চৌঠা আগস্ট, ১৫৭৮।
আল্কাজারের রণক্ষেত্র, মরক্কো।
মাত্র শেষ হয়েছে পর্তুগিজ ও মরক্কান সেনাদলের যুদ্ধ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে দুই দলের সৈন্যদের মৃতদেহ। জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়ে গেছে, কিন্তু জয় উপভোগ বা পরাজয়ের গ্লানি আর কোনোদিন স্পর্শ করবে না লড়াইয়ের সর্বাধিনায়কদের, কারণ এই লড়াই কেড়ে নিয়েছে তিন তিনজন রাজার প্রাণ- মরক্কোর দুই সুলতান এবং পর্তুগালের প্রথম সেবাস্টিয়ান।
ইউরোপ আর উত্তর আফ্রিকার ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই সংঘর্ষের নামই ব্যাটল অব আলকাজার। মরক্কানদের কাছে এল-কাজার এল কাবির। রণক্ষেত্রের নামানুসারে একে ব্যাটল অন ওয়াদি আল-মাখাজিনও বলা হয়। তবে তিনজন রাজার মৃত্যুর কারণে ব্যাটল অব দ্য থ্রি কিংস নামেই অধিক পরিচিত এই যুদ্ধ।
প্রথম সেবাস্টিয়ান
লিসবনের রাজপ্রাসাদ। ১৫৫৪ সালের ২০ জানুয়ারি।
পর্তুগিজ রাজকন্যা, ক্যাথেরিন অব অস্ট্রিয়া প্রসব বেদনায় কাতরাচ্ছেন। অবশেষে জন্ম নিল সুস্থ-সবল পুত্রসন্তান, ঘটা করে তার নাম রাখা হলো সেবাস্টিয়ান। শিশুর জন্মের তিন সপ্তাহ আগেই মারা গেছেন তার পিতা, যুবরাজ ম্যানুয়েল (João Manuel), কাজেই সেবাস্টিয়ানই এখন ভাবী রাজা। তার দাদা, তৃতীয় জনের পর সিংহাসনের দাবি তারই।
বাবা পর্তুগিজ বটে, তবে মায়ের দিক থেকে সেবাস্টিয়ানের গায়ে বইছে স্প্যানিশ হাবসবুর্গ রক্ত। ক্যাথেরিন অব অস্ট্রিয়ার ভাই পঞ্চল চার্লস সুবিশাল হাবসবুর্গ সাম্রাজ্যের অধিপতি, একইসাথে তিনি হলি রোমান এম্পেরর। কাজেই সেবাস্টিয়ানের ক্ষমতাশালী আত্মীয়-স্বজনের অভাব নেই।
নাতির জন্মের তিন বছরের মাথায় মৃত্যুবরণ করলেন রাজা জন। তিন বছর বয়সী যুবরাজ অভিষিক্ত হলেন সিংহাসনে। নাবালক রাজার পক্ষে শাসনকাজ পরিচালনার ভার নিলেন দাদি ক্যাটালিনা (Catalina)। খুব শীঘ্রই অবশ্য সেবাস্টিয়ানের অভিভাবকত্বের দাবিতে দানা বেধে উঠলো দ্বন্দ্ব। চাচা কার্ডিনাল হেনরি ক্যাটালিনাকে সরিয়ে নিজে হাল ধরলেন রাজ্যের।
হেনরি নিজে কার্ডিনাল, তাই ভাইপোর শিক্ষাদীক্ষার দায়িত্বও দিলেন সেরকম লোকদেরই। খ্রিস্টানদের একটি উপদল, জেসুইট (Jesuits)। রক্ষণশীল জেসুইটদের তত্ত্বাবধানে সেবাস্টিয়ান বড় হতে থাকেন তাদের মতাদর্শে। ক্যাথলিক চার্চের প্রতি শর্তহীন আনুগত্য দাবি করতো তারা। তাদের সংস্পর্শে থেকে নারীসঙ্গের প্রতিও বিমুখ হয়ে যান সেবাস্টিয়ান।
পরিণত বয়সে হেনরি সেবাস্টিয়ানের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দেন। সিংহাসনে বসেই আফ্রিকায় ক্রুসেডে যাবার ইচ্ছে প্রকাশ করেন তিনি। তার উদ্দেশ্য মুসলিমদের হাতে হারানো এই মহাদেশে খ্রিষ্টীয় আদর্শের পুনঃস্থাপন।
আফ্রিকাতে একসময় পর্তুগিজদের বেশ বড় উপনিবেশ ছিল, ছোট হতে হতে তা গিয়ে ঠেকেছে উপকূলবর্তী কয়েকটা দুর্গে। ১৫৭৪ সালে সেগুলোর একটি, সিউটায় (Ceuta) পা রাখেন তিনি। উত্তর মরক্কোর এই জায়গায় বেশ কয়েক সপ্তাহ অবস্থান করেন সেবাস্টিয়ান। সঙ্গে আনা ছোট্ট সেনাদল নিয়ে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে মাসখানেক ঘুরে বেড়ালেন পর্তুগিজ রাজা, কিন্তু যুদ্ধ করার উদগ্র ইচ্ছে সফল হলো না। কারণ মরক্কোর সুলতান মোহাম্মদ (Moulay Mohammad) বিদেশী রাজার পাগলামিতে অবাক হয়েছিলেন, শঙ্কিত নয়।
সুলতানের নির্দেশে তার লোকেরা দূর থেকে কেবল পর্তুগিজদের উপর নজর রেখে গেলো, শুধু শুধু তার সাথে লড়াই করে রক্তক্ষয়ের কোনো কারণ দেখলো না তারা। তবে এতে ফল হলো উল্টো। সেবাস্টিয়ান মনে করলেন তার সাথে সরাসরি সংঘর্ষে যাবার শক্তি নেই মরক্কানদের, তাই নিজেদের শহরে লুকিয়ে আছে তারা। তিনি ঠিক করলেন আরো লোকজন নিয়ে এসে হামলা করবেন, নিশ্চয়ই সফল হবে তার ক্রুসেড!
মরক্কোর সুলতান
মরক্কোর সিংহভাগ যখন পর্তুগিজ নিয়ন্ত্রণে ছিল, তখন তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে নেতৃত্ব দেয় সাদিয়ান বংশ (The Saadians)। আরব উপদ্বীপ থেকে আসা সাদিয়ানরা সাংগঠনিক ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে পর্তুগিজদের বিপক্ষে যুদ্ধকে রূপ দেয় পবিত্র যুদ্ধ বা হলি ওয়ারে। তাদের একজন, মোহাম্মদ ইবনে আব্দ-আল-রাহমান (Muhammad ibn ‘Abd al-Rahman) দায়িত্ব নেন মরক্কান সামরিক বাহিনীর। তার মৃত্যুর পর ছেলে আহমাদ আল-আরাজ পিতার স্থলাভিষিক্ত হন, তার প্রধান সহকারী ভাই মোহাম্মদ আল-আসঘার। দুজন মিলে ১৫৪১ সালে পর্তুগিজদের পরাজিত করে তাড়িয়ে দেন বিশাল এলাকা থেকে। তারা উপকূলের কিছু দুর্গে নিজেদের আবদ্ধ করে ফেলে।
এমন সময় দুই ভাইয়ের মধ্যে আরম্ভ হয় ক্ষমতার লড়াই। মোহাম্মদ জিতে যান এই লড়াইয়ে, সেনাবাহিনী চলে আসে তার অধীনে। তিনি এবার মনোযোগ দিলেন তৎকালীন মরক্কোর রাজবংশ ওয়াতাসিদদের (Wattasids) উৎখাতে। ১৫৪৯ সালে মরক্কোর রাজধানী ফেজ দখল করে নিয়ে পাকাপাকিভাবে ওয়াতাসিদদের বিতাড়িত করেন তিনি। সূচনা হয় সাদিয়ান শাসনের।
মোহাম্মদ রাজধানী সরিয়ে আনেন মারাকেশে। দেশকে স্থিতিশীল করতে তার সামনে তখন দুটো চ্যালেঞ্জ। উপকূলে পর্তুগিজ উপস্থিতি, এবং প্রতিবেশী আলজেরিয়াতে ক্রমবর্ধমান উসমানি শক্তি। তার ওয়াতাসিদ প্রতিদ্বন্দ্বী উসমানি সহায়তা নিয়ে ১৫৫৪ সালে ফেজ পুনর্দখল করলেও মোহাম্মদ দ্রুতই আবার শহর ফিরিয়ে নেন। উসমানিদের বিপক্ষে গিয়ে তিনি এমনকি স্প্যানিশদের সাথেও আঁতাত করেন। ফলে ১৫৫৭ সালে উসমানিরা আততায়ী পাঠিয়ে তাকে হত্যা করে।
নতুন সুলতান হলেন মোহাম্মদের জ্যোষ্ঠ ছেলে, মুলয় আল ঘালিব (Mulay al-Ghalib)। ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে দু’ধরনের কথা প্রচলিত। ঐতিহাসিক চার্লস আন্দ্রে জুলিয়ানের মতে, মতবিরোধ থাকলেও গৃহযুদ্ধ এড়াতে ঘালিবের তিন ভাই দেশ ছাড়েন। তারা আশ্রয় নেন উসমানিদের কাছে। আব্দ আল-মালিক আর আহমাদ আল-মানসুর নামে দুই ভাই নাকি কন্সট্যান্টিনোপোলে চলে যান, সেখানে সুলতান সুলেইমানের দরবারে কাজ নেন। তবে আরেক ঐতিহাসিক, বোভিল দাবি করেন ঘালিব আসলে এক ভাইকে মেরেই ফেলেছিলেন। বাকি দুজন, মালিক আর মানসুর আগেই উসমানিদের কাছে চলে গিয়েছিলেন।
১৫৭৪ সালে মারা যান ঘালিব। তার ছেলে মুলয় মোহাম্মদ সিংহাসনে বসেন। মালিক আর মানসুর এবার তৎপর হলেন ভাতিজার থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে। আব্দ আল-মালিকের আবেদনে উসমানি সুলতান একদল সেনা দিলেন তাকে। তিনি রওনা হলেন মরক্কো অভিমুখে। ১৫৭৬ সালে আল-মালিকের কাছে পরাস্ত হয়ে মুলয় মোহাম্মদ পালিয়ে যান রাজধানী ছেড়ে। যেই সেবাস্টিয়ানকে একসময় শত্রু হিসেবে দেখেছিলেন তিনি, মুকুট ফিরে পেতে সাহায্য চাইলেন তার কাছেই। পর্তুগিজ রাজার দেখলেন এ তো মেঘ না চাইতেই জল! মুলয় মোহাম্মদকে তিনি আশ্বাস দিলেন সাহায্যের, তবে বিনিময়ে তাকে দিতে হবে মরক্কোর বিস্তীর্ণ অঞ্চল। রাজি হয়ে গেলেন সিংহাসনচ্যুত সুলতান।
সেবাস্টিয়ানের প্রস্তুতি
মরক্কোতে গিয়ে পর্তুগিজ সেনাদল যুদ্ধ করবে, এই ভাবনা অনেকের কাছেই উপাদেয় ঠেকেনি। তাছাড়া এই অভিযানে সফল হলেও খুব একটা লাভ হতো না পর্তুগালের, মরক্কোর থেকে যেসব অঞ্চল তার দাবি করেছিলো তার কোনো কৌশলগত গুরুত্ব নেই! আর হারলে তো কেলেঙ্কারি। তার ওপর প্রয়োজন না থাকলেও সেবাস্টিয়ান ঘোষণা দেন তিনি নিজেই যাবেন মরক্কো।
অনর্থক এই যুদ্ধাভিযান থেকে বিরত থাকতে ভাইপোকে পরামর্শ দেন স্পেনের হাবসবুর্গ শাসক, দ্বিতীয় ফিলিপ। তার দূত হুয়ান দা সিলভা কয়েকবার দেখা করেন রাজার সাথে, তবে সেবাস্টিয়ান তখন বুঁদ মরক্কোতে ক্রুসেডের স্বপ্নে। ফলে সিলভার সাবধানবাণী কানেই তুললেন না তিনি। সিলভা শেষ অবধি ফিলিপকে জানিয়ে দেন সেবাস্টিয়ানকে থামানোর কোনো উপায় নেই। ফিলিপ যে খুব অখুশী হয়েছিলেন সেটা বলা যাবে না, কারণ তার চোখ ছিল পর্তুগালের সিংহাসনে। সেবাস্টিয়ান অবিবাহিত, ফলে তার কোনো উত্তরাধিকারী নেই। যুদ্ধে তিনি মারা গেলে হাবসবুর্গদের হাতে চলে আসবে আরেকটি বিশাল সাম্রাজ্য।
ফিলিপ বলে পাঠালেন দা সিলভাকে, যদি সে সফল হয়, তাহলে আমরা পাবো এক দুর্দমনীয় জেনারেল। আর মারা গেলে তার রাজ্য। যেটাই হোক না কেন লাভ আমাদেরই। যাত্রা আরম্ভের আগে তিনি পর্তুগিজ রাজাকে উপদেশ দিলেন তিনি যেন মরক্কোর বেশি ভেতরে চলে না যান, বন্দরনগরী লারাশ (Larache) পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখেন তার গতিবিধি। কারণ বেশি ভেতরে চলে গেলে নিজেদের অন্যতম শক্তি নৌবাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন সেবাস্টিয়ান, তদুপরি তার কাছে অজানা-অচেনা ভূমিতে সুবিধা পাবে শত্রুপক্ষ।
কে শোনে কার কথা! সেবাস্টিয়ানের আসল ইচ্ছে মরক্কোকে পুনরায় বশীভূত করে খ্রিষ্টীয় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার। ১৫৭৮ সালের ২৬ জুন লিসবন থেকে ঝান্ডা উড়িয়ে যাত্রা করলেন তিনি। পর্তুগিজ নৌবহর নোঙর ফেললো কাদিজে এসে, অপেক্ষা করতে লাগলো স্পেন থেকে প্রতিশ্রুতি মোতাবেক অতিরিক্ত লোকবল ও রসদপত্রের।
১৪ জুলাই কাদিজ ছেড়ে গেলেন সেবাস্টিয়ান। পরবর্তী গন্তব্য আর্জিলার নৌবন্দর। লারাশের ত্রিশ কিলোমিটার দূরে এই শহরে অপেক্ষা করছিলেন মুলয় মোহাম্মদ। কামান আর ২০,০০০ সেনা নিয়ে তার সাথে যোগ দিলেন পর্তুগিজ রাজা।
পর্তুগিজ প্ল্যান
২৭ জুলাই জেনারেলদের সাথে সভায় বসলেন রাজা। রণপরিকল্পনা চূড়ান্ত হলো। ৪০ কিলোমিটার দূরের কাজার-আল-কাবির এলাকা প্রথম অধিকার করবেন তারা। এরপর টার্গেট হবে লারাশ। এজন্য লৌক্কোস (Loukkos) নদী পার হয়ে তীর ধরে এগিয়ে যেতে হবে পশ্চিমে। পেছনে রেখে যাবেন ২,০০০ সেনা, যারা নৌবাহিনীর সাথে নদীপথে সেখানে তাদের সাথে মিলিত হবে।
কাজার-এল-কাবির হয়ে লারাশ পর্যন্ত যেতে সেবাস্টিয়ান ছয়দিনের সময় নির্ধারণ করেন, রসদ নিতে নির্দেশ দেন সেই পরিমাণে। নির্দেশ দেন ঠিক দুদিন পর মার্চ আরম্ভ করতে। তবে অভিজ্ঞ অফিসারেরা রাজাকে বোঝাতে চেষ্টা করেন নৌবাহিনীর সুবাদে তারা শত্রুর থেকে সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন, তাই জাহাজ ফেলে একাকী স্থলপথে এগিয়ে গেলে মরক্কান সেনারা তাদের ফাঁদে ফেলতে পারে। তরুণ রাজা তাদের কথায় মত পরিবর্তন করলেন না।
মরক্কান প্রতিরক্ষা
আব্দ আল-মালিক গুপ্তচরদের থেকে সব খবরাখবরই পাচ্ছিলেন। সেবাস্টিয়ান যখন লিসবনে সৈন্য সমাবেশে ব্যস্ত, তখন থেকেই তিনি ও তার ভাই সেনাদল গোছাতে শুরু করেন। লারাশে আক্রমণ আসবে ধরে নিয়ে সেখানকার প্রতিরক্ষা মজবুত করেন তিনি।
পর্তুগিজ বাহিনী যখন কাদিজে, তখন মারাকেশ থেকে ১৬,০০০ সেনা আর ২৬টি কামান নিয়ে বেরিয়ে এলেন আল-মালিক। ভাই মানসুর ফেজ থেকে রওনা দেন ২৭,৫০০ লোক নিয়ে। সালে শহরে এসে দুই ভাই একত্র হন। ঠিক করলেন সেখান থেকে তারা চলে যাবেন কাজার আল-কাবির, এই পথে পর্তুগিজ আক্রমণ মোকাবেলার জন্য। তবে ১০ জুলাই আল-মালিক প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়লে কিছুটা বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় মরক্কান সেনাদলে।