কেন পড়বেন সানজু’র ‘দ্য আর্ট অফ ওয়্যার’?

সানজু আর তার ‘দ্য আর্ট অব ওয়ার’কে বাতিল আর অচল বলার লোক এই একবিংশ শতাব্দীতে আপনি অনেক পাবেন। যেমন খ্রিস্টের জন্মেরও পাঁচশ বছর আগে এই লোক বলে গেছেন, ভুলেও কেউ যেন দেয়াল দিয়ে ঘেরা কোনো শহর আক্রমণ করতে না যায়। কিন্তু এই আধুনিক যুগে শহরের চারপাশে কেউ আর দেয়াল বানায় না, তাছাড়া দেয়াল ভাঙার জন্যও এখন আর হাতুরি-বাটাল লাগে না। বোমা মেরেই উড়িয়ে-গুড়িয়ে দেয়া যায়। তাই এই একবিংশ শতাব্দীতে তার এই বক্তব্যের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। তারপরও এই বই এখনো অনেকেই পড়েন, সামরিক বাহিনীর লোকেরা বেশি পড়েন, আবার ব্যবসায়ী আর স্ট্র্যাটেজিস্টরাও পড়েন! তাহলে সানজু আর তার ‘দ্য আর্ট অব ওয়ার’ কেন আজও এর আবেদন হারাচ্ছে না? রহস্যটা কি?

Source: Amazon UK

আমার নিজের ধারণা ছিল, আগেকার দিনে রাজায় রাজায় যুদ্ধ হত, আর যুদ্ধের ময়দানে ঢাল-তলোয়ার আর তীর-ধনুক নিয়ে দুই পক্ষ হা-রে-রে বলে একে অন্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তো। যার সৈন্য সংখ্যা আর সৈন্যের মান যত ভাল, শেষপর্যন্ত সে-ই জিতত। কিন্তু ঘটনাচক্রে একদিন কোনো কিছু পড়ার না পেয়ে সানজুর দ্য আর্ট অব ওয়ার নামের বইটা পড়তে শুরু করলাম। এই বই বিভিন্ন লাইব্রেরির শেলফে সযত্নে পড়ে থাকে। নানান অজুহাতে আমাদের অনেকেই এটা পড়ার আগ্রহ পাই না। দ্য আর্ট অব ওয়ার ১৩ অধ্যায়ের ছোটো একটি বই। শুরুতে মনে হল ডেল কার্নেগির বইয়ের মতো কোনো উপদেশের বই, ‘এটা করো না; এটা করলে ওটা হবে’ গোছের সব কথাবার্তা!

ডেল কার্নেগি; Source: Famous Authors

কিন্তু বই শেষ করার পর আমার প্রথম উপলব্ধি হল, এই বই কিভাবে খ্রিস্টের জন্মের ৫০০ বছর আগে লেখা হলো! অভাবনীয়! যুদ্ধে ট্যাকটিক্স বলতে যে একটা জিনিস আছে আর ঐ আমলের লোকেরা যে এই বিদ্যায় কতটা পারদর্শী ছিল তা জেনে আমার এতদিনের ভুল ধারণার জন্য কিঞ্চিত লজ্জিতই হলাম। মজার ব্যাপার হলো, এই বই অনেকবার পড়ার পরও প্রতিবারই সানজুর একই লেখায় আমি নতুন নতুন অ্যাঙ্গেল খুঁজে পাই। যেন একই স্পটে আরেকবার ফিরে তাকাবার পর দেখলেন অনেক ডিটেইলস, যা আগেরবার চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল। যেমন ধরুন এই দেয়াল ঘেরা শহর আক্রমণ করতে সানজুর বারণের কথা।

প্রাচীনকালে গুরুত্বপূর্ণ শহর, এমনকি গোটা দেশের চারপাশ ঘিরে প্রতিরক্ষা প্রাচীর নির্মাণ করা হত, যেন শত্রু এসে বিনা বাধায় কোনো শহর দখল করে ফেলতে না পারে। কেউ আক্রমণ করতে এলে শহরের মূল ফটক আটকে দিয়ে, অস্ত্রপাতি আর রসদ নিয়ে শহরের ভেতর থেকেই দিনের পর দিন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া যেত। অগত্যা প্রতিপক্ষকে বাধ্য হয়েই শহর অবরোধ করতে হত। কিন্তু ভেবে দেখুন, আপনি কয়েক শ’ মাইল দূর থেকে এসে কতদিন একটা শহর অবরোধ করে রাখবেন? এমনিতেই শহরবাসী সুযোগ পেলেই আপনার তাবুর উপর তীর-পাথর-গরম পানি ছুড়ে মারে। তার উপর আপনার রসদ আনতে হয় সেই একশ মাইল দূর থেকে। আবার দেয়াল বেয়ে উঠতে গেলে অথবা দেয়াল ভাঙতে গেলেই উপর থেকে বৃষ্টির মত তীর-বর্শা ধেয়ে আসে।

একটি সুরক্ষিত শহর; Source: Touropia

আপনি সেনাপতি, যুদ্ধ করতে এসেছেন, দাবা খেলতে নয় যে, দিন শেষে দুই ঘুঁটি নিয়ে জিতলেই চলবে। নিজের সৈনের প্রতি আপনার মায়া আছে, আর আপনি জানেন, অনন্তকাল ধরে যুদ্ধ করতে এরা সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয় নি। যথারীতি আপনি বলটা এবার আপনার রাজার কোর্টে পাস করে দিলেন। রাজা হিসেব করে দেখলেন, পরিণামে তার লাভ তেমন নেই। শত্রুর দেয়ালের পাশে বসে অবরোধ করার চেয়ে তার ব্যবসা বাণিজ্যের রাস্তা আটকে দেয়া অনেক সহজ আর লাভজনক, অথচ ফায়দা তো সেই একই। তো আপনার সেনাবাহিনীর জন্য আরেক চালান রসদের প্রয়োজন পড়ার আগেই তিনি আপনাকে ফিরে আসার নির্দেশ দেবেন। আর যদি রাজা তার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন, তাহলে আরো কিছু সৈন্য পাঠিয়ে দেবেন। এবার আপনি আপনার করণীয় সম্পর্কে নিশ্চিত। লা-পরোয়া হয়ে আপনি একটা ঝটিকা আক্রমণ করবেন, পঙ্গপালের মতো আপনার সেনাও মরবে, প্রতিপক্ষকেও মারবে। একসময় শহরের পতন হবে, আর আপনি নিজ হাতে রাজার ঝান্ডা উড়িয়ে রাজার কাছে বার্তা পাঠাবেন, ‘মিশন একমপ্লিশ্ড!’ গর্বিত রাজা খুশি হয়ে আপনাকে পুরস্কৃত করবেন।

Source: Airheadsfly.com

এ তো গেল আদ্দিকালের কথা। কিন্তু এই আধুনিককালে তো দেয়ালের বাঁধা কোনো বাঁধাই না। এমনকি হাজার মাইল দূরে বসেই মিসাইল দিয়ে এমন দেয়াল গুঁড়িয়ে দেয়া কোনো ব্যাপারই না। তাহলে কি সানজুর কথাটা অচলই হয়ে গেল? এই কুইজটা বুঝতে হলে আপনাকে একটু কাল্পনিক হতে হবে। আগে শহরের ডিফেন্সে যে দেয়ালটা ছিল সে-রকম একটা দেয়াল তো আর এখন চাইলেই সারা দেশের চারদিক ঘিরে দেয়া যায় না। তার দরকারও নেই। কারণ শত্রুও তো এখন আর ঢাল-তলোয়ার-তীর-বল্লম নিয়ে আসে না। এখনকার যেকোনো আক্রমণ (অফেন্সিভ) শুরুই হয় বিমান হামলা দিয়ে। প্রথমেই সফল একটি বিমান হামলা চালিয়ে সে আপনার বিমানবাহিনী আর এয়ার-ডিফেন্সকে ধ্বংস করে নেবে। তারপর সে তার স্থলবাহিনী পাঠাবে আপনার সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করতে। কিন্তু কোনোভাবে একবার যদি আপনি শত্রুর ঐ বিমান হামলাটি বানচাল করে দিতে পারেন, তাইলেই কেল্লাফতে। শত্রু এবার তার স্থল-অভিযান আদৌ শুরু করবে কিনা সেটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। এই ফাঁকে আপনি দরকষাকষি শুরু করতে পারেন, জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাকে ডাকুন, সামর্থ্য থাকলে আপনি নিজেই প্রতি-আক্রমণে (কাউন্টার অফেন্সিভ) যেতে পারেন।

মোদ্দা কথা হল, শত্রুর বিমান হামলা ঠেকানোর জন্য আপনার একটা প্রতিরক্ষা দেয়াল দরকার। এই দেয়ালটাকে এই যুগে বলে এয়ার ডিফেন্স। তো সানজু কি ভুল কিছু বলেছেন? তার সময়কার ইট-পাথরের দেয়াল বলতে আপনাকে আধুনিক সময়ের এয়ার ডিফেন্সকেই বুঝে নিতে হবে। এখন আপনার যদি একটা আধুনিক এয়ার ডিফেন্সের দেয়াল থাকেই, তাহলে সানজু কিন্তু আপনাকে নয়, বরং আপনার শত্রুর জন্যই বলছেন, “প্রাচীরবেষ্টিত নগর আক্রমণ করা সমীচিন নহে।

 

আবার প্রাচীর ছাড়া আধুনিক শহরের কথাই যদি বলেন, তো পার্সিয়ান গালফ ওয়ারের (১৯৯০-৯১) কথা স্মরণ করুন। স্থল অভিযান শুরুর আগে বহুজাতিক বাহিনী বিমান হামলার মাধ্যমে ইরাকের এয়ার ডিফেন্সসহ অন্যান্য সামরিক সামর্থ্যগুলো একের পর এক গুড়িয়ে দিচ্ছিল। হঠাৎ এক ভুল গোলাবর্ষণের ফলে শতাধিক বেসামরিক ইরাকি নাগরিকের মৃত্যুতে বিশ্বজনমত প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠল। এর ফলে বহুজাতিক বাহিনী ইরাকি শহরের ভেতর বিমান আক্রমণের বদলে স্কাড হান্টে মনোযোগ দিতে বাধ্য হয়। এ ধরনের কোলেটেরাল ড্যামেজ (সামরিক অভিযানের কারণে অসামরিক জান-মালের ক্ষয়ক্ষতি) ছাড়াও নগর বা বিল্ড-আপ এরিয়াতে যুদ্ধ অত্যন্ত বিপজ্জনক, ব্যয়বহুল আর সময়সাপেক্ষ বলে একেবারে নিরুপায় না হলে কোনো কমান্ডারই তার বাহিনী নিয়ে নগর আক্রমণ করতে যেতে চান না।

Source: history.com

সানজুর দ্য আর্ট অফ ওয়ার-এর আবেদন চিরায়ত। বাঁশের চাটাইয়ের ওপর লিখে যাওয়া তার বই প্রায় দু’হাজার বছর ধরে যুদ্ধবিদ্যার ছাত্রদের অন্যতম পাঠ্য। মাও সে তুং, গিয়াপ আর হালের ম্যাক আর্থারের মতো সেনানায়কেরা তার এই বই থেকে প্রেরণা নিয়েছেন বলে স্বীকার করে গেছেন। স্ট্র্যাটেজি, ট্যাকটিক্স আর লজিস্টিক্সের মতো সমরবিদ্যার জটিল অথচ আবশ্যক বিষয়গুলো নিয়ে চর্চার শেষ নেই। খোদ ‘আর্ট অফ ওয়ার’ নামেই ম্যাকিয়েভেলি আর জোমেনির আলাদা বই আছে। এক্ষেত্রে সমরবিশেষজ্ঞ হিসেবে ক্লসউইৎজ, চানক্য অথবা লিডেলহার্টের অবদানও কম নয়। তবে সমরবিদ্যার একটা মজার দিক হল সমরতত্ত্ব বা সামরিক ইতিহাস কখনই সুনির্দিষ্ট সমাধান বাতলে দেয় না। যেমন ক্লসউইৎজের প্রিন্সিপালস অফ ওয়ার। যুদ্ধজয়ের প্রায় অমোঘ গাইডলাইন হিসেবে যুগ যুগ ধরে সমরবিদেরা এই প্রিন্সিপালস অধ্যয়ন করে আসছেন। কিন্তু কোনো একটি নির্দিষ্ট যুদ্ধে কখনই সবকটা প্রিন্সিপাল একযোগে অপরিহার্য হয়ে ওঠে নি।

Source: Amazon.com

যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সামরিক ক্ষেত্রেও বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ব্যবহার অনেক বেড়েছে। প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে এসব ক্লাসিক যুদ্ধ কৌশলের উপযোগীতা (অ্যাডাপ্টেশন) নিয়ে অনেকেই সন্দিহান। এ কথা অনস্বীকার্য যে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির কল্যাণে আধুনিক সমরাস্ত্রে বৈপ্লবিক উন্নয়ন ঘটে চলেছে। যেমন আগে তীর যেত সাকুল্যে ৩০০ মিটার, এখন আর্টিলারি রেঞ্জ বেড়ে হয়েছে প্রায় ১০ থেকে ১০০ কিলোমিটার, মিসাইল রেঞ্জ আরো বেশি। আগে তলোয়ার নিয়ে একহাতের মধ্যে লড়তে হত, এখন ভাল এসল্ট রাইফেল দিয়ে প্রায় ৩০০ মিটার দূর থেকেই সম্মুখযুদ্ধ চলে, ঘোড়া আর রথের তুলনায় আধুনিক ট্যাঙ্কের গতি এবং সামর্থ্য অনেক বেশি, ওয়্যারলেস আর স্যাটফোনের যোগাযোগ আগেকার ঘোড়সওয়ার দূত দের চেয়ে বহুগুণ দ্রুত আর নিশ্চিত, স্যাটেলাইট ইমেজও কাগুজে ম্যাপের চেয়ে ঢের বেশি তথ্যসমৃদ্ধ এবং নির্ভুল। কিন্তু যুদ্ধে সিদ্ধান্ত এখনো মানুষই নেয়, আবহাওয়ার পরিবর্তনও এখনো ঈশ্বরনির্ভর। তাই অধুনা কমান্ডাররাও এসব পরিবর্তন আর উন্নয়নের কথা মাথায় রেখেই তাদের পরিকল্পনা আর সিদ্ধান্ত গ্রহণের পদ্ধতি সমন্বয় করে নেন। তাই যতদিন প্রশিক্ষণ, পরিকল্পনা আর সিদ্ধান্ত নেয়ার কাজটা মানুষ করবে, তদ্দিন যুদ্ধের স্ট্র্যাটেজিক, অপারেশনাল আর ট্যাকটিক্যাল বিষয়গুলো কিছু শাশ্বত ‘প্রিন্সিপালস অফ ওয়ার’-এর মধ্যেই কিঞ্চিত এদিক সেদিক হয়ে পুনরাবৃত্তি হতেই থাকবে।

Source: The Independent

সমরতত্ত্ব আর সমর ইতিহাস অধ্যায়ন নিঃসন্দেহে একজন সমর নায়ককে শিক্ষিত করে তোলে। এই শিক্ষা একদিকে যেমন সমরকলার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে তাকে সচেতন করে তোলে, অন্যদিকে অতীতের উদাহরণ তাকে রণপরিকল্পনা প্রণয়নে আরো কুশলী হবার সুযোগ দেয়। আর তাই সমরতত্ত্ব আর সমর ইতিহাসকে বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করতে পারা একজন সমর নায়কের অত্যন্ত জরুরি যোগ্যতা। সানজুর ‘ম্যানুভারিস্ট অ্যাপ্রোচ,’ ক্লসউইৎজের ‘৩:১ অ্যাটাক রেশিও’ অথবা চানক্যের ‘ভ্রুণাবস্থায় শত্রুনিধন তত্ত্ব’-এর কোনটাই কিন্তু সমরাস্ত্র নির্ভর তত্ত্ব নয়। এটা সম্পূর্ণই সংশ্লিষ্ট সমরনায়কের ব্যক্তিগত সক্ষমতার বিষয় যে তিনি বর্তমান প্রেক্ষাপট আর বাস্তবতার নিরিখে কখন কোন পরিস্থিতিতে কার কোন তত্ত্বের প্রয়োগ করবেন। সমর ইতিহাস আর সমরবিদ্যা অধ্যয়নের কারণে সমরনায়ক থেকে সমরনায়কে পার্থক্য গড়ে ওঠে, এই পার্থক্যের জন্যই যুদ্ধে কেউ হারে আর কেউ জেতে। সানজুর সীমাবদ্ধতা হলো অনেক ক্ষেত্রেই তিনি সেই সময়কার সুনির্দিষ্ট উদাহরণ টেনে (স্পেসিফিক্স) এনেছেন, যেমন প্রাচীরবেষ্টিত শহর, শুয়াই জান সাপ অথবা অন্যান্য। কিন্তু বিচক্ষণ পাঠক মাত্রই এর নেপথ্যে লুকিয়ে থাকা সূত্র বা তত্ত্বটা ধরতে পারেন। আর এভাবেই স্মার্ট কমান্ডাররা আজও সানজুর দ্য আর্ট অব ওয়ার অধ্যয়ন করেন এবং এ থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা খুঁজে নেন।

Source: MilitaryImages.Net

এক মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম। কিন্তু জাতিগতভাবে আমরা কখনই ক্ষত্রিয়ের জাত ছিলাম না। রামায়ণ আর মহাভারত দুটোই কিন্তু যুদ্ধের ইতিকথা। তার মানে ট্যাকটিক্স আর স্ট্র্যাটেজিতে ভারতীয়রা চীনাদের চেয়েও পুরাতন। গুপ্তচরবৃত্তিতেও প্রাচীন ভারতের ইতিহাস ফারাও ইজিপসিয়ানদের সমসাময়িক। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এর কিছুই সংরক্ষিত হয় নি। চাণক্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ আমাদের একমাত্র সম্পদ। কিন্তু তা-ও আমাদের দেশে তেমন চর্চিত নয়। সানজু অথবা ক্লসউইৎজের লেখার মতো কোনো লেখা আমাদের কখনই ছিলো না। কিন্তু আমরা সবাই জানি, এটাই আমাদের শেষ যুদ্ধ নয়, আমাদের প্রতিনিয়ত আরেকটা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে, আর এই প্রস্তুতিই আমাদের অন্যতম রক্ষাকবচ। গ্যারান্টি দেয়া যায় যে, পরের যুদ্ধটা ১৯৭১-এর চেয়ে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং হবে। আর আমাদের মত ছোট রাষ্ট্রে সেনাবাহিনী একা কখনও যুদ্ধ করে না, জনতাকে সম্পৃক্ত হতেই হয়। তাই যুদ্ধের অ-আ-ক-খ জানা-বোঝা কিন্তু আমাদের সবার জন্যই জরুরি। অতএব ধার করে পড়া ছাড়া গত্যন্তর কই?

Source: Youtube

এমন উপলব্ধি থেকেই সানজুর দ্য আর্ট অব ওয়ার নিয়ে লেখার ইচ্ছে হল। প্রথমে স্রেফ অনুবাদ করতেই চেয়েছিলাম, কিন্তু করতে গিয়ে দেখি পাদটীকা দিতে দিতে পৃষ্ঠা ভরে যাবে। কারণ ‘টেরেইন,’ ‘মেনুভার’ আর ‘ওয়েজিং ওয়ার’-এর মতো শব্দের আক্ষরিক অনুবাদ অনেক ক্ষেত্রেই মূলভাব প্রকাশে যথেষ্ট নয়। তখন ভাবলাম ভাবানুবাদ করি। তাতে আবার আরেক সমস্যা, সানজুর ভাবটা ছিল চাইনিজ, প্রথম অনুবাদ করেছিল জনৈক ফ্রেঞ্চ পাদ্রি, কিন্তু পরে স্যামুয়েল গ্রিফিতের মতো বাকি অনুবাদকেরা সেই অনুবাদকে ‘অতি দুর্বল’ বলে প্রত্যাখ্যান করে বিভিন্ন চীনা গবেষকদের ব্যাখ্যাসহ ‘ইলাসট্রেটেড’ ভার্সন বের করলেন। বেশ সহজ ইংরেজিতেই লেখা এই ইংরেজি অনুবাদগুলো আগ্রহী পাঠক চাইলেই পড়তে পারবেন। তাহলে বাংলায় যারা পড়বেন তাদের জন্য চায়নিজ থেকে ইংরেজিতে একবার তর্জমা করা লেখা আরেক দফা অনুবাদ বা ভাবানুবাদ করে কী লাভ? তাছাড়া সানজু বা গ্রিফিত, এরা কেউই বাঙালি পাঠকের কথা ভেবে লেখেন নি। তার মানে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে না পারলে পাঠক দ্রুত আগ্রহ হারাবেন, আর সানজুর শিক্ষাগুলো যথারীতি পাঠকদের অজানাই থেকে যাবে। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম নিজের মতো করেই লিখব। নাম হোক ‘আধুনিক দৃষ্টিকোণে সানজু’র দ্য আর্ট অব ওয়ার।’ প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে পাদটীকা সংযোজন করা হয়েছে যেন আগ্রহী পাঠকরা ইচ্ছে করলেই আরো বেশি জানার সূত্রটা সহজেই খুঁজে নিতে পারেন। আশা করছি এ সিরিজের লেখাগুলো আপনাদের ভাল লাগবে।

সম্পাদকীয়

বিশিষ্ট লেখক ডেল এইচ খানের অনুমতিক্রমে রোর বাংলায় শুরু হতে যাচ্ছে ‘আধুনিক দৃষ্টিকোণে সানজু’র দ্য আর্ট অফ ওয়্যার’ সিরিজ। এ সিরিজের লেখাগুলো আগেও বই আকারে বের হয়েছে। তাহলে বইয়ের সাথে এখানে পার্থক্য কোথায়? পার্থক্য তো অবশ্যই আছে। এই বই পড়লে আপনার মনে হবে না যে, হাজার হাজার বছর আগের কোনো লেখকের লেখা পড়ছেন। লেখক সেভাবেই আমাদের মতো করে সহজভাবে বিষয়গুলো ফুটিয়ে তুলেছিলেন তার লেখনীর মাধ্যমে, তার মূল বইয়ে। তবে রোর বাংলার পাঠকদের জন্য তিনি আরো একটি নতুন বিষয় নিয়ে এসেছেন, তা হলো সানজু’র মূল বই!

হ্যাঁ, এখন থেকে সিরিজে প্রতিটি অধ্যায়ে লেখকের উপস্থাপনার পাশাপাশি সানজু আসলে কী বলতে চেয়েছিলেন, সেটাও লেখক সুন্দর করেই মূল লেখার সাথে জুড়ে দেবেন, যা ছিল না মূল বইয়ে। অর্থাৎ আধুনিক দৃষ্টিকোণের সাথে পরিচিত হয়ে নেয়া যাবে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণের সাথেও! তবে আর দেরি কেন? কোমর বেঁধে লেগে যান আমাদের অসাধারণ এই সিরিজটির একজন নিয়মিত পাঠক হতে!

ফিচার ইমেজ: Octopus Digital Strategy

Related Articles

Exit mobile version