(প্রথম পর্বের পর থেকে)
বার্লিন প্রাচীরের পতন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিভিন্ন দেশের উপর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। মার্কিন-সোভিয়েত প্রতিযোগিতায় বলির পাঁঠা হয় অনেক দেশ। জার্মানিও এই ফাঁদে পড়ে। বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের পর জার্মানিকে পূর্ব ও পশ্চিমে ভাগ করা হয়। পূর্ব জার্মানি ছিল কমিউনিস্টদের অধীনে, সোভিয়েত ইউনিয়নের আজ্ঞাবহ। আর পশ্চিম জার্মানি ছিল পুঁজিবাদী এবং গণতান্ত্রিকভাবে শাসিত।
একইভাবে জার্মানির রাজধানী বার্লিনকেও ভাগ করা। ১৯৬১ সালে বার্লিন শহরের মাঝে পূর্ব ও পশ্চিমকে আলাদা করার জন্য দেয়াল নির্মাণ করা হয়। সেই থেকে বার্লিন দেয়াল জার্মানিকে সোভিয়েত-কমিউনিস্ট শাসিত পূর্ব জার্মানি এবং গণতান্ত্রিক পশ্চিম জার্মানিতে বিভক্ত করে। প্রাচীরটি কমিউনিস্ট শাসনে অসন্তুষ্ট পূর্ব জার্মানদের পশ্চিমে স্বাধীনতার জন্য পালিয়ে যেতে বাধা দেয়। কিন্তু মন কী আর বাঁধা মানে? শত বাঁধা অতিক্রম করেও অনেক জার্মান পূর্ব থেকে দেয়াল টপকে পশ্চিমে গিয়েছে। দেয়াল অতিক্রমের সময় ১৯৬১ ও ১৯৯১ এর মধ্যে প্রায় ২০০ জন জার্মান নিহত হয়। জার্মানরা একত্রিত হওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে।
১৯৮৭ সালের ১২ জুন পশ্চিম জার্মানিতে দেওয়া এক বক্তব্যে মার্কিন রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রিগ্যান সোভিয়েত নেতা গর্বাচেভকে প্রাচীরটি ভেঙে দেওয়ার জন্য আহ্বান জানান। এ সময়ের মধ্যে, রিগ্যানের কমিউনিস্টবিরোধী ‘রিগ্যান ডকট্রিন’ পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েতের প্রভাবকে দুর্বল করে দিয়েছিল এবং সেইসঙ্গে জার্মান পুনর্মিলনের বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়। ১৯৮৮ ও ১৯৮৯ সালে পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বিপ্লবের ধারাবাহিকতায় পূর্ব জার্মানিতেও আন্দোলন শুরু হয়। প্রথমদিকে আন্দোলনকারীরা পশ্চিম জার্মানিতে চলে যাওয়ার দাবি তুললেও পরবর্তীতে তারা পূর্ব জার্মানিতে থেকেই সরকার পতনের দাবি তুলে। আন্দোলন ক্রমেই তীব্র হতে থাকে।
প্রবল আন্দোলনের মুখে পূর্ব জার্মানির দীর্ঘকালীন নেতা এরিক হোনেকার ১৯৮৯ সালের ১৮ ই অক্টোবর পদত্যাগ করেন এবং এদিন নতুন নেতা হিসেবে অ্যাগন ক্রেঞ্জ তার স্থলাভিষিক্ত হন। ১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বরে নতুন পূর্ব জার্মানি সরকার ও জনগণ সত্যিই বার্লিন প্রাচীর ভেঙে ফেলে। এর মাধ্যমে তিন দশকের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয় জার্মানরা।
১৯৯০ সালের অক্টোবরের মধ্যে জার্মানি পুরোপুরি একত্রিত হয়। জার্মানির পুনর্মিলন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং অন্যান্য কমিউনিস্ট পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোকে আন্দোলিত করে। বার্লিন প্রাচীরের পতনের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র।
আফগানিস্তান যুদ্ধ ও সামরিক কারণ
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পেছনে অন্যান্য কারণের পাশাপাশি তার সামরিক বাহিনীও অনেকাংশে দায়ী ছিল। সাবেক সোভিয়েত নেতা ব্রেজনেভ ক্ষমতায় আসার পর স্নায়ু যুদ্ধ চরম আকার ধারণ করে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে শুরু হয় অস্ত্র প্রতিযোগিতা। বহির্বিশ্বে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে অনেক দেশে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন। ফলে সোভিয়েত সামরিক ব্যায় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু অর্থনীতির সাথে সামরিক ব্যায়ের বিশাল তফাত তৈরি হয়। বাজেটে অন্যান্য খাত থেকে সামরিক খাতে অত্যাধিক ব্যায় করা হয়। ধারণা করা হয়, সোভিয়েত জিডিপির ১০ থেকে ২০ ভাগই ব্যায় হতো সামরিক খাতে। এরই মধ্যে ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান আক্রমণ করে। আফগান যুদ্ধ ধুঁকতে থাকা সোভিয়েত অর্থনীতিকে আরো দুর্বল করে দেয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রোনাল্ড রিগ্যান ক্ষমতায় আসার পর পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়। রিগ্যান কট্টর কমিউনিস্ট বিরোধী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। রোনাল্ড রিগ্যান সোভিয়েত ইউনিয়নকে ‘ইভিল এম্পায়ার’ হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি কমিউনিজমের ধ্বংস ও স্নায়ু যুদ্ধের সমাপ্তির লক্ষ্যে কমিউনিস্ট বিরোধী ‘রিগ্যান ডকট্রিন’ প্রকাশ করেন। প্রথমদিকে তিনি অস্ত্র প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে দেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে সোভিয়েত সামরিক বাজেট আরো বৃদ্ধি করতে হয়। যা ভাংতে থাকা সোভিয়েত অর্থনীতিকে আরো দুর্বল করে দেয়। গর্বাচেভ ক্ষমতায় আসার পর তিনি স্নায়ু যুদ্ধ সমাপ্তির পথে হাঁটেন। তার নেওয়া নতুন নীতি অনুযায়ী তিনি সামরিক ব্যায় কমানোর পরিকল্পনা নেন। গর্বাচেভ সামরিক বাজেট ও সামরিক বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা কয়েক লক্ষ কমিয়ে আনেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অস্ত্র প্রতিযোগিতা কমিয়ে আনার জন্যও চুক্তি করেন।
আফগানিস্তান যুদ্ধ তখনো চলছে। দশ বছর (১৯৭৯-১৯৮৯) ধরে চলা আফগান যুদ্ধে সোভিয়েত অর্থনীতি অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই যুদ্ধে ৬ লক্ষাধিক সোভিয়েত সেনা অংশগ্রহণ করে। যুদ্ধে ১৫ হাজার সোভিয়েত সৈন্য নিহত হয় এবং হাজার হাজার সৈন্য আহত হয়। এই যুদ্ধে দুই থেকে আড়াই লক্ষ আফগান মুজাহিদিন নিহত হয়। শুধু সামরিক বাহিনী নয় এই যুদ্ধে দশ লক্ষাধিক আফগান বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়। যুদ্ধ যখন শুরু হয়, সোভিয়েত ইউনিয়নের নাগরিক ও মিডিয়া তখন সরকার কর্তৃক কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত ছিল। তবে গর্বাচেভের গ্লাসনস্ত (স্বচ্ছতা) নীতির ফলে জনগণ ও মিডিয়ার উপর থেকে কঠোরতা উঠে যায়। ফলে মিডিয়ায় প্রচারিত যুদ্ধের ভয়াবহতা সোভিয়েত জনগণকে সচেতন করে তুলে। সোভিয়েত সৈন্যরা যুদ্ধের ভয়াবহতা ও যুদ্ধকালীন যে অপব্যবহারের শিকার তারা হয়েছে তা প্রকাশ্যে বলতে থাকে। ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নে যুদ্ধবিরোধী জনমত বৃদ্ধি পেতে থাকে।
ইউরোপীয় প্রজাতন্ত্রগুলোর সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে বিভাজন ছিল আরও নাটকীয়। ইউক্রেনে যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়। বাল্টিক অঞ্চলের প্রজাতন্ত্রগুলো আফগানিস্তান যুদ্ধকে তাদের নিজেদের দেশে রাশিয়ার দখলের সাথে তুলনা করে দেখছিল। এই যুদ্ধ ১৯৯০ সালে তিনটি বাল্টিক রাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ঘটনার জ্বালানি হিসেবে কাজ করে।
১৯৮৯ সালে মিখাইল গর্বাচেভ আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। ফলে শেষ হয় ভয়াবহ আফগান যুদ্ধ। কিন্তু এর রেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটিয়ে শেষ হয়। এরই মধ্যে সোভিয়েত সামরিক বাহিনীর ভিত দুর্বল হয়ে পড়ে। সেইসঙ্গে সোভিয়েত সৈন্যরাও তাদের মনোবল হারিয়ে ফেলে। দুর্বল সোভিয়েত সেনাবাহিনী জর্জিয়া, আজারবাইজান এবং লিথুয়ানিয়া প্রজাতন্ত্রগুলোতে সোভিয়েত বিরোধী বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দমন করতে অক্ষম ছিল। যার ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
সোভিয়েত সেনাবাহিনীর এমন নাজুক অবস্থার জন্য কট্টর কমিউনিস্ট সমর্থক সেনা সদস্যরা গর্বাচেভের নীতি (গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রোইকা)-কে দায়ী করে। তারা গর্বাচেভকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ১৯৯১ সালের আগস্ট মাসে সোভিয়েত সেনাবাহিনীর একটি অংশ অভ্যুত্থানের চেষ্টা করে। কিন্তু তিন দিনের মধ্যে অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়। এই অভ্যুত্থান চেষ্টার ফলে সোভিয়েত অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও বিশৃঙ্খলা এবং অবিশ্বাস দেখা যায়। এর ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন আরো ত্বরান্বিত হয়। এজন্য আফগান যুদ্ধকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
রাজনৈতিক কারণ
মিখাইল গর্বাচেভ ক্ষমতায় আসার পর তিনি সোভিয়েত রাজনীতিতেও সংস্কার আনেন। ১৯৮৮ সালে সুপ্রিম সোভিয়েত কাউন্সিলের পরিবর্তে ‘কংগ্রেস অব পিপলস ডেপুটিজ’ গঠন করা হয়। তিনি কমিউনিস্ট পার্টি ও রাষ্ট্রকে আলাদা করার পরিকল্পনা করেন। নতুন পদ্ধতিতে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছাড়াও অন্যান্য নাগরিকদের নির্বাচন করার সুযোগ তৈরি হয়। নতুন কংগ্রেসে শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানীদের জন্য কিছু আসন রাখা হয়। পরিবর্তিত পদ্ধতি অনুযায়ী কংগ্রেসের সদস্য সংখ্যা ছিল ২,২৫০ জন, যারা উন্মুক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হতো। এই পিপলস ডেপুটিজদের ভেতর থেকে ৫৪২ সদস্য বিশিষ্ট নতুন সুপ্রিম কাউন্সিল গঠিত হয়, যার চেয়ারম্যান হতেন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট।
সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন প্রজাতন্ত্রের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়। এমনকি সোভিয়েত কেন্দ্রীয় কমিটিতেও পরিবর্তন আনা হয়। গর্বাচেভ সোভিয়েত নীতিনির্ধারণী কমিটিতে অনেক নতুন সদস্যকে জায়গা দেন। ১৯৮৫ সালের ১ জুলাই তিনি পলিটব্যুরো থেকে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রেগরি রোমানভকে সরিয়ে দেন এবং বরিস ইয়েলৎসিনকে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে জায়গা দেন।
একই বছরের ডিসেম্বরে গর্বাচেভ ইয়েলৎসিনকে মস্কো কমিউনিস্ট পার্টির ফার্স্ট সেক্রেটারি পদে ভিক্টর গ্রিশিনের স্থলাভিষিক্ত করেন। ১৯৮৭ সালে গর্বাচেভ কয়েক ডজন রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দেন। ১৯৮৭ সালে বরিস ইয়েলৎসিন কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর তিনি গর্বাচেভের সমালোচনায় মেতে ওঠেন। এর মাধ্যমে ইয়েলৎসিনের উত্থান ঘটে। পরবর্তী চার বছরে গর্বাচেভ-ইয়েলৎসিন রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে বড় ভূমিকা রাখে।
১৯৮৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বাল্টিক, ককেশাস ও অন্যান্য পূর্ব ইউরোপীয় প্রজাতন্ত্রগুলোতে গণতন্ত্র ও কিছু অঞ্চলে স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। ইতোমধ্যে সেখানে কমিউনিস্ট পার্টির বাইরে দল গঠন করে জনপ্রিয়তা পেতে থাকে। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রথমবারের মতো গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। একই বছর সিএনএন কোনো বিদেশি চ্যানেল হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নে সংবাদ প্রচারের অনুমোদন পায়। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত নির্বাচনে ৬টি প্রজাতন্ত্রে কমিউনিস্ট পার্টির ভরাডুবি হয়, সেখানে জাতীয়তাবাদীরা জয়লাভ করে। সেখানকার জাতীয়তাবাদীরা কেন্দ্রীয় সরকারকে ট্যাক্স দিতে অস্বীকার করে। ফলে সোভিয়েত কেন্দ্রীয় সরকার ও আঞ্চলিক সরকারের মধ্যে টানাপোড়েন শুরু হয়।
১৯৯০ সালের ১২ জুনের সুপ্রিম সোভিয়েত নির্বাচনে রাশিয়ান প্রজাতন্ত্রে বরিস ইয়েলৎসিন জয়লাভ করেন। বিপরীতে গর্বাচেভের পছন্দসই প্রার্থী বিশাল ব্যবধানে হারে। ফলে রাশিয়ান ফেডারেশন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ইয়েলৎসিন সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভেঙে দেওয়ার জন্য অন্যান্য প্রজাতন্ত্রগুলোর সাথে আলোচনা করতে থাকেন।
১৯৯১ সালের শুরুতে কয়েকটি প্রজাতন্ত্রে স্বাধীনতার দাবিতে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৫টি প্রজাতন্ত্রের অনেকগুলোতেই স্বাধীনতার আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। এমন পরিস্থিতিতে গর্বাচেভ সোভিয়েত কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা হ্রাস করার পরিকল্পনা করেন।
১৯৯১ সালের ২০ আগস্ট রাশিয়ান ফেডারেশন একটি নতুন চুক্তি করার উদ্যোগ নেয়, চুক্তি অনুযায়ী সোভিয়েত ইউনিয়নের পরিবর্তে স্বাধীন রাষ্ট্রগুলো মিলে একটি ফেডারেশন গঠন করবে। সামরিক ও পররাষ্ট্র দপ্তর থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে, অন্যান্য সকল বিষয়ে আঞ্চলিক সরকার পূর্ণ স্বাধীনতা পাবে। মধ্য এশিয়ার দেশগুলো একে সমর্থন করে।
এমন পরিস্থিতিতে ১৯ আগস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঠেকাতে কট্টরপন্থী কমিউনিস্টরা, ভাইস প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, কেজিবির প্রধান ও অন্যান্য কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মিলে সামরিক বাহিনীর সাহায্যে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করে। গর্বাচেভের উদারপন্থী নীতির বিপরীতে তারা আবারো আগের কঠোরতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন এবং গর্বাচেভ ও বরিস ইয়েলৎসিনকে গ্রেফতারের চেষ্টা করেন।
সাধারণত কোনো অভ্যুত্থানের পর অভ্যুত্থানকারীরা জরুরি অবস্থা জারি করে। সোভিয়েত ইউনিয়নেও তারা চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ীই রাষ্ট্রীয় জরুরি অবস্থা জারি করে। এ সময় গর্বাচেভ ক্রিমিয়ায় ছিলেন, সেখানে তাকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। অভ্যুত্থানকারীরা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও অধিকাংশ সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করে। কিন্তু রাশিয়ান পার্লামেন্টের সামনে অভ্যুত্থানের বিরোধীতা করে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়। ইয়েলৎসিনের নেতৃত্বে মস্কোয় রাশিয়ান পার্লামেন্টের সামনে বিশাল জনসমাবেশ করা হয়।
তিন দিন পর ২১ আগস্ট অভ্যুত্থানচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এই অভ্যুত্থানচেষ্টা সোভিয়েত ইউনিয়নকে রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল করে তোলে। ২৪ আগস্ট গর্বাচেভ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে ইস্তফা দেন তবে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বহাল থাকেন। গর্বাচেভ সরকার ও পার্টিকে আলাদা করার উদ্দেশ্যে সরকারের অভ্যন্তরে পার্টির সকল কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করেন। তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট পদের বিলুপ্তি ঘোষণা করেন, সেইসঙ্গে নতুন কিছু পদ তৈরি করেন। একই দিনে ইউক্রেন স্বাধীনতা ঘোষণা করে বসে।
কয়েকদিনের মধ্যে সুপ্রিম সোভিয়েত কাউন্সিল সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিস্ট পার্টির সকল কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এর মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিস্ট পার্টির আধিপত্য শেষ হয়। ৫ সেপ্টেম্বর গর্বাচেভ স্টেইট কাউন্সিল অব দ্যা সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠন করেন। এমন পরিস্থিতিতে ১৭ সেপ্টেম্বর এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়া (যারা ইতোমধ্যে স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়েছে) জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে।
১৯৯১ সালের ৮ ডিসেম্বর পূর্ব বেলারুশের এক বিলাসবহুল বাড়িতে বৈঠকে বসলেন তিনটি সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের (রাশিয়া, বেলারুশ ও ইউক্রেন) নেতারা। বৈঠকটি ডেকেছিলেন বেলারুশের প্রেসিডেন্ট স্ট্যানিস্লাভ শুশকেভিচ। ইউক্রেনের নেতা লিওনিদ ক্রাভচুক আর রাশিয়ার নেতা বরিস ইয়েলৎসিন যোগ দিলেন তার সঙ্গে। ইউক্রেন কিছুদিন আগেই স্বাধীনতা ঘোষণা করে দিয়েছে।
তাদের এই বৈঠক সোভিয়েত ইউনিয়নের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়। বৈঠকে তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির বিষয়ে একমত হন। “আন্তর্জাতিক ও ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় সোভিয়েত ইউনিয়নের আর কোনো অস্তিত্ব নেই” এ বক্তব্য দিয়ে বলে তিন নেতা ঐতিহাসিক বেলাভেজা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। উক্ত চুক্তির মাধ্যমে সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভ কার্যত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়লেন। এর মধ্য দিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিনের হাতে আরও বেশি ক্ষমতা দেওয়া হলো। পুরো পরিকল্পনাটির পেছনে স্বয়ং বরিস ইয়েলৎসিন ছিলেন। সেই রাতেই ইয়েলৎসিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশকে ফোন করে চুক্তির বিষয়ে জানান।
১২ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের রাশিয়ান প্রজাতন্ত্রের সুপ্রিম সোভিয়েত কাউন্সিল এই চুক্তির অনুমোদন দেয়। একই দিন সোভিয়েত ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সুপ্রিম সোভিয়েত কাউন্সিল থেকে রাশিয়ান ডেপুটিজদের প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। ১৯৯১ সালের ২১ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের অবশিষ্ট ১২টি প্রজাতন্ত্রের ১১টির প্রতিনিধিরা (জর্জিয়া ছাড়া) ‘আলমা-আতা প্রটোকল’ চুক্তির মাধ্যমে ঘোষণা দেয় যে তারা আর সোভিয়েত ইউনিয়নে থাকবে না, পরিবর্তে তারা স্বাধীন রাষ্ট্রগুলো মিলে একটি কমনওয়েলথ গঠন করবে। তিনটি বাল্টিক প্রজাতন্ত্র (লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া এবং এস্তোনিয়া) ইতোমধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছে। তারা এরপর ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেয়। এমন পরিস্থিতিতে গর্বাচেভের পদত্যাগ করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। গর্বাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন প্রজাতন্ত্রের স্বাধীনতা ঘোষণা ও বিচ্ছেদে হতাশ হয়ে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে ইস্তফা দেবেন বলে ঘোষণা দেন।
২৫ ডিসেম্বর ১৯৯১, শেষবারের মতো মস্কোর ক্রেমলিনে সোভিয়েত পতাকা উড়ে। সেদিন সন্ধ্যা ৭:০২ মিনিটে সোভিয়েত পতাকা নামিয়ে সেখানে রাশিয়ার পতাকা উত্তোলন করা হয়। এ দিন (২৫ ডিসেম্বর) সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বশেষ নেতা মিখাইল গর্বাচেভ “আমরা এখন একটি নতুন পৃথিবীতে বাস করছি” বলে পদত্যাগ করেন। এরপর গর্বাচেভ রাশিয়ান ফেডারেশনের রাষ্ট্রপতি বরিস ইয়েলৎসিনের কাছে ক্ষমতা (পারমাণবিক অস্ত্রের কোড ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়) হস্তান্তর করেন।
১৯৯১ সালের ২৬ ডিসেম্বর সুপ্রিম সোভিয়েত কাউন্সিল সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পক্ষে ভোট দেয়। এর মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে। ৬৯ বছর আগে গঠিত হওয়া বিশাল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ১৫টি আলাদা রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
শেষ কথা
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের জন্য কোনো একক কারণকে দায়ী করা যায় না। অনেকগুলো কারণ যখন একে অপরের সঙ্গে মিলেছে তখন পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে এর পতন অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয় গর্বাচেভের নীতিগুলোকে। তবে গর্বাচেভের নীতিগুলো প্রত্যক্ষভাবে দায়ী থাকলেও এর পতনের শেকড় আরো গভীরে।
চূড়ান্ত বিশ্লেষণে অনুযায়ী, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পেছনে সবচেয়ে বেশি দায়ী গর্বাচেভের পূর্বসূরি লিওনিড ব্রেজনেভ, যিনি সোভিয়েত নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে কাজ করার পরিবর্তে আমেরিকার বিরুদ্ধে অযাচিত অস্ত্রের লড়াইয়ে দেশটির অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নেই কমিউনিস্ট শাসনের অবসান ঘটায়নি বরং কমিউনিজমের অস্তিত্বের প্রতি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের রেশ ধরে আরো কয়েকটি দেশে কমিউনিজমের পতন ঘটে।