খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতকে গোড়াপত্তন হওয়া অটোম্যান সাম্রাজ্যের পতাকা গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেওয়ার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন সুলতান ওসমান, তা তখনও ওসমানীয়দের স্বপ্নই থেকে গিয়েছিল। সাহসী যুদ্ধকৌশল, ভয়ডরহীন ক্ষিপ্রতা আর তীক্ষ্ণ রাজনীতি দিয়ে ওসমানীয়রা নিজেদের সাম্রাজ্যকে বিস্তৃত করলেও অভ্যন্তরীণ কোন্দল আর বিদ্রোহ যেন পিছু টেনে ধরছিল সবসময়। সুলতান প্রথম মেহমেদ ওসমানীয়দের জন্য অনেকটা আশির্বাদরূপে আবির্ভূত হন। তিনি অভ্যন্তরীণ কোন্দল আর বিদ্রোহ মিটিয়ে সাম্রাজ্যকে একটি স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে আসতে সক্ষম হন। তার অনুসারীদের শুধু প্রয়োজন ছিল এই সার্বভৌমত্ব ধরে রেখে সাম্রাজ্যের বিস্তৃতির দিকে নজর দেওয়া।
প্রথম মেহমেদের ছেলে সুলতান দ্বিতীয় মুরাদ সেই কাজে অনেকটাই সফল হয়েছিলেন। তিনি বেশ দক্ষ যোদ্ধা এবং একজন তীক্ষ্ণ কূটনীতিক ছিলেন। যুদ্ধের থেকে শান্তির প্রতি তার ঝোঁক ছিল বেশি। সাম্রাজ্যের স্বার্থে যুদ্ধ এড়াতে তিনি বেশ কিছু লাভজনক সন্ধির মাধ্যমে শান্তি বজায় রাখতে সক্ষম হন। এ সময়টা ছিল অটোম্যান সাম্রাজ্যের সূর্যের দীপ্তি ছড়ানোর কাল। একটি গোত্র থেকে ওসমানীয়রা ইসলামের শাসন ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন দিগ্বিদিক। ঠিক এমন সময়ে মুরাদের এক দাসীর কোল আলোকিত করে জন্ম নেন অটোম্যান ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজয়ী সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদ।
সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদ ১৪৩২ সালের ৩০ মার্চ, তত্কালীন অটোম্যান রাজধানী আদ্রিয়ানোপোলে জন্মগ্রহণ করেন। তার মায়ের পরিচয় সম্পর্কে খুব একটা জানা যায় না। খুব সম্ভবত তিনি কোনো খ্রিস্টান পরিবারের মেয়ে ছিলেন এবং দাসী হিসেবে অটোম্যান হারেমে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তবে নিশ্চিতভাবে তিনি সুলতান মুরাদের বিবাহিত স্ত্রী ছিলেন না। তাছাড়াও মেহমেদের বড় ভাইয়েরা ছিলেন মুরাদের উচ্চবংশীয় বিবাহিত বা স্বীকৃত স্ত্রীর সন্তান, তাই বলার অপেক্ষা রাখে না, মেহমেদ শৈশবে তার ভাইদের তুলনায় পিতার সুদৃষ্টির অপেক্ষাকৃত দুর্বল দাবিদার ছিলেন। শুধু পিতার সুদৃষ্টি নয়, তার বড় শাহজাদাদের কারণে সিংহাসনের দাবিদার হিসেবেও তিনি ছিলেন উপেক্ষিত। কিন্তু সিংহাসন কখন কার দিকে তাকিয়ে হাসবে, সেটা বলা যে বড়ই মুশকিল!
‘মেহমেদ’ তুর্কি ভাষার একটি শব্দ, যার অর্থ প্রশংসনীয়। বাংলায় ‘মোহাম্মদ’ শব্দটিও একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। তাই বাংলায় অনেকে তাকে দ্বিতীয় মোহাম্মদ নামেও চেনেন। তবে এই সিরিজে আমরা তার নামের তুর্কি ভাষার উচ্চারণের রীতিতেই এগোব। তাহলে এবার ঢুকে পড়া যাক, ইসলামের ইতিহাসের অন্যতম বীর এই সুলতানের জীবনের ঘটনাবহুল ইতিহাসের পাতায়।
জন্মের দু’বছর পর দাসীর হাতে বড় হয়ে ওঠা মেহমেদকে পাঠানো হয় আমাসিয়াতে। এটি ছিল আনাতোলিয়ার একটি প্রসিদ্ধ ও ধর্মীয় গাম্ভীর্যপূর্ণ স্থান। মাত্র ছ’বছর বয়সে আমাসিয়ার প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব নেন তিনি। সুলতান মুরাদ তার ছেলেদের রাজধানীর বাইরে রাখতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন, যাতে বিদ্রোহের ক্ষতি তাদের ছুঁতে না পারে। এর মধ্যেই মেহমেদের বড় ভাই মারা যান এবং অপর বড় ভাই আলী ম্যাগনেসিয়ার শাসক নিযুক্ত হন। পিতার আদেশে মেহমেদ এবং আলী নিজেদের কর্মক্ষেত্র অদল-বদল করেন। অর্থাৎ, মেহমেদ চলে যান ম্যাগনেসিয়া, আর আলী নিযুক্ত হন আমাসিয়াতে।
কিন্তু হঠাৎ একদিন বিছানায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আলী মৃত্যুবরণ করলে মেহমেদ হয়ে পড়েন মুরাদের সবচেয়ে বড় জীবিত শাহজাদা, যাকে এখনকার দিনে বলা হয় ‘ক্রাউন প্রিন্স’। এর মধ্যেই মুরাদ একবার মেহমেদকে আদ্রিয়ানপোলে ডেকে পাঠান এবং তার শিক্ষা-দীক্ষার দুরবস্থা দেখে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন। আসলে ছেলেবেলায় মেহমেদ ছিলেন বেশ একগুঁয়ে স্বভাবের। এজন্য শিক্ষকেরা তার সাথে পেরে ওঠেননি। ফলে, শৈশবে শিক্ষা-দীক্ষার একটা বড় ঘাটতি দেখা দিয়েছিল তার মাঝে।
সাম্রাজ্যের ভবিষ্যত সুলতানের এহেন অবস্থা দেখে মুরাদ বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন এবং একজন যোগ্য শিক্ষক খুঁজতে থাকেন। তখনকার সময়ে আহমেদ কৌরানি নামক একজন দুনিয়াত্যাগী আল্লাহ-ভীরু মৌলভীর সুখ্যাতি ছিল। মুরাদ নিজেও তাকে বেশ সম্মানের চোখে দেখতেন। এমনকি সাক্ষাতের সময় রীতিবিরুদ্ধভাবে সুলতান মুরাদ সেই ধর্মীয় শিক্ষকের হাতে চুমু খেতেন, যা সুলতানের প্রতি সম্মান দেখাতে সবাই করে থাকেন। তিনি এই দ্বীনি মৌলভীকে নিজের শাহজাদার শিক্ষার দায়িত্বের জন্য নিয়োগ করেন।
এখানে ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায় যে, মুরাদ মৌলভীকে একটি বেত দেন, যাতে মেহমেদ তার অবাধ্য হলে অবশ্যই এই বেতের ব্যবহার করা হয়। শুরুর দিকে শিক্ষকের কথার অবাধ্য হলেও ব্যাপক মারধরের ভয়ে একসময়ের একগুঁয়ে স্বভাব থেকে বেরিয়ে আসতে থাকেন মেহমেদ। তিনি নিজেকে করে তোলেন আরো সংযত, আরো ধৈর্যশালী। ম্যাগনেসিয়াতে চলতে থাকে মেহমেদের নিজেকে ভেঙে নতুন করে গড়ার প্রশিক্ষণ। অন্যদিকে মুরাদ চলে যান হাঙ্গেরি অভিযানে।
শুরুতেই বলেছি, মেহমেদের পিতা সুলতান মুরাদ ছিলেন একজন শান্তিকামী শাসক। ১৪৩৮ সালের দিকে মুরাদ হাঙ্গেরি দখল করে নিলে পোপের নেতৃত্বে ক্রুসেডার খ্রিস্টান বাহিনী মিত্রশক্তি গঠন করে এবং অটোম্যান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা করে। হাঙ্গেরির ক্ষমতাধর সেনাপতি হুনিয়াদির নেতৃত্বে ক্রুসেডাররা চরম আঘাত হানে ওসমানীয় বাহিনীর উপর। যুদ্ধের ভয়াবহতা এড়াতে ১৪৪৪ খ্রিস্টাব্দে সিজ্জাদানে দশ বছরের শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় অটোম্যান আর হাঙ্গেরিয়ান নেতৃত্বের ক্রুসেডারদের মধ্যে।
ছেলে আলীর মৃত্যুতে এমনিতেই শোকে পর্যবসিত হয়েছিলেন সুলতান মুরাদ। আর অন্যদিকে সাম্রাজ্যের শত্রুদের সাথেও শান্তি স্থাপিত হয়েছিল। তাই এবার তিনি রাজকার্যের ভার থেকে মুক্ত হয়ে নিভৃতে ধর্মচর্চা করার জন্য মনস্থির করলেন। তিনি মেহমেদকে রাজধানী ডেকে পাঠালেন এবং শাসনভার তার হাতে তুলে দিলেন। এভাবেই শাহজাদা মেহমেদ হয়ে উঠলেন অটোম্যান সাম্রাজ্যের সপ্তম সম্রাট ‘সুলতান মেহমেদ’। পুত্র মেহমেদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে মুরাদ স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যান এশিয়া মাইনরে।
মেহমেদ যখন সিংহাসনে বসেন, তখন তার বয়স মাত্র চৌদ্দ বছর। তবে তিনি ততদিনে উপযুক্ত গুরুর শিষ্যত্বের মাধ্যমে তিনি জ্ঞান, গরিমা এবং চারিত্রিক গুণাবলিতে বিকশিত হয়ে উঠেছেন। কিন্তু, ইউরোপের খ্রিস্টানরা এই বালক সুলতানের অনভিজ্ঞতার সুযোগ নিতে চাইল; তাদের বাহিনী সুলতান মুরাদের অবসরে যাওয়ার খবর পেয়েই শান্তিচুক্তি ভেস্তে দিল। বৃহৎ বাহিনী সংগঠিত করে তারা অগ্রসর হলো অটোম্যান অধ্যুষিত অঞ্চলের দিকে। এদিকে নতুন সুলতান পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুভব করে পিতাকে ফিরে আসার জন্য পত্র পাঠিয়ে অনুরোধ জানালেন। কিন্তু সুলতান মুরাদ সেই অনুরোধ ফিরিয়ে দিয়ে নিজে থেকেই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার পরামর্শ দিলেন। এদিকে খ্রিস্টান বাহিনী বড়সড় আক্রমণের জন্য একেবারে প্রস্তুত ছিল। মেহমেদের কাছে এ অভিজ্ঞতা ছিল একেবারে নতুন। উপায়ন্তর না দেখে তিনি আবার তার পিতা সুলতান মুরাদকে চিঠি লিখলেন, যার সারমর্ম ছিল-
“আপনি যদি সুলতান হন, দ্রুত বাহিনীর দায়িত্ব নিয়ে জনগণকে রক্ষা করুন। আর যদি আমি সুলতান হয়ে থাকি, তবে আপনাকে আদেশ করছি, রাজধানীতে ফিরে আসুন এবং জনগণকে রক্ষা করে শত্রুদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হোন।”
সাম্রাজ্যের এই খারাপ সময়ে মুরাদ তাই স্বেচ্ছা অবসর ত্যাগ করে রাজধানীতে ফিরে আসেন এবং রাজ্যভার গ্রহণ করেন। ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র দু’বছরেরও কম সময়ের ব্যবধানে সিংহাসনচ্যুত হন সুলতান মেহমেদ। এরপর মুরাদ অটোমান বাহিনী নিয়ে খ্রিস্টান বাহিনীকে পরাস্ত করতে অগ্রসর হন। ১৪৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১৭ অক্টোবর, কসোভোর মাটিতে তিনদিন স্থায়ী রক্তক্ষয়ী এই যুদ্ধে অটোমান সৈন্যরা নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। এ যুদ্ধে মুরাদ হাঙ্গেরিয়ান রাজ্যগুলোর কোমর এমনভাবে ভেঙে দেন যে তারা আর সহজে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এরপর মুরাদ আবার অবসরে চলে যান। অনেক সময় অনেক শাসকই স্বেচ্ছা অবসরে গেছেন কিন্তু সুলতান মুরাদ ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি, যিনি দু’বার স্বেচ্ছা অবসর গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু এবারেও তার অবসর বাসনা পূর্ণতা পেল না। দ্বিতীয় অবসরে যাওয়ার সাথে সাথেই তিনি খবর পান, জেনিসারি সৈন্যরা বেতন বাড়ানোর দাবিতে বিদ্রোহ করে বসেছে।
সুলতান মেহমেদ তখন ছিলেন একজন অল্পবয়স্ক ও অপরিণত যুবক। জেনিসারিদের এ বিদ্রোহ ছিল অনেকটা অনাস্থা প্রকাশের সংকেত। এর মাঝেই প্রধান উজির হালিল পাশা মুরাদের কাছে পরিস্থিতির সুদূরপ্রসারী প্রভাব তুলে ধরে সুলতান মেহমেদের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেন। সুলতান মুরাদ কালবিলম্ব না করে সাম্রাজ্য বাঁচাতে অবসরের চিন্তা ছেড়ে দিয়ে রাজধানীতে চলে আসেন এবং শাসনভার আবারও নিজের হাতে তুলে নেন। দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতা হারান মেহমেদ। এরপর থেকেই প্রধান উজির হালিল পাশার সাথে দূরত্ব বাড়তে থাকে তার। সুলতান মুরাদ অবসর যাপনের সিদ্ধান্ত বাদ দিয়ে এবার করে মেহমেদকে পাঠিয়ে দেন আনাজুলের প্রশাসক হিসেবে, মানিসায়। তার সাথে দিয়ে দেন পূর্বের মতোই কিছু জ্ঞানী ও আধ্যাত্মিক শিক্ষক। মুরাদের শাসন চলতে থাকে অটোম্যান সাম্রাজ্যের উপর। অন্যদিকে মানিসায় আগুনে পুড়ে স্বর্ণের মতো দীপ্তি ছড়ানোর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকেন মেহমেদ।
৩ ফেব্রুয়ারি, ১৪৫১ সালে ওসমানীয়দের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুলতান দ্বিতীয় মুরাদ মৃত্যুবরণ করেন। এত বছরের চড়াই-উতরাই, সিংহাসনের ইঁদুরদৌড় খেলার পর অবশেষে মেহমেদের সামনে সুযোগ আসে আধিপত্য বিস্তার করে মহান এক সাম্রাজ্যের শাসনভার কাঁধে তুলে নেওয়ার। ততদিনে তিনি যোগ্য হয়ে উঠেছেন। ধর্মীয় শিক্ষা, চারিত্রিক ও মানবীয় গুণাবলী, তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক জ্ঞান, সব মিলিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন এক বলিষ্ঠ অটোম্যান উত্তরাধিকারী। ইংরেজ ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড গিবন মেহমেদের এই বলিষ্ঠতা বর্ণনা করেছেন এভাবে,
“তার ঠোঁটে ছিল শান্তির বাণী, হৃদয়ে ছিল যুদ্ধের ঝঙ্কার।”
সবকিছু পেছনে ফেলে মেহমেদের সময় এখন ইতিহাসকে নতুন করে লেখার, রচনা করার এমন এক অমরত্বের আখ্যান, যা পারেনি তার কোনো পূর্বপুরুষ। মেহমেদের নজর এবার দ্য রেড অ্যাপল!
(চলবে…)