দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মোড় ঘুড়িয়ে দেয়ার মতো একটি ঘটনা হলো মিত্র শক্তির ফ্রান্স পুনর্দখল। ইউরোপকে জার্মান বাহিনীর হাত থেকে রক্ষার জন্য মিত্র শক্তি যে যুদ্ধে নেমেছিলো, তার সূচনা হয়েছিলো ডি-ডে’র মধ্য দিয়ে। ডি-ডে বলতে অনেকে মনে করে থাকেন এটি কোনো নির্দিষ্ট অভিযানের নাম হয়তো। আবার অনেকে “ডি” শব্দ বলতে অন্য কোনো শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ মনে করেন।
আসলে এটি একটি ভুল ধারণা। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জাদুঘরের মতে, “ডি-ডে বলতে এমন সব গুরুত্বপূর্ণ সামরিক অভিযানকে বোঝায় যেগুলোর কোনো নির্দিষ্ট তারিখ প্রকাশ করা হয় না।” অর্থাৎ অত্যন্ত গোপনীয় সামরিক অভিযান শুরুর দিনগুলোকে বলা হয় ডি-ডে। এখানে “ডি” বলতে ইংরেজিতে ডে বা দিন বোঝায়।
ফ্রান্সের সাথে জার্মানির পূর্বশত্রুতা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্সের সরাসরি অংশগ্রহণের জের ধরে ১৯৪০ সালে ফ্রান্স দখল করে নেয় হিটলারের জার্মান বাহিনী। আর ১৯৪৪ সালে এই ফ্রান্স জার্মানমুক্ত হয় পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ রাষ্ট্র নিয়ে গঠিত মিত্রশক্তির “অপারেশন ওভারলর্ড” এর সূচনার মধ্য দিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বহুল আলোচিত ডি-ডে হলো মূলত মিত্রশক্তির ইউরোপ পুনর্দখল অভিযান অপারেশন ওভারলর্ডের সূচনা অংশ। হিটলারের জার্মান বাহিনীকে চরম পর্যায়ের বোকা বানিয়ে কীভাবে মিত্রশক্তি ফ্রান্সকে শত্রুমুক্ত করলো সেই ঘটনাই আজ তুলে ধরা হবে এই লেখায়।
ইতিহাসের পাতায় ৬ জুন, ১৯৪৪-কে ডি-ডে বা অপারেশন ওভারলর্ডের শুরুর দিন হিসেবে বলা হলেও এই আক্রমণের পরিকল্পনা তৈরি হচ্ছিলো আরও অনেক আগে থেকেই। হিটলার জানতেন, মিত্রশক্তি ফ্রান্স পুনর্দখলের জন্য আক্রমণ চালাবে এবং তারা যেকোনো সময় জার্মানিতেও হামলা চালাতে পারে। কিন্তু তিনি জানতেন না, মিত্রশক্তি কোন সময়ে এবং কোন জায়গা থেকে আক্রমণ চালাবে। এই কারণে মিত্রশক্তি হিটলারকে পুরো একটি গোলকধাঁধাঁর মধ্যে ফেলে দিতে সক্ষম হয়েছিলো। অপরদিকে পূর্ব ইউরোপ থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের জার্মানি আক্রমণ ঠেকাতে বেশি ব্যস্ত থাকায় পশ্চিমের দিকে তেমন একটা মনোযোগই দিতে পারছিলেন না হিটলার। এই ঘটনার পুরো সুযোগ নেয় মিত্র শক্তি।
হিটলারকে ফাঁদে ফেলার জন্য তার কাছে অনেকগুলো ভুল তথ্য প্রকাশ করে মিত্রবাহিনী। হিটলারের সকল বিশ্বাসযোগ্য মাধ্যমের কাছে তারা এই তথ্য পৌঁছে দিয়েছিলো যে, মিত্রশক্তির ৩ লক্ষ ৫০ হাজার সেনাসদস্য স্কটল্যান্ডে অবস্থান করছে। সেই সাথে তারা এই তথ্যও ছড়িয়ে দিয়েছিলো যে, নতুন একটি ব্রিটিশ সামরিক বাহিনী তৈরি করা হয়েছে যার সাংকেতিক নাম হলো “Skye”। এদের কথাবার্তাও রেডিও মাধ্যমে শোনা যাচ্ছিলো। অর্থাৎ ফ্রান্সের উত্তরদিক থেকে মিত্র শক্তির আক্রমণ আসতে যাচ্ছে এরকম একটা গুজব হিটলারকে বিশ্বাস করানোর জন্য এই তথ্যগুলোই যথেষ্ট ছিলো। কিন্তু এই দুটি তথ্যই ছিলো পুরোপুরি ভুল এবং মিত্রশক্তির একটি অপপ্রচার মাত্র। স্কটল্যান্ডে ৩ লক্ষ ৫০ হাজার সেনাসদস্যের উপস্থিতি ছিলো পুরোপুরি মিথ্যা। আর নতুন ব্রিটিশ সামরিক বাহিনী? এরা ছিলো সম্পূর্ণ একটি কাল্পনিক বাহিনী! বাস্তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এদের কোনো অস্তিত্বই ছিলো না! আর এই কাল্পনিক বাহিনীর চিন্তাই নাকি তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিলো জার্মান রাষ্ট্রনেতা অ্যাডলফ হিটলারকে।
মিত্রশক্তির পাতা ফাঁদে হিটলার ভালো মতোই পা দিয়েছিলেন। মিত্রশক্তির অপারেশন ওভারলর্ড ঠিকমতো পরিচালনার জন্য সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়ার দায়িত্বে ছিলেন মার্কিন জেনারেল আইসেনহাওয়ার। মূলত তার পরিকল্পনায় এসব ফাঁদ পাতা হচ্ছিলো জার্মানিকে দমন করার জন্য। মিত্রশক্তি চাচ্ছিলো তাদের পরিকল্পনা মতো মূল আক্রমণের জায়গা থেকে যত বেশি সম্ভব জার্মান বাহিনী আগে থেকে সরিয়ে ফেলতে। এতে ফ্রান্সে প্রবেশের রাস্তাটা তাদের জন্য অনেক সহজ হয়ে যাবে। মিত্রশক্তির আসল লক্ষ্য ছিলো ফ্রান্সের উত্তর-পশ্চিমে নরম্যান্ডি সমুদ্র উপকূল। সেখান থেকে হিটলারের জার্মান বাহিনীকে সরাতে পারলে প্যারিস দখল নিয়ে কোনো সমস্যাই হবে না।
হিটলার মনে করছিলেন, মিত্রশক্তি ফ্রান্সের উত্তর দিক থেকে আক্রমণ চালাবে। তার কাছে থাকা তথ্য অন্তত এই কথাই বলছিলো। কিন্তু হিটলার যেটা জানতেন না তা হলো, তার দলের ভেতরেই কেউ তার বিপক্ষে গিয়ে কাজ করতে পারে! মিত্রশক্তির সকল গোপন তথ্য যারা অক্ষশক্তির কাছে পৌঁছে দিচ্ছিলো, তারা আসলে মিত্রশক্তির লোক হিসেবে হিটলারের কাছে ভুল তথ্য ফাঁস করছিলো! হিটলার তাদের কথা শুনে নিশ্চিত হন যে, ফ্রান্সের উত্তরে মিত্রশক্তি বেশ পাকাপোক্তভাবে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। হিটলার তার নিজস্ব লোক পাঠান নিজ চোখে সব দেখে আসার জন্য। হিটলারের লোকেরা স্কটল্যান্ড যায়। তারা দেখে সেখানে সারি সারি যুদ্ধবিমান এবং ট্যাংক জমা করে রাখা হয়েছে আক্রমণের জন্য। যেন যেকোনো সময় তারা আক্রমণ শুরু করে দিতে পারে। এসব কিছুর ছবি এনে তারা হিটলারকে দেখায়। হিটলার বুঝে ফেলেন ফ্রান্সের উত্তরে সেনা মজুদ করা হবে তার জন্য সেরা সিদ্ধান্ত। এজন্য তিনি ফিল্ড মার্শাল এরউইন রোমেলকে প্রধান করে উত্তরে একঝাঁক সেনা মজুদ করে রাখেন।
হিটলার বুঝে ফেলেছিলেন মিত্রশক্তির লক্ষ্য হলো উত্তরে নরওয়ে দখল করা এবং সেখান থেকে পরবর্তীতে ফ্রান্সে আক্রমণ চালানো। নরওয়ে হারালে সমুদ্রপথে যোগাযোগ চালানো হিটলারের জন্য কঠিন হয়ে যাবে। কারণ তখন নরওয়েতেই ছিলো হিটলারের সবচেয়ে কার্যকর সমুদ্র বন্দর। কিন্তু হিটলার জানতেন না তার পাঠানো লোকেরা একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তাকে দেয়নি। স্কটল্যান্ডে যেসকল যুদ্ধবিমান তারা দেখে এসেছে, সেগুলো সব ছিলো কাঠ জোড়া দিয়ে কোনো রকমে বানানো একেকটি বিমানের খোলস মাত্র! আর ট্যাংকারগুলো ছিলো সব যুদ্ধবিধ্বস্ত এবং সম্পূর্ণ অকেজো! হিটলার জানতেনই না তার বিরুদ্ধে এমন একটি বড় ষড়যন্ত্র চলছে।
৫ জুন, ১৯৪৪। পরিকল্পনা ছিলো এই দিনে মিত্রশক্তি “অপারেশন ওভারলর্ড” শুরু করবে। কিন্তু বাঁধ সাধে বৈরি আবহাওয়া। এজন্য আক্রমণের সময় ২৪ ঘন্টা পিছিয়ে দেয়া হয়। ৫ জুন রাতেই ৫,০০০ এর বেশি যুদ্ধজাহাজ এবং ১১,০০০ যুদ্ধবিমান যাত্রা শুরু করে নরম্যান্ডি সমুদ্র উপকূলের দিকে।
৬ জুন, ১৯৪৪। মিত্রশক্তি তাদের পরিকল্পনা মতো অবস্থান নিয়েছে। নরম্যান্ডি সমুদ্র উপকূলকে ৫টি সমুদ্র সৈকতে ভাগ করা হয়েছিলো। এগুলোর সাংকেতিক নাম ছিলো গোল্ড, জুনো, সোর্ড, উতাহ এবং ওমাহা। ব্রিটিশ এবং কানাডিয়ান সৈন্যরা নেমেছিল গোল্ড, জুনো এবং সোর্ড সৈকতে। আর আমেরিকানরা নেমেছিলো উতাহ এবং ওমাহা সৈকতে। আক্রমণ শুরু হলেও জার্মানরা বুঝতে পারেনি এটাই প্রকৃত আক্রমণ কি না। কারণ ফিল্ড মার্শাল রোমেল তখন ফ্রান্সের উত্তরে আক্রমণের আশায় বসে আছেন। আর হিটলার ধরেই নিয়েছিলেন এটি উত্তরের আক্রমণ থেকে জার্মানদের চোখ ফিরিয়ে নেয়ার একটি ধান্ধা মাত্র! তাই হিটলার পাল্টা আক্রমণ তো দূরের কথা, আক্রমণকারীদের ঠেকানোর জন্য নতুন কোনো ফোর্স পাঠানোর কথাও চিন্তা করেননি। প্রায় ১ লক্ষ ৫০ হাজার মিত্রশক্তির সৈন্য সেদিন নরম্যান্ডির সমুদ্র উপকূলে আক্রমণ চালায়। এক সপ্তাহের মাথায় ১১ই জুন তারিখে নরম্যান্ডির সমুদ্র উপকূল পুরোপুরি মিত্রশক্তির অধীনে চলে আসে। ততক্ষণে সেখানে প্রায় ৩ লক্ষ ২৬ হাজার সামরিক সেনা, ৫০ হাজারেরও বেশি যুদ্ধযান এবং ১ লক্ষ টনেরও বেশি যুদ্ধ সরঞ্জাম পৌঁছে গিয়েছে।
হিটলার যখন প্রকৃত ঘটনা বুঝতে পারেন, তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। নরম্যান্ডি শত্রুমুক্ত করে মিত্রশক্তি এগিয়ে যায় উত্তরের দিকে। আগস্টের শেষ প্যারিস দখলমুক্ত হয়ে যায়। এরপর তারা প্রবেশ করে জার্মানিতে। সেখানে হিটলারের জার্মান বাহিনীর আগে থেকেই সোভিয়েত সেনাদের সামাল দিতে দিতে নাজেহাল অবস্থা। এরপর দ্রুতই হিটলারের পতন ঘটে। মূলত নরম্যান্ডি সমুদ্র উপকূলে হিটলার বাহিনীর বিশাল পরাজয়ই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মোড় পুরোপুরি মিত্রশক্তির দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিলো। বিশ্বের ইতিহাসে এই ব্যাটেল অফ নরম্যান্ডিই সবচেয়ে বড় স্থল, নৌ এবং বিমান বাহিনীর সম্মিলিত অভিযান।