বাবা-মায়ের শখ করে দেয়া ডাকনামের পাশাপাশি বন্ধুমহলে আমাদের অনেকেরই একটি-দুটি করে ডাকনাম প্রচলিত আছে। বাবা-মা আমাদের ডাকনামটি রেখেছিলেন আদর করে। অন্যদিকে বন্ধুরা আমাদের এ নামগুলো দিয়ে থাকে স্রেফ মজা করার জন্যই। তবে এখানে লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হলো- আমাদের কথাবার্তা, কাজকর্ম, নিজেদের দৈহিক আকৃতি ইত্যাদি নানা বিষয়ের মাঝে থেকে কোনো একটিকে বেছে নিয়ে বন্ধুরা এসব নাম দিয়ে থাকে।
বিচিত্র এমন সব ডাকনাম এককালের রাজা-রাণীদেরও ছিলো। তাদের বিচিত্র সেসব নামের পাশাপাশি সেসব নামের পেছনের মজার ইতিহাস নিয়েই সাজানো হয়েছে আজকের লেখাটি।
চতুর্থ হেনরি
মধ্যযুগে আইবেরিয়ান উপদ্বীপে অবস্থিত ক্রাউন অফ ক্যাস্টিল অঙ্গরাজ্যের রাজা ছিলেন চতুর্থ হেনরি। ১৪৫৪ থেকে ১৪৭৪ পর্যন্ত প্রায় ২০ বছর শাসকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে হেনরিকে লোকে ‘নপুংসক’ ডাকনামে চিনতো।
১৪৪০ সালে ১৫ বছর বয়সে নাভারের দ্বিতীয় ব্লাঞ্চেকে বিয়ে করেন রাজা। কিন্তু বিয়ের ১৩ বছর পর তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। জানা যায় যে, ১৩ বছর পরেও রাণী কুমারী ছিলেন। ১৪৫৫ সালে পর্তুগাল ও আল্গ্রেভসের রাজা পঞ্চম আলফন্সোর বোন জোয়ানকে বিয়ে করেন তিনি। ৬ বছর পরে তাদের একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়, যার নামও রাখা হয় জোয়ান। কিন্তু রাজার বিরোধীপক্ষ সবসময়ই বলে এসেছে যে, জোয়ান আসলে রাজার প্রকৃত মেয়ে না। বরং আলবার্কার্কির ১ম ডিউক বেল্ত্রান দ্য লা কুয়েভার সাথে রানীর অবৈধ সম্পর্কের ফলেই জন্ম হয়েছিলো জোয়ানের। পরবর্তীতে বিশপ ফন্সেকার ভাগ্নের সাথে সম্পর্কের ফলে রানীর আরো দুই সন্তানের জন্ম হলে বিরোধীদের দাবি আরো জোরদার হয়। একইসাথে রাজাকে নপুংসক নামে ডাকতে থাকারাও যেন গলায় আরো জোর খুঁজে পান।
নবম আলফন্সো
আইবেরিয়ান উপদ্বীপের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত লিওন রাজ্যের রাজা ছিলেন নবম আলফন্সো। বাবার মৃত্যুর পর ১১৮৮ সালে লিওনের সিংহাসনে বসেন তিনি, ছিলেন ১২৩০ সালে নিজের মৃত্যুর আগপর্যন্ত।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আলফন্সো যখন কোনো বিষয়ে উত্তেজিত হয়ে যেতেন, তখন তার মুখ দিয়ে লালা ঝরতো। এজন্য মজা করে লোকে তার নাম দিয়েছিলো ‘লালা ঝরা রাজা’।
প্রথম সেবাস্টিয়ান
পর্তুগাল ও আল্গ্রেভসের রাজা প্রথম সেবাস্টিয়ান তার জন্মের দু’সপ্তাহ আগেই অর্থাৎ মায়ের গর্ভে থাকাকালেই রাজা হিসেবে ঘোষিত হন। কারণ জন্মের দু’সপ্তাহ আগে তার বাবা মারা যান। তার দাদা তৃতীয় জন মারা গেলে মাত্র তিন বছর বয়সে সিংহাসনে আসীন হন সেবাস্টিয়ান। চব্বিশ বছর বয়সে যুদ্ধরত অবস্থায় যখন সেবাস্টিয়ান মারা যান, তখনও বিয়ে করেন নি তিনি। ঐতিহাসিকদের মতে, নারী সংস্পর্শেও কখনো আসা হয় নি সেবাস্টিয়ানের। তাই ‘ভার্জিন কিং’ নামেই পরিচিত ছিলেন এ রাজা।
প্রথম উইলিয়াম
১১৫৪ থেকে ১১৬৬ সাল পর্যন্ত সিসিলির রাজা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন প্রথম উইলিয়াম। শাসক হিসেবে শুরুতে বেশ ভালোই দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন উইলিয়াম। তার সময়ে সেখানে শিক্ষার প্রসার ঘটে। বিভিন্ন ধর্মেও প্রতিও তিনি সহনশীল ছিলেন বলে জানা যায়।
তবে এতকিছুর পরেও রাজার কপালে একটি ডাকনাম জুটে যায়- ‘খারাপ’। কেন্দ্রের শাসনক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে সিসিলির ব্যারনদের ক্ষমতার অবদমন জনতার কাছে তার অবস্থানের অবনমন ঘটায়। ১১৬০ সালে আফ্রিকায় সিসিলির অধিকৃত অঞ্চলগুলো হাতছাড়া হয়ে যায়। পরবর্তীতে রাজ্যজুড়ে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহও শুরু হয়। ফলে ‘খারাপ’ ডাকনামটি একেবারে পাকাপোক্তভাবেই কপালে জুটে যায় এ রাজার।
প্রথম মেরি
ইংল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের রাণী প্রথম মেরি ১৫৫৩-১৫৫৮ সাল পর্যন্ত মাত্র ৫ বছর ক্ষমতায় আসীন ছিলেন। কিন্তু এ ক’বছরের মাঝেই কুখ্যাত এক ডাকনাম বাগিয়ে নেন মেরি- ‘নিষ্ঠুর মেরি’।
রাণী মেরি মনে-প্রাণে ছিলেন একজন ক্যাথলিক। ১৫৫৩ তে তাই যখন তিনি ক্ষমতায় আসলেন, তখনই তিনি প্রতিজ্ঞা করে নেন যেভাবেই হোক ইংল্যান্ডে ক্যাথলিসিজম ফিরিয়ে আনতে হবে। এ উদ্দেশ্যে রোমের সাথে ইংলিশ চার্চের যোগসূত্র স্থাপন করেন তিনি। ১৫৫৫ সালে বাইবেলের ইংরেজি অনুবাদ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এ সময়ে তার নির্দেশে প্রায় ২৮০ জন প্রোট্যাস্টান্ট ব্যক্তিকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছিলো। এ ঘটনাগুলোই মেরির ‘নিষ্ঠুর’ ডাকনামের জন্য দায়ী।
রাণী ভিক্টোরিয়া
গ্রেট ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ডের রাণী এবং পরবর্তীতে ১৮৭৬ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের সম্রাজ্ঞীর খেতাব পাওয়া ভিক্টোরিয়ার শাসনকাল ছিলো অনেক দীর্ঘ। ১৮৩৭-১৯০১ সাল পর্যন্ত প্রায় ৬৪ বছর রাজত্ব করেছেন তিনি।
৯ সন্তানের এ জননীর পরবর্তীকালে ৪২টি নাতি-পুতি হয়েছিলো যাদের ইউরোপের নানান রাজবংশে বিয়ে হয়। যেমন- তার বড় ছেলে সপ্তম এডওয়ার্ড বিয়ে করেছিলেন ডেনমার্কের রাজা নবম ক্রিশ্চিয়ানের মেয়ে আলেক্সান্ড্রাকে। বর্তমান নেদারল্যান্ডের রাজা উইলেম-আলেক্সান্ডার ছাড়া ইউরোপের এমন কোনো রাজপরিবার নেই যার সাথে রাণী ভিক্টোরিয়ার রক্ত কিংবা বৈবাহিক দিক দিয়ে সম্পর্ক নেই। এ কারণে তাকে ‘ইউরোপের দাদী’ বলা হয়!
তৃতীয় জর্জ
১৭৬০-১৮২০ সাল পর্যন্ত গ্রেট ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ডের রাজা হিসেবে দায়িত্ব পালন করা তৃতীয় জর্জ ছিলেন ব্রিটিশ রাজপরিবারের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশিকাল রাজা হিসেবে থাকা ব্যক্তি। তবে এ পরিচয়ের বাইরেও আরেকটি পরিচয় ছিলো তার। জাঁকজমকপূর্ণ রাজকীয় জীবন ছেড়ে মাঝে মাঝেই তিনি চলে যেতেন গ্রাম্য এলাকাগুলোয়। সেখানে তার জমিতে টুকটাক সবজির চাষ করতেন অবসর পেলেই। এজন্যই তার নাম হয়ে গিয়েছিলো ‘কৃষক জর্জ’।
সপ্তম হেনরি
মধ্যযুগে ইংল্যান্ডের রাজা হিসেবে দায়িত্ব পালন করা সপ্তম হেনরির শাসনকালের মেয়াদ ছিলো প্রায় ২৪ বছর (১৪৮৫-১৫০৯)। ইংল্যান্ডে টিউডরদের গোড়াপত্তনকারী এ রাজা একইসাথে ছিলেন ঝানু ব্যবসায়ী। তার সময়ে রাজ্যের বার্ষিক আয় তিনগুণ বেড়ে ১,৪২,০০০ ইউরোতে গিয়ে ঠেকে (বর্তমানের হিসেবে ৯,০০,০০,০০০ ইউরো)। এর পেছনে যেমন রাজার নিজের তুখোড় ব্যবসায়িক বুদ্ধি কাজ করেছিলো, তেমনি ছিলো তার লর্ড চ্যান্সেলর জন মর্টনের অনমনীয় কর নীতিও। এসব কারণে তাকে ‘হিসাবরক্ষক হেনরি’ নামে ডাকতো সবাই। এছাড়া সমুদ্রপথে বাণিজ্যের দক্ষ পরিচালনার জন্য ‘ফেরিওয়ালা রাজা’ নামটিও নিজের দখলে নিয়েছিলেন সপ্তম হেনরি।
অষ্টম হেনরি
বাবার ব্যবসায়িক বুদ্ধির ছিটেফোঁটাও পান নি রাজা অষ্টম হেনরি। তার ব্যয়ের হাত ছিলো বেশ প্রসারিত। পাশাপাশি তখন ফ্রান্স ও স্কটল্যান্ডে চলা সামরিক অভিযানের জন্যও প্রচুর অর্থ ব্যয় হচ্ছিলো। এজন্যই শেষ দিকে এসে খরচ সামলাতে অনেক জায়গায়ই কাটছাঁট করতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। এর মাঝে অন্যতম উল্লেখযোগ্য ছিলো মুদ্রার উপাদানে পরিবর্তন। আগে যেসব মুদ্রা শুধুমাত্র রুপা ও সোনা দিয়ে বানানো হতো, হেনরির ব্যয় সংকোচন নীতির ফলে এগুলোর সাথে তামার মতো কম দামী ধাতু মেশানো হতো। এর ফলে মুদ্রাগুলো হতো অত্যন্ত নিম্নমানের। প্রায় সময়েই ঘষা দিলে উপরের হালকা রুপার স্তর উঠে গিয়ে ভেতরের সস্তা তামার স্তর উন্মুক্ত হয়ে যেতো। দুর্ভাগ্যজনকভাবে মুদ্রার যেদিকে রাজার মুখের ছাপ থাকতো, সেদিকটাই ঘষায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতো। এজন্য রাজার নাম হয়ে যায় ‘তামাটে নাকের বুড়ো’!
প্রথম এডওয়ার্ড
১২৭২ থেকে ১৩০৭ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩৫ বছর ইংল্যান্ডের সিংহাসনে আসীন ছিলেন রাজা প্রথম এডওয়ার্ড। দীর্ঘ এ শাসনামলে সাম্রাজ্যের উত্তর সীমানায় অনেক যুদ্ধের মোকাবেলা করতে হয়েছিলো তাকে। এজন্য তার ডাকনাম হয়ে যায় ‘স্কটদের হাতুড়ি’। আবার তার সময়ের অন্যান্য লোকদের তুলনায় বেশ লম্বা ছিলেন রাজা, ৬ ফুট ২ ইঞ্চি। এজন্য তাকে ‘লম্বা পায়ের রাজা’ নামেও ডাকতো অনেকে।
প্রথম রিচার্ড
১১৮৯ থেকে ১১৯৯ সাল পর্যন্ত দশ বছর ইংল্যান্ডের রাজার ভূমিকায় থাকা প্রথম রিচার্ডকে ‘সিংহ-হৃদয়ের রিচার্ড’ নামেই চেনে সবাই। সমরাভিযানের দক্ষতা ও নিপুণ কৌশলই তাকে এনে দিয়েছিলো এ নামটি। তবে তার আরেকটি ডাকনামও ছিলো ‘Oc-E-Non’ অর্থাৎ ‘হ্যাঁ এবং না’। ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কোনো কথা না বলে একেবারে সরাসরিই তা বলতে পছন্দ করতেন তিনি। এছাড়া তিনি ছিলেন বেশ স্বল্পভাষী। এজন্যই তার ভাগ্যে জুটেছিলো অদ্ভুত এ নাম।