৌশল, আত্মবিশ্বাস এবং দৃঢ়তার কাছে সেদিন পরাজিত হলো মঙ্গোলরা। এ যুদ্ধে প্রচুর মঙ্গোল সেনা মুসলমানদের হাতে নিহত হয়। নিহত হন মঙ্গোল বাহিনীর সেনাপতি ও চেঙ্গিস খানের পুত্র তোলি খানও।
চেঙ্গিস খান অনুধাবন করলেন, জালালুদ্দিনকে থামানো না গেলে তার পক্ষে আর সামনের দিকে এগোনো সম্ভব না। তাই সকল দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মনোযোগ দিলেন জালালুদ্দিনের দিকে। এতে করে ইউরোপ এবং আব্বাসীয় খিলাফত ততদিন পর্যন্ত নিরাপদ ছিল। চেঙ্গিস খান তার বিচ্ছিন্ন সৈন্যদেরকে একত্র করতে লাগলেন চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য।
চেঙ্গিস খান যখন চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখন গনিমতের মাল ভাগাভাগি করা নিয়ে সুলতানের বাহিনী দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। সুলতানের প্রধান সেনাপতি সাইফুদ্দিন আগরাক প্রায় অর্ধেক সৈন্য নিয়ে দলত্যাগ করলেন। সুলতানের অনুরোধে সাইফুদ্দিন দলে যোগ দিলেও পরের দিন গভীর রাতে তিনি তার বাহিনী নিয়ে মুসলিম শিবির থেকে পালিয়ে যান।
এদিকে পুরো মঙ্গোল বাহিনী নিয়ে বিধ্বংসী রূপে এগিয়ে আসছেন চেঙ্গিস খান। অন্যদিকে মুসলিম শিবিরে বিভক্তি আর অভ্যন্তরীণ কোন্দলে সময় পার হচ্ছে। সুলতান জালালুদ্দিন তার বাহিনী নিয়ে গজনি ত্যাগ করলেন। অসুস্থ হয়ে পড়া সত্ত্বেও সুলতান তীব্র বেগে ছুটতে থাকলেন সিন্ধু অভিমুখে। সুলতানের মাত্র কয়েক হাজার সৈন্যকে ধাওয়া করতে লাগল কয়েক লক্ষ সৈন্যের বিশাল মঙ্গোল ঝড়।
সুলতান চেয়েছিলেন, সিন্ধু নদ অতিক্রম করে ভারতবর্ষে প্রবেশ করবেন। সেখান থেকে দিল্লির শাসক শামসুদ্দিন ইলতুতমিশের সাহায্যে সেনাবাহিনীর গঠন করে পুনরায় আফগানিস্তানে ফিরে এসে মঙ্গোলদের সঙ্গে লড়বেন। এদিকে চেঙ্গিস খান বুঝতে পারলেন, সুলতান জালালুদ্দিন যদি কোনোভাবে সিন্ধু অতিক্রম করেন, তাহলে আর তাকে আটকানো সম্ভব হবে না। তাই তিনি চাচ্ছিলেন, যেকোনো উপায়ে সিন্ধু নদ পার হওয়ার আগেই জালালুদ্দিনকে ঘায়েল করতে হবে।
২৪ নভেম্বর, ১২২১ সাল। সিন্ধু নদীর পাড়ে নিলাব নামক স্থানে সুলতান জালালুদ্দিন পড়লেন অকূল পাথারে। মঙ্গোল বাহিনী অতি নিকটে চলে এসেছে, পেছনে খরস্রোতা সিন্ধু নদ প্রবহমান। সৈন্যদের পারাপারের জন্য কোনো বাহন নেই। এখানে দাঁড়িয়ে সুলতান জীবনের সবচেয়ে কঠিনতম সিদ্ধান্ত নিলেন। একদিকে তিনি জীবন বাজি রেখে চূড়ান্ত যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলেন, অন্যদিকে পরিবারের নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। পরিবারের নারীদের চেঙ্গিস খানের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পেতে খরস্রোতা সিন্ধুর বুকে ভাসিয়ে দেন তিনি।
শুরু হয়ে গেল তুমুল যুদ্ধ। কয়েক লক্ষ দুর্ধর্ষ মঙ্গোল যোদ্ধার মোকাবেলা করা সুলতানের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনীর অবস্থানের ফলে বিস্তৃত যুদ্ধক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে এলো। অধিকাংশ মুসলিম সৈন্য নিহত হলো। সুলতানের সাথে মাত্র হাতেগোনা কয়েকজন যোদ্ধা লড়তে থাকে মঙ্গোল বাহিনীর বিপক্ষে। চেঙ্গিস খান তার সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করেন সুলতানকে বধ করতে। কিন্তু এই বিশাল বাহিনী নিয়েও হাতেগোনা সৈন্যের সঙ্গে সহজে পেরে উঠছিলেন না তিনি।
সুলতান জালালুদ্দিন যখন দেখলেন, কোনোভাবেই আর মোকাবেলা করা সম্ভব নয়, তখন তিনি মঙ্গোলদের সাথে যুদ্ধ করতে করতে উঠে গেলেন এক টিলায়। টিলার ডানপাশে বইছে উত্তাল সিন্ধু নদ। প্রায় ১৮০ ফুট উচ্চতা থেকে তিনি আচমকা ঘোড়াসহ ঝাঁপ দিলেন উত্তাল সিন্ধুর বুকে। মঙ্গোলরা বিস্ময় চোখে তাকিয়ে ছিল সুলতানের দিকে। তারা ভাবতেও পারেনি সুলতান হুট করে এমন কাজ করে বসবেন। সাঁতরে তিনি পার হয়ে এলেন নদীর এপারে। ওপারে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল চেঙ্গিস খান ও তার কয়েক লক্ষ সৈন্য।
সুলতান জালালুদ্দিন তখন চেঙ্গিস খানের দিকে তাকিয়ে বিকট শব্দে অট্টহাসি দিলেন। সে হাসির শব্দ সহজেই পৌঁছে গেল নদীর অপর পাড়ে চেঙ্গিস খানের কানে। এ হাসির শব্দ চেঙ্গিস খানের কানে নিজের ব্যর্থতার করুণ সুর হয়ে ধরা দিল।
সুলতান জালালুদ্দিন তার সমগ্র জীবন ব্যয় করেছেন মঙ্গোলদের রুখতে। মঙ্গোল বাহিনী এবং মুসলমানদের মধ্যে তিনি দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন জুলকারনাইনের প্রাচীর হিসেবে। তার প্রতিরোধের মুখে চেঙ্গিস খান থেমে যান খোরাসানের মাটিতে। এছাড়া সুলতানকে লড়াই করতে হয়েছিল আব্বাসীয় খিলাফত এবং জর্জিয়ায় ক্রুসেডের বিরুদ্ধেও। কিন্তু মুসলিম বিশ্ব তখন জালালুদ্দিনের এই অবদানকে গুরুত্ব দেয়নি।
সুলতান জালালুদ্দিনের মৃত্যুর কয়েক বছর পরই নতুন করে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে মঙ্গোলরা। তখন আর তাদেরকে প্রতিরোধ করার কেউ নেই। ১২৫৮ সালে হালাকু খানের আক্রমণে চূড়ান্তভাবে পতন ঘটল বাগদাদের। পৈশাচিক গণহত্যার শিকার হলো ১৬ লক্ষ মানুষ। পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ নগরী পরিণত হলো ভাগাড়ে। এভাবেই একের পর এক পতন হতে থাকলো মুসলিম শহরগুলোর।
সুলতান জালালুদ্দিনের মৃত্যু নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। কারো মতে, তিনি কুর্দিদের হাতে নিহত হয়েছেন। আবার কেউ বলেন, দস্যু কিংবা ব্যক্তিগত শত্রুতার জের ধরে তাকে হত্যা করা হয়েছিল। তবে জীবনের শেষ সময়ে তিনি ছিলেন প্রায় নিঃসঙ্গ। মৃত্যুর সময় কোনো সেনাবাহিনী তার সঙ্গে ছিল না। সে সময় তিনি অসুস্থও হয়ে পড়েছিলেন। পুরোটা জীবন নৃশংস মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে লড়াই করে ১২৩১ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট, সুলতান জালালুদ্দিন মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল মাত্র ৩২ বছর।