বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থীর মধ্যে একজন ফুতু। তার এবং তার পরিবারের করুণ কাহিনী উঠে এসেছে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিনের Sarah A. Topol-এর The Schoolteacher and the Genocide শিরোনামের একটি সুদীর্ঘ আর্টিকেলে। আমাদের এই সিরিজটি সেই আর্টিকেলেরই অনুবাদ। এটি হচ্ছে সিরিজের দশম এবং সর্বশেষ পর্ব।
সবগুলো পর্ব: ১ম পর্ব | ২য় পর্ব | ৩য় পর্ব | ৪র্থ পর্ব | ৫ম পর্ব | ৬ষ্ঠ পর্ব | ৭ম পর্ব | ৮ম পর্ব | ৯ম পর্ব | ১০ম পর্ব
(পূর্ববর্তী পর্বের পর থেকে…) শরণার্থী শিবিরে আমার শেষ রাতে হাঁটুর উপর ভর দিয়ে ফুতু তার বাঁশের তৈরি কুটিরের ভেতর বসেছিলেন। রাত ৮টার মতো বাজছিল তখন। কার্ফিউর সময় আরো আগেই পেরিয়ে গিয়েছিল। অন্ধকার ডানা মেলে কুটিরের ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করছিল। একটা মাত্র সোলার-পাওয়ারের লাইট বাল্বের আলোর সামনে তার একটা ছায়ামূর্তির অবয়ব ফুটে উঠেছিল।
ফুতুর ভেতরে কিছু একটা ঘটে গিয়েছিল। আমি আজও জানি না ঠিক কী ঘটেছিল, কিন্তু ফুতু, যিনি সব সময়ই ছিলেন একজন আশাবাদী মানুষ, যিনি নিষ্ঠার সাথে অভীষ্ট লক্ষ্যে কাজ করতে পছন্দ করতেন, হঠাৎ করেই তিনি যেন ভেঙে পড়লেন। কুটিরের ভেতর তার আত্মীয়স্বজন এবং প্রতিবেশীরা সবাই উপস্থিত ছিল। তাদের সামনে তিনি নিজের জীবনকে যাচাই করতে শুরু করলেন।
“এটাই কি জীবন, যার জন্য কেউ অপেক্ষা করবে? কেন কাউকে এরকম কষ্টকর জীবন যাপন করতে হবে?” তিনি জিজ্ঞেস করলেন। “আমার বাচ্চারা, আমার বাবা … আমার বাবা মারা গেছেন, আমার দাদা মারা গেছেন। কিন্তু কিছুই পরিবর্তিত হয়নি। এবার আমার পালা। আমার দুটি সন্তান আছে। এখনই সময়, আমাকে আমার সন্তানদের ভরণপোষণ করতে হবে। আমি আর সন্তান নিতে চাই না। এটা চিন্তা করাও অর্থহীন। আমরা এখানে শুধু বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি। এবং ভবিষ্যতে আমার কী হবে সেটাও আমি জানি না। এ নিয়ে চিন্তা করতে গেলেই আমার মাথায় জট পাকিয়ে যায়। আমি কত কিছু করতাম। সে সময় আমি শিক্ষার প্রচারে খুব আগ্রহী ছিলাম, কিন্তু এখন আমি সেগুলো নিয়ে ভাবতে চাই না। আমার মন এখন খুবই অশান্তিতে আছে।”
ফুতু বসেছিলেন তার হাঁটুর উপর ভর দিয়ে। তার মুখে ছিল যন্ত্রণার চিহ্ন। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে “সিস্টার” বলে সম্বোধন করলেন, যেটা তিনি আমাদের পরিচয়ের এক সপ্তাহ পর থেকেই শুরু করেছিলেন।
তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপা, আপনার বাবা-মা আপনাকে ভালো পড়াশোনা করিয়েছেন, আপনার শিক্ষার জন্য তারা নিজেরা কষ্ট করেছেন, আপনাকে বিশেষজ্ঞ বানানোর জন্য নিজেদের কষ্টে উপার্জিত অর্থ ব্যয় করেছেন। এখন আপনি সেই বিশেষ জ্ঞান কাজে লাগাচ্ছেন আপনার আত্মীয়স্বজনকে, আপনার দেশকে, কিংবা হয়তো অন্যান্য দেশকেও সাহায্য করার জন্য। যদি কেউ তার জ্ঞান কাজে লাগানোর জন্য এরকম সুযোগ না পায়, তাহলে এই কঠোর পরিশ্রমের, সারা জীবন ধরে বাবা-মায়ের এই কষ্টের কী মানে আছে?”
“আমার বাবা-মা আমার পড়াশোনার জন্য কষ্ট করেছেন। যদি তারা না করতেন, তাহলেই বরং আরো ভালো হতো। আমি সমস্ত ঝামেলা এবং মারধর থেকে বেঁচে থাকতে পারতাম। ব্যাপারটা এরকমই, আপা। যদি কেউ মারা যায়, তাহলে সেখানেই শেষ। যদি আমরা মারা যাই… অনেক মানুষ মারা গেছে… তাহলে সবকিছু সেখানে শেষ হয়ে যেত। তার পরিবর্তে আমরা আমাদের জীবন নিয়ে এখানে পালিয়ে এসেছি। মাঝে মাঝে আমি যখন এগুলো নিয়ে চিন্তা করি, আমার খুবই কষ্ট লাগে। আমার মনে চায় সবকিছু ছেড়ে দিই।”
বাংলাদেশের ক্যাম্পগুলোতে আমি এক মাস ধরে ধর্ষণ এবং ধ্বংসযজ্ঞের কাহিনী শুনে কাটিয়েছিলাম, কিন্তু সেগুলোর কিছুই আমাকে মানুষের মনের গণহত্যার জন্য প্রস্তুত করতে পারেনি। গণহত্যার পরেও একটি জাতি টিকে থাকতে পারে; যারা বেঁচে যায় তারা নতুন করে জীবন গঠন করতে পারে। কিন্তু যখন একটি জাতির আত্মপরিচয় তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়, তখন কী ঘটে? যখন বছরের পর বছর ধরে তাদেরকে পৃথিবী থেকে বারবার মুছে ফেলা হয়? যখন প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তাদেরকে বলা হয় যে, তাদের অস্তিত্ব নেই? এবং কী ঘটে, যখন তাদের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবীরা হাল ছেড়ে দেয়, লেখা বন্ধ করে দেয়, শিক্ষকতা বন্ধ করে দেয় এবং চিন্তাভাবনা বন্ধ করে দেয়? এটাই কি বার্মিজ সরকার শুরু থেকে চেয়ে আসছিল?
সেই রাতে বেরিয়ে যাওয়ার আগে আমি ফুতুকে একটি উপহার দিয়েছিলাম। একটি নোটবুক। আমি ভেবেছিলাম যদি তিনি কখনও অনুপ্রেরণা খুঁজে পান, তাহলে হয়তো তিনি এটাকে ডায়েরি হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন। আমাদের বিদায় ছিল গুরুগম্ভীর এবং বেমানান। ফুতু আমাকে বলেছিলেন, তিনি নিশ্চিত যে তারা যদি ফিরে যান তাহলে তাদের সবাইকে মেরে ফেলা হবে।
আমরা হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ রেখেছিলাম। শরণার্থী শিবিরের নেটওয়ার্ক ছিল খুবই খারাপ। তারপরেও ফুতু যখন সিগন্যাল পেতেন, তখন মাঝে মাঝে আমার সাথে তার যোগাযোগ হতো। আমি চলে যাওয়ার পর একদিন তিনি আমাকে ম্যাসেজ পাঠিয়ে জানালেন, তিনি আবার ডায়েরি রাখতে শুরু করেছেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন, তার স্বপ্ন পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থ জমিয়ে তিনি একদিন একটি কম্পিউটার কিনবেন।
কয়েক সপ্তাহ পর তিনি আবার আমাকে ম্যাসেজ পাঠালেন। তিনি জানালেন, তিনি একটি নতুন প্রকল্পের সাথে যোগ দিয়েছেন, ক্যাম্পগুলোতে বৃক্ষরোপণ প্রকল্প- ভূমিধ্বস রোধে সহায়তা করার জন্য, পৃথিবীতে শেকড় দৃঢ় করার জন্য। এর কয়েক সপ্তাহ পর তিনি আবারও ম্যাসেজ পাঠালেন, এবার তিনি অন্যান্য সম্প্রদায়ের নেতাদের সাথে মিলে একটি নতুন স্কুল খোলার জন্য কাজ শুরু করছেন। এই স্কুলে তারা বার্মিজ, ইংরেজি এবং গণিত শেখাবেন। তাদের লক্ষ্য এক হাজার শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছা।
ডিসেম্বর মাসে তারা স্কুলটি নির্মাণ শেষ করেছিলেন- নীল রঙের তেরপল দিয়ে ঘেরা বাঁশের তৈরি বড় একটি আশ্রয়কেন্দ্র। জানুয়ারির মধ্যে এটার মেরামতের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। ফুতু ব্যাখ্যা করেছিলেন, তাদের কাছে যথাযথভাবে স্কুল নির্মাণের জন্য যথেষ্ট অর্থ ছিল না। তারা শিক্ষার্থীদের বাবা-মায়েদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করছিলেন, কিন্তু শরণার্থীদের নিজেদেরই কোনো চাকরি ছিল না, পড়াশোনার পেছনে জন্য অর্থ খরচ করার মতো তাদের সত্যিকারের কোনো আয় ছিল না।
ভূমিধ্বস রোধের প্রকল্পটি এগিয়ে গিয়েছিল। ফুতু প্রায়ই আমাকে গাছ এবং চারার ছবি পাঠাতেন। তিনি আমাকে তার বাবাকে নিয়ে দেখা স্বপ্নগুলোর কথা জানিয়ে মেসেজ পাঠাতেন। কখনো কখনো তারা বার্মিজ সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে ছুটে পালাতেন; কখনো কখনো তারা কেবল তাদের জীবন নিয়ে কথা বলতেন।
ফুতু আমাকে সবচেয়ে বেশি মেসেজ পাঠাতেন তার ডায়েরিগুলো নিয়ে তার দুঃখের কথা জানিয়ে, তার অতি যত্নে সংগ্রহ করা ইতিহাসের ধ্বংসের কথা জানিয়ে। তিনি এই আর্টিকেলটি সম্পর্কেও প্রায়ই জিজ্ঞেস করতেন। তিনি জানতে চাইতেন, রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে আমেরিকানরা কী ভাবে? তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করতেন, তিনি এই ম্যাগাজিনের একটি কপি স্পর্শ করতে পারবেন কি না। তিনি আমাকে বারবার অনুরোধ করেছিলেন, যেন আমি এর একটা কপি তাকে পাঠাতে ভুলে না যাই। তিনি বলেছিলেন, তিনি এটা ভবিষ্যতের জন্য রেখে দিতে চান।
সবগুলো পর্ব: ১ম পর্ব | ২য় পর্ব | ৩য় পর্ব | ৪র্থ পর্ব | ৫ম পর্ব | ৬ষ্ঠ পর্ব | ৭ম পর্ব | ৮ম পর্ব | ৯ম পর্ব | ১০ম পর্ব
প্রিয় পাঠক, রোর বাংলার ‘ইতিহাস’ বিভাগে এখন থেকে নিয়মিত লিখতে পারবেন আপনিও। সমৃদ্ধ করে তুলতে পারবেন রোর বাংলাকে আপনার সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত লেখনীর মাধ্যমে। আমাদের সাথে লিখতে চাইলে আপনার পূর্বে অপ্রকাশিত লেখাটি সাবমিট করুন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/