“জনগণ আমার নিজ সন্তানের মতো। আমি তাদের পিতার মতোই স্নেহ করি। একজন পিতা যেমন সর্বদা তার সন্তানদের মঙ্গল কামনা করে, আমিও আমার রাজ্যবাসীদের মঙ্গল কামনা করি, সর্বদা তাদের সুখ-শান্তির জন্যে প্রার্থনা করি।”
এই উক্তিগুলো ছিলো একজন সম্রাটের, আজ থেকে তেইশ শত বছর পূর্বে যিনি রাজত্ব করেছিলেন পৃথিবীর একাংশে।
তার নাম অশোক, আমরা জানি সম্রাট অশোক হিসেবে। তিনি ছিলেন মৌর্য্য সাম্রাজ্যের তৃতীয় শাসক, খ্রিষ্টপূর্ব ২৬৮ থেকে ২৩২ সাল পর্যন্ত ছিল তার শাসনকাল। ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য ছিল অশোকের। ধারণা করা হয়, এত বড় সাম্রাজ্যের অধিকারী আর কোনো সম্রাট ছিলেন না সে আমলে। তার জন্ম হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৩০৪ সালে। ৩৬ বছর বয়সে খ্রিস্টপূর্ব ২৬৮ সালে ক্ষমতা গ্রহণ করে মৃত্যু পর্যন্ত সাম্রাজ্য পরিচালনা করেছিলেন সম্রাট অশোক।
তিনি ছিলেন ইতিহাসের এক আদর্শ শাসক। যদিও তার জীবনের প্রথম পর্যায়টি সম্পূর্ণ উল্টো কথা বলে। সে পর্যায়ে তার নৃশংসতা ছিল উদাহরণ দেওয়ার মতো। ইতিহাস স্বাক্ষী, তার জীবনের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজগুলোও মহত্ত্বের উদাহরণ দেওয়ার মতোই। মৌর্য সাম্রাজ্যের উদ্ভাসিত সূর্য ধীরে ধীরে স্তিমিত হতে থাকে সম্রাট অশোকের মৃত্যুর পরেই।
রাজত্বের প্রথম আট বছর, অশোকের নৃশংসতার দরুন তার প্রচলিত নাম ছিল চন্ডাশোক, যার অর্থ হলো ‘নৃশংস অশোক’। কলিঙ্গের যুদ্ধের পর, সহনশীল মনোভাব নিয়ে অশোক যখন রাজ্য পরিচালনা শুরু করেন, তার নাম তখন চন্দাশোক থেকে পাল্টে প্রচলিত হয় ধর্মাশোক,যার অর্থ হলো ‘ধার্মিক অশোক’।
মৌর্য্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য। ইতিহাসে তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যিনি ভারত উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ অংশকে একক রাজ্যের অধীনে নিয়ে আসেন। তামিল ও কলিঙ্গ ব্যতীত উপমহাদেশের প্রায় পুরোটাই দখলে নিয়ে নেন চন্দ্রগুপ্ত। আর তার পৌত্র হলেন সম্রাট অশোক; ক্ষমতায় এসে অশোক সেই তামিল আর কলিঙ্গকেও সাম্রাজ্যের বাইরে থাকতে দেননি। ইতিহাস বিখ্যাত কলিঙ্গের যুদ্ধের কথা আমরা জানি, অশোক অসম্ভব নিষ্ঠুরতার সাথে এই যুদ্ধে জয়ী হন। ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া একটি যুদ্ধ ছিল এটি, লেখার একাংশে থাকছে এর কথা।
ইতিহাসবিদদের মতে, সম্রাট অশোক সিংহাসনে আরোহণ করেই তার পিতামহ চন্দ্রগুপ্তের মতোই নৃশংস পথ অবলম্বন করতে শুরু করেন। তার রাজ্য চালনা নীতিগুলো ছিল প্রচণ্ড নিষ্ঠুরতায় পূর্ণ, তবে জনগণকে নিজের হাতের পুতুল বানিয়ে রাখতে সেগুলো কার্যকরী ছিল বেশ। সূক্ষ্ম রণকৌশল দ্বারা অশোক তার সৈন্যবাহিনীর সর্বোচ্চ ব্যবহার করে ভারত উপমহাদেশের প্রায় পুরোটাই তো দখল করে নিয়েছিলেন!
চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাং ভারত উপমহাদেশে এসেছিলেন খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে। তিনি জানান, অশোকের রাজত্বের প্রায় নয়শ বছর পরও উপমহাদেশের মানুষ অশোকের জেলখানার নৃশংসতার কথা মনে রেখেছিল। রাজধানীর উত্তরে নির্মিত সেই জেলখানা পরিচিত ছিল ‘অশোকের নরক’ নামে। সম্রাট অশোকের আদেশ ছিল এমন, “জেলখানার কয়েদীদের যেন কাল্পনিক ও অকল্পনীয় সব রকমের অত্যাচারের মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। কোনো বন্দী যাতে জীবিত বের হতে না পারে সেই নরক থেকে!”
দ্বিতীয় মৌর্য সম্রাট বিন্দুসারা ও মহারানী ধর্ম-এর ঘরে জন্মান অশোক। পাটালিপুত্র নামক স্থানে তার জন্ম। শৈশব থেকেই অশোক ছিলেন অত্যন্ত একরোখা, জেদী আর নিষ্ঠুর প্রকৃতির। তার সবচেয়ে পছন্দের কাজ ছিল প্রাণী শিকার করা। কথিত আছে যে, অশোক একবার এক সিংহকে হত্যা করেছিলেন শুধুমাত্র একটি লাঠি দিয়ে!
অশোকের আপন ছোট ভাই ছিল শুধু একজন, বাকিরা সবাই সৎ ভাই। অশোক যখন সেনাপ্রধান হিসেবে একের পর এক বিজয় লাভ করছিলেন, তখন সুশিমা নামের তার এক সৎ ভাইয়ের মনে সংশয় তৈরি হয় যে, এভাবে চলতে থাকলে সিংহাসনে অশোকই বসবেন শেষপর্যন্ত। সেসময় সুশিমার সিংহাসনে আরোহণের সম্ভাবনা ছিল বেশি, কেননা বিন্দুসারার প্রিয় পুত্র ছিল সে। বিন্দুসারা সবসময় চাইতেন, তার বড় ছেলে সুশিমাই সিংহাসনে বসুক।
তক্ষশীলা নামক এক জায়গায় বিদ্রোহের সৃষ্টি হলে সুশিমা তার বাবা বিন্দুসারার কাছে প্রস্তাব রাখেন যে, এই বিদ্রোহ দমন করা কেবল অশোকের পক্ষেই সম্ভব। অশোক এই বিদ্রোহ সহজে দমন করতে পারবেন না, এমনটাই ভেবেছিলেন সুশিমা। এদিকে বিন্দুসারার সুশিমার কথামতো অশোককেই দায়িত্ব দিলেন বিদ্রোহ দমনের। সে লক্ষ্যে অশোক যুদ্ধযাত্রা করলেন। সিংহাসনে বসার আগে থেকেই অশোকের নৃশংসতার এমনই ‘সুনাম’ ছিল যে, তার যুদ্ধযাত্রার খবরটা তক্ষশীলায় পৌঁছানো মাত্রই বিদ্রোহীরা স্বউদ্যোগে থেমে গেল। এত সহজে অশোক বিদ্রোহ দমন করে ফেলবেন, এটা কল্পনাতেও ছিল না সুশিমার। তখন তিনি বিন্দুসারাকে রাজি করান যাতে অশোককে কলিঙ্গ রাজ্যে নির্বাসনে পাঠানো হয়। সুশিমা জানতেন, কলিঙ্গ রাজ্য তখন প্রচণ্ড প্রতাপশালী, সেখানে অশোক কিছুই করতে পারবেন না।
কলিঙ্গ রাজ্যে নির্বাসনে থাকাকালীন সেখানকার রাজকুমারী কৌরভাকীর সাথে প্রণয়ে জড়িয়ে পড়েন অশোক। তবে দুজনের কেউই একে অপরের পরিচয় জানতেন না। পরবর্তী সময়ে অশোকের সাথে কৌরভাকীর বিয়েও হয়েছিল। নির্বাসনের মেয়াদ শেষ হয়ে আসে। এদিকে উজাইন নগরীতে বিদ্রোহ দেখা দিলে, বিন্দুসারা লোক মারফৎ অশোককে ডেকে নেন। এবারে উজাইন নগরীতে বিদ্রোহ দমনের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করা হয় অশোককে। দুর্দান্ত এক সংঘর্ষে সেবারে অশোক আহত হন।
এরপর অনেকদিন সময় লেগেছিল অশোকের সুস্থ হতে। আর তার চিকিৎসা করেছিলেন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা। সেসময়েই অশোক প্রথম বৌদ্ধধর্মের নীতিশাস্ত্রের ব্যাপারে জানার সুযোগ পান। দেবী নামের এক মেয়ে সেখানে তার সেবা করতেন, পরবর্তীতে অশোক বিয়ে করেন তাকে।
উজাইন যুদ্ধের প্রায় বছরখানেক পর বিন্দুসারা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেই যাত্রায় যে আর তার জীবন রক্ষা হবে না, এটা বুঝে গিয়েছিল সবাই। আর তখনই বিন্দুসারার ছেলেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যায় সিংহাসনে কে বসবে তা নিয়ে। ইতিহাস বড়ই নির্মম, একের পর এক দ্বন্দ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অশোক হত্যা করেন তার ভাইদের। খ্রিষ্টপূর্ব ২৬৮ সালে অশোক সম্রাট হলেন। রাজত্বের প্রথম আট বছরে মানুষের কাছে নিজেকে নৃশংসতার আদর্শ হিসেবে গড়ে তুললেন তিনি। ক্ষ্যাপা হায়েনার মতো মৌর্য সাম্রাজ্য বাড়াতে থাকলেন অশোক।
বৌদ্ধধর্মের কিছু গ্রন্থ হতে জানা যায় যে, অশোক সিংহাসনে বসার জন্য তার ৯৯ জন ভাইকে হত্যা করেছিলেন! ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম আট বছর তিনি একের পর এক যুদ্ধযাত্রা করেন, কোনো যুদ্ধেই তাকে কেউ হারাতে পারেনি। অশোক তার রাজ্যকে বর্ধিত করে পুরো ভারতীয় উপমহাদেশ বিজয় করে নেন, এমনকি পশ্চিমে বর্তমান ইরান ও আফগানিস্তান আর পূর্বে বাংলাদেশ ও বার্মাও চলে আসে অশোকের দখলে।
অশোক সিংহাসনে আসীন হওয়ার প্রায় আট বছর পর খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ২৬১তে আসে ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া সেই যুদ্ধ, কলিঙ্গের যুদ্ধ। এই হলো সেই কলিঙ্গ সাম্রাজ্য, যা চন্দ্রগুপ্তও জয় করতে পারেননি। কিন্তু তার পৌত্র অশোক, নৃশংসতার চরমে আরোহণ করে কলিঙ্গকে ঠিকই জয় করে নিয়েছিলেন। ইতিহাসই সাক্ষ্য দেয়, বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ছিল সেই কলিঙ্গের যুদ্ধ। কলিঙ্গ সাম্রাজ্য নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য পুরো শক্তি প্রয়োগ করেও হেরে যায় অশোকের নৃশংসতার কাছে।
কলিঙ্গ জয় শেষে অশোক ঠিক করেন, রাজ্যটির ক্ষয়ক্ষতি দেখতে যাবেন। যে রাজ্যে তাকে নির্বাসিত করা হয়েছিল, সে রাজ্যকে যেন আর খুঁজে পেলেন না অশোক; পুরো কলিঙ্গ যেন ধূলোর সাথে মিশে গেছে। ঘর-বাড়ি সব পুড়ে ছারখার, পুরো ময়দান জুড়ে শুধু মৃতদেহ, লাশের কারণে পা ফেলা যাচ্ছে না। বলা হয় যে, অশোক প্রথমবারের মতো যুদ্ধ পরবর্তী সময়ের ক্ষয়ক্ষতি সরাসরি নিজ চোখে দেখেছিলেন সেবার। কথিত আছে যে, অশোক এই রক্তে ভেজা ভূমি দেখে আপন মনে উচ্চারণ করে উঠেন, “এ আমি কী করলাম?” তিনি তার বাকি জীবনে কলিঙ্গ রাজ্যের সেদিনকার দৃশ্যগুলো ভুলতে পারেননি।
মৌর্য্য সাম্রাজ্যের ইতিহাস আজকে আমরা অন্যভাবে পড়তাম, যদি না কলিঙ্গের যুদ্ধ সংঘটিত হতো। এ যুদ্ধে বিজয়প্রাপ্তির পর, অশোক নিজের নৃশংসতায় নিজেই যেন ভড়কে যান। এত দিন পর তার নজর পড়ে নিজের নৃশংস শাসন ব্যবস্থার প্রতি। পূর্বের কৃতকর্মগুলোর জন্য অনুতপ্ত হন তিনি। প্রায়শ্চিত্ত করার উদ্দেশ্যে তার সাম্রাজ্যে নতুন বিচারব্যবস্থা প্রবর্তন করেন অশোক। রাতারাতি শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণ উল্টে ফেললেন তিনি।
অশোকের স্ত্রী দেবী ছিলেন বৌদ্ধধর্মে বিশ্বাসী, দেবীর কাছ থেকে অশোক বৌদ্ধধর্মের অনেক কিছুই জানতে পেরেছিলেন। অশোকের মন তখন বারবার বৌদ্ধধর্মের সহনশীলতার কথাগুলো আওড়াতে শুরু করে। কলিঙ্গ যুদ্ধের ভয়াবহতা অনুধাবনের পর অশোক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তিনি বৌদ্ধধর্মে বিশ্বাস আনবেন। আর তিনি যতদিন বাঁচবেন, তার রাজ্য পরিচালিত হবে বৌদ্ধনীতির উপর ভিত্তি করে। কলিঙ্গ যুদ্ধের আগের আট বছরে অশোক যা যা অন্যায় করেছিলেন, সবকিছু যেন উল্টো দিক থেকে আবার শুরু করলেন তিনি। সকল বন্দীকে মুক্তি দেয়া হলো তার হুকুমে, তাদের সম্পত্তিও ফিরিয়ে দেয়া হলো যথাযথরূপে।
অশোকের জীবনের এই পর্যায় নিয়ে একটি গল্প প্রচলিত রয়েছে; কতটুকু সত্য তা যাচাইয়ের উপায় নেই। অশোক যখন তার ভাইদের হত্যা করেছিলেন, কোনো এক ভাইয়ের স্ত্রী নিজের শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে মহল থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। সেই শিশুটি বড় হয় রাজ্যের বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের আশ্রমে। ছেলেটির বয়স যখন ১৩, অশোক জানতে পারেন তার পরিচয়ের কথা। নিজের কৃতকর্মের কথা ভেবে অত্যন্ত মর্মবেদনা অনুভব করেন তিনি। দ্রুতই ছেলেটি আর তার মাকে প্রাসাদে ফিরিয়ে আনেন অশোক।
কলিঙ্গ দখলের পর ভারৎ উপমহাদেশের প্রায় পুরোটাই অধিকারে চলে এলো অশোকের। তবে সর্বদক্ষিণের অঞ্চল সামান্য বাকি ছিলো। অশোক খুব সহজেই সেই অঞ্চলটুকুর দখল নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, সে অঞ্চলটি দখল করবেন না। এর পেছনে কারণগুলো নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। তবে মোদ্দাকথা হলো, চক্রবৃদ্ধি হারে যেভাবে অশোক তার রাজ্যসীমা বৃদ্ধি করেই চলেছিলেন, সেটা হুট করে বন্ধ হয়ে যায়। কলিঙ্গ যুদ্ধের পরের দিনগুলোতে যেন পুরো উপমহাদেশে শান্তির বাতাস বইতে শুরু করে।
নতুনরূপে রাজ্য পরিচালনার রূপরেখা তৈরি করলেন অশোক। জনহিতকর কাজে হাত দেন পুরোদমে। অনেকগুলো বৌদ্ধমন্দির স্থাপন করা হয় গোটা রাজ্য জুড়ে। পথিকদের জন্য স্থানে স্থানে রাত যাপনের জন্য বাড়ি নির্মিত হয়, যেখানে রাতের বেলা তারা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে অবস্থান করতে পারতো। ফরমান জারি করে প্রাণী হত্যা নিষিদ্ধ করা হয়, নিরামিষভোজী আহারকে প্রলুব্ধ করা হয়। পাঠশালা আর হাসপাতালও নির্মিত হয় পুরো রাজ্য জুড়ে। পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোর সাথে শান্তিচুক্তি করেন অশোক, এমনকি উপমহাদেশের সম্পদের সুবিধা ভোগের অধিকারও দেয়া হয় রাজ্যগুলোকে। ইতিহাস সাক্ষী যে, এসব প্রতিবেশী রাজ্য দখলে নিয়ে আসা অশোকের পক্ষে অতি সহজ কাজ ছিল, তবু তিনি তা করেননি।
পুরো রাজ্যে শান্তি আনয়নের জন্য ইতিহাসখ্যাত এক ফরমান জারি করেন সম্রাট অশোক। জারি করেই ক্ষান্ত হননি তিনি, একই সাথে তার রাজপরিষদের সকল কর্মকর্তাদের হুকুম দেন যেন পুরো রাজ্যের স্থানে স্থানে পাথরের স্তম্ভ নির্মাণ করে তাতে অহিংসা নীতি সম্বলিত ফরমানটি খোদাই করে দেয়া হয়। এই স্তম্ভগুলোই ‘অশোকস্তম্ভ’ নামে পরিচিত। সেই সাথে অশোক এটাও বলেন, খোদাই করার সময় যেন প্রতিটি অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করে সহজ সাবলীলভাবে উপস্থাপন করা হয়। এই ফরমান জারির সাথে সাথে অশোক ধর্মীয় স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তিনি তার রাজসভাসদদের আদেশ দেন, রাজ্যের সকল দরিদ্র্য আর বয়স্কদের বিশেষ সুবিধা প্রদানের জন্য। রাজ্যের জায়গায় জায়গায় যেন মানুষ এবং প্রাণীদের জন্য চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা করা হয়। রাতারাতি রাজ্যের চেহারা বদলে যেতে শুরু করে। আইন করে একে একে পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের বাধ্যতা, গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধানত দৃষ্টি, জাত-কুল-ধর্ম নির্বিচারে সকলের প্রতি সহমর্মিতা, রাজ্যের সর্বস্থানে পথিকদের জন্য ফলদায়ক ও ছায়াদায়ক বৃক্ষরোপণ, কূপ খনন- সবকিছুরই বাস্তবায়ন করতে শুরু করেন সম্রাট অশোক।
রাজ্যের স্থানে স্থানে নির্মিত ‘অশোকস্তম্ভ’গুলো ছিল ৪০-৫০ ফুট উঁচু, সবগুলো স্তম্ভেই অশোকের অহিংসামূলক নীতি খোদাই করা হয়।
অশোকের জারিকৃত ফরমানে ছিল ১৪টি নীতি। এগুলো হলো:
১. কোনো জীবন্ত প্রাণীকে হত্যা করা যাবে না, ঈশ্বরের উদ্দেশ্যেও বলিদান নিষিদ্ধ।
২. পুরো রাজ্য জুড়ে মানুষের সাথে সাথে পশুদের জন্যও চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা করা হবে।
৩. প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সন্ন্যাসীদের একবার করে পুরো রাজ্য ভ্রমণে বেরোতে হবে, সেসময় তারা রাজ্যের জনসাধারণকে বৌদ্ধধর্মের নীতিতে দীক্ষিত করবেন।
৪. সন্ন্যাসী, পুরোহিত আর নিজ পিতা-মাতার প্রতি সবাইকে শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।
৫. বন্দীদের সাথে মানবিক আচরণ বজায় রাখতে হবে।
৬. যেকোনো খবর সকলের আগে সম্রাট অশোকের কাছে পৌঁছাতে হবে, তিনি যত ব্যস্তই থাকুন না কেন।
৭. ধর্মবিশ্বাসকে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হলো।
৮. প্রয়োজন হলে সন্ন্যাসী, ব্রাহ্মণ কিংবা অভাবগ্রস্তকে সাহায্যের মনোভাব রাখতে হবে।
৯. ধর্মের প্রতি সহনশীলতা ও শিক্ষাগুরুর প্রতি সদাচরণকে বিয়ে কিংবা অন্য যেকোনো পালা-পার্বণের চেয়ে অধিক সম্মানের বলে বিবেচিত করা হবে।
১০. মানুষ যদি ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা না রাখে, তাহলে খ্যাতি কিংবা গৌরব মূল্যহীন।
১১. কাউকে দেয়া ধর্মীয় শিক্ষা হবে তার প্রতি সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার।
১২. পূর্ণ ভক্তির সাথে কেউ যদি তার ধর্ম পালন করে এবং একইসাথে অন্যের কাছে প্রমাণ করতে চায় তার ধর্মের প্রাধান্য, সে যেন নিজ ধর্মেরই অপমান সাধন করে।
১৩. জোর করে কোনো কিছু জয় করার চেয়ে ধর্ম দ্বারা জয় করা উত্তম।
১৪. এই ১৪টি নীতি এখানে লিখে রাখা হলো, শুধু পড়ার জন্য নয়, মানুষ যেন তা পড়ে সে অনুযায়ী জীবন ধারণ করতে পারে সেজন্যও।
কলিঙ্গ যুদ্ধের পর অশোক প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, এখন থেকে তিনি তার রাজ্যের দেখভাল করবেন একজন পিতার মতো, রাজ্যের মানুষের মনে তার প্রতি কোনো ভীতি থাকবে না। বলির নামে প্রাণী হত্যা, খেলার নামে পশু শিকারের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন তিনি। বন-জঙ্গল উচ্ছেদ করা বন্ধ করেন, কারণ বন্য প্রাণীদের একমাত্র বাসস্থানই ছিল জঙ্গল। অশোক রাজ্যের কর্মকর্তাদের হুকুম দেন, যেকোনো প্রয়োজনে যেন তার কাছে খবর প্রথমে পৌঁছানো হয়। তিনি যদি খাবার গ্রহণ কিংবা ঘুমের মাঝেও থাকেন, তবু তার আদেশ যেন মানা হয়। শাস্তির নামে অপরাধীদের উপর আগে যে নির্যাতন চালানো হতো, তাতেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন অশোক। এমনকি বয়স্ক কিংবা যারা মানবেতর কাজে নিয়োজিত তাদের জন্য ক্ষমাসুলভ আইন প্রণয়ন করেন তিনি।
অশোকের মৃত্যুর পর যদিও ধীরে ধীরে মৌর্য্য সাম্রাজ্য স্তিমিত হয়ে পড়ে, তবু তিনি যে নীতিগুলো রচনা করেছিলেন সেগুলো খ্যাতি লাভ করে, ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে চারিদিকে। ভারত উপমহাদেশে যে কয়জন শ্রেষ্ঠ সম্রাট ছিলেন, তাদের মাঝে একজন হলেন সম্রাট অশোক- এভাবেই তিনি পরিচিতি লাভ করেন বিশ্ব ইতিহাসে।
ইতিহাসের সবকিছু নিয়ে মতবিরোধ থাকেই। ইতিহাস পুরোপুরি সত্যভাবে জানা সম্ভব হয় না কখনো। তেমনি অশোকের ইতিহাসের একটি ব্যাপারে যথেষ্ট মতপার্থক্য দেখা যায় যে, অশোক কি সত্যিই বৌদ্ধধর্মে বিশ্বাস এনেছিলেন নাকি কেবলমাত্র রাজ্যে শান্তি নিয়ে আসার জন্য বৌদ্ধধর্মকে নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন? অশোকের উদ্দেশ্য যা-ই হয়ে থাকুক না কেন, শাসনকর্তা হিসেবে তিনি শেষপর্যন্ত সফল। ইতিহাস তো কত পুরনো, কত বছরের ধুলো জমে গিয়েছে! তবু সম্রাট অশোকের প্রণীত আইনের নিদর্শন কিন্তু আজও অমলিন রয়ে গেছে ভারতের শাসনব্যবস্থার আনাচে-কানাচে। বৌদ্ধধর্মকে অশোক কেবল কিছু প্রচলিত আচার-অনুষ্ঠান থেকে রাজ্যের প্রধান শাসনব্যবস্থায় রূপান্তর করেছিলেন। অবশ্য অশোকের মৃত্যুর পরপরই সেই ব্যবস্থায় ভাটা পড়ে, ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসেন বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষকেরা।
অশোক ছিলেন প্রথম শাসনকর্তা যিনি কিনা সমগ্র ভারত উপমহাদেশকে এক রাজ্যের ছায়াতলে নিয়ে এসেছিলেন। একই সাথে তিনি ছিলেন ইতিহাসের প্রথম বৌদ্ধ শাসনকর্তা। তিনি প্রায় চল্লিশ বছরের মতো রাজ্য শাসন করেন। তার মৃত্যুর পঞ্চাশ বছরের মাথায় মৌর্য্য সাম্রাজ্য প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে আসে। মৌর্য্য সাম্রাজ্য শেষ হলেও বৌদ্ধধর্মের খ্যাতি কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি, সহনশীল ধর্ম হিসেবে সাধারণ মানুষ একে গ্রহণ করতে শুরু করে। উপমহাদেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে এ ধর্মের নীতিগুলো। ২৪টি নীতি নিয়ে সম্রাট অশোকের তৈরি চক্র তার আমলে নির্মিত সকল স্থাপনায় পাওয়া যায়। একে বলা হয় অশোকের ধর্মচক্র। এই চক্রটিই এখনও ভারতের জাতীয় পতাকায় আমরা দেখতে পাই। নীতিগুলো হলো- ভালোবাসা, সাহস, ধৈর্য, শান্তি, দয়া, সু-মনোভাব, বিশ্বাস, ভদ্রতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, নিঃস্বার্থতা, আত্মত্যাগ, সত্যবাদিতা, ন্যায়পরায়ণতা, সুবিচার, করুণা, উদারতা, নম্রতা, সহমর্মিতা, সহানুভূতি, ঈশ্বরীয় জ্ঞান, ঈশ্বরীয় পাণ্ডিত্য, ধর্মীয় নৈতিকতা, ঈশ্বরে ভক্তি এবং ঈশ্বরে বিশ্বাস।
এছাড়া চারটি সিংহ একে অপরের পিঠ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, এমন একটি ভাস্কর্য নির্মাণ তদারকি করেছিলেন অশোক; যা স্থাপিত হয় মৌর্য্য সাম্রাজ্যের রাজধানীতে। বর্তমানে ভাস্কর্যটি সারনাথ জাদুঘরে রয়েছে। এই ভাস্কর্যটিই হলো বর্তমান ভারতের জাতীয় প্রতীক। তবে অশোকস্তম্ভগুলোর মধ্যে যেগুলো টিকে আছে এখনো, সেগুলো সরানো হয়নি।
সবকিছুর পরেও অশোকের শাসনামলের ত্রুটি যে একেবারেই ছিল না, তাও নয়। তার অধীনস্ত সব মানুষই অশোক প্রণীত সকল আইনে খুশি ছিল, এমনটাও নয়। যেমন, ব্রাহ্মণসমাজ যখন দেখলো, তাদের প্রাচীন আচার-অনুষ্ঠানগুলো বাতিল হতে চলেছে, তখন তারা এই নীতি পছন্দ করল না। যেহেতু রাজ্যে প্রাণী হত্যাকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো, তাই ব্রাহ্মণ পুরুতেরা তাদের স্রষ্টার প্রতি বলি দিতে পারছিলেন না। শিকারী আর জেলেরাও ক্ষুব্ধ ছিল, কেননা এ আইন তাদের উপরেও বর্তায়। এ উদাহরণগুলো থেকে একটি কথাই বারবার স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, শাসনকর্তা নৃশংস হোন আর দয়ালু হোন, সমগ্র রাজ্যের জনগণকে সম্পূর্ণরূপে সন্তুষ্ট করা তার পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়।
ফিচার ছবিসূত্র: History Discussion