যুগে যুগে নানান ভঙ্গিমায় নানান আঙ্গিকে বিকশিত হয়েছে শিল্প। শিল্প যেমন বর্তমানকে করেছে প্রজ্বলিত, তেমনি অতীতকে বানিয়েছে তার আধার। জ্ঞান, ইচ্ছে, শিল্প ও প্রাচুর্যের জাদুকরী ছোঁয়া জন্ম দিতে পারে মহান ও জগদ্বিখ্যাত শিল্পকর্মের। এভাবেই সৃষ্ট ইতিহাসের পাতায় অজর অমূল্য দুইটি নিদর্শন- ময়ূর সিংহাসন ও দরিয়া-ই-নূর। এদেরই গল্প নিয়ে আজ হাজির হয়েছি ‘লুণ্ঠিত ঐতিহাসিক নিদর্শনের গল্প’- শীর্ষক লেখাটির দ্বিতীয় পর্বে।
ময়ূর সিংহাসন, ভারত
ময়ূর সিংহাসন ইতিহাসের বুকে এক ভাস্বর নাম। অসামান্য ও অমূল্য এ নিদর্শনের কথা জানতে হলে আপনাকে ঘুরে আসতে হবে সপ্তদশ শতাব্দী থেকে। মুঘল সাম্রাজ্যের শাসনামলের স্বর্ণযুগ বলা হয় সম্রাট শাহজাহানের আমলকে। তাজমহলের নির্মাতা শাহজাহান কর্তৃক নির্মিত আরেকটি ঐতিহাসিক ও অসাধারণ নিদর্শন এই ময়ূর সিংহাসন- যা কিনা লাল কেল্লার ‘দিওয়ান-ই-খাস’ এর শোভা হিসেবে বিরাজমান ছিল। (তবে তাভেরনিয়ার এটিকে দিওয়ান-ই-আম এ দেখেছেন বলে উল্লেখ করেন, কাজেই ধরে নেয়া যায় সিংহাসনটির অবস্থান মাঝে মধ্যেই দিওয়ান-ই-খাস ও আমের মধ্যে বদল করা হতো)
সম্রাট শাহজাহান আদতে শৌখিন লোক ছিলেন, সেই সাথে মুঘল সম্রাট হবার গরিমাও কিছু কম ছিল না। শোনা যায় তার মতবাদ অনেকটা এমন ছিল যে, অযুত ধনরাশি ও রত্নাদি রাজকোষাগারে জমা রেখে কী লাভ? যদি না জনসম্মুখে তা জাহির করা যায়? মুঘল জৌলুস জাহির করবার ইচ্ছে থেকেই অনেকটা ময়ূর সিংহাসন তৈরির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন শিল্প ও সাহিত্যের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক এ সম্রাট।
ময়ূর সিংহাসন তৈরি করতে সময় লেগেছিল ৭ বছর, কিন্তু খরচ পড়েছিল তাজমহল তৈরির খরচের দ্বিগুণ। ময়ূর সিংহাসনের বর্ণনা অনেকেই দিয়েছেন, যার মধ্যে ঐতিহাসিক আব্দুল হামিদ লাহোরি, এনায়েত খান, ফরাসি পর্যটক ফ্রাঙ্কোইস বার্নিয়ার এবং ফরাসি জহুরী জিন ব্যাপ্টিস্ট তাভেরনিয়ার। সব মিলিয়ে এর সম্পর্কে যা জানা যায় তা হলো:
পারস্যের পঞ্জিকানুযায়ী ১০৪৪ সালের নওরোজ (পারস্য বসন্ত উৎসব) এবং ‘ঈদ-উল-ফিতর’ একই দিনে (১২ই মার্চ, ১৬৩৫ খ্রিষ্টাব্দ) পড়ায় সেটিকে খুবই শুভ সময় হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং সম্রাট ঐদিনই প্রথম সিংহাসনটিতে আরোহণ করেন। দিনটি একসাথে ছিল সম্রাটের রাজ্যাভিষেকের সপ্তম বর্ষপূর্তির এবং এদিন এভাবেই সিংহাসনটির উদ্বোধন হয়। সিংহাসনটিকে আগে তাখত-মুরাসা বা রত্নসজ্জিত সিংহাসন বলে ডাকা হতো। পরবর্তীতে এর উপরে ময়ূর থাকার জন্য এর নাম ময়ূর সিংহাসন বা তাখত-এ-তাভূস (তাউস) হয়। সে সময়ের প্রায় এক কোটি (মতান্তরে চার কোটি) রুপির মণিমাণিক্য সিংহাসনটিকে সাজাতে ব্যবহৃত হয়েছিল। সিংহাসনটির মুখ্য স্বর্ণকারিগর সাইদ গিলানিকে বিবাদাল খান (অতুলনীয় পন্ডিত) উপাধি, পুরস্কার ও সম্রাটের ওজনের সমান স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে সম্মানিত করা হয়।
তাভেরনিয়ারের মতে, সিংহাসনটি ছিল ৬ ফুট X ৪ ফুট, উচ্চতা কতো ছিল তা তিনি উল্লেখ করেননি, তবে কোণের ৪টি পায়ের প্রতিটির দৈর্ঘ্য ছিলো ২ ফুট। মতান্তরে লাহোরির মতানুযায়ী সিংহাসনটি ছিল ৯ ফুট X সাড়ে ৭ ফুটের, উচ্চতায় প্রায় ৫ গজের মতন। আবার এনায়েত খানের মতে তা ছিল লম্বায় সাড়ে তিন গজ, প্রস্থে আড়াই গজ এবং নিচ থেকে উপর পর্যন্ত উচ্চতা ছিল ৫ গজ। সিংহাসনটির ৬ টি পা ছিল। তাভেরনিয়ারের মতে, সিংহাসনের ২০ থেকে ২৫ ইঞ্চি লম্বা বিশাল ৪টি পা মোট চারটি ১৮ ইঞ্চির আনুভূমিক সোনার বার দিয়ে যুক্ত ছিল যা সিংহাসনের ভিত তৈরি করেছিল। এই ভিত্তির উপরে ছিল ১২টি কলাম যা তিনদিক থেকে (প্রতিপাশে চারটি) সিংহাসনটিকে ঘিরে রেখেছিল এবং সিংহাসনের চাঁদোয়ার ভিত হিসেবে কাজ করতো।
একমাত্র সম্রাট যেদিকে মুখ করে বসতেন, সেদিকে কোনো কলাম ছিল না, সেদিকটা ছিল উন্মুক্ত। লাহোরির মতানুযায়ী ১২টি কলামই ছিল পান্নার, তাভেরনিয়ারের মতে কলামগুলোয় সারি সারি মুক্তো বসানো ছিল, সেগুলো ছিল গোলাকৃতির এবং ৬-১০ ক্যারেটের। তাভেরনিয়ারের মতে, যে বারগুলো দিয়ে সিংহাসনের ভিত তৈরি হয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে রুবি বসানো থাকতো এবং প্রতিটি রুবির চারদিকে চারটি করে পান্না বসিয়ে তৈরি হতো বর্গাকৃতির ক্রস। বারগুলোর দৈর্ঘ্য বরাবর এমন অনেকগুলো বর্গাকৃতি ক্রস বসানো ছিল যেগুলোর কোনোটার কেন্দ্রে রুবি ও চারিদিকে পান্না বসানো ছিল, আবার কোনোটির মাঝে পান্না ও তার চারদিকে রুবি বসানো ছিল। রুবি ও পান্নার মধ্যের স্থানগুলোয় হীরে বসানো ছিল বলে বলা হয়।
তাদের উভয়ের দেয়া বর্ণনার মধ্যে আরো অসামঞ্জস্যতা লক্ষ্য করা যায় এই সিংহাসনের ওপরে স্থাপিত ময়ূরটিকে নিয়ে। লাহোরির মত অনুযায়ী সিংহাসনটির প্রতিটি পিলারের ওপরে দুটি করে ময়ূর এবং ময়ূর দুটির মাঝখানে একটি করে রত্ন বসানো গাছ থাকার কথা। ময়ূর ও গাছগুলোতে হীরে, পান্না, চুনি ও মুক্তো বসানো। এ বিবরণ সঠিক হলে সিংহাসনের ১২টি কলামের (পিলার অর্থ কলাম ধরে নিয়ে) জন্য মোট ২৪টি ময়ূর থাকবার কথা। কিন্তু তাভেরনিয়ারের বর্ণনা থেকে জানা যায় সিংহাসনের চতুর্ভুজাকার গম্বুজের ওপর একটিমাত্র বৃহৎ ময়ূর ছিল যার লেজটি ছিলো ছড়ানো এবং নীলকান্তমণি ও অন্যান্য রঙিন রত্ন বসানো। ময়ূরের শরীর সোনা দিয়ে তৈরি এবং মূল্যবান রত্ন খচিত এবং ময়ূরটির বুকে বৃহদাকৃতির একটি রুবি বা চুনি বসানো। এই চুনিটি থেকে একটি প্রায় ৫০ ক্যারেটের নাশপাতি আকৃতির বৃহৎ মুক্তো ঝুলতো। ময়ূরটির উভয়পার্শ্বে একটি করে স্বর্ণনির্মিত ফুলের তোড়া ছিল যাতে সোনা ও মূল্যবান রত্নপাথর সহযোগে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল নানা ফুল। তোড়া দুটি লম্বায় ময়ূরটির সমান ছিল।
সিংহাসনের গম্বুজাকৃতি ছাদের ভেতরের দিকে হীরে ও মুক্তো বসানো ছিল, এছাড়াও এর চতুর্দিকে মুক্তোর ঝালরও ছিল। দিওয়ান-ই-খাস (কিংবা আম) অভিমুখী দিকটিতে একটি ৮০-৯০ ক্যারেটের হীরে ও তাকে ঘিরে চুনি ও পান্না খচিত ছিল। তাভেরনিয়ারের মতে সিংহাসনটিতে বসানো বৃহৎ ব্যালাস রুবি বা চুনি ছিল যেগুলোর সবচেয়ে ছোটগুলি ১০০ ক্যারেটের এবং অনেকগুলি ২০০ ক্যারেট বা বেশিও ছিল। এতে পান্না ছিল মোট ১১৬টি যা চুনির থেকে বেশি, পান্নাগুলো ছিল চমৎকার রঙের তবে নিখুঁত নয়। এগুলো সর্বনিম্ন ৩০ থেকে ৬০ ক্যারেট পর্যন্ত ছিল। সিংহাসনটিতে একটি তরবারি, রাজদণ্ড, গোলাকৃতির ঢাল, ধনুকসহ তূণভরা তীর দেয়া ছিল। এছাড়াও সম্রাটের পেছনদিকে একটি বৃহদাকার পাশবালিশ ও দু’পাশে দুটি সমতল কুশন দেয়া ছিল। সেগুলিও মণিমুক্তাদি খচিত ছিল বলে জানা যায়।
লাহোরির বর্ণনামতে সিংহাসনে আরোহনের সিঁড়ি ছিল তিনটি, তাভেরনিয়ারের মতে তা চারটি। বলাবাহুল্য এই সিঁড়িগুলিও রত্নমণ্ডিত ছিল। এছাড়াও লাহোরির বর্ণনা থেকে জানা যায় সিংহাসনটিতে অত্যন্ত মূল্যবান পাথর; যেমন- ১৮৬ ক্যারেটের কোহ-ই-নূর, ৯৫ ক্যারেটের আকবর শাহ্ হীরে, ৮৮.৭৭ ক্যারেটের শাহ্ হীরে, ৮৩ ক্যারেটের জাহাঙ্গীর হীরে এবং ৩৫২.৫০ ক্যারেটের তিমুর রুবি বসানো ছিল। তবে তাভেরনিয়ারের বর্ণনাতে এমন কিছুর উল্লেখ নেই, শুধু শাহ্ হীরেটি সিংহাসনটির একপাশে বসানো ছিল বলে উল্লেখ করেন তিনি। বলা হয় আকবর শাহ্ হীরে এবং কোহ-ই-নূর হীরে ময়ূরের চোখ হিসেবে বসানো ছিল।
লাহোরির মতে শাহজাহানের গুণগান গেয়ে মোহাম্মদ কুদসীর লেখা ২০টি যুগ্মক পঙক্তির একটি কবিতা পান্নার হরফে সিংহাসনে লেখা ছিল। তাভেরনিয়ার এসবের কিছুই উল্লেখ করেননি। তাভেরনিয়ারের মতে সিংহাসনের দুই দিকে দুটি স্বর্ণবাঁটযুক্ত রত্নখচিত লাল মখমলের ছাতা ছিল ৭-৮ ফুট দৈর্ঘ্যের, এগুলো সিংহাসনের অংশ না হলেও তার থেকে কিছু দূরে রাখা ছিল।
লাহোরি এবং তাভেরনিয়ারের বর্ণনায় এত অমিল থাকার কারণ হিসেবে নানা যুক্তি দেয়া যায়। প্রথমত, লাহোরির বর্ণনাটি ১৬৪৮ সালের পূর্বে লেখা, হয়তো সেটি একেবারে পুরোপুরি মূল সিংহাসনটিকে নিয়ে না লিখে তার যে নকশা তৈরি করা হয়েছিল তার সাপেক্ষে লেখা হয়েছে। অপরপক্ষে তাভেরনিয়ার দিল্লী আসেন শাহ্জাহানপুত্র সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে, ১৬৬৫ সালে। ততদিনে মূল নকশা ছেড়ে হয়তো ভিন্নভাবে তৈরি হয়ে গিয়েছিল ময়ূর সিংহাসন কিংবা হয়তো তাতে পরিবর্তন আনা হয়েছিল।
লাহোরির বর্ণনায় যে সব অমূল্য রত্নপাথরের বিবরণ আমরা পাই সেগুলো মূলত শাহ্জাহানের, তাভেরনিয়েরের সিংহাসন অবলোকন করার সময় শাহ্জাহান আওরঙ্গজেব কর্তৃক গৃহবন্দী অবস্থায় ছিলেন। তাই হয়তো সে সময় রত্নগুলো শাহ্জাহানের কাছেই ছিল, তাই সিংহাসনে সেগুলোর উপস্থিতি তাভেরনিয়ারের দৃষ্টিগোচর হবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। ১৬৬৬ সালের ২২ জানুয়ারি শাহ্জাহান মারা গেলে রত্নগুলোর মালিকানা সে লাভ করে। কুদসী কর্তৃক লেখা কবিতাটির কথা তাভেরনিয়ার লেখেননি এর কারণ হিসেবে ধরা যায় হয় তিনি সেগুলো ভাষা না জানায় পড়তে পারেননি অথবা আওরঙ্গজেব সম্রাট হবার পর সেগুলো সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেন। লাহোরি কিংবা তাভেরনিয়ার কিংবা অন্যান্য বিবরণ দানকারী ব্যক্তিদের বক্তব্যের সত্যাসত্য যাচাই করার মতো ময়ূর সিংহাসনের কোনো ছবি নেই বলে কারটি সঠিক সেটা নিখুঁতভাবে বলা অসম্ভব।
আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর একে একে মুঘল সাম্রাজ্যের শাসক হন প্রথম বাহাদুর শাহ্, জাহানদার শাহ্, ফররুখসিয়ার, রাফি-উদ-দারাজাত, দ্বিতীয় শাহ্জাহান। এদের পর শাসক হিসেবে আগমন ঘটে মুঘল বাদশাহ মুহাম্মাদ শাহ্ এর। এই মুহাম্মাদ শাহ্ এর কাছ থেকেই ময়ূর সিংহাসন নিয়ে যান পারস্য সম্রাট নাদির শাহ্। ১৭৩৯ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারি কারনালের যুদ্ধে মুহাম্মাদ শাহ্কে পরাজিত করেন নাদির শাহ্ এবং একই বছরের মে মাসে দেশে ফিরে যাবার পথে জয়ের নিদর্শনস্বরূপ অজস্র ধনরত্ন ও অন্যান্য বস্তুর সাথে ময়ূর সিংহাসনটিকেও নিয়ে যান তিনি।
১৭৪৭ সালের ১৯শে জুন নাদির শাহ্ নিহত হবার পর থেকে ময়ূর সিংহাসনটিও নিখোঁজ হয়ে যায়। নাদির শাহ্ দিল্লীতে ১০ হাজার মানুষকে হত্যা করে এবং এই পরিমাণ সম্পদ লুঠ করে আনে যে, তিন বছরের জন্য কোনোপ্রকার কর আদায় করেনি সে। তার লুণ্ঠন করে আনা রত্নসম্পদ দিয়ে একটি তাঁবু তৈরি করেছিল সে যা তার মৃত্যুর পর টুকরো টুকরো করে ভাগ বাটোয়ারা করে নেয়া হয় এবং বলা হয় ময়ূর সিংহাসনের ভাগ্যেও ঠিক এমনি কিছু ঘটেছিল।
আবার অনেকের মতে, ময়ূর সিংহাসনটি অটোম্যান সম্রাটকে উপহারস্বরূপ দেয়া হয়, তবে এর সত্যাসত্য নিয়েও সন্দেহ আছে। হয়তো ময়ূর সিংহাসনের অনুরূপ আরেকটি ছোট সিংহাসন তৈরি করে তা উপহার হিসেবে দেয়া হয়েছিল। কারো কারো মতে ময়ূর সিংহাসনের কিছু অংশ দিয়ে অন্য সিংহাসন যেমন- সূর্য সিংহাসন তৈরি করা হয়েছিল। আবার নাদির শাহ্ ময়ূর সিংহাসন নিয়ে যাবার পর অনুরূপ বিকল্প একটি সিংহাসন তৈরি করে দিওয়ান-ই-খাস এ রেখেছিল মুঘলরা। কালক্রমে সেটিও হারিয়ে যায়। এভাবেই কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে প্রাচুর্যমন্ডিত রত্নসজ্জিত বহুল আলোচিত ময়ূর সিংহাসন- যা একসময় মুঘল গরিমা ও বৈভবের প্রতীক ছিল।
দরিয়া-ই-নূর, ভারত
দরিয়া-ই-নূর বা আলোর সাগর একটি গোলাপি আভাযুক্ত হীরের নাম। গোলাপি রঙা হীরে বস্তুত খুবই দুর্লভ এবং যতগুলি গোলাপি হীরে আছে তার মধ্যে সর্ববৃহৎ ও পুরনো এই ১৮৬ ক্যারেটের (প্রায় ৩৭ গ্রাম) হীরেটি। হীরেটি গোলকুণ্ডার কল্লুর খনি থেকে পাওয়া যায়। ধারণা করা হয় এটি গ্রেট টেবিল ডায়মণ্ড (ডায়ামান্তা গ্র্যান্ডে টেবিল) থেকে কাটা হয়। গ্রেট টেবিল ডায়মন্ড থেকে কাটা দুটি অংশের একটি দরিয়া-ই-নূর এবং অপরটি ৬০ ক্যারেটের নূর-উল-আইন যা ইরানের রাজকীয় রত্ন সংগ্রহের অংশ হিসেবে থাকা একটি টায়রায় খচিত রয়েছে। দরিয়া-ই-নূর বর্তমানে বাংলাদেশের সোনালী ব্যাংকে রয়েছে বলে শোনা যায়। যদিও ইরানের দাবি এটি তাদের কাছেই রয়েছে এবং তেহরানে অবস্থিত ইরানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রয়েছে।
দিল্লী আক্রমণের পর বিজয়ী নাদির শাহ্ এটি সাথে করে পারস্য নিয়ে গিয়েছিল, তার মৃত্যুর পর তার পৌত্র শারুখ মির্জার হস্তগত হয় হীরেটি। এরপর সেটি লতিফ আলি খান ঝান্দ এর হাতে যায়। লতিফ আলি খান আগা মোহাম্মদ খান কাজারের হাতে যুদ্ধে পরাজিত হলে ঝান্দ বংশের হাতছাড়া হয়ে ইরানের কাজার রাজবংশের কাছে চলে যায় হীরেটি। এরপর নানা হাত ঘুরে সেটি পাহলভি রাজবংশের রেজা শাহ্ এর কাছে চলে যায় বলে বলা হয়। শোনা যায় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নাকি হীরেটি হস্তগত করে এবং ১৮৫১ সালে সেটি লন্ডনের ক্রিস্টাল প্যালেসে প্রদর্শন করা হয়। তবে ইরানের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় সেটি কখনোই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্ট ছেড়ে যায়নি!
তবে অন্যসূত্র মতে, হীরেটি নানা হাত ঘুরে পাঞ্জাবের মহারাজা রঞ্জিত সিং এর কাছে আসে এবং তার পুত্র দুলীপ সিং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিকট পরাজিত হলে মহারাজার রাজকোষাগারের অন্যান্য অনেক রত্নের মতো এটিকেও ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়। কিন্তু কোহিনূরের মতো এটি ব্রিটিশ রাজবংশের সদস্যদের আকর্ষণ করতে পারেনি। তাই দু’বছর পর এটিকে ভারতে ফেরত পাঠানো হয় এবং সেখানে নিলামে এটিকে কিনে নেন বাংলাদেশের নবাব পরিবারের একজন সদস্য। এটি বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের ভল্টে আছে।
ঐতিহাসিক এসব নিদর্শনের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে জ্ঞান ও কাহিনী। এগুলো নানা সময়ের সাক্ষী, কালদর্শী। এসব নিয়ে যেমন আলোচনার কমতি নেই তেমনি অপ্রতুল নয় বিতর্কও। এমনই আরো কিছু চমৎকার ঐতিহাসিক নিদর্শনের গল্প নিয়ে দেখা হবে লেখাটির আগামী পর্বে।