পলাশী। ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে এই নামটির সাথে জড়িয়ে আছে বিশ্বাসঘাতকতা, পরাজয়, আর পরাধীনতার নাম। নবাব সিরাজের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সেনাপতিদের বিশ্বাসঘাতকতায় ইতিহাস লজ্জিত হলেও, সে যুদ্ধে আমৃত্যু লড়েছিলেন বেশ কয়েকজন দেশপ্রেমিক, অকুতোভয় সেনাপতি। এরই মধ্যে অনন্য মর্যাদায় ভূষিত এক যোদ্ধা- মীর মদন।
কে ছিলেন মীরমদন?
১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন, পলাশীর আম্রকাননে অপ্রত্যাশিতভাবে ডুবে গিয়েছিল বাংলার স্বাধীনতার সূর্য। সেই সূর্য সমর্যাদায় ধরে রাখতে আমৃত্যু লড়েছিলেন তিনি। দেশ-জাতির প্রতি তার দায়, জীবন দিয়ে শোধ করে মুর্শিদাবাদের ভাগীরথী নদী তীরবর্তী ফরিদপুর গ্রামে শুয়ে আছেন নবাব সিরাজ তথা জন্মভূমির পক্ষে লড়া পলাশীর যুদ্ধের অন্যতম সেনানায়ক বখশী মীর মদন। ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ একটি বাঁকে, পলাশীর সমরে তার ভূমিকা ছিল অত্যন্ত সাহসী।
যতটুকু জানতে পারা যায়, মীর মদন হাসানউদ্দিন খানের অধীনে ঢাকায় কাজ করতেন। হাসানউদ্দীন খান ছিলেন হোসেন কুলি খানের ভ্রাতুষ্পুত্র। মীর মদনকে তার বিশ্বস্ততা ও কর্মদক্ষতার জন্য নবাব আলীবর্দী খান নিজেও পছন্দ করতেন। পরে তাকে ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদ নিয়ে এসে সেনাপতির আসনে বসান নবাব সিরাজ। তাকে দেওয়া হয় ‘বখশী’ উপাধি। সেখান থেকে পলাশীর সমরে মৃত্যু পর্যন্ত কখনো নবাবের বিশ্বাস ভাঙেননি তিনি।
পলাশীর যুদ্ধে মীর মদন
আর দশটা স্বাভাবিক দিনের মতোই সেদিন সূর্য উঠেছিল মুর্শিদাবাদের আকাশে। কিন্তু সে আকাশ মেঘলা হয়ে যায় দুপুর নাগাদ। সেইসাথে বাংলা অঞ্চলের স্বাধীনতার আকাশেও দেখা দেয় দুর্যোগের ঘনঘটা।
সমকালীন ইতিহাসের নানা সূত্রে জানা যায়, ১৭৫৭ সালের জুন মাসের শুরুর দিকে লর্ড ক্লাইভের বাহিনী কলকাতা থেকে রওয়ানা হয়ে জুনের ১৭ তারিখে দক্ষিণে কাটোয়া দুর্গ অধিকার করে। ষড়যন্ত্রকারীরা এমনই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল যে, কলকাতা থেকে কাটোয়ার মধ্যবর্তী স্থানে নবাবের বেশ কিছু সেনা ছাউনি থাকলেও কেউ বাধা দিতে এগিয়ে আসেনি। ২১ জুন ক্লাইভ তার বাহিনী নিয়ে পলাশীর দিকে যাত্রা করে এবং পথিমধ্যে মীর জাফরের কাছ থেকে আসে প্রতীক্ষিত সবুজ বার্তা। একথা সবারই জানা, নবাব সিরাজকে সরাতে হয়েছিল একটি ঘৃণিত ও কলঙ্কজনক প্রাসাদ ষড়যন্ত্র।
এতে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিল বিশ্বাসঘাতক জগৎশেঠ মাহতাব চাঁদ, মীর জাফর, উমিচাঁদ, স্বরুপচাঁদ, ইয়ার লতিফ, রায়দুর্লভ, ঘষেটি বেগমদের ক্ষমতার লোভ। তার সাথে রাজা রাজবল্লভ, মহারাজ নন্দকুমার, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়, রানী ভবানী প্রমুখের প্রচ্ছন্ন সহায়তা।
ফিরে আসা যাক পলাশীর প্রান্তরে। ক্লাইভের নেতৃত্বে ইংরেজ বাহিনী হুগলি নদী পার হয়ে ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে শিবির স্থাপন করে। পলাশীর আম্রকাননে সুবিধাজনক অবস্থানে শিবির স্থাপন করে ইংরেজ বাহিনী। সেখানে আগে থেকেই ছিল নবাব সিরাজের একটি সুরক্ষিত শিকারবাড়ি। লক্ষবাগ নামের আমবাগানের চারপাশে মাটির বাঁধ ইংরেজ বাহিনীকে দিয়েছিল বাড়তি সুবিধা।
পলাশী যুদ্ধে নবাবের পক্ষে ছিল ৫০,০০০ সৈন্যের বিশাল বাহিনী। আর ইংরেজ পক্ষে ছিল মাত্র হাজার তিনেক সৈন্য। অস্ত্র, গোলাবারুদ, হাতি, ঘোড়া কোনোদিক থেকেই পিছিয়ে ছিল না নবাবের বাহিনী। কিন্তু এর মধ্যে ৪০,০০০ সৈন্যই ছিল মীর জাফর সহ বিশ্বাসঘাতক সেনানায়ক রায়দুর্লভ, ইয়ার লতিফদের অধীনে। আর যুদ্ধক্ষেত্রে তারা নিয়েছিল নীরব ভূমিকা।
পলাশী সমরক্ষেত্রের নদী তীরবর্তী অঞ্চলে অবস্থান নিয়েছিলেন মীর মদন। তার একপাশে ছিল ফরাসি সেনানায়ক মঁসিয়ে সিনফ্রে ও অপর পার্শ্বে সেনাপতি মোহনলাল। সবমিলিয়ে তাদের অধীনে ছিল মাত্র হাজার দশেকেরও কম সৈন্য। সে যুদ্ধে মীর মদন ও মোহনলাল ছাড়া আর যে কয়েকজন নবাব কিংবা নিজ দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেননি, তারা হচ্ছেন- বন্দুক বাহিনীর কমান্ডার বাহাদুর আলি খান, গোলন্দাজ বাহিনীর অধিনায়ক নয়ে সিং হাজারি প্রমুখ।
যুদ্ধের শুরুতেই মীর মদন ইংরেজ বাহিনীকে কোণঠাসা করে ফেলেন। তবে ইংরেজরা এতটা প্রতিরোধ আশা করেনি। ক্লাইভ বিচলিত হয়ে মীর জাফরকে জিজ্ঞেস করেন, কেন এমন প্রতিরোধ হচ্ছে? মীর জাফর তাকে উত্তর পাঠান, তাদের বাহিনী কোনো যুদ্ধ করছে না, যারা লড়ছে তারা মীর মদন আর মোহনলালের বাহিনী। শুধু তাদের পরাস্ত করতে পারলেই হবে।
যুদ্ধ চলতে থাকে। দুপুর নাগাদ আকাশে জমে মেঘ। শুরু হয় তুমুল বৃষ্টি। ধুরন্ধর ইংরেজ বাহিনী নিজেদের কামান আর গোলাবারুদ তারপুলিন দিয়ে ঢেকে ফেললেও নিজেদের কামান আর গোলাবারুদ ঢাকতে ব্যর্থ হয় নবাবের বাহিনী। যার ফলে বৃষ্টিতে ভিজে অকার্যকর হয়ে যায় নবাব বাহিনীর গোলাবারুদ। অপরদিকে সম্পূর্ণ সক্রিয় থাকে ইংরেজদের কামান।
বৃষ্টিতে আকস্মিক বিপর্যয়ের পরেও মীরমদন তার প্রতিরোধ চালিয়ে যান। তার সাথে প্রাণপণে লড়ে যান মোহনলাল, খাজা আব্দুল হাদী খান, নয়ে সিং হাজারী ও ফরাসি সেনানায়ক সিনফ্রে প্রমুখের অধীন সৈনিকরা। মীর মদন ভেবেছিলেন, ইংরেজদের গোলাবারুদও হয়তো ভিজে গেছে তাদের মতো। তাই বেশ কিছু এগিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। যুদ্ধের এ পর্যায়ে কোণঠাসাও করে ফেলেন ইংরেজ বাহিনীকে। এমন কোণঠাসা অবস্থায় ক্লাইভ চিন্তা করেছিলেন, দিনটা কোনোমতে টিকে থেকে রাতের আঁধারে আক্রমণ করবেন কিংবা কলকাতা পালিয়ে যাবেন।
যুদ্ধের যখন এই অবস্থা, সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাটি ঘটে তখন। বেলা তিনটার দিকে দুর্ভাগ্যজনকভাবে হঠাৎ ইংরেজদের একটি কামানের গোলা এসে আঘাত করে মীর মদনের বুকে। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। তাকে নবাবের তাঁবুতে নিয়ে আসা হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি বিদায় নেন পৃথিবী থেকে। মীর মদনের মৃত্যু নবাবকে হতভম্ব করে দেয়।
তবে মীর মদনের মৃত্যুর পরেও নিজেদের অবস্থান ধরে রাখেন মোহনলাল। কিন্তু মুষড়ে পড়েন নবাব। তিনি ডেকে পাঠান মীর জাফরকে। মীর জাফর নবাবকে প্রলুব্ধ করেন যুদ্ধ বন্ধ রাখতে। অপরদিকে রায়দুর্লভ নবাব সিরাজকে প্ররোচিত করেন মুর্শিদাবাদ ফিরে যেতে। অতঃপর মোহনলালকে নবাব নির্দেশ পাঠান, যুদ্ধ বন্ধ করে শিবিরে ফিরে আসতে। তিনি না ফিরলে বারংবার তাকে শিবিরে যুদ্ধ থামিয়ে ফিরে আসতে বলা হয়। মোহনলাল এ পর্যায়ে ক্ষোভে, অভিমানে যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করেন। নবাব সিরাজ নিজেও পরাজয় মাথায় করে ফিরে যান মুর্শিদাবাদের দিকে।
এ পর্যায়ে বিক্ষিপ্ত, নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে যুদ্ধরত বাহিনী। ঠিক এই মুহূর্তে ক্লাইভ আক্রমণ করে বসলেন নবাবের বিক্ষিপ্ত বাহিনীকে। নেতৃত্বহীন অবস্থায় নবাবের সৈনিকরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লেন। তবে ফরাসি সেনানায়ক সিনফ্রে যুদ্ধ চালিয়ে যান আরো কিছুক্ষণ। তিনি মীরজাফরের কথায়ও কান দেননি কিংবা নবাবের কথাও শোনেননি। কিন্তু শেষ অবধি টিকতে না পেরে যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করেন তিনিও। মুহূর্তের ব্যবধানে পরিবর্তিত হয়ে যায় যুদ্ধের গতি। সন্ধ্যার দিকেই বিজয়ী ক্লাইভ বীরদর্পে যাত্রা করলেন মুর্শিদাবাদের দিকে। বাংলার আকাশ ছেয়ে যায় অমানিশায়। বৃথা যায় মীর মদনের আত্মত্যাগ।
মীর মদনের সমাধি
মীর মদনের অনুগত সৈনিকরা তাদের প্রিয় সেনাপতির দেহ ফেলে আসেননি। তারা তার মৃতদেহকে গোপনে বহন করে নিয়ে আসেন পলাশী থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে মুর্শিদাবাদের রেজিনগরের নিকট একটি গ্রামে। ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী সে গ্রামটির নাম ফরিদপুর। ফরিদপুর নামটি হয়েছে সাধক ফরিদ খানের নামানুসারে। সেই ফরিদ খানের সমাধির পাশেই তাকে সমাহিত করা হয়।
যে মৃত্যু প্রেরণা যোগায়
ইতিহাসে পরস্পরবিরোধী দু’টি চরিত্র মীর মদন ও মীর জাফর। মীর জাফর, রায়দুর্লভ, ইয়ার লতিফরা যেখানে স্বার্থে অন্ধ হয়ে বিকিয়ে দিয়েছিলেন নিজের দেশ ও জাতিকে, সমান্তরালভাবে মীরমদন, মোহনলাল, নয়ে সিং হাজারির মতো দেশপ্রেমিক সেনানায়করা নিজের দেশ ও জাতির জন্য লড়েছেন নিজেদের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে। ইতিহাস মীর জাফরদের ক্ষমা করেনি। অপরদিকে মর্যাদায় আসীন করেছে মীর মদন, মোহনলাল, নয়ে সিং হাজারি ও বাহাদুর খানের মতো দেশপ্রেমিক সেনানায়কদের। যুগ যুগ ধরে তারা হয়ে থাকবেন লাখো-কোটি মানুষের প্রেরণা, সুমহান মর্যাদায়।