ডিসেম্বর এলেই চারপাশ ছেয়ে যায় বিজয়ের রঙে। বিজয়ের উৎসবে যেমন মেতে ওঠে বাংলাদেশ তেমনি বাংলার কৃতি সন্তানদের হারানোর দুঃখও মনকে আচ্ছন্ন করে যায়। দুদিন আগে পালিত হওয়া মহান বিজয় দিবসে চারিদিকে যেমন দেখা গেছে শ্রদ্ধা ও গৌরবের প্রাণোচ্ছ্বাস তেমনি পতপত করে উড়েছে বাংলাদেশের গৌরবের অনন্য প্রতীক- বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। এ কথা আমাদের কারোই অজানা নয় যে লাল সবুজে ঘেরা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা বাঙ্গালির জীবন ও ইতিহাসে কতখানি গুরুত্ব বহন করে। তবে বর্তমান যে পতাকাটি আমরা সর্বত্র দেখি তা আগে কিন্তু ঠিক এরকম ছিলো না। বর্তমান পতাকাটির রূপকার কামরুল হাসান হলেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ও তার কিছু আগে যে পতাকাটি ব্যবহার করা হয়েছিলো তার নকশাকার ভিন্ন। বাংলাদেশের প্রথম পতাকা এবং তা থেকে পতাকার বর্তমান বৈশিষ্ট্যে আরোহনের কারণ ও ঘটনা নিয়েই আজকের লেখাটি সাজানো।
বাংলাদেশ- অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এক নাম। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার নকশা কিন্তু করা হয়ে গিয়েছিলো স্বাধীনতার কিছু আগেই। বাংলাদেশের প্রথম পতাকাটির নকশা কিন্তু ‘স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস’ সংগঠনের কিছু কর্মী এবং ছাত্রনেতার হাত ধরে। ১৯৭০ সালের ৬ ই জুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ইকবাল হলের (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ১০৮ নং কক্ষে পতাকার প্রাথমিক নকশাটি করা হয় যার নকশাকাররা হচ্ছেন ছাত্রলীগ নেতা আ স ম আব্দুর রব, কাজী আরেফ আহমেদ, শাহজাহান সিরাজ, মনিরুল ইসলাম (মার্শাল মনি), স্বপন কুমার চৌধুরী; জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ) ছাত্রলীগ নেতা নজরুল ইসলাম, কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা শিবনারায়ণ দাস, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সাধারণ সাধারণ সম্পাদক হাসানুল হক ইনু, ছাত্রনেতা ইউসুফ সালাহউদ্দিন আহমেদ, কামরুল আলম খান (খসরু) সহ আরো অনেকে।
সেখানে হওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সবুজ পটভূমিতে লাল সূর্যের মাঝে হলুদ বাংলাদেশের মানচিত্র সম্বলিত পতাকার নকশাটি চূড়ান্ত হয়। এই বাংলাদেশের মানচিত্রটি একটি বিশেষ কারণবশত পতাকায় যোগ করা হয়। সে সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত স্লোগান ছিলোঃ “জয় বাংলা”। সে ক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন থেকেই যায়, যে কোন বাংলার কথা বলা হচ্ছে? পূর্ব বাংলা, পশ্চিম বাংলা নাকি দুই বাংলাই? তখন সিদ্ধান্ত হয় পতাকায় দেয়া থাকবে তৎকালীন পূর্ব বাংলা (বর্তমান বাংলাদেশ) এর ভূমি প্রতিকৃতি তথা মানচিত্র। মজার ব্যাপার হলো দেশ স্বাধীন হলে যে ঐ মানচিত্রের প্রয়োজন হবে না সে সিদ্ধান্তটিও ওখানে নেয়া হয়েছিলো- যা কিনা পরবর্তীতে পটুয়া কামরুল হাসানের নকশা করা পতাকার (বর্তমান পতাকা) ক্ষেত্রে সত্যি হয়েছিলো।
অ্যাপোলো টেইলর্স এর মালিক বজলুর রহমান লস্করের দেয়া কাপড় নিয়ে কামরুল আলম খান (খসরু) তখন ঢাকা নিউ মার্কেটের বিহারী দর্জির দোকান থেকে বড় এক টুকরো সবুজ কাপড়ের মাঝে লাল একটি বৃত্ত সেলাই করে আনেন। এ ঘটনার স্মৃতি রোমন্থনকালীন শিবনারায়ণ দাসের এক বক্তব্য অনুসারে, রাত প্রায় ১২ টার দিকে পতাকাটি সেলাই করতে যাওয়া হয় এবং ঐ মধ্যরাত্রে দর্জিদের তুলে কাজটির কথা বলা হয়। পতাকার কাজের কথা শুনে কিন্তু দর্জিরা একটুও আপত্তি করেননি বরং বিনা পারিশ্রমিকে কাজটি করে দিয়েছিলেন তারা।
এরপরে, ইউসুফ সালাউদ্দিন আহমেদ এবং হাসানুল হক ইনু পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বর্তমান বুয়েট) কায়েদে আজম হলের (বর্তমান তিতুমীর হল) ৩১২ নং কক্ষের এনামুল হকের কাছ থেকে মানচিত্রের বই নেন এবং তাঁরা ট্রেসিং পেপারে পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র আঁকেন। ছাত্রনেতা শিবনারায়ণ দাস অতঃপর হলুদ রং এবং ম্যাচের কাঠি ব্যবহার করে মানচিত্রটি পতাকার লাল বৃত্তের মাঝে আঁকেন। এভাবেই প্রস্তুত হয় বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় পতাকা যা কিনা ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় প্রথম উত্তোলিত হয়।
প্রথম উত্তোলনটি করেন ছাত্রনেতা ও ‘ডাকসু’র তদানীন্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট আ স ম আবদুর রব, এ সময় অন্যান্য ছাত্রনেতা ও কর্মীরাও উপস্থিত ছিলেন। অতঃপর মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে ২৩ শে মার্চ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ধানমন্ডি ৩২ নম্বর এর বাসভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। পতাকার লাল বৃত্তটি ছিলো উদীয়মান লাল সূর্যের প্রতীক। ‘সিআইএ ওয়ার্ল্ড ফ্যক্টবুক’ অনুযায়ী, বাংলাদেশের সবুজ প্রকৃতি বুঝাতে পতাকায় সবুজ রং ব্যবহার করা হয়েছিল। তৎকালীন পতাকাটি তাই ছিলো উজ্বল সবুজে বিরাজমান লাল বৃত্তের মাঝে বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব বাংলা) এর মানচিত্র।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পটুয়া কামরুল হাসানকে পতাকাটির নতুন নকশা, ব্যাখ্যা ও এর উপর প্রতিবেদন করার নির্দেশ দেন। কামরুল হাসান কর্তৃক নকশা করা মানচিত্রবিহীন পতাকাটিই বর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা হিসেবে সর্বত্র প্রচলিত। কামরুল হাসানের কিন্তু বর্তমান পতাকাটি মাপজোখ ও তৈরি করতে বেশ সময় লেগেছিলো। পতাকার জন্য ১৯৭২ সালে প্রণীত হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পতাকা বিধিমালা। এই বিধিমালা অনুযায়ী বর্তমান জাতীয় পতাকার মাপ এবং প্রকৃতি নিম্নরূপঃ
১) পতাকাটি হবে গাঢ় সবুজ রঙের এবং দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের অনুপাত ১০:৬ এমন একটি সবুজ রঙের আয়তক্ষেত্রের মধ্যভাগের কাছাকাছি থাকবে একটি লাল বৃত্ত।
২) লাল বৃত্তটির ব্যাসার্ধ হবে পতাকার দৈর্ঘ্যের এক-পঞ্চমাংশ। পতাকার দৈর্ঘ্যের নয়-বিংশতিতম অংশ হতে অঙ্কিত লম্বরেখা এবং পতাকার প্রস্থের মধ্যবিন্দু হতে অঙ্কিত আনুভূমিক রেখার ছেদবিন্দুই হবে লাল বৃত্তটির কেন্দ্রবিন্দু।
(অর্থাৎ, পতাকার দৈর্ঘ্য ১০ ফুট হলে প্রস্থ হবে ৬ ফুট, লাল বৃত্তের ব্যাসার্ধ হবে ২ ফুট, পতাকার দৈর্ঘ্যের সাড়ে ৪ ফুট ওপরে প্রস্থের মাঝ বরাবর অঙ্কিত আনুপাতিক রেখার ছেদ বিন্দু হবে লাল বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দু)।
৩) পতাকার সবুজ পটভূমিতে থাকবে প্রতি হাজারে প্রোসিয়ন ব্রিলিয়ান্ট গ্রীন এইচ-২ আর এস ৫০ পার্টস রং এবং লাল বৃত্তটি হবে প্রতি হাজারে প্রোসিয়ন ব্রিলিয়ান্ট অরেঞ্জ এইচ-২ আর এস ৬০ পার্টস রঙের।
পতাকা ব্যবহারের জন্য সরকারী নির্দেশনানুযায়ী বিভিন্ন মাপ রয়েছে যেমন- ভবনে ব্যবহার্থে ১০ বাই ৬ ফুট (৩.০ বাই ১.৮ মিটার) কিংবা ৫ বাই ৩ ফুট (১.৫২ বাই ০.৯১ মিটার) কিংবা ২.৫ বাই ১.৫ ফুট (৭৬০ বাই ৪৬০ মিলিমিটার)। মোটরগাড়িতে ব্যবহারের জন্য পতাকার বিভিন্ন মাপের মধ্যে বড় গাড়ীর জন্য- ১৫ বাই ৯ ইঞ্চি (৩৮০ বাই ২৩০ মিলিমিটার) এবং ছোট ও মাঝারী গাড়ীর জন্য ১০ বাই ৬ ইঞ্চি (২৫০ বাই ১৫০ মিলিমিটার)। আন্তর্জাতিক ও দ্বিপাক্ষিক অনুষ্ঠানে যে সব টেবিল পতাকা ব্যবহৃত হয় সেগুলোর জন্য ১০ বাই ৬ ইঞ্চি (২৫০ বাই ১৫০ মিলিমিটার) মাপটি নির্ধারিত।
স্বাধীন বাংলাদেশে জাতীয় পতাকা ২৬ শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস, ১৬ ই ডিসেম্বর বিজয় দিবস, ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী এবং সরকার কর্তৃক প্রজ্ঞাপিত অন্য যে কোন দিবসে সকল সরকারী ও বেসরকারী ভবনসমূহে এবং বিদেশে অবস্থিত কূটনৈতিক মিশনের অফিস ও কনস্যুলার পোস্টসমূহে উত্তোলন করতে হয়। ২১ শে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বা শহীদ দিবস, ১৫ ই আগস্ট জাতীয় শোক দিবস এবং সরকার কর্তৃক প্রজ্ঞাপিত অন্য যে কোন দিবসে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার নিয়ম রয়েছে।
পটুয়া কামরুল হাসান এর ডিজাইনকৃত বর্তমান জাতীয় পতাকায় গাঢ় সবুজ রঙটি বাংলাদেশের সবুজ প্রকৃতি এবং তারুণ্যের প্রতীক। আর মাঝের লাল বৃত্তটি উদীয়মান সূর্যের পাশাপাশি বাংলাদেশের মানুষের দেয়া রক্ত ও আত্মত্যাগ কে নির্দেশ করে। বর্তমান পতাকায় বাংলাদেশের মানচিত্র বাদ যাওয়ার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে- পতাকার দুইদিকে মানচিত্রের সঠিক উপায়ে সেলাই নিয়ে জটিলতা। সকলবিধিপূর্বক বানানো কামরুল হাসানের নকশা করা বাংলাদেশের পতাকাটি ১৯৭২ সালের ১৭ ই জানুয়ারী দাপ্তরিকভাবে ও সম্পূর্ণরূপে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা হিসেবে গৃহীত হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশের গৌরবজ্বল উপাখ্যানের অন্যতম ধারক ও বাহক গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। লাল-সবুজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকিয়ে আছে বাংলাদেশীদের অপরিমেয় আত্মত্যাগ ও বীরত্বের কাহিনী। প্রাক্তন থেকে বর্তমান পতাকার আগমনযাত্রা সাক্ষী হয়েছে রক্তক্ষয়ী এক অধ্যায়ের। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, গৌরব, জাতীয়তা আর মহান আত্মত্যাগ মিশে রয়েছে জাতীয় পতাকার লাল-সবুজে।