সিরিয়াল কিলিং বা সিরিয়াল কিলারদের নিয়ে আমাদের আগ্রহের শেষ নেই। তাদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে মনোবিজ্ঞানী থেকে শুরু করে অপরাধবিজ্ঞানীদেরও গবেষণার শেষ নেই। সিরিয়াল কিলার বা ধারাবাহিক খুনিদের নিয়ে যুগে যুগে বহু সিনেমা, গল্প, কাহিনীর জন্ম হয়েছে। রহস্যময় সেই সিরিয়াল কিলাররা হয়ত আমাদের আশেপাশেই লুকিয়ে আছে কিংবা যে পুলিশ ডিপার্টমেন্ট খুনের তদন্তের দায়িত্বে আছে সেখানেই হয়ত ভালোমানুষের মুখোশ নিয়ে লুকিয়ে থাকে সিরিয়াল কিলার। ডেক্সটার (Dexter) সিরিয়ালটি দেখে থাকলে হয়ত আরো ভালো বুঝবেন।
আজ আমরা ইতিহাসখ্যাত সেই খুনিদের গল্প জানবো শুধু তাই নয় মানুষ কেন সিরিয়াল কিলার হয় তা সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো। প্রথমেই আসা যাক সিরিয়াল কিলার বলতে কি আমরা বুঝি। সিরিয়াল কিলার হচ্ছে একজন ব্যক্তি যে একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর খুনে লিপ্ত হন কিংবা নির্দিষ্ট নাও হতে পারে। অধিকাংশ সিরিয়াল কিলার ঠাণ্ডা মাথায় প্ল্যান করে খুন করে এবং একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীকে সর্বদা টার্গেট করে। নারীবিদ্বেষ থেকে কেউ কেউ সিরিয়াল কিলার হন যেমন আমাদের রসু খাঁ, যৌন বিকৃত রুচি যেমন “Superficial Charmer” Ted Bundy কিংবা রক্ত দেখার প্রবল তৃষ্ণার কারণে সিরিয়াল কিলাররা খুনে লিপ্ত হয়।
ধারণা করা হয় ৩৩১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে রোমান সাম্রাজ্যে ১৭০ জন নারী ছিলেন যারা হাজার হাজার রোমান পুরুষকে বিষ পান করিয়ে হত্যা করেন। উইকিপিডিয়া মতে পৃথিবীর প্রথম সিরিয়াল কিলার হলো Dr. Henry Howard Holmes সংক্ষেপে H. H. Holmes যিনি কিনা ২০০ খুন করেছেন এর মধ্যে ৯ টি নিশ্চিত, ২৭ টি স্বীকার করেছেন আর বাকিগুলোর হদিশ পাওয়া যায়নি। যদিও ইতিহাস বলে পৃথিবীর প্রথম সিরিয়াল কিলার হলেন একজন নারী।
লকাস্টা নামক এক নারী, রোমান সম্রাট নিরোর মা, এগ্রিপিন্নার অধীনে কাজ করতেন। তার দায়িত্ব ছিল রোমের অভিজাত পরিবারের সদস্যদের বিষক্রিয়ার মাধ্যমে খুন করা যাতে কেউই সম্রাট নিরোর সম্রাট হওয়ার পথে কাঁটা হয়ে না দাঁড়াতে পারে। শুধু তাই নয়, ধারণা করা হয় সম্রাট নিরোর বাবা সম্রাট ক্লডিয়াসকেও হত্যা করেছেন এই নারী যদিও তার সত্যতা প্রমাণিত হয়নি। লকাস্টা সব কিছুই করেছেন এগ্রিপিন্নার হয়ে যার ফলশ্রুতিতে ৬৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে রাজা নিরো তাকে পুরস্কৃত করেন!
তারই এক বছর পর Aspernas নামক এক রোমান নিজেই কোর্টে এসে ১৩০ জনকে খুনের কাহিনী বর্ণনা করে যান।
এবার আসা যাক সিরিয়াল কিলিং এর প্রকারভেদে। ১৯৭৪ সালে FBI এর Behavioral Science Unit (BSU) এর নেতৃত্বে ৩৬ জন সিরিয়াল কিলারের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। তাদের সাক্ষাতকারের ভিত্তিতে সিরিয়াল কিলিংকে তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়। যেমন-
Organized বা পূর্ব পরিকল্পিত হত্যা
এই ধরণের সিরিয়াল কিলাররা খুব ঠাণ্ডা মাথায় খুন করে থাকেন। এরা খুব সাবধানে শিকার সনাক্ত করে এবং শিকারের পেছনে যথেষ্ট সময় দেয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এরা নারীদের দৌর্বল্যের আশ্রয় নিয়ে প্রেমের ছলনা করে এবং অবশেষে সময় সুযোগ বুঝে হত্যা করে। অধিকাংশ সময়ই তারা শিকার বা victim কে দূরে পূর্ব নির্ধারিত কোনো জায়গায় নিয়ে গিয়ে শান্তিমতো হত্যা করে এবং হত্যার স্থান থেকে দূরে কোথাও নিয়ে মৃতদেহটি ফেলে রেখে যায়। এই ধরণের কেসে তদন্ত করাটাই সবচেয়ে মুশকিলের ব্যাপার। অপরদিকে সিরিয়াল কিলাররা নিয়মিত খবর দেখে এবং পুলিশের মাথার ঘাম পায়ে দেখে আনন্দ পায়।
এবার টেড বান্ডির (Ted Bundy) গল্পে আসা যাক। বিশেষজ্ঞদের মতে, Organized বা পূর্ব পরিকল্পিত হত্যাকারীর সবচেয়ে ‘Perfect’ উদাহরণ টেড বান্ডি। তার হত্যার পদ্ধতি এমন ছিল যে ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফ্লোরিডা পুলিশ যদি তাকে গ্রেফতার না করত তবে সে ১০০রও বেশি নারীকে হত্যা করে ফেলত।
তো বান্ডি সাহেব কীভাবে হত্যা করতেন? বান্ডি দেখতে সুদর্শন ছিলেন বলে যেকোন মেয়েই সহজেই তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ত। আর বান্ডি এই সুযোগটাই কাজে লাগাতেন। প্রথমে বান্ডি পছন্দ মতো কোন নারীকে প্রেম নিবেদন করতেন তারপর তাকে তার গাড়িতে উঠতে বলতেন। শিকার হাতে পেয়েই বান্ডি প্রথমেই তাকে অজ্ঞান করে বেঁধে ফেলতেন। এবার পূর্ব নির্ধারিত কোনোজায়গায় নিয়ে গিয়ে “হাতের কাজ” টি সেরে ফেলতেন। তারপর সুবিধামতো কোনো জায়গায় মৃতদেহটি ফেলে রেখে যেতেন।
১৯৭৪ থেকে ১৯৭৮ সাল, এই চার বছরের মধ্য টেড বান্ডি ৩০ টি খুন করেন যার প্রমাণ পুলিশ পেয়েছে, আরো অনেক খুনই বান্ডি করেছে যার হদিশ কেউ জানে না। নিজের সম্পর্কে বান্ডির মতামত ‘the most cold-hearted son of a b***h you’ll ever meet.’
Disorganized বা অপরিকল্পিত হত্যা
এ ধরণের সিরিয়াল কিলাররা আসলে তেমন একটা ক্ষতিকর না। কারণ এরা হঠাৎ মাথা গরম করে কিংবা অতিরিক্ত নেশায় hallucination এর বশে খুন করে ফেলে বলে পুলিশ খুব সহজেই এদের হদিশ পেয়ে যায়।
Mixed
এই ধরণের সিরিয়াল কিলাররা মাঝে মাঝে পূর্ব পরিকল্পিত উপায়ে খুন করে আবার মাঝে মাঝে হঠাৎ করে জেদের বশে খুন করে থাকে। Fred West নামক এক সিরিয়াল কিলার তার পরিবার সহ ১২ জনকে হত্যা করে নিজের বাড়ির বাগানে পুঁতে ফেলেন।
একজন সিরিয়াল কিলারের মস্তিষ্ক
মেডিকেল ইমেজিং টেকনিক ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন সাইকোপ্যাথদের Subcortical এলাকার টিশ্যু সাধারণের চেয়ে যথেষ্ট পাতলা। এই এলাকাকে বলা হয় (limbic system)। Orbitofrontal Cortex এবং Temporal pole কে Para Limbic সিস্টেম বলে। যা লিম্বিক সিস্টেমের সাথে যুক্ত এবং আমাদের আবেগ অনুভুতির কেন্দ্রস্থল। আমদের হাসি, কান্না, দুঃখ, কষ্ট, অভিমান, ভয়, হিংসা এই অংশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। আর এই অংশের টিস্যুগুলো যদি Damaged বা underdeveloped হয় তবে আবেগ অনুভুতির বহিঃপ্রকাশটাও স্বাভাবিকভাবে বদলে যাবে আর এটাই সাইকোপ্যাথদের হয়ে থাকে।
কোনো কোনো নিউরোবিজ্ঞানী মনে করেন, হাইপোথ্যালামাস, ফ্রন্টাল লোব এবং লিম্বিক সিস্টেমের damage এর কারণে সিরিয়াল কিলাররা পাশবিক, নির্দয় এবং প্রচন্ড রুদ্র মেজাজের হয়ে থাকেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, হেনরি লি লুকাস নামক এক সিরিয়াল কিলার ১১ জনকে হত্যা করে এবং তার মস্তিষ্কের এই তিনটি অংশে ভয়ানক Damage ছিল।
আবার আরেকদল বিজ্ঞানীর মতে, Amygdala এবং Ventromedial Prefrontal Cortex (vmPFC) এর মধ্যকার সংযোগ দুর্বল হলে মানুষ নির্দয় কিংবা অমানুষের মতো পাশবিক আচরণ করে।
আমাদের অনেকের ধারণা সাইকোপ্যাথ মানেই সিরিয়াল কিলার। এটা ভুল ধারণা কিছু কিছু সিরিয়াল কিলার সাইকোপ্যাথ বটে।
মানুষ কেন সিরিয়াল কিলার হয়?
এই প্রশ্নটি আমাদের মনের কোণে প্রায়ই উঁকি দেয়। কেন মানুষ সিরিয়াল কিলার হয়? কেন তারা আর দশটা মানুষের মতো স্বাভাবিক না? এর মনস্তাত্ত্বিক বর্ণনা তো হলো। এবার কিছু বাস্তবাতায় আসা যাক।
অনেক সময় পরিবেশ মানুষকে সিরিয়াল কিলারে পরিণত করে। শৈশবের কোন বীভৎস স্মৃতিও মানুষকে এই জান্তব রুপ দিতে সহায়তা করে। জন ওয়েন গ্যাসি (John Wayne Gacy) বা killer clown নামক এক সিরিয়াল কিলার ৩৩ জন যুবককে হত্যা করে। তদন্তে দেখা যায় শৈশবে তার বাবা তাকে গাধা, অপদার্থ বলে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতেন এবং বেধঢক পিটাতেন। একদিন রাগ করে গ্যাসির প্রিয় কুকুরটিকে গুলি করে মেরে ফেললেন। চোখের সামনে প্রিয় কুকুরের এই মৃত্যু গ্যাসিকে আমূলে বদলে দেয়।
আলবার্ট ডিস্লাভো নামক আরেক সিরিয়াল কিলার ১১ জন বস্টনের নারী হত্যা করেছেন। শৈশবে তার বাবা বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে তার মায়ের হাত ভেঙ্গে দেন যা শিশু আলবার্ট নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করেন। তারপর তার বাবা সন্তানসহ তার স্ত্রীকে এক কৃষকের নিকট বিক্রি করে দেন। শৈশবের নির্মম কষ্ট তাকে এই জান্তব রুপ দিয়েছে।
তবে সব সময়ই যে পরিবেশের দরুন মানুষ এমন দানব হয়ে ওঠে তা সত্য নয়। জেফেরি ডাহফার নামক এক সিরিয়াল কিলার ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সালের মাঝে ১৭ জন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেন। তার শৈশব আর দশটা মানুষের মতোই নর্মাল ছিল। কিন্তু ছোটবেলায় সে জীব জন্তু মারতে এবং মৃত জীবজন্তু সংগ্রহ করতে ভালবাসত।
অধিকংশ ক্ষেত্রে দেখা বাবা মায়ের অস্থিতিশীল সম্পর্কে শিশুদের মনে বিরুপ প্রভাব ফেলে। তারা সমাজ, ব্যক্তি কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না, ভরশা করতে পারে না। তাই নিজে হাসি খুশি থেকে সন্তানদের একটি আনন্দময় পরিবেশ উপহার দিন আর দেশকে একজন সুনাগরিক দিয়ে দেশের প্রতি দায়িত্ব কর্তব্য পালন করুন।