ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে যায়, দিন শেষে আসে মাস, গড়িয়ে যায় বছর।
আটাশ বছরের যুবক ফ্রেডেরিক প্রুশিয়ার সিংহাসনে বসার পর পেরিয়ে গেছে কয়েক দশক। পিতার রেখে যাওয়া সেই ছোট্ট প্রুশিয়া এখন ইউরোপের রাজাদের ঈর্ষার কারণ। তাদের চোখে ফ্রেডেরিক দোর্দণ্ড প্রতাপশালী এক শাসক। কিন্তু সময় তো আর সেসব বোঝে না, সে বয়ে চলে নিজের গতিতে। ফ্রেডেরিকের চোখে-মুখে এখন বয়সের ছাপ। বহু লড়াইয়ের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ ফ্রেডেরিক এখন নিঃসঙ্গ। চলার পথে হারিয়েছেন কত বন্ধু আর শত্রু। স্ত্রীকে তো কোনোদিনই গ্রহণ করেননি তিনি। প্রিয় বোন উইলহেলমিনার প্রয়ানের পর মনের কথা খুলে বলার লোকও নেই। ভাইয়েরাও কেউ বেঁচে নেই। সন্তানসন্ততিহীন ফ্রেডেরিকের উত্তরাধিকারী হবেন ভাইয়ের ছেলে। তবে তাই বলে রাজকার্যে ফ্রেডেরিক উদাসিন নন। পোল্যান্ডের পার্টিশনের মাধ্যমে নিজের সীমান্ত বৃদ্ধি করেছেন তিনি, নতুন নতুন মৈত্রীচুক্তি সম্পাদন করে প্রুশিয়ার নিরাপত্তা পোক্ত করতেও তিনি বদ্ধপরিকর।
বাভারিয়ান সাকসেশন ওয়ার
১৭৭৭ সালের ৩০ ডিসেম্বর বাভারিয়ার ইলেক্টর ম্যাক্সিমিলিয়ান তৃতীয় জোসেফ মারা গেলেন। তিনি ছিলেন উইটেসবাখস (Wittelsbachs)পরিবারের লোক। নিজের কোনো সন্তান না থাকায় রাজ্যের কর্তৃত্ব চলে গেল তার কাজিন প্যালাটাইনের ইলেক্টর চার্লস থিওডোরের ( Charles Theodore) হাতে। থিওডোরের নিজেরও কোনো বৈধ ছেলে না থাকায় পরবর্তী উত্তরাধিকারের দাবি ছিল এস্ফ্রাইবুকেনের (Zweibrücken) উইটেসবাখস বংশের ডিউক চার্লসের। তিনি আবার স্যাক্সোনির অধিকর্তা ফ্রেডেরিক অগাস্টাসের বোনজামাই।
এদিকে সিলিসিয়া হাতছাড়া হয়ে যাবার পরে অস্ট্রিয়ান দ্বিতীয় জোসেফের ভাবনা ছিল জার্মানিতে কীভাবে নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধি করা যায়। থিওডোরের মাঝে তিনি চমৎকার সম্ভাবনা দেখতে পেলেন। থিওডোর প্যালাটাইন নিয়েই সন্তুষ্ট, তার কাছে বাভারিয়ার তেমন কোনো মূল্য নেই। ফলে জোসেফ প্রস্তাব দিলেন অস্ট্রিয়ান নেদারল্যান্ডসের কিছু অংশের বিনিময়ে বাভারিয়ার বোঝা থেকে তাকে মুক্তি দেয়ার। এই প্রস্তাব থিওডোরের মনে ধরল। বাভারিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল (Lower Bavaria) এবং মিন্ডেলহেইম (Mindelheim) শহরের বিনিময়ে জোসেফ বর্তমান বেলজিয়াম দিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতিতে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এতে মারিয়া থেরেসার তেমন সায় ছিল না, কারণ তিনি জানতেন এর ফলে প্রুশিয়ার সাথে নতুন সংঘাত সৃষ্টি হতে পারে। যুদ্ধ করতে করতে তিনি ক্লান্ত, তাছাড়া ফ্রেডেরিকের সাথে লড়াই করে তিনি এখন পর্যন্ত তেমন কিছুই আদায় করতে পারেননি।
স্যাক্সোনির ইলেক্টর ফ্রেডেরিক অগাস্টাস একইসাথে বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ। থিওডোর ভেবেছেটা কী? জার্মানির অখণ্ডতা নিজের মনে করে বিলিয়ে দেবে? বোন জামাই চার্লসের ব্যাপারটাও তার মাথায় ছিল, যিনি কোনোক্রমেই অস্ট্রিয়ার হাতে বাভারিয়ার কোনো অংশ ছেড়ে দিতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু জোসেফের মতো শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে মোকাবেলা করার সামর্থ্য একজনেরই আছে, তিনি স্যাক্সোনির পুরনো শত্রু ফ্রেডেরিক দ্য গ্রেট। বারে বারে তিনি প্রুশিয়াকে অখণ্ড জার্মানির রক্ষাকর্তা হিসেবে জাহির করেছেন। সুতরাং অতীতের বিবাদ ভুলে স্যাক্সোনি আর এস্ফ্রাইবুকেন ফ্রেডেরিকের সহায়তার আবেদন করে।
ফ্রেডেরিক ব্যস্ত সেভেন ইয়ার্স ওয়ারের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠায়। নতুন করে যুদ্ধ করবার ইচ্ছা তার কম। তবে ঝানু রাজনীতিকের সুযোগ চিনতে ভুল হয় না। ইতোমধ্যেই ১৭৭৮ সালের জানুয়ারিতে বাভারিয়াতে অস্ট্রিয়ান একদল সেনা প্রবেশ করেছিল দখল বুঝে নিতে। ফ্রেডেরিক জোসেফের কাছে দাবি করলেন হলি রোমান এম্পায়ারের দুই জার্মান প্রিন্সিপালিটি আন্সবাখ এবং বেইরুথ (Ansbach and Bayreuth) প্রুশিয়ার কাছে ছেড়ে দেবার, তাহলে বাভারিয়ার ব্যাপারে অস্ট্রিয়ান দাবি তিনি মেনে নেবেন। কিন্তু জোসেফ রাজি হলেন না। ফলে তেসরা জুলাই, ১৭৭৮ সালে বাভারিয়ার ব্যাপারে স্যাক্সোনি এবং চার্লসের বিরোধিতার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে ফ্রেডেরিক আনুষ্ঠানিকভাবে আবারো অস্ট্রিয়ানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ডাক দেন। ষাটোর্ধ প্রুশিয়ান রাজা সেনাদের নিয়ে ঢুকে পড়লেন বোহেমিয়াতে, সেখানে উত্তরাঞ্চলে মুখোমুখি হলেন অস্ট্রিয়ান সেনাবাহিনীর।
এই যুদ্ধ চূড়ান্ত সংঘর্ষে গড়ায়নি। কোনো পক্ষেরই অযথা রক্তপাতের ইচ্ছা ছিল না। তাদের উদ্দেশ্য ছিল পরস্পরের প্রতি শক্তি প্রদর্শন জারি রাখা, যতক্ষণ পর্যন্ত কূটনৈতিক একটি সমাধান খুঁজে না পাওয়া যায়। অস্ট্রিয়ার মিত্র ফ্রান্স তলে তলে সমর্থ দিচ্ছিল চার্লসকে। রাশিয়াও প্রুশিয়ার পক্ষেই ছিল। কাজেই ফ্রান্স এবং রাশিয়া মধ্যস্থতার উদ্যোগ নেয়।
আলোচনা দীর্ঘায়িত হওয়ার ফলে সেনাদের শীত কাটাতে হয় রণক্ষেত্রেই। পার্শ্ববর্তী সুদেটান পর্বতের (Sudeten mountains) ঢালে ফ্রেডেরিক শীতকালীন ক্যাম্প স্থাপন করেন। কনকনে শীতে অস্ত্রের ঝনঝনানির থেকে মুখ্য হয়ে দাঁড়ায় খাদ্য সংকট। আশপাশ থেকে খাবার সংগ্রহ করতে গিয়ে, বিশেষ করে জমে যাওয়া আলুর দখল নিয়ে বেশ কয়েকবারই দুই দলের সেনার মধ্যে বিক্ষিপ্ত মারামারি লেগে যায়। এ কারণে জার্মানিতে এই সংঘাত পরিচিত “পটেটো ওয়ার” বা আলুযুদ্ধ (“potato war”/ জার্মানে Kartoffelkrieg, অস্ট্রিয়ানরা বলত Zwetschgenrummel/Plum Fuss) নামে।
সংঘাত পূর্ণ যুদ্ধে গড়ানোর পূর্বেই ছেলে জোসেফকে না জানিয়ে মারিয়া থেরেসা ফ্রেডেরিকের কাছে শান্তি প্রস্তাব পাঠান। জোসেফ গাইগুই করতে থাকলে সম্রাজ্ঞী ক্যাথেরিন দ্য গ্রেট হুমকি দিলেন প্রুশিয়ার সাথে তার সেনারাও যোগ দেবে। ফলে জোসেফ হাল ছেড়ে দিলেন। সিলিসিয়ার অন্তর্গত টেশেনে (Teschen) ১৭৭৯ সালের ১০ মার্চ থেকে আলোচনা শুরু হয়। মে মাসের ৩ তারিখে চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো। অস্ট্রিয়া পেল বাভারিয়ার ইন নদীর পূর্বাঞ্চল (Innviertel)। আন্সবাখ আর বেইরুথের ব্যাপারে প্রুশিয়ার দাবিও ভবিষ্যতে বিবেচনা করবার আশ্বাস দেয়া হলো। ১৭৯১ সালে দুটি এলাকাই প্রুশিয়া কিনে নেয়। বাভারিয়াতে থিওডোরকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে চার্লস এবং স্যাক্সোনির মুখ প্রচুর অর্থের বিনিময়ে বন্ধ করা হলো। এই চুক্তি প্রমাণ করে যে ফ্রেডেরিকের সাথে শক্তি পরীক্ষা করতে অস্ট্রিয়া আর ইচ্ছুক নয়, জার্মান রাষ্ট্রগুলোও এই সময় জার্মান অখণ্ডতার চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ফ্রেডেরিকের পক্ষাবলম্বন করে।
জোসেফ কিন্তু হাল না ছেড়ে দ্বিতীয়বার চেষ্টা করেছিলেন। সত্যিকার অর্থে অস্ট্রিয়ান নেদারল্যান্ডস তার জন্য ছিল একটি মাথাব্যথা। হাবসবুর্গদের মূল ভূমি থেকে বহুদুরে এই এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জোসেফের জন্য দিনকে দিন কঠিন হয়ে পড়ছিল। ফলে তিনি চাচ্ছিলেন হাত থেকে অস্ট্রিয়ান নেদারল্যান্ডস ঝেড়ে ফেলে পার্শ্ববর্তী জার্মানিতে খুঁটি গাড়তে। থিওডোরের আকাঙ্ক্ষা তিনি অস্ট্রিয়ান নেদারল্যান্ডস এবং জার্মানিতে অধিনস্ত এলাকা, যা পূর্বে প্রাচীন বারগান্ডিয়ান সাম্রাজ্যের অংশ ছিল, তা নিয়ে ডাচি অফ বারগান্ডি গঠন করবেন। মনের গহিনে রাজা উপাধি পাবার স্বপ্নও তিনি লালন করছিলেন। কিন্তু জার্মানিতে তার ভাই-বেরাদার, বিশেষ করে স্যাক্সোনি আর হ্যানোভার ঘরের ভেতর অস্ট্রিয়ানদের দেখতে একদমই রাজি ছিল না।
মায়ের মৃত্যুর পর হাবসবুর্গদের একক শাসক জোসেফ ১৭৮৫ সালে আবার থিওডোরের সাথে অঞ্চল বিনিময় করতে চেষ্টা করেছিলেন। এবারো ফ্রেডেরিক বাধা দিলেন। হ্যানোভার, স্যাক্সোনি এবং ছোট ছোট কয়েকটি প্রোটেস্ট্যান্ট জার্মান রাষ্ট্রের সাথে মিলে তিনি গঠন করেন লীগ অফ প্রিন্স’স (League of Princes/Fürstenbund)। মাত্র আঠার মাসের মধ্যে এর সদস্য সংখ্যা আঠার ছাড়িয়ে যায়। এমনকি মেইঞ্জের ক্যাথলিক আর্চবিশপও এই দলে ভিড়ে যান, যদিও তার পরিচিতি ছিল হলি রোমান এম্পায়ারের ভাইস-চ্যান্সেলর এবং অস্ট্রিয়ার শুভানুধ্যায়ী হিসেবে। লেজ গুটিয়ে জোসেফ এবারো জার্মানি ছাড়তে বাধ্য হলেন।
মারিয়া থেরেসার অবসান
১৭৬৫ সালে স্বামী স্টেফানের মৃত্যুর পর থেকেই মারিয়া থেরেসার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ছিল। ১৭৬৭ সালে তিনি গুটিবসন্তে আক্রান্ত হন, এই রোগ থেকে পরিপূর্ণভাবে তিনি কখনোই সেরে ওঠেননি। রাষ্ট্র পরিচালনা নিয়ে বড় ছেলে জোসেফের সাথেও তার মনোমালিন্য ছিল। সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতক ইউরোপের ইতিহাসে এনলাইটেনমেন্টের (Enlightenment) সময়, যখন কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিকদের প্রভাবে শিল্প সংস্কৃতিতে বড় বড় পরিবর্তন সূচীত হয়। জ্ঞানবিজ্ঞানেও প্রভূত উৎকর্ষ হচ্ছিল। এর প্রভাব পড়ছিল শাসনব্যবস্থা, নাগরিকদের রাজনৈতিক সচেতনতা আর সামাজিক অধিকারের প্রশ্নে। মারিয়া থেরেসার দুই দশকের অধিক শাসন পরোক্ষভাবে এনলাইটেনমেন্টের সহায়ক হলেও তার রক্ষণশীল ধর্মীয় চিন্তাধারা এবং কিছু বিতর্কিত পদক্ষেপ আবার এর বিপরীতে কাজ করে। সেদিক থেকে জোসেফ এনলাইটেনমেন্টের ধারণায় অনেক বেশি প্রভাবান্বিত ছিলেন। ফলে মায়ের সাথে শাসন নিয়ে বিরোধ আশ্চর্য ছিল না।
১৭৮০ সালের ২৯ নভেম্বর সন্তানসন্ততি পরিবেষ্টিত অবস্থায় মারিয়া থেরেসা মারা যান। তার মৃত্যুতে ফ্রেডেরিক দ্য গ্রেট শোক প্রকাশ করেন। মারিয়া থেরেসা তার রাজনৈতিক এবং সামরিক প্রতিপক্ষ ছিলেন বটে, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে ফ্রেডেরিক তার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতেন না, বরং একজন যোগ্য সম্রাজ্ঞী হিসেবে মারিয়া থেরেসাকে তিনি শ্রদ্ধা করতেন। মারিয়া থেরেসাই হাবসবুর্গ বংশের শেষ শাসক, কারণ বৈবাহিক সূত্রে তার উত্তরাধিকারীরা ছিলেন হাবসবুর্গ-লরেইন বংশীয়। জীবদ্দশায় হাবসবুর্গ সম্রাজ্ঞী ছাড়াও স্বামীর সূত্রে হলি রোমান এম্প্রেস উপাধিও তিনি প্রাপ্ত হয়েছিলেন। মায়ের প্রয়াণের পর তার বড় ছেলে জোসেফ অস্ট্রিয়ান সিংহাসনে একক সম্রাট হিসেবে অভিষিক্ত হন।
মারিয়া থেরেসা নিজের মেয়েদেরকে কঠোর অনুশাসনে বড় করেছিলেন, উদ্দেশ্য একটাই ছিল- তাদের মাধ্যমে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে হাবসবুর্গ শক্তিকে বজায় রাখা। একমাত্র তার প্রিয় কন্যা মারিয়া ক্রিস্টিনা বাদে সকল মেয়েকেই তিনি নিজের মত অনুযায়ী বিয়ে দিয়েছিলেন, কেবল মারিয়া ক্রিস্টিনার সুযোগ হয়েছিল নিজের ভালবাসার মানুষের হাত ধরবার। মারিয়া থেরেসার আরেক মেয়ের কথা না বললেই নয়, যার নাম মারিয়া অ্যান্টোনিয়া। ফ্রান্সের ভবিষ্যৎ সম্রাট ষোড়শ লুইয়ের সাথে বিয়ের সুবাদে ফরাসিরা তাকে ডাকত মাঁরি আন্তোয়াঁনেত (Marie Antoinette) বলে।
পথচলার সমাপ্তি
মৃত্যু সবার জন্যই আসে, রাজা-প্রজার কোনো ভেদাভেদ সে করে না। ফ্রেডেরিকের মধ্যেও দিন দিন মৃত্যুর ছায়া স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। লীগ অফ প্রিন্স’স গঠন করার পরের বছর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্টে তিনি ঘুমাতে পারছিলেন না। তার শরীর ফুলে যেতে থাকে। ব্যথা-বেদনায় অস্থির ফ্রেডেরিক ডেকে পাঠালেন হ্যানোভারের বিখ্যাত চিকিৎসক জিমারম্যানকে। জিমারম্যান জানিয়েছেন- তিনি যখন ফ্রেডেরিককে দেখেন তখন রাজা তার দিকে পিঠ দিয়ে চেয়ারে বসে ছিলেন। তার পরনে ছিল স্যাটিনের পোশাক, পায়ে বুট। এক পা ছোট একটি টুলে রেখে অন্য পা ফেলে রেখেছিলেন মেঝেতে। তার মাথায় শোভা পাচ্ছিল বহুল ব্যবহারে জীর্ণ পালক খচিত একটি টুপি। জিমারম্যানকে তিনি ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন শত ব্যস্ততার মাঝেও এত দূরে ছুটে আসবার জন্য।
ফ্রেডেরিক জানতেন তার সময় ঘনিয়ে আসছে। তার চাওয়া ছিল শুধুমাত্র যেন তার যন্ত্রণার উপশম হয়। কিন্তু তখনকার চিকিৎসাবিজ্ঞানের পক্ষে তা সম্ভব ছিল না। জিমারম্যানের অনেক চেষ্টার পরেও খুব একটা লাভ না হওয়ায় ভবিতব্যকে মেনে নেন রাজা। চিকিৎসককে পুনরায় ধন্যবাদ দিলেন তার ঐকান্তিক চেষ্টার জন্য। জিমারম্যান ফিরে এলেন হ্যানোভারে, রেখে এলেন মৃত্যুর দিন গোনা এককালের পরাক্রমশালী রাজাকে।
ছয় সপ্তাহ শ্বাসকষ্টে ঠিকমতো ঘুমাতে পারলেন না ফ্রেডেরিক। চিরকাল প্রায় নিঃসঙ্গ মানুষটি শেষ বেলাতেও নিঃসঙ্গই থেকে গেলেন। ১৭৮৬ সালের ১৭ আগস্ট রাত ২টা বেজে ২২ মিনিটে পটসড্যামের সানুসি প্রাসাদে চোখ বুজলেন ফ্রেডেরিক দ্য গ্রেট। চুয়াত্তর বছরের জীবনের ছেচল্লিশ বছরই তিনি কাটিয়েছেন প্রুশিয়ার রাজা হিসেবে। প্রুশিয়ার ইতিহাসে এত দীর্ঘকাল শাসন করার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য কারোরই হয়নি। মানুষের প্রতি ফ্রেডেরিকের বরাবরই অনাস্থা ছিল, যা শেষ বেলাতেও প্রকাশ পায়, যখন তিনি উইলে লিখে যান প্রিয় কুকুরগুলোর পাশে সানুসির বাগানে তাকে কবর দিতে। তবে সেই ইচ্ছা পূরণ করা হয়নি। ফ্রেডেরিককে তার বাবার ঠিক পাশে, পটসড্যামের গ্যারিসনের চ্যাপেলে সমাধিস্থ করা হলো।
ফ্রেডেরিকের ভ্রাতুষ্পুত্র দ্বিতীয় ফ্রেডেরিক উইলিয়াম নাম নিয়ে সিংহাসনে বসলেন। তার অধীনে প্রায় ৭২,০০০ বর্গ মাইল অঞ্চল, যেখানে বাস করছে ছয় মিলিয়ন মানুষ। রাজার হাতে দুই লাখের বেশি সেনা, যাদের পেছনে ব্যয় হয় রাজস্বের চার-পঞ্চমাংশ।