ব্ল্যাক ডেথ বলা হয় মধ্যযুগে ইউরোপের মহামারি প্লেগ রোগকে। এটি পশ্চিম ইউরোপে ১৩৪৬ সালে শুরু হয়। ইংল্যান্ডে এর প্রকোপ শুরু হয় ১৩৪৮ সালে। ১৩৫০ দশকের শুরুর দিক পর্যন্ত প্রায় পাঁচ থেকে ছয় বছর ধরে চলতে থাকে এই ভয়াবহ মহামারি। এতে ইউরোপের প্রায় ৩০-৬০ শতাংশ জনগণ মারা যায়। ইতিহাসে যত মহামারি হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যাওয়ার রেকর্ড এই ব্ল্যাক ডেথের জন্যই। তার চেয়েও ভয়ানক ব্যাপার ছিল এই রোগটা কেন হচ্ছিল তার কারণ কেউ ধরতে পারেনি তখন।
ব্ল্যাক ডেথ নামের সাথে রোগের বা এর লক্ষণের কোনো সম্পর্ক নেই। সম্ভবত ল্যাটিন শব্দ ‘আতরা’কে ভুলভাবে অনুবাদ করায় এই নাম এসেছে। আতরা দিয়ে ‘ভয়ংকর’ এবং ‘কালো’ দুটি অর্থই প্রকাশ পায়।
প্লেগের উৎস ও লক্ষণ
মধ্যযুগে মানুষ মনে করত, প্লেগ রোগটি দূষিত বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়। ‘জার্ম থিওরি’ বা জীবাণু তত্ত্ব আবিষ্কারের আগে চিকিৎসাবিদ্যায় একে বলা হতো ‘মায়াজমা তত্ত্ব’। প্রাচীন গ্রিক ভাষায় ‘মায়াজমা’ শব্দের অর্থ ছিল দূষণ বা খারাপ বাতাস। উনবিংশ শতকের শেষের দিকে জানা যায় প্লেগ রোগের জন্য দায়ী জীবাণুটি হচ্ছে Yersinia pestis নামের ব্যাকটেরিয়া। এটি মাছি আর উকুনের মাধ্যমে মানুষের শরীরে পৌঁছায়। তবে পূর্বে ইঁদুরকে দায়ী করা হতো এই জীবাণু বহনের জন্য।
যখন সংক্রমিত মাছি মানুষকে কামড় দেয়, তখন ব্যাকটেরিয়া লাফ দিয়ে মানুষের রক্তে চলে আসে। রক্তের মাধ্যমে গিয়ে শরীরের লিম্ফ নোডে জমা হতে থাকে। স্বাভাবিক অবস্থায় মানুষের শরীরের লিম্ফ নোডগুলো দৃশ্যমান থাকে না। কিন্তু এই ব্যাকটেরিয়ার কারণে লিম্ফ নোডগুলো ফুলতে থাকে, যে অবস্থাকে বলা হয় ‘বুবোস’। একারণে এই প্লেগকে বুবোনিক প্লেগ বলা হয়। আরো দুই ধরনের প্লেগ আছে, যারা হচ্ছে নিউমোনিক প্লেগ এবং সেপটিসেমিক প্লেগ।
শুরুর দিকে মাথাব্যথা, জ্বর, অত্যাধিক দুর্বলতা এসব লক্ষণ দেখা যায়। বমি বমি ভাব এবং সারা শরীরে ব্যথাও থাকতে পারে। যখন ব্যাকটেরিয়া লিম্ফ নোডে পৌঁছায়, তখন লিম্ফ নোডগুলো ফুলে যাওয়ার কারণে খুব যন্ত্রণা হয়। কামড়ের স্থানের কাছাকাছি যে লিম্ফ নোডগুলো থাকে, সেগুলো আগে ফুলে। সাধারণত উরু, কনুইয়ের পেছনের অংশ, কাঁধ এসব স্থানই বেশি আক্রান্ত হয়। কখনো কখনো এগুলো ফুলে ডিমের আকার ধারণ করত। অত্যন্ত ব্যথায় কামড়ের এক সপ্তাহের মধ্যেই মানুষ মারা যেত।
লিম্ফ নোড থেকে জীবাণু সারা শরীরেই ছড়িয়ে পড়ত। এতে অভ্যন্তরীণ রক্তপাত হতো। মল-মূত্রের সাথে রক্ত আসত। ফুসফুসে যখন সংক্রমণ হয়ে নিউমোনিক প্লেগ হতো, তখন কাশির সাথে রক্ত আসত। কখনো কখনো সারা শরীরে কালো দাগ সৃষ্টি হতো। তারা নিশ্চিতভাবেই মারা যেত। প্লেগ থেকে মাত্র ২০ শতাংশ মানুষ সুস্থ হয়ে ফিরে আসতে পেরেছিল।
প্লেগের উৎপত্তিস্থল
ধারণা করা হয়, মধ্য এশিয়ার ইসিক-কুল হ্রদ থেকেই প্লেগ রোগটি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় এই অঞ্চলে ১৩৩৮ এবং ১৩৩৯ সালে উচ্চ মৃত্যুহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। এছাড়া কিছু স্মৃতিস্তম্ভও পাওয়া যায় যা প্লেগ রোগকেই নির্দেশ করে। বিশেষজ্ঞরা তাই মনে করেন, প্লেগ রোগটি এখান থেকেই পূর্ব দিকে চীন এবং দক্ষিণ দিকে ভারতে ছড়িয়েছে। চীন এবং কাস্পিয়ান সাগর অঞ্চলের জন্য এই হ্রদ খুব সহজেই অতিক্রমযোগ্য ছিল। কারণ এই হ্রদটি ঐতিহাসিক সিল্ক রোডের পাশে ছিল। তাই এখানে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে প্রচুর লোকসমাগম হতো।
তবে কিছু সূত্র মতে, প্লেগ ১৩২০ এর দশকে চীনে প্রথম শুরু হয়। সম্ভবত এটি ইসিক-কুল হ্রদে যাওয়ার আগে চীনকে সংক্রমিত করেছিল অথবা এটি ছিল শুধু চীনের মধ্যে সীমাবদ্ধ একটি বিচ্ছিন্ন সংক্রমণ। তবে এই রোগের কারণে চীনেও লাখ লাখ মানুষ মারা যায়।
চীন থেকে বাণিজ্যিক রাস্তার মাধ্যমে রোগটি ভারতেও এসে পৌঁছায়। ভারতেও প্রচুর মানুষ মারা যায় এই রোগে। প্লেগের থাবা থেকে রক্ষা পায়নি মধ্যপ্রাচ্যও। মক্কাতেও ছড়িয়ে পড়ে এর ভয়াবহতা। সম্ভবত ব্যবসায়ী আর হজ্ব যাত্রীদের কাছ থেকেই এই রোগ ছড়িয়ে পড়ে।
ইউরোপে যেভাবে ছড়িয়ে পড়ে প্লেগ
১৩৪৭ সালের অক্টোবরে সিসিলির মেসিনা বন্দরে কৃষ্ণ সাগর থেকে ১২টি জাহাজ নোঙর করে। বন্দরে যত মানুষ ছিল, তারা এক ভয়ংকর দৃশ্য দেখে। জাহাজের যত নাবিক ছিল, বেশিরভাগই ছিল মৃত। যারা জীবিত ছিল, তারাও ছিল খুব অসুস্থ। তাদের শরীরে ছিল ফোলা অংশ। এগুলো থেকে রক্ত আর পুঁজ বের হচ্ছিল। মেসিনার কর্তৃপক্ষ যখন বুঝতে পারে এই জাহাজের মাধ্যমে নতুন রোগ চলে এসেছ, তখন তারা জাহাজগুলোকে সরিয়ে দেয় এই অঞ্চল থেকে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
শহরের জনগণ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং রোগে আক্রান্তরা পালিয়ে যায় গ্রামে। এতে তারা প্রত্যন্ত অঞ্চলেও রোগের সংক্রমণ ছড়িয়ে দিতে থাকে। এদিকে সিসিলি যখন মহামারির সংক্রমণে ভুগছিল, সেই জাহাজগুলো নভেম্বরের মধ্যে তাদের প্রতিবেশী দ্বীপ অঞ্চল কর্সিকা ও সার্ডিনিয়াতেও এই রোগ ছড়িয়ে দেয়।
১৩৪৭ সালে এটি শুধু ইতালি ও গ্রিসের কিছু অংশে ছড়ায়। কিন্তু ১৩৪৮ সালের জুন মাসের মধ্যে ইউরোপের প্রায় অর্ধেক অঞ্চলই ব্ল্যাক ডেথের সংক্রমণের শিকার হয়। কয়েক মাসের মধ্যেই ফ্রান্স, স্পেন, জার্মানিতে ছড়িয়ে পড়ে। আফ্রিকার তিউনিসও মেসিনার জাহাজগুলোর মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। মধ্যপ্রাচ্যেও ছড়িয়ে পড়ে এই মহামারি।
বাদ যায়নি ইংল্যান্ডও। ক্যামব্রিজশায়ারের কিছু গ্রামের ৭০ শতাংশ জনগণই মারা যায় প্লেগের ছোঁয়ায়। ১৩৪৮-৪৯ সালে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ হয় পাহাড়ি অঞ্চল এবং তুলনামূলক বিচ্ছিন্ন অঞ্চলগুলোতে। শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বাজে অবস্থা ছিল ইতালির ফ্লোরেন্সের। এই শহর ছিল বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্র। প্লেগের কারণে এর প্রায় ৬৫,০০০ বাসিন্দা মারা যায়। তবে অনেক ব্যস্ত শহর হওয়া সত্ত্বেও আশ্চর্যজনকভাবে ইতালির মিলানে প্লেগ রোগ ছড়ায়ইনি বললে চলে।
১৩৫৩ সালে এটি যখন রাশিয়ায় পৌঁছে দুর্বল হয়ে যায়, ফিনল্যান্ড আর আইসল্যান্ডের মতো অল্প কিছু দেশই এর হাত থেকে রক্ষা পায়। ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় এর সংক্রমণ দুর্বল হয়ে যায়। ভয়াবহ এই মহামারিতে প্রায় ৫ কোটি মানুষ মারা যায়। শহরগুলোর চেয়ে গ্রামাঞ্চলে বেশি প্রকোপ দেখা দেয়। ইংল্যান্ডেরই এক হাজার গ্রামে প্লেগের সংক্রমণ দেখা দেয়। যারা প্লেগের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিল, তারাও গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়। গরিবদের মাঝেই রোগটি বেশি ছড়াত। তবে ধনীরাও এর হাত থেকে রক্ষা পায়নি। স্পেনের ক্যাস্টাইল রাজ্যের রাজা আলফনসো একাদশও এই রোগে মারা যান।
তখনকার মানুষেরা মনে করত, এটি তাদের পাপের জন্য সৃষ্টিকর্তার দেয়া অভিশাপ। ১৩৫৩ সালে এই মহামারি শেষ হয়। কিন্তু পরবর্তী শতকগুলোতেও এর আক্রমণ হতে থাকে। তবে পরবর্তীতে ইতালি ও ইউরোপের অন্যান্য দেশে চিকিৎসাবিদ্যার উন্নতি হতে থাকায় এর সংক্রমণ কমতে থাকে।
ব্ল্যাক ডেথের প্রভাব
ব্ল্যাক ডেথের কারণে কর্মক্ষম লোকের সংখ্যা কমে যায়। ফলে শ্রমিকদের পারিশ্রমিক বেড়ে যায়। এতে জমির মালিকরা বিপত্তিতে পড়ে। পরবর্তীতে এই সমস্যাটি কৃষিকাজে যন্ত্রের ব্যবহার ত্বরান্বিত করে। মহামারির সময় কোনো সহায়তায় না আসায় চার্চ ও পাদ্রীদের ওপর জনগণ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
ধনীর কন্যা সন্তান ও স্ত্রীরা এতিম বা বিধবা হয়ে যাওয়ায় বিবাহের হার বেড়ে যায়। জন্মহারও বাড়তে থাকে। সমাজে নৈরাজ্য ও ব্যভিচার বৃদ্ধি পায়। উত্তর ইউরোপের সংস্কৃতিতে এটি প্রভাব ফেলে। মৃত্যুকে প্রাধান্য দিয়ে বিভিন্ন শিল্পকর্ম শুরু হয়।
শেষ কথা
অন্ধকারের পর যেমন আসে সূর্যের আলো, ভয়াবহ প্লেগের পরেই আসে ইউরোপে রেনেসাঁ যুগ। অবশ্য প্লেগও যে বিলুপ্ত হয়েছে তা নয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে ইউরোপ আবার প্লেগে আক্রান্ত হয়েছে। তবে প্লেগের জীবাণু আবিষ্কার হওয়ার পর মানুষ একে নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে।
The Black Death বইটি কিনতে ভিজিট করুন রকমারিতে।